কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ইসলামের প্রভাব

post title will place here

জীবন মাত্রই স্বাধীনতা প্রত্যাশী। স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। এটি যেকোনো জাতির সর্বোচ্চ অর্জন। এটি স্রষ্টার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। অন্যদিকে পরাধীনতা অর্থই— শৃঙ্খল, হতাশা, ব্যর্থতা, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা ও অভিশাপ। স্বাধীনতাহীন জাতি মাত্রই বুঝতে পারে পরাধীনতার যন্ত্রণা। স্বাধীনতার স্বাদ পেতে মানুষ অবলিলায় বুক পেতে দেয় শত্রুর কামানের মুখে, হাসিমুখে গলায় পরে ফাঁসির রজ্জু, স্বেচ্ছায় বরণ করে নেয় কারাগারের মরণযন্ত্রণা। তাই বিশ্বমানবতার কল্যাণধর্ম ইসলামের অবস্থান সবসময় মাযলূমের পক্ষে এবং যালেমের বিপক্ষে। নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত মানবতাকে রক্ষার জন্য এবং তাদেরকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জন্য ইসলাম উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর পথে এবং অসহায় নর-নারী ও শিশুদের জন্য সংগ্রাম করবে না? যারা বলছে, হে আমাদের প্রতিপালক! এ অত্যাচারী শাসকের দেশ হতে আমাদেরকে অন্যত্র নিয়ে যাও এবং তোমার নিকট হতে কাউকে আমাদের অভিভাবক ও সাহায্যকারী বানাও’ (আন-নিসা, ৪/৭৫)

মীরজাফর ও জগৎশেঠদের ষড়যন্ত্রে ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। তারপর প্রায় ২০০ বছর এদেশবাসী বন্দি ছিল ইংরেজদের গোলামির জিঞ্জিরে। তখন কতিপয় বিশ্বাসঘাতকের সহায়তায় ইংরেজরা এদেশকে শাসন ও শোষণ করেছে, এদেশকে শকুনের মতো খুবলে খুবলে খেয়েছে, এদেশের কৃষ্টি-কালচারকে ধ্বংস করেছে, এদেশ থেকে পাচার করা সম্পদে বিলেতে প্রাচুর্যের পাহাড় গড়েছে। এসময় কিছু লোক স্বদেশ ও স্বজাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ইংরেজদের পদলেহনপূর্বক ‘নওয়াব’, ‘স্যার’, ‘জমিদার’ উপাধি লাভে ধন্য হয়েছেন। অন্যদিকে, যারা দেশমাতৃকার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি, দখলদার ইংরেজদের সাথে হাত মেলায়নি তাদের বুক হয়েছে ইংরেজদের ট্রিগারের নিশানা। তাদের ঠিকানা হয়েছে ফাঁসির মঞ্চ অথবা কালো পানির আন্দামান দীপপুঞ্জ। এদের মধ্যে প্রথম সারিতে ছিলেন ইসলামপন্থী লোকজন, বিশেষ করে আলেম সমাজ। তাদের আপসহীন সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, কুরবানী আর রক্তের স্রোতের প্রবল প্রবাহে ইংরেজ বেনিয়াদের মসনদ তছনছ হয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৭ সালে তারা এ দেশ থেকে লেজ গুটিয়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিল এবং দেশবাসী পেয়েছিল স্বাধীন ভূখণ্ড ‘পাকিস্তান’। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, মুসলিমদের রক্তের ওপর ভিত্তি করে এবং ইসলামের নামে পাকিস্তানের জন্ম হলেও দেশটি মুসলিমদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। পাকিস্তানের জনক শীআ মতালম্বী জিন্নাহ ও ইয়াহিয়া গোষ্ঠীর একগুঁয়েমি, শঠতা এবং যুলুমের কারণে দেশবাসী আবারও স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে থাকে। ক্রমে তা স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নেয়। ১৯৭১ সালে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে দেশবাসী আবার লাভ করে লাল-সবুজের পতাকা এবং একটি ভূখণ্ড ‘বাংলাদেশ’।

ভারতীয় উপমাহাদেশে ধর্মপ্রাণ মুসলিম সম্প্রদায় বিশেষ করে আলেম সমাজের ইতিহাস প্রতারিত হওয়ার ইতিহাস। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। কিছু লোকের অদূরদর্শিতা এবং কিছু লোকের ষড়যন্ত্রের কারণে এবারও লাঞ্ছনা ও নিগ্রহের শিকার হন ধর্মপ্রাণ মুসলিম সমাজ ও ইসলামের প্রকৃত ধারক-বাহক আলেম সমাজ। স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের অবদান, ত্যাগ-তিতিক্ষাকে অবলীলায় অস্বীকার করা হয়। অথচ তাদের অবদান কোনো বিবেচনায়ই অন্যদের তুলনায় কম ছিল না। দেশবাসী বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেছে যে, ইতোপূর্বে শিশু শিক্ষার্থীদের তৃতীয় শ্রেণির খ্রিষ্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বইয়ে ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে খ্রিষ্টান শহীদ’, চতুর্থ শ্রেণির বইয়ে ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে খ্রিষ্টানদের অংশগ্রহণ’ এবং পঞ্চম শ্রেণির বইয়ে ‘দেশ ও জাতির সেবায় বাংলাদেশ খ্রিষ্টমণ্ডলী’ শিরোনামে লেখা ছাপানো হয়েছে। সেখানে তাদের কীর্তিগাঁথা প্রচার করা হয়েছে সুকৌশলে এবং অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। অথচ, ৯২ ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত দেশে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে আলেমদের অবদান নিয়ে কোনো লেখা স্থান পায়নি কোনো স্তরের পাঠ্যপুস্তকে। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশপ্রেমিক আলেম সমাজের অবদান, বীরত্বগাঁথা নিয়ে একটি পুস্তক কিংবা পুস্তিকা তো দূরে থাক একটি প্রবন্ধ পর্যন্ত লেখা কিংবা ছাপা হয়নি রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে। বরং নতুন প্রজন্মের কাছে তাদেরকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। দোষ-গুণ নির্বিশেষে তাদেরকে দেশবিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধী তকমা দিতে এমন কোনো প্রচেষ্টা নেই যা করা হয়নি। টুপি, দাড়ি, পাঞ্জাবী আর সেজদার চিহ্নকে দেশদ্রোহী, রাজাকার এবং খারাপ লোকের পরিচায়ক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের ধুয়া তুলে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’, ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ এবং ‘আল্লাহু আকবর’ শ্লোগান নিয়ে বিষোদগার করা হচ্ছে। এখানেই শেষ নয়, একের পর এক নগ্নভাবে আঘাত হানা হচ্ছে ইসলামী শিক্ষা, সংস্কৃতির উপর। ইসলামী শিক্ষা বন্ধ করা, সংকুচিত করা এবং নিরুৎসাহিত করার নানামুখি ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। কোমলমতি শিশুদের পাঠ্যবইয়ে, নগ্ন ছবি-মূর্তি এবং বিবর্তনবাদের মতো কুফরী মতবাদকে ঢুকিয়ে দিয়ে ঈমান হরণের ঘৃণ্য চক্রান্ত করা হচ্ছে। ড্রেসকোডের নামে হিজাবের মতো ফরয বিধান নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হচ্ছে। যৌনশিক্ষার অন্তরালে সমকামিতার মতো জঘন্য অপরাধকে বৈধতা দানের চেষ্টা করা হচ্ছে। দাদাবাবুদের লেখা ‘কাবুলিওয়া’ নামক গল্পের আড়ালে সুকৌশলে মুসলিমদেরকে উগ্র ও সন্ত্রাসী হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ইসলামের পবিত্র পরিভাষা ‘ফতওয়া’, ‘জিহাদ’-কে নিষিদ্ধ করার পাঁয়তারা চলছে। ভয় দেখিয়ে বলপূর্বক ঈমান ও ইসলামবিরোধী কাজে ধর্মপ্রাণ মুসলিমদেরকে বাধ্য করা হচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হয়েও ধর্মপ্রাণ মুসলিম ও আলেম সমাজ দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মতো মাথা নিচু করে চলতে বাধ্য হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি স্তরে ইসলামপন্থী জনগণ এবং আলেম সমাজ অসামান্য অবদান রেখেছেন। সুতরাং স্বাধীনতা সংগ্রামে আলেম সমাজের অবদান এবং ইসলামের প্রভাব বিষয়টির আলোচনা খুবই প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বের দাবি রাখে। এর মাধ্যমে সত্য উদ্ঘাটিত হবে, ইসলামবিদ্বেষীদের মুখোশ উন্মোচন হবে, ইতিহাসের সাথে বিশ্বাসঘাতকদের মুখে চপেটাঘাত হবে এবং প্রমাণিত হবে যে, ইসলাম ও ধর্মপ্রাণ মুসলিম সম্প্রদায় কোনোভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধী ছিল না। বরং ইসলামের নামে এবং ইসলামকে ব্যবহার করেই স্বাধীনতা সংগ্রাম সূচিত হয়েছে, গতি লাভ করেছে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছছে।

১. ঐতিহাসিক পটভূমি ও রাজনৈতিক পথ-পরিক্রমা : রাজনৈতিক স্বাধীনতা কখনো একদিনে বা হঠাৎ করে আসে না। স্বাধীনতার ভিত রচিত হয় ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল সেই ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। এরপর ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৫৬ সালের সংবিধান আন্দোলন, ৬৬ সালের ৬ দফা, ৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ৭০ সালের নির্বাচন আমাদের স্বাধিকার ও স্বাধীনতার আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। সর্বশেষ মুক্তিযুদ্ধের মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি। স্বাধীনতা আন্দোলনের এসব পর্যায়েই সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল ইসলামপন্থী তাওহীদী জনতার। এ ক্ষেত্রে যাদের নাম উল্লেখ না করলে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় তারা হলেন— মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ এবং শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ। মওলানা ভাসানী হলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ তথা বর্তমান আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক গুরু। তিনিই স্বাধীন বাংলার প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনিই সর্বপ্রথম এদেশের স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার দাবি উত্থাপনকারী। তাঁকে নিয়েই স্বাধীনতার প্রথম কবিতা ‘সফেদ পাঞ্জাবী’ লেখা হয়েছিল। এ মওলানাকে নিয়েই আব্দুল গাফফার চৌধুরী— ‘আমাদের মিলিত সংগ্রাম/মৌলানা ভাসানীর নাম’ কবিতা এবং আবু জাফর উবায়দুল্লাহ বিখ্যাত কবিতা ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’ লিখেছিলেন। ‘৭১-এর বহু আগেই ‘আস-সালামু আলাইকুম’ এবং ‘লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়াদীন’ বলে তিনি পাকিস্তানকে বিদায় জানিয়েছিলেন।[1]

২. ইসলামের দৃষ্টিতে ৬ দফার ব্যাখ্যা দান : ঐতিহাসিক ৬ দফা ছিল বাঙালির ‘বাঁচার দাবি’ এবং ‘মুক্তির সনদ’। শহীদ বুদ্ধিজীবী মাওলানা অলিউর রহমান ‘শরীয়তের দৃষ্টিতে ৬ দফা’ বই লিখে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। সে সময় ৬ দফা কর্মসূচির সমর্থনে পুস্তিকাটির হাজার হাজার কপি দেশব্যাপী ধর্মপ্রিয় জনগণের হাতে পৌঁছানো হয়েছিল। ফলে ৬ দফা কর্মসূচি যে পবিত্র ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে কোনো কার্যক্রম নয় এটা জনগণ সহজেই বুঝতে পেরেছিল এবং ধর্মপ্রাণ জনগণ ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ৬ দফা কর্মসূচিকে সমর্থন করে আওয়ামী লীগকে একচেটিয়া ভোট প্রদান করেছিল।[2] ৬ দফার পক্ষে নিজের ভূমিকার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মাওলানা শেখ উবায়দুল্লাহ সাঈদ জালালাবাদী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আগস্টের এক সন্ধ্যায় আমরা কয়েকজন মাঠে বসে আলাপ আলোচনা করছিলাম। সেখানে ঐতিহাসিক রাণী ভবানীর নাতি এবং নাটোরের এককালীন জমিদার ও নবনির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য শ্রী শঙ্কর গোবিন্দ চৌধুরী আমাকে বলেন, ‘মাওলানা সাহেব, আপনার জন্যই আজ আমাদের দুর্গতি! আপনি আওয়ামী লীগের ৬ দফার পক্ষে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে ও দেশব্যাপী বই-পুস্তক প্রচার করে যদি ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলিম জনগণকে আওয়ামী লীগের পক্ষে উদ্বুদ্ধ না করতেন তাহলে ১৯৭০-এর জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে পারত না এবং আমরাও এরূপ ভোগান্তির শিকার হতাম না। কথাগুলো হয়তোবা তিনি মজা করার জন্য বলেছেন, কিন্তু এর প্রতিটি শব্দই বাস্তবসম্মত। কারণ আমাদের মুসলিম জনগণ খুবই ধর্মভীরু। তাদেরকে আমাদের সঠিক ধর্মীয় ব্যাখ্যা নিশ্চিতভাবে প্রভাবিত করেছিল’।[3]

৩. ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতান্ত্রিক ঘোষণায় ইসলামের ব্যবহার : আওয়ামী লীগ সংবিধান কমিটি কর্তৃক ৬ দফার ভিত্তিতে প্রণীত পাকিস্তানের খসড়া শাসনতন্ত্রে কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষা ও বিধান প্রতিপালনের গ্যারান্টি দিয়ে শুরু হয়েছিল ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’ দিয়ে এভাবে— In the name of Allah, the Beneficient, the Merciful, ...and in pursuance of this object to enable the Muslims of Pakistan, individually and collectively, to order their lives in accordance with the teachings of Islam as set out in the Holy Quran and the Sunnah.[4]

এই খসড়া শাসনতন্ত্রের ৩য় ভাগে নির্দেশমূলক রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ‘ইসলাম’ অংশে (১) কুরআন-সুন্নাহবিরোধী আইন পাস না করার, (২) কুরআন ও ইসলামিয়াত শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করার ও (৩) মুসলিমদের মধ্যে ইসলামী নৈতিকতা উন্নয়নের পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা ছিল এভাবে—

PART III-DIRECTIVE PRINCIPLES OF STATE POLICY

  1. ISLAM

(1) No law shall be repugnant to the injunctions of Islam as laid down in the Holy Quran and Sunnah.

(2) Facilities shall be provided for the teaching of the Holy Quran and Islamiat to the Muslims of Pakistan.

(3) Observance of Islamic moral standars should be promoted among the Muslims of Pakistan.[5]

৪. ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ইসলামবিরোধী আইন না করার অঙ্গীকার : ২৮ অক্টোবর, ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রেকর্ডকৃত নির্বাচনী ইশতেহার ভাষণে ‘কুরআন ও সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন না করার’ বিষয়টি স্পষ্টরূপে উল্লেখ ছিল। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে পাকিস্তান বেতার ও টেলিভিশনে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে, আমরা ইসলামে বিশ্বাসী নই। এ কথার জবাবে আমার সুস্পষ্ট বক্তব্য, আমরা লেবাসসর্বস্ব ইসলামে বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী ইনছাফের ইসলামে। আমাদের ইসলাম রাসূলে করীম a-এর ইসলাম, যে ইসলাম জগৎবাসীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র। ইসলামের প্রবক্তা সেজে পাকিস্তানের মাটিতে বারবার যারা অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ-বঞ্চনার পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছেন, আমাদের সংগ্রাম সেই মুনাফেক্বদের বিরুদ্ধে। যে দেশের শতকরা ৯৫ জনই মুসলিম সে দেশে ইসলামবিরোধী আইন পাশের কথা ভাবতে পারেন তারাই, ইসলামকে যারা ব্যবহার করেন দুনিয়াটা ফারস্থা করে তোলার কাজে’।[6]

১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ স্পষ্টভাবেই ইসলাম প্রশ্নে তাদের অবস্থান ঘোষণা করেছিল এভাবে— ‘...অঞ্চলে অঞ্চলে এবং মানুষে মানুষে সুবিচারের নিশ্চয়তা প্রত্যাশী কোনো কিছুই ইসলামের পরিপন্থী হতে পারে না। আমরা এই শাসনতান্ত্রিক নীতির প্রতি অবিচল ওয়াদাবদ্ধ যে, কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশিত ইসলামী নীতির পরিপন্থী কোনো আইনই এ দেশে পাশ হতে বা চাপিয়ে দেওয়া যেতে পারে না’।[7]

৫. নির্বাচনী আবেদনে ইসলামের ব্যবহার : ১ ডিসেম্বর ১৯৭০ সালের নির্বাচনী আবেদনে শেখ মুজিবুর রহমান ‘আস-সালামু আলাইকুম’ বলে শুরু করেছিলেন। নির্বাচনী আবেদনের এক পর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, ‘সেই দুর্দিনে করুণাময় আল্লাহর আশীর্বাদস্বরূপ আপনারাই কেবল আমার সাথে ছিলেন’। এ আবেদনের শেষ অংশে উল্লেখ ছিল— ‘শহীদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। ন্যায় ও সত্যের সংগ্রামে নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সহায় হবেন’।[8]

৬. মুক্তিযুদ্ধে আলেমদের নেতৃত্বদান : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় আলেম সমাজের অবদান অনস্বীকার্য। শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন মুক্তযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের ইতিহাসে একমাত্র হাফেয প্রধানমন্ত্রী তিনিই। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছায়াসঙ্গী। ৭১’-এ বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তিনিই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সেকারণে বাংলাদেশের ইতিহাস হাফেয প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনকে বাদ দিয়ে লেখা যায় না।[9] মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে শহীদ তাজউদ্দীন কুরআন মাজীদ সঙ্গে রাখতেন।[10]

মওলানা ভাসানী ছিলেন প্রবাসী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার-এর সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান। বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া যেমন বাংলাদেশের কল্পনা করা যায় না, ঠিক তেমনি ভাসানীকে ছাড়াও বাংলাদেশের চিন্তা করা যায় না। স্বাধীনতার সমার্থক শব্দ যেন ‘মুজিব’ ও ‘ভাসানী’। একটানা ১০ বছর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পক্ষে মাওলানা তর্কবাগীশের ছিল দীপ্ত পদক্ষেপ, সাহসী ভূমিকা। একাত্তরের দিনগুলোতে তিনি পুরো উত্তরবঙ্গ ঘুরে ঘুরে মানুষকে যুদ্ধের প্রতি উৎসাহিত করেন, মিটিং করেন। একাত্তরে তিনি ছিলেন পাক হানাদারদের জন্য এক মূর্তিমান আতঙ্ক।

৭. ইসলামী শব্দ ও পরিভাষা ব্যবহার : ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা লাভ পর্যন্ত প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগ্রামে যারা নিহত হয়েছে, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে তাদের প্রত্যেকের নামের সাথে ‘শহীদ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী পৌরসভার একটি সড়কের নাম আছে ‘শহীদ কাঞ্চন কুণ্ডু’ লেন। ১৯৫২ সালে ভাষার দাবিতে শহীদদের স্মরণে তৈরি ‘শহীদ মিনার’ আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম স্মারক, প্রথম প্রেরণা। অথচ ‘শহীদ মিনার’-এর দুটি শব্দই আরবী। স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধুসহ অনেক বড় নেতা-নেত্রী তাদের বক্তৃতায় ‘শহীদ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এখনও করছেন। অথচ ‘শহীদ’ শব্দটি ইসলামের অতি মর্যাদা ও গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিভাষা। ‘শহীদ’ শব্দটি মূলত শুধু তাদের জন্য প্রযোজ্য যারা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল...। গোলাম মুরশিদের মতে, হিন্দু ধর্মে ‘শহীদের ধারণা নেই’।[11]

৮. ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনির ব্যবহার : ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি মুসলিমদের চিন্তা-চেতনার উৎস, সকল আন্দোলন-সংগ্রামের প্রাণশক্তি। ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখার মূল চেতনা হলো ‘আল্লাহু আকবর’। এই চেতনাই পূর্ববঙ্গকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পৃথক রাজনৈতিক মর্যাদা দিয়েছে। এই চেতনাই পূর্ববঙ্গকে ‘বাংলাদেশ’ নামে পৃথিবীর বুকে পৃথক রাষ্ট্রীয় মানচিত্র দান করেছে। পিছনের দিকে তাকালে দেখতে পাই, শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবুর রহমানের ১৪ই সেপ্টেম্বর সিলেট আগমন উপলক্ষ্যে ৯ই সেপ্টেম্বর ১৯৫৭ সালে প্রচারিত বিজ্ঞাপন— নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবর। দেখতে পাই ৭ই ডিসেম্বর ১৯৭০-এর জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের বিজ্ঞাপনের শীর্ষে ‘আল্লাহু আকবর’ ‘আওয়ামী লীগ জিন্দাবাদ’। দেখতে পাই ১৯৭০ সালের ৬ই নভেম্বর বগুড়ার গুজিয়া হাইস্কুল মাঠে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আয়োজিত বিরাট জনসভার বিজ্ঞাপনের শীর্ষে ‘আল্লাহু আকবর’। শুনতে পাই ১৯৭১ সালের ৩রা জানুয়ারি রবিবার রেসকোর্স ময়দানে প্রধান অতিথির ভাষণ শেষে শেখ মুজিবের ভরাট গগণভেদী সমাপ্তি শ্লোগান ‘নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবর’।[12]

৯. ধর্মীয় নাম ও ব্যক্তিদের ব্যবহার করে অনুষ্ঠান : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ‘পুতুল নাচের খেল’ (আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত) কথিকায় যশোরের এক গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেবের চরিত্র যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। কথিকার শেষ অংশে ইমাম সাহেবের বক্তব্য ‘আমীন, আমীন। ইয়া আল্লাহ, রব্বুল আলামীন, বাংলাদেশের সেই সুদিন যেন দেখে যেতে পারি’ অংশটুকু নিঃসন্দেহে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিটি কর্মী-সমর্থককে অনুপ্রাণিত করেছিল।[13]

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ‘জল্লাদের দরবার’ অনুষ্ঠানে ‘ঈমান’ চরিত্রটিও মুক্তিপাগল জনতাকে উৎসাহিত করেছিল চরমভাবে।[14] স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বাইশ ও চব্বিশ নং গানেও ইসলামী অনুভূতিকে ব্যবহার করা হয়েছে স্বার্থকভাবে। বাইশ ও চব্বিশ নং গানে যথাক্রমে উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে— ‘ওরে মনের আশা আল্লাহয় তাঁরে কইরা দিক সফল রে’, ‘তোরা দুরাচারী ধ্বংস করো সহায় আছে রাব্বানা’।[15]

১০. ধর্মীয় ভাবাবেগের ব্যবহার : ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ মঙ্গলবার পল্টনের জনসভার শুরুতেই গণআন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন তাঁদের জন্য মওলানা ভাসানীর ইমামতিতে গায়েবী জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া, সভায় গৃহীত প্রস্তাবে দেশের সর্বত্র গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠানের জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।[16]

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ‘রামাযানের ওই রোজার শেষে’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমেও মুসলিম ভাবাবেগকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করা হয়েছে।

(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)

মো. হাসিম আলী

সহকারী শিক্ষক, পল্লী উন্নয়ন একাডেমী ল্যাবরেটরী স্কুল এন্ড কলেজ, বগুড়া।


[1]. মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, (বাংলা একাডেমী), পৃ. ১০৯, ১২১, ১২৪, ১২৬, ১৫৩, ৩৪৮, ৩৫৬, ৩৬০, ৩৬১, ৩৮৮, ৪৪৮; আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে, পৃ. ৯৪।

[2]. শাকের হোসাইন শিবলি, একাত্তরের চেপে রাখা ইতিহাস আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে, (আল-এছহাক প্রকাশনী, প্রকাশকাল: জুন ২০১৪), পৃ. ১৩১-১৪৭।

[3]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৭।

[4]. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ২/৭৯৩।

[5]. প্রাগুক্ত, ২/৭৯৪।

[6]. সামীম মোহাম্মদ আফজাল, ইসলাম প্রচার-প্রসারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, (ইফা), পৃ. ১৯; অধ্যক্ষ মো. শাহজাহান আলম সাজু, ইসলাম ও বঙ্গবন্ধু, (ইফা), পৃ. ৫১।

[7]. বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও নির্বাচিত দলিল, (সময় প্রকাশন, ২০১৫), পৃ. ২৫৫-৫৬; মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম, (গার্ডিয়ান পাবলিকেশন, চতুর্থ সংস্করণ-২০১৮), পৃ. ১৭-১৮।

[8]. বাঙালির কণ্ঠ, (বঙ্গবন্ধু পরিষদ), পৃ. ১৮০-১৮১।

[9]. দৈনিক কালের কণ্ঠ, ১০ জানুয়ারি, ২০২০।

[10]. আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে, পৃ. ১৫৯।

[11]. উইকিপিডিয়া।

[12]. দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ জানুয়ারি, ১৯৭১; মাসিক আত-তাহরীক, নভেম্বর, ২০২২।

[13]. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ৫/১৫৮।

[14]. প্রাগুক্ত, ৫/৩৬৫।

[15]. প্রাগুক্ত, ৫/৪১৭-৪১৯।

[16]. প্রাগুক্ত, ২/৭২৩, ৭২৫।

Magazine