ঈমানের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে জ্ঞান। জ্ঞান অর্জন না করলে মানুষ ঈমানের দাবি অনুযায়ী আমল করতে পারবে না। সঠিক আমলের জন্য সঠিক জ্ঞান অতীব জরুরী। তাই ঈমানের অধ্যায়ের পর ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ জ্ঞানের অধ্যায় রচনা করেছেন।
জ্ঞানের পরিচয় ও প্রকার:
জ্ঞানকে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়, ঠিক যেমন গোলাপ ফুলের গন্ধের কোনো সংজ্ঞা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। এই বিষয়গুলো মানুষ জন্মগতভাবেই অনুভব করে থাকে। যেহেতু এগুলো দৃশ্যমান কোনো বিষয় নয়, সেহেতু এগুলোর সংজ্ঞা নির্ধারণও সম্ভব নয়।
জ্ঞানের প্রকার: জ্ঞানকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করা যায়। তবে আমরা অধ্যায়ের সাথে সম্পৃক্ত রেখে জ্ঞানকে শুধু দুই ভাগে বিভক্ত করতে চাই।
শারঈ জ্ঞান: এই অধ্যায়ে জ্ঞান দ্বারা মূলত শারঈ জ্ঞান উদ্দেশ্য। কুরআন ও হাদীছে জ্ঞানের যত ফযীলত বর্ণিত হয়েছে, তার সবকিছুই মূলত শারঈ জ্ঞানের জন্য প্রযোজ্য। শারঈ জ্ঞান ফরযে আইন তথা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরয।
দুনিয়াবী জ্ঞান: দুনিয়াবী জ্ঞান ফরযে কিফায়াহ। তবে নিয়্যতের কারণে সকল দুনিয়াবী জ্ঞানকেও নেকীতে পরিণত করা যায়। যদি দুনিয়াবী জ্ঞান অর্জন দ্বারা উদ্দেশ্য হয় মুসলিম উম্মাহ ও মুসলিম দেশের কল্যাণে কাজে লাগানো, মানুষের সেবা করা, গরীব-দুঃস্থ মানুষের দুঃখ মোচন করা, অসহায় আত্মীয়স্বজনের পাশে দাঁড়ানো ইত্যাদি, তাহলে অবশ্যই দুনিয়াবী জ্ঞান অর্জন থেকেও নেকী অর্জিত হবে, ইনশা-আল্লাহ!
بـابُ فَضْلِ العِلْمِ(জ্ঞান অর্জনের ফযীলত)
এটা ‘কিতাবুল ইলম’-এর প্রথম অনুচ্ছেদ। এই অনুচ্ছেদের অধীনে ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ দুটি আয়াত উল্লেখ করেছেন। কোনো হাদীছ উল্লেখ করেননি।
অনুচ্ছেদের অধীনে কোনো হাদীছ উল্লেখ না করার কারণ:
ছহীহ বুখারীতে প্রায় শতাধিক জায়গা এমন রয়েছে, যেখানে ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ অনুচ্ছেদ রচনা করলেও তার অধীনে কোনো হাদীছ নিয়ে আসেননি। আর এই ধরনের অনুচ্ছেদগুলো সাধারণত তিন ধরনের হয়ে থাকে।
প্রথমত: কিছু অনুচ্ছেদের অধীনে সরাসরি কোনো মুসনাদ হাদীছ না থাকলেও মুআল্লাক্ব হাদীছ, আয়াত ও সালাফে ছালেহীনের আছার থাকে।
দ্বিতীয়ত: কিছু অনুচ্ছেদ এমন রয়েছে, যার অধীনে কোনো হাদীছ বা সালাফে ছালেহীনের আছার নেই, তবে অনুচ্ছেদের নামের সাথেই কুরআনের আয়াত সম্পৃক্ত থাকে।
তৃতীয়ত: কিছু অনুচ্ছেদ এমন রয়েছে, যার অধীনে কোনো হাদীছ, আয়াত ও সালাফে ছালেহীনের আছার নেই এবং অনুচ্ছেদের নামের সাথেও কোনো হাদীছ বা আয়াত সংযুক্ত নেই। তবে সেক্ষেত্রে অধ্যায়ের অর্থ প্রমাণ করার জন্য অধ্যায়ের পূর্বে অথবা পরে সেই ধরনের অর্থবোধক আয়াত ও হাদীছ পাওয়া যায়।
তবে এভাবে হাদীছবিহীন অনুচ্ছেদ রাখার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে অনুচ্ছেদকে প্রমাণ করতে পারবে এমন হাদীছ ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ-এর শর্ত অনুযায়ী না পাওয়া। যেমন এই অনুচ্ছেদে ইলমের ফযীলতের প্রমাণে পেশ করার মতো একটি ছহীহ হাদীছ হতে পারত এই হাদীছটি,مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا سَهَّلَ اللهُ لَهُ طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّةِ. ‘যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জনের রাস্তায় বের হলো, মহান আল্লাহ তার জান্নাতে যাওয়ার রাস্তাকে সহজ করে দেন’।[1]
এই হাদীছটি ছহীহ হলেও ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ-এর শর্ত পূরণ করতে না পারায় তিনি তা উল্লেখ করেননি।
আর ছহীহ বুখারীর শর্ত পূরণ করতে পারে এমন হাদীছ পাওয়া গেলেও সেই হাদীছটি হয়তো ইতঃপূর্বে বা পরে কোথাও ব্যবহৃত হয়েছে। এজন্য বারবার একই হাদীছ প্রয়োগ করতে না চাওয়া থেকেও অনুচ্ছেদগুলো এভাবে হাদীছবিহীন থেকে গেছে।
অনুচ্ছেদে উল্লেখিত দুটি আয়াত:
প্রথম আয়াত:
يَرْفَعِ اللهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا العِلْمَ دَرَجَاتٍ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ
এই আয়াতের পূর্ণরূপ এরকম—
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا قِيلَ لَكُمْ تَفَسَّحُوا فِي الْمَجَالِسِ فَافْسَحُوا يَفْسَحِ اللَّهُ لَكُمْ وَإِذَا قِيلَ انْشُزُوا فَانْشُزُوا يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ
‘হে ঈমানদারগণ! যখন তোমাদেরকে বলা হয় মজলিস প্রশস্ত করো, তখন তোমরা মজলিস প্রশস্ত করে দাও! মহান আল্লাহ তোমাদের জন্য প্রশস্ত করে দিবেন আর যখন মজলিস থেকে উঠে যাওয়ার জন্য বলা হয়, তখন উঠে যেয়ো। যারা তোমাদের মধ্যে ঈমান আনয়ন করেছে এবং যাদেরকে মহান আল্লাহ জ্ঞান দিয়েছেন তাদের সম্মান মহান আল্লাহ বাড়িয়ে দিবেন। আর তোমরা যা করো, সে বিষয়ে মহান আল্লাহ সম্যক অবগত’ (আল-মুজাদালা, ৫৮/১১)।
দলীলের যৌক্তিকতা: উক্ত আয়াতটি মূলত আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট ছাহাবীগণের বসার বিন্যাস নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছে। উক্ত আয়াত প্রমাণ করে জ্ঞানীদের জন্য দুনিয়াতেও মহান আল্লাহ বিশেষ সম্মান দিয়েছেন। যেমন- ছালাতের কাতারের ক্ষেত্রে জ্ঞানীদেরকে ইমামের নিকটে থাকার নির্দেশ,[2] ইমাম নির্বাচনে জ্ঞানীদেরকে প্রাধান্য দেওয়ার নির্দেশ ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে জ্ঞানীদের সম্মানের বিষয়টি উক্ত আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে।
দ্বিতীয় আয়াত:
رَبِّ زِدْنِي عِلْمًا
আয়াতটির পূর্ণরূপ এরকম—
فَتَعَالَى اللَّهُ الْمَلِكُ الْحَقُّ وَلَا تَعْجَلْ بِالْقُرْآنِ مِنْ قَبْلِ أَنْ يُقْضَى إِلَيْكَ وَحْيُهُ وَقُلْ رَبِّ زِدْنِي عِلْمًا
‘সুতরাং আল্লাহ মহান, যিনি সত্যিকার মালিক, আপনার প্রতি অহী সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বে আপনি কুরআন পাঠে তাড়াহুড়া করবেন না এবং আপনি বলুন, হে আমার রব! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন’ (ত্ব-হা, ২০/১১৪)
দলীলের যৌক্তিকতা: আমাদের নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জ্ঞান চাওয়ার জন্য দু‘আ করতে বলা হচ্ছে। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মতো জ্ঞানী ব্যক্তিকে আরও অতিরিক্ত জ্ঞানের জন্য দু‘আ করার আদেশ দেওয়া প্রমাণ করে, জ্ঞান অবশ্যই অতি মূল্যবান একটি বিষয়।
সুতরাং প্রথম আয়াত থেকে জ্ঞানীদের মর্যাদা ও দ্বিতীয় আয়াত থেকে জ্ঞানের মর্যাদা প্রমাণিত হয়।
(ইনশা-আল্লাহচলবে)
আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক
ফাযেল, দারুল উলূম দেওবান্দ, ভারত; বি. এ (অনার্স), মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়,
সঊদী আরব; এমএসসি, ইসলামিক ব্যাংকিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, ইউনিভার্সিটি অফ ডান্ডি, যুক্তরাজ্য।
[1]. তিরমিযী, হা/২৬৪৬।
[2]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ৮/৪০-৫০।