কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

আদর্শ দাঈর গুণাবলি

দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া নবী-রাসূল ও তাঁদের অনুসারীগণের কাজ। আর নবী-রাসূলগণ আলাইহিমুস সালাম-এর পরে তাঁদের সেই কাজগুলো বর্তমানে ইসলামের দাঈগণ আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। একজন দাঈকে দাওয়াতের ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু গুণের অধিকারী হতে হবে। নিচে সংক্ষেপে তাদের গুণাবলি আলোচনা করা হলো।

(১) যেদিকে আহ্বান করবে, তার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস থাকা : দাওয়াতের বিষয়ে ঈমানের দৃঢ়তার উপর তার ফলাফল নির্ভরশীল। বিশ্বাস যত গভীর হবে, ফলাফল তত ভালো হবে। বিশ্বাস যত দুর্বল হবে, ফলাফল তত কম হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, يَا يَحْيَى خُذِ الْكِتَابَ بِقُوَّةٍ ‘হে ইয়াহইয়া! এ কিতাব (তাওরাত)-কে সুদৃঢ়ভাবে ধারণ করুন’ (মারইয়াম, ১৯/১২)। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন, فَخُذْهَا بِقُوَّةٍ وَأْمُرْ قَوْمَكَ يَأْخُذُوا بِأَحْسَنِهَا ‘সুতরাং তা শক্ত করে ধরুন এবং আপনার কওমকে নির্দেশ দিন, যেন তারা গ্রহণ করে এর উত্তম বিষয়গুলো’ (আল-আ‘রাফ, ৭/১৪৫)

(২) যার দিকে আহ্বান করছে, তার সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক থাকা : একজন দাঈর সাহায্য পাওয়ার জন্য আল্লাহর সাথে দৃঢ় সম্পর্ক থাকতে হবে। আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্কের দৃঢ়তা‌ প্রমাণিত হবে দুটি জিনিসের মাধ্যমে। যথা—

(ক) দাওয়াতের ক্ষেত্রে নিয়্যতের বিশুদ্ধতা : একজন দাঈ তার কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করবে। দুনিয়াবী কোনো উপকার আশা করবে না। ইখলাছের বিন্দু পরিমাণ কমতির কারণে উদ্দেশ্য পরিবর্তন হয়ে ফলাফল নষ্ট হয়ে যাবে।

(খ) আল্লাহর ভালোবাসা : যখন একজন দাঈ বেশি বেশি নফল ইবাদত, যিকির-আযকারে মশগূল থাকবে, অপছন্দনীয় বিষয় পরিহার করবে এবং আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করবে, তখন আল্লাহ তাআলাও তাকে ভালোবাসবেন। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি আমার কোনো অলীর সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করবে, আমি তার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করব। সর্বাধিক প্রিয় জিনিস, যার মাধ্যমে বান্দা আমার নৈকট্য লাভ করে তা হলো, যা আমি তার উপর ফরয করেছি। আমার বান্দা সর্বদা নফল ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করতে থাকে, এমনকি অবশেষে আমি তাকে ভালোবাসি। আর আমি যখন তাকে ভালোবাসি, তখন আমি তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শুনে; আমি তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখে; আমি তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে; আমি তার পা হয়ে যাই, যা দ্বারা সে চলে। সে যদি আমার কাছে কিছু চায়, তবে আমি নিশ্চয়ই তাকে তা প্রদান করি। আর যদি সে আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে, তবে অবশ্যই আমি তাকে আশ্রয় দেই। আমি কোনো কাজ করতে চাইলে তা করতে কোনো দ্বিধা করি না, যতটা দ্বিধা করি মুমিন বান্দার প্রাণ নিতে; সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে আর আমি তাকে কষ্ট দেওয়া অপছন্দ করি’।[1]

(৩) যে‌দিকে আহ্বান করবে সে বিষয়ে জ্ঞান ও বিচক্ষণতা থাকা : সেই প্রকৃত আহলুল ইলম‌, যে দাওয়াতী কর্মকাণ্ডকে তার জ্ঞানের ও বিচক্ষণতার সাথে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়। এ ধরনের কাজ জাহেলের কাছ থেকে আশা করা যায় না। আল্লাহ তাআলা বলেন,قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ ‘বলুন, যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান?’ (আয-যুমার, ৩৯/৯)

(৪) ইলম‌ অনুযায়ী আমল করা এব়ং চলার পথে সুপ্রতিষ্ঠিত থাকা‌ : ঐ‌ দাঈর‌ কোনো ভালো ফলাফল আশা করা যায় না, যে ইলম অনুযায়ী আমল করে না এবং চলার পথে সুপ্রতিষ্ঠিত থাকে না। আল্লাহর বাণী,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُونَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা করো না, তা কেন বলো’ (আছ-ছফ‌, ৬১/২)

আমল থেকে ইলমকে পৃথক করার দুনিয়াবী প্রভাব : যদি দাঈ‌ নিজে আমল না করে, তাহলে যাদের আহ্বান করা হয় তারা বলবে, তার কথা যদি উপকারী হয়, তাহলে সে নিজে কেন আমল করে না। তখন তার ডাকে কেউ সাড়া দিবে না। অথচ তার আমল যদি ইলম অনুযায়ী হতো, তাহলে আহ্বান ছাড়াই অনেক মানুষ তার অনুকরণ করত। কেননা মুখের কথার চেয়ে বাস্তব অবস্থার কথা বেশি উপকারী।

(৫) পরিপূর্ণ সচেতনতা : একজন দাঈকে তিনটি বিষয়ে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। তা হলো—

(ক) যুগের চাহিদা অনুযায়ী দাওয়াতের বাস্তবতা।

(খ) তার আশেপাশের আহূত ব্যক্তির অবস্থা।

(গ‌) দাঈর‌ নিজের অবস্থা এবং যে পরিস্থিতি তাকে বেষ্টন করে রেখেছে তার অবস্থা।

(৬) কর্মপদ্ধতিতে প্রজ্ঞা অবলম্বন : একজন দাঈকে তার কর্মকাণ্ডে অবশ্যই প্রজ্ঞাবান হতে হবে। অবস্থার চাহিদা অনুযায়ী সর্বোত্তম পদ্ধতিতে যথাস্থানে প্রয়োগ করার নামই প্রজ্ঞা। আল্লাহ তাআলা বলেন, يُؤْتِي الْحِكْمَةَ مَنْ يَشَاءُ ‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হিকমত প্রদান করেন’ (আল-বাক্বারা, ২/২৬৯)

(৭) উত্তম চরিত্রের অধিকারী হওয়া : দাঈর‌ জন্য উত্তম চরিত্রে চরিত্রবান হওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ। আল্লাহ তাআলা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চরিত্রের ব্যাপারে বলেন,وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ ‘নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী’ (আল-ক্বালাম, ৬৮/৪)

(৮) মুমিনদের প্রতি ভালো ধারণা রাখা : একজন দাঈ অবশ্যই সমস্ত মুসলিমের প্রতি ভালো ধারণা পোষণ করবেন। দাঈ‌ তার বাহ্যিক অবস্থার প্রতি নির্ভর করবে এবং গোপন বিষয়গুলো আল্লাহর দিকে ন্যস্ত করবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা অধিক ধারণা করা থেকে বেঁচে থাকো, নিশ্চয়ই কিছু ধারণা পাপ’ (আল-হুজুরাত, ৪৯/১২)

(৯) মানুষের নিকট থেকে তাদের দোষত্রুটি গোপন করা : রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللهُ فِى الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলিম ব্যক্তির দোষ গোপন করবে, মহান আল্লাহ তার দোষ গোপন রাখবেন দুনিয়াতে ও আখিরাতে’।[2]

(১০) ভালো-মন্দ অবস্থা বিবেচনা করে মানুষের সাথে মেশা : দাওয়াতের ক্ষেত্রে একটি আবশ্যক বিষয় হলো মানুষদের কল্যাণের পথে আহ্বান করা, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করতে তাদের সঙ্গে মেশা। হাদীছে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,الْمُؤْمِنُ الَّذِي يُخَالِطُ النَّاسَ، وَيَصْبِرُ عَلَى أَذَاهُمْ أَفْضَلُ مِنَ الْمُؤْمِنِ الَّذِي لَا يُخَالِطُ النَّاسَ وَلَا يَصْبِرُ عَلَى أَذَاهُمْ ‘যে মুমিন ব্যক্তি মানুষের সাথে মিশে এবং তাদের থেকে পাওয়া কষ্টের উপর ধৈর্যধারণ করে, সে উত্তম ঐ মুমিনের চেয়ে যে মুমিন ব্যক্তি মানুষের সাথে মিশে না এবং তাদের থেকে পাওয়া কষ্টে ধৈর্যধারণও করে না’।[3]

তবে মেলামেশার ক্ষেত্রে কিছু শর্ত রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَإِذَا رَأَيْتَ الَّذِينَ يَخُوضُونَ فِي آيَاتِنَا فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ حَتَّى يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ ‘যখন আপনি দেখবেন সেসব লোককে, যারা আমার আয়াত নিয়ে সমালোচনা করছে, তখন আপনি তাদের থেকে সরে পড়ুন, যে পর্যন্ত না তারা অন্য আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়’ (আল-আনআম, ৬/৬৮)। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বর্ণনা অনুযায়ী বনী ইসরাঈলের মাঝে সর্বপ্রথম যে ঘাটতি প্রবেশ করে, তা হলো তাদের আলেমদের নিয়ন্ত্রণহীনভাবে খারাপ লোকদের সাথে মেশা। এটা তো স্পষ্ট বিষয় যে, একজন ডাক্তার যখন কোনো রোগীর চিকিৎসা করেন, তখন তিনি রোগের জীবাণু থেকে নিজেকে সর্তকতার‌ সাথে সংরক্ষণ করেন।‌ আর তা না হলে চিকিৎসক নিজেই রোগে আক্রান্ত হয়ে যেতে পারেন।

(১১) মানুষদেরকে যথাযথ মর্যাদা দান এবং সম্মানিত ব্যক্তিদের সম্মানের স্বীকৃতি প্রদান : হাদীছে এসেছে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‌لَيْسَ ‌مِنَّا ‌مَنْ ‌لَمْ ‌يَرْحَمْ صَغِيرَنَا وَيُوَقِّرْ كَبِيرَنَا ‘সে ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে ছোটদের স্নেহ করে না এবং বড়দের সম্মান করে না’।[4]

সুতরাং একজন দাঈর‌ জন্য আবশ্যক হলো, তিনি মানুষের মান-মর্যাদা ও অবস্থানের প্রতি লক্ষ্য রাখবেন এবং মানুষদেরকে যথাযথ স্থানে স্থান দিবেন। কারণ মর্যাদাবান ব্যক্তিদের সম্মানের স্বীকৃতি শুধু মর্যাদাবান ব্যক্তিরা দিতে পারেন।

(১২) অন্য দাঈদের সাথে সুন্দর আচরণ করা, পরস্পর পরামর্শ করা ও কল্যাণ কামনা করা : আল্লাহ তাআলার বাণী, وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى ‘তোমরা তাক্বওয়া এবং ভালো কাজে পরস্পর সহযোগিতা করো’ (আল-মায়েদা, ৫/২)। এই আদব রক্ষা করলে দাঈদের পারস্পরিক ভালোবাসা গভীর হবে, তাদের নিজেদের অকল্যাণগুলো দূরীভূত হবে এবং প্রত্যেকেই নিজ মতের ওপর সন্তুষ্ট থাকার মতো ধ্বংসাত্মক সমস্যার সমাধান পেয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

হে আল্লাহ! আপনি আমাদের সকল দাঈকে এই বিষয়গুলো জেনে-বুঝে সঠিকভাবে পরস্পরের মধ্যে মিলেমিশে দাওয়াতী কাজ করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

আব্দুল কাইয়ূম বিন জাহাঙ্গীর আলম

দাওরায়ে হাদীছ, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী; আরবী শিক্ষক, মাদরাসাতুল‌ হাসানাহ, সাভার, ঢাকা।


[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৫০২।

[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৯৯, হাদীছ ছহীহ।

[3]. ইবনু মাজাহ, হা/৪০৩২, হাদীছ ছহীহ।

[4]. তিরমিযী, হা/১৯১৯, হাদীছ ছহীহ।

Magazine