বুদ্ধপূর্ণিমা, জন্মাষ্টমী, ক্রিসমাস ডে, মীলাদুন্নবী এই চারটি উৎসবের ধরন একই। প্রতিটি উৎসবই পালন হয় ধর্ম প্রবর্তকদের জন্মবার্ষিকী হিসেবে। বৌদ্ধদের গৌতম বুদ্ধের জন্মদিনকে বুদ্ধপূর্ণিমা, হিন্দুধর্মের প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিনকে জন্মাষ্টমী, খ্রিষ্টানদের যীশুখ্রীষ্টের জন্মদিনকে ক্রিসমাস ডে বা বড়দিন, ঠিক একইভাবে ইসলাম ধর্মের নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্মদিন উপলক্ষ্যে কিছু মুসলিম নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তেকালের অনেক বছর পরে ‘ঈদে মীলাদুন্নবী’ নামে একটি নব্য ইবাদত উৎসব হিসাবে পালন করে আসছে, যা বিদআত। বক্ষ্যমান প্রবন্ধে আমরা এই বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব।
এসব উৎসবের উৎপত্তি :
এই চারটি জন্মদিন পালনের শুরু কখনোই কোনো ধর্মীয় প্রবর্তকেরা করেননি। এসব উৎসব শুরু হয়েছে তাঁদের মৃত্যুর শত শত বছর পরে। ইতিহাস ভালো করে চর্চা করলে আমরা এমনই তথ্য পাই। যেহেতু হাজার হাজার বছর আগে কোনো ক্যালেন্ডারই যখন সৃষ্টি হয়নি, তখন তাদের জন্মদিন বা জন্মবার্ষিকীই বা কীভাবে নির্ণয় করা যায়? সুতরাং এই চারটি ধর্মীয় উৎসব মূলত পালন করা হয় অনুমানের ভিত্তিতে এবং তাদের অনুসারীদের ইচ্ছার প্রতিফলনে। কোনো ধর্মীয় গ্রন্থেই জন্মদিন নিয়ে কোনো কিছু পাওয়া যায় না। সেখানে ধর্মীয় প্রবর্তকদের জন্মদিন পালন করার তো প্রশ্নই আসে না।
যদিও বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে ফেরাউনের জন্মদিনের উৎসবের কথা এসেছে অস্পষ্টভাবে। যেখানে তার জন্মদিনে দরবারের সবাইকে মদ, পানীয় ইত্যাদি দিয়ে আপ্যায়ন করার কথা উল্লেখ হয়েছে। যেমন— ওল্ড টেস্টামেন্টে এসেছে, ‘তৃতীয় দিনটি ছিল ফেরাউনের জন্মদিন। ফেরাউন তার সব কর্মকর্তাদের জন্য ভোজের আয়োজন করেন। ফেরাউন তার মদ পরিবেশক ও রুটি প্রস্তুতকারককে ক্ষমা করে দিলেন’।[1] অতএব, এই চারটি উৎসবেরই কোনো সুনির্দিষ্ট ভিত্তি নেই। এমনকি যীশুখ্রীষ্টের যে জন্মদিন পালন হচ্ছে, সেটা তার মৃত্যুর ৪৫০ বছর পরে সীমিতভাবে পালন করার কথা তৎকালীন পোপ স্বীকার করেছিলেন। পরবর্তীতে অন্যান্য ধর্মের ধর্মীয় উৎসবের বিপরীতে এই উৎসবটি সামগ্রিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করে।
যেমন ইসলাম ধর্মে দুটি ঈদ রয়েছে। যা জাহেলী যুগের দুটি উৎসবের পরিবর্তে মুসলিমদের দেওয়া হয়েছে।[2] এটা হাদীছ দ্বারা সুস্পষ্টভাবে স্বীকৃত যে, ইসলামে ঈদ দুটি। অর্থাৎ উৎসব হচ্ছে দুটি। আর তাহলো ঈদুল ফিত্বর ও ঈদুল আযহা।
ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করা বিদআত কেন?
কেন এই নব্য উৎসব পালন করা ইসলামে বৈধ নয়, বরং বিদআত, তার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। যেমন- এই জাতীয় উৎসব কারা কারা পালন করছে তা আমাদের দেখতে হবে। অর্থাৎ অন্য কোনো ধর্মে এই জাতীয় উৎসব আছে কি-না? যদি থেকে থাকে, তাহলে আমরা অনুরূপ কিছু পালন করতে পারব কি-না? যদি এই উৎসব অন্য ধর্মের লোকেরা পালন করে থাকে, তাহলে আমরাও কি একই উৎসব পালন করতে পারি? অথবা আমরা এমন কিছু পালন করছি কি-না, যা অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ?
উপরিউক্ত বিষয় জানার জন্য আমরা সরাসরি প্রশ্ন করব কুরআনকে যে, আমরা অন্য ধর্মের অনুসরণ-অনুকরণ করতে পারি কি-না? বা আমরা বিধর্মীদের অনুসরণ করতে পারি কি-না? আল্লাহ আমাদের ইসলামে এমন কিছু পালন করার অনুমতি দিয়েছেন কি-না?
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে লক্ষ্য করে একটি আয়াত নাযিল করেছেন। তা হলো,﴿وَلَنْ تَرْضَى عَنْكَ الْيَهُودُ وَلَا النَّصَارَى حَتَّى تَتَّبِعَ مِلَّتَهُمْ﴾ ‘আর ইয়াহূদী ও নাছারাগণ আপনার প্রতি কখনো সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না আপনি তাদের মিল্লাতের অনুসরণ করেন’ (আল-বাক্বারা, ২/১২০)। অর্থাৎ তৎকালীন ইয়াহূদী এবং খ্রিষ্টানরা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে পছন্দ করতেন না এবং রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি সন্তুষ্ট হতেন না। কারণ রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে অনুসরণ-অনুকরণ করেননি এবং তাদের ধর্মেরও অনুসরণ করেননি। আর তারা যা চাইত, তা করা তো দূরের কথা বরং তার বিপরীত করার আদেশ দিতেন। যার প্রেক্ষিতে তারা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি সন্তুষ্ট হতে পারেনি। আর এই কথাই আল্লাহ উপরিউক্ত আয়াত দ্বারা মুমিনদের জানিয়ে দিলেন। আর তা এজন্যই যে, আমরাও যেন কখনো এই ইয়াহূদী-খ্রিষ্টানদের অনুসরণ না করি।
পবিত্র কুরআনে বিধর্মীদের অনুসরণ সম্পর্কে মুসলিমদের জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। আল্লাহ বলেন,﴿وَلَا تُطِعِ الْكَافِرِينَ وَالْمُنَافِقِينَ﴾ ‘আর আপনি কাফের ও মুনাফিক্বদের অনুসরণ করবেন না’ (আল-আহযাব, ৩৩/৪৮)। এই আয়াত দ্বারা এটা সুস্পষ্ট যে, কখনোই বিধর্মীদের অনুকরণ, অনুসরণ ইত্যাদি করা যাবে না। যদি আমরা তাদের অনুসরণ, অনুকরণ করি, তাহলে আমরা কুরআনের বিরুদ্ধে চলে যাব। মাআযাল্লাহু মিন যালিক!
আসুন, এবার দেখা যাক, যাকে নিয়ে এবং যার জন্মদিন পালন করাকে আমরা বড় ইবাদত তথা সকল ঈদের সেরা ঈদ বলে উল্লসিত হচ্ছি, সেই নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ব্যাপারে কী বলেছেন। হাদীছে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে, সে ব্যক্তি তাদেরই অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে’।[3] অর্থাৎ মুসলিমদের কেউ যদি অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের অনুসরণ করে, তাহলে তাকে সেই ধর্মের অনুসারী হিসেবেই গণ্য করা হবে। অতএব, এই হাদীছের আলোকেও আমরা বিধর্মীদের অনুসরণ করতে পারি না। শুধু তাই নয়, বিধর্মীদের সামান্যতম অনুকরণও রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মেনে নেননি।
অতএব, দেখা যাচ্ছে যে, অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের অনুসরণ করতে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কত কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। আর আমাদের উপমহাদেশে গত ৫০ বছর ধরে যেভাবে বিধর্মীদের অনুকরণে ঈদে মীলাদুন্নবীর উৎসবের নামে মিছিল, মিটিং, জসনে জুলূস, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদির আয়োজন হচ্ছে, তা কতটুকু সমর্থনযোগ্য?
দ্বিতীয়ত, যে বিষয়টা আমাদের লক্ষ্য করতে হবে, সেটা হচ্ছে এই উৎসব করার অনুমোদন ইসলাম আমাদের দিচ্ছে কি-না। কেননা যেকোনো ইবাদত যা নেকীর উদ্দেশ্যে করা হয়, তার একটি নির্দিষ্ট মানদণ্ড ইসলামে রয়েছে। ইসলামে যেকোনো ইবাদত অবশ্যই রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অনুমোদিত হতে হবে। এখন এই উৎসব যা অধিকাংশ লোকই পালন করছে, তা কি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পালন করেছেন? ছাহাবী, তাবেঈ, তাবে-তাবেঈ, সালাফে ছালেহীন পালন করেছেন কি? যদি তারা পালন না করে থাকেন এবং পালন করার নির্দেশ, অনুমোদন কিছুই করে না থাকেন, তাহলে তা আমরা কীভাবে পালন করতে পারি? ইতিহাস সাক্ষী, এই মীলাদুন্নবী পালন শুরু হয়েছে ৩০০ হিজরীরও পরে। তাও একজন শাসকের তত্ত্বাবধানে। কোনো আলেম, বুজুর্গ বা কোনো আল্লাহর নেয়ামতপ্রাপ্ত বান্দাদের দ্বারা নয়।
সুতরাং যা অতীতে ছিল না, এখন তা যতই জৌলূস নিয়ে উদযাপন করা হোক না কেন, তা কখনই ইসলাম সমর্থিত হতে পারে না। কেননা ইসলামে নতুন কোনো আমল চালু করাই হচ্ছে বিদআত। যেই রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্মদিন পালন করার জন্য এই উৎসব চালু করা হয়েছে, সেই রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ই বলছেন, مَنْ أَحْدَثَ فِى أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيهِ فَهُوَ رَدٌّ ‘যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছুর উদ্ভব ঘটাল, যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[4] জাবের রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,أَمَّا بَعْدُ فَإِنَّ خَيْرَ الْحَدِيثِ كِتَابُ اللهِ وَخَيْرَ الْهَدْىِ هَدْىُ مُحَمَّدٍ وَشَرَّ الأُمُورِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ ‘নিশ্চয়ই শ্রেষ্ঠ বাণী হলো আল্লাহর কিতাব এবং শ্রেষ্ঠ হেদায়াত হলো মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হেদায়াত। আর নিকৃষ্টতম কাজ হলো দ্বীনের মধ্যে নতুন সৃষ্টি এবং প্রত্যেক নতুন সৃষ্টিই হলো ভ্রষ্টতা’।[5] সুনানে নাসাঈর বর্ণনায় রয়েছে,وَكُلُّ ضَلاَلَةٍ فِى النَّارِ ‘প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণতি জাহান্নাম’।[6]
উপরিউক্ত হাদীছগুলো যদি আমরা ব্যাখ্যা করি, তাহলে এটা খুবই সুস্পষ্ট যে, যেসব আমল রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ছাহাবী রযিয়াল্লাহু আনহুম, তাবেঈ, তাবে-তাবেঈ রহিমাহুমুল্লাহ করেননি, তা কখনোই করা যাবে না। আর কেউ করলে তা পরিত্যাজ্য বলে গণ্য হবে। শুধু তাই নয়, ইসলামে আমলের নামে নেকীর উদ্দেশ্যে কোনো ইবাদত তৈরি করা খুবই নিকৃষ্টতম কাজ। নতুন সকল ইবাদতই পথভ্রষ্টতা। আর সকল পথভ্রষ্টতাই হচ্ছে জাহান্নামের ইন্ধন। সুতরাং যেখানে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নতুন ইবাদত সৃষ্টিকে নিষিদ্ধ করেছেন, সেখানে আজ আমরা নিত্যনতুন রঙেঢঙে, নিত্যনতুন চাকচিক্যে, নিত্যনতুন বাহারে যে জসনে জুলূসে ইদে মীলাদুন্নবী পালন করছি, তা কতটুকু ইসলামসম্মত হতে পারে?
যারা জোড়াতালি দিয়ে ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করাকে বৈধ মনে করছেন, তাদের কাছে জিজ্ঞাসা হচ্ছে, আপনারা বা আপনাদের পূর্ববর্তীরা কুরআনের যে আয়াত এবং হাদীছ দ্বারা মীলাদুন্নবী জায়েয সাব্যস্ত করছেন তা কি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ছাহাবী রযিয়াল্লাহু আনহুম, তাবেঈ এবং তাবে-তাবেঈগণ রহিমাহুমুল্লাহ বুঝতে পারেননি? ইসলাম প্রতিষ্ঠার ৩০০ বছর পর্যন্ত যা কেউ করেননি, বুঝেননি তা কি এখন আপনারা নতুন করে বুঝতে পেরেছেন? যে কুরআন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়ে এসেছেন, তিনি যে বুঝ বুঝেননি, কুরআন যাদেরকে সরাসরি শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, সেসব ছাহাবীগণ যে বুঝ বুঝেননি, সে বুঝ কখনো সঠিক বুঝ হতে পারে না। কাজেই আমরা শত, হাজার বছর পর এসে যদি বুঝি যে বিধর্মীদের মতো আমাদেরও একটি উৎসব করা দরকার, তবে সেটা নেহায়েত ভ্রষ্টতা ছাড়া আর কী হতে পারে?
ঈদে মীলাদুন্নবী হচ্ছে জন্মবার্ষিকী পালন। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা যেভাবে, যে আশায় পালন করছে আমরাও তাদের মতোই করছি। অথচ জন্মবার্ষিকী বা মৃত্যুবার্ষিকী ইত্যাদি কোনো কিছুই পালন করার কোনো অনুমোদন বা পালন করার কোনো নযীর ইসলামে নেই।
যদি এমন কিছু থাকত, তাহলে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সন্তানদের, স্ত্রীদের জন্মদিন বা জন্মবার্ষিকী বা মৃত্যুবার্ষিকী অবশ্যই পালন করতেন। লক্ষাধিক ছাহাবী ছিলেন, যারা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। অথচ তারা কখনই এমনটা করলেন না, তাদের পরবর্তীতেও কেউ কিছু করল না আর আমরা ইসলামের সোনালী যুগের বহু পরে এসে নতুন করে আবিষ্কার করলাম সকল ঈদের সেরা ঈদ ‘ঈদে মীলাদুন্নবী’!
ইসলামে সর্বপ্রথমে ভালোবাসতে হবে আল্লাহকে। আর আল্লাহর ভালোবাসা পেতে শর্ত হচ্ছে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ভালোবাসা এবং তাঁর অনুসরণ করা। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন,﴿قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ﴾ ‘(হে রাসূল!) আপনি বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস, তবে আমার অনুসরণ করো, তাহলেই আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাশীল, দয়ালু’ (আলে ইমরান, ৩/৩১)।
উক্ত আয়াতে কত সুন্দর করে আল্লাহ বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং ভালোবাসা অর্জন করতে হলে অবশ্যই রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ করতে হবে।
আজ আমরা যারা মীলাদুন্নবী পালন করছি, তাদের সিংহভাগই বেনামাযী। সিংহভাগ লোকই ইসলামের ন্যূনতম জ্ঞান রাখে না। তারা না করে কুরআন চর্চা, না করে হাদীছ অধ্যয়ন। আমাদের অধিকাংশ মুসলিমই শুধু শুনে শুনে মুসলিম হওয়ার চেষ্টা করি। কষ্ট করে কখনই কিছু পাওয়ার চেষ্টা করি না। যেখানে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসেছেন কুরআনকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য, সেখানে তারা কুরআনের ধারেকাছেও নেই। আছে শুধু রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ভালোবাসার দোহাই দিয়ে ইসলামে বিদআতী আমল করে আশেকে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাজার অপচেষ্টা।
অথচ যারা অন্য ধর্মাবলম্বীদের অনুসরণে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভালোবাসার নামে এমন বিদআতী কাজ করছেন, ইসলামে নতুন নতুন আমলের সৃষ্টি করছেন, তাদের জন্য হাদীছে রয়েছে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুস্পষ্ট হুঁশিয়ারি। হাদীছে এসেছে, আবূ হাযেম রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি সাহল রযিয়াল্লাহু আনহুকে বলতে শুনেছি, তিনি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছেন, তিনি বলেছেন, ‘আমি তোমাদের পূর্বেই হাউযে কাউছারের নিকট পৌঁছে যাব। যে ব্যক্তি সেখানে নামবে, সে পানি পান করবে আর যে ব্যক্তি সেই পানি পান করবে, সে কখনও পিপাসিত হবে না। সেখানে কিছু লোক আমার নিকট আসবে, যাদেরকে আমি চিনি আর তারাও আমাকে চেনে। অতঃপর আমার ও তাদের মধ্যে অন্তরায় সৃষ্টি করা হবে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলবেন, ‘তারা তো আমার অন্তর্ভুক্ত’। তখন (আমাকে) বলা হবে, ‘আপনি জানেন না যে, এরা (দ্বীনের মধ্যে) আপনার পরে কী পরিবর্তন সাধন করেছে’! তখন আমি বলব, ‘দুর্ভোগ তার জন্য, যে ব্যক্তি আমার পরে (দ্বীনকে) পরিবর্তন করেছে’।[7]
উপরিউক্ত হাদীছে এটা সুস্পষ্ট যে, ইসলামে নতুন কোনো কিছু যারা তৈরি করবে, তাদেরকে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্বিয়ামতের মাঠে হাউযে কাউছার থেকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিবেন। অথচ এই হাউযে কাউছারের পানির জন্য এবং রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুপারিশের জন্য আমরা এই নব্য বিদআত ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করছি!
শুধু তাই নয় রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতেন যে, তাঁর উম্মত বিধর্মীদের অনুসরণ-অনুকরণ করবে। তাই তিনি আগেই এই ব্যাপারে সাবধান করে গেছেন। হাদীছে এসেছে, ‘তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তীদের রীতিনীতি অনুসরণ করবে; বিঘতে বিঘতে এবং হাতে হাতে। এমনকি তারা যদি দ্বব (গুইসাপ সদৃশ প্রাণী) এর গর্তেও প্রবেশ করে, তবে তোমরাও তাতে প্রবেশ করবে’। আমরা বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনি কি ইয়াহূদী ও নাছারার কথা বলছেন? জবাবে তিনি বললেন, ‘তাছাড়া আর কারা?[8] অতএব, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা আজ সত্য প্রমাণিত হয়েছে। যারা বিধর্মীদের অনুসরণে-অনুকরণে ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করছে, তারাও এদের অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহ আমাদের সর্বদা বিধর্মীদের অনুসরণ এবং আনুগত্য করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ تُطِيعُوا الَّذِينَ كَفَرُوا يَرُدُّوكُمْ عَلَى أَعْقَابِكُمْ فَتَنْقَلِبُوا خَاسِرِينَ﴾ ‘হে মুমিনগণ! যদি তোমরা কাফেরদের আনুগত্য কর, তবে তারা তোমাদেরকে পশ্চাতে (কুফরে) ফিরিয়ে দেবে; ফলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবে’ (আলে ইমরান, ৩/১৪৯)। আল্লাহ অন্য আয়াতে বলেন,﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ تُطِيعُوا فَرِيقًا مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ يَرُدُّوكُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ كَافِرِينَ﴾ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা যদি যাদেরকে কিতাব প্রদান করা হয়েছে, তাদের এক দলের আনুগত্য কর, তবে তারা তোমাদেরকে ঈমান আনার পর আবার কাফের অবস্থায় ফিরিয়ে দিবে’ (আলে ইমরান, ৩/১০০)।
অর্থাৎ যারা আল্লাহর কুরআন এবং হাদীছের বিপরীতে গিয়ে বিধর্মীদের অনুসরণ-আনুগত্য করবে, তারা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর একজন মুসলিমের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো ঈমানহারা হওয়া। কেউ যদি ঈমানহারা হয়, তাহলে তার দুনিয়া এবং আখেরাত দুটিই ধ্বংস হবে। সুতরাং এমন কাজ করা থেকে আমাদের বিরত থাকা উচিত, যে কাজের কারণে আমরা জাহান্নামের অধিবাসী হয়ে যাব। আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন- আমীন!
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।
[1]. ওল্ড টেস্টামেন্ট, বুক অব জেনেসিস, ৪০/২০।
[2]. আবূ দাঊদ, হা/১১৩৪; নাসাঈ, হা/১৫৫৬; মুসনাদ আহমাদ, হা/১২০০৬। আলবানী রহিমাহুল্লাহ হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন।
[3]. মুসনাদে আহমাদ, ২/৫০; আবূ দাঊদ, হা/৪০৩১; আর আলবানী রহিমাহুল্লাহ হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন। ছহীহ আল-জামে‘ আছ-ছাগীর, হা/৬০২৫।
[4]. ছহীহ বুখারী, হা/২৬৯৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১৭১৮।
[5]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৪১; মিশকাত, হা/১৪১।
[6]. নাসাঈ, হা/১৫৭৮, হাদীছ ছহীহ।
[7]. ছহীহ বুখারী, হা/৭০৫০-৭০৫১।
[8]. ফাতহুল বারী, ১৩/৩০০; ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৬৯।