(৫) অসীলা ধরা :*চারিদিকে অসীলার ছড়াছড়ি। জীবিত বা মৃত মানুষকে অসীলা ধরার প্রচলন তো আছেই; সাথে অন্যান্য পশু-প্রাণীসহ গাছ-পাথরের মতো জড়বস্তুকেও অসীলা বানাতে মানুষ লজ্জাবোধ করে না। দুঃখজনক হলো, এ তালিকায় হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মালম্বীদের সাথে অনেক মুসলিমও যুক্ত হয়েছে। আমাদের দেশের অসংখ্য মুসলিম বেহিসাব অসীলা ধরে চলেছে। জীবিত বা মৃত তথাকথিত অসংখ্য পীর-মুরশিদ, অলি-আউলিয়াকে তারা অসীলা হিসেবে গ্রহণ করেছে। তারা সরাসরি মহান আল্লাহর কাছে নিজের দাবী-দাওয়া পেশ না করে এসব অসীলার মাধ্যমে পেশ করছে। এমনকি কেউ কেউ আরো আগ বাড়িয়ে সরাসরি তাদের কাছেই চাচ্ছে! -নাঊযুবিল্লাহ- এভাবে তাদের মহান রবের মাঝে ও নিজেদের মাঝে অসীলা নামক দেওয়াল তৈরি হচ্ছে; মহান আল্লাহর সাথে শিরক সঙ্ঘটিত হচ্ছে। মহান আল্লাহ ক্রোধান্বিত হচ্ছেন। অথচ তিনি সরাসরি তাঁর বান্দার প্রার্থনা শুনতে চান। মহান আল্লাহ বলেন, وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ فَلْيَسْتَجِيبُوا لِي وَلْيُؤْمِنُوا بِي لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ ‘যখন আমার বান্দাগণ আমার সম্পর্কে তোমার নিকট জিজ্ঞেস করে, আমি তো (তাদের) নিকটেই। আহ্বানকারী যখন আমাকে ডাকে, আমি তার ডাকে সাড়া দেই। সুতরাং তাদের উচিত, আমার নির্দেশ মান্য করা এবং আমার প্রতি ঈমান আনা, যাতে তারা সরলপথ প্রাপ্ত হয়’ (আল-বাক্বারা, ২/১৮৬)। তাহলে অসীলা নামক দেওয়াল দিয়ে আপনার খুব কাছের রবকে কেন দূরে ঠেলে দিচ্ছেন? তিনিই তো আপনাকে সরাসরি ডাকতে বলছেন। যাহোক, এসব অসীলা গ্রহণের মধ্য দিয়ে অসীলাগ্রহণকারী মুসলিমদের ও মক্কার কাফের-মুশরিকদের মাঝের পার্থক্যের দেওয়াল দুমড়ে-মুচড়ে পড়ছে। কারণ এদের মতো মক্কার কাফেরদের অধিকাংশই আল্লাহকে রব, সৃষ্টিকর্তা, রিযক্বদাতা, পরিচালনাকারী হিসেবে স্বীকার করত। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُوْلُنَّ خَلَقَهُنَّ الْعَزِيْزُ الْعَلِيْمُ ‘যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞেস কর, কে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করেছেন? তারা অবশ্যই বলবে, এগুলো সৃষ্টি করেছেন পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ আল্লাহ’ (আয-যুখরুফ, ৪৩/৯)। কিন্তু তারা তাঁর সাথে অন্যান্য মূর্তি, দেব-দেবীকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করত। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَالَّذِيْنَ اتَّخَذُوْا مِنْ دُوْنِهِ أَوْلِيَاءَ مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُوْنَا إِلَى اللهِ زُلْفَى ‘আর যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে, তারা বলে, আমরা কেবল এজন্যই তাদের ইবাদত করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে’ (আয-যুমার, ৩৯/৩)। আর সে কারণেই তারা মুমিন হতে পারেনি। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللهِ إِلَّا وَهُمْ مُشْرِكُوْنَ ‘তাদের অধিকাংশ আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে, তবে (ইবাদতে) শিরক করা অবস্থায়’ (ইউসুফ, ১২/১০৬)। তারা অসীলা গ্রহণ করলেও সাধারণত মন্দ কাউকে অসীলা বানাতো না। এরপরও আল্লাহ তাদেরকে কাফের ও মুশরিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং চিরস্থায়ী জাহান্নামের ঘোষণা দিয়েছেন। আর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের রক্ত ও মালকে বৈধ গণ্য করে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছেন। অথচ আমাদের সমাজের যারা অসীলা ধরছে, তারা লেংটা-নোংরা মানুষকে পর্যন্ত অসীলা হিসেবে গ্রহণ করছে। তাদেরকে অসীলা করে আল্লাহর কাছে দু‘আ-প্রার্থনা করছে। কেউ-বা সরাসরি তাদের কাছেই চাচ্ছে— যা বড় শিরক, যা একজন মুসলিমকে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের করে দেয়। তাহলে এদের অবস্থা কী হতে পারে?!
প্রিয় পাঠক! দুঃখজনকভাবে এসব অসীলা ধরার ব্যাপারগুলো আমাদের দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হানাফী ভাইদের মাঝে চর্চা হয়। ফলে মানুষ এটাকে ইমাম আবূ হানীফা রাহিমাহুল্লাহ-এর আক্বীদা বলে মনে করে। অন্তত হানাফী আক্বীদা মনে করতে মানুষ ভুল করে না। অথচ এটা না ইমাম আবূ হানীফা রাহিমাহুল্লাহ-এর আক্বীদা, না হানাফী আক্বীদা। খোদ ইমাম আবূ হানীফা রাহিমাহুল্লাহ দ্ব্যর্থহীনভাবে বলে গেছেন, لَا يَنْبَغِيْ لِأَحَدٍ أَنْ يَّدْعُوَ اللهَ تَعَالَى إِلَّا بِهِ ‘কারো জন্য মহান আল্লাহকে তাঁর অসীলা ছাড়া (অন্যের অসীলায়) ডাকা উচিত নয়’।[1] ‘তাঁর অসীলা ছাড়া’-এর ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে আবেদীন লিখেছেন, أَيْ بِذَاتِهِ وَصِفَاتِهِ وَأَسْمَائِهِ ‘অর্থাৎ তাঁর সত্তা, গুণাবলি ও নামসমূহের অসীলা ছাড়া’।[2] উল্লেখ্য, মহান আল্লাহর সুন্দরতম নামসমূহ ও গুণাবলির ব্যাপারে ইমাম মালেক রাহিমাহুল্লাহ-এর একটি চিরন্তন বাণী[3] যেমন জাহমী ও তার বশংবদ মাতুরী-আশআরীদের মূল শেকড় কেটে দিয়েছে, তেমনি ইমাম আবূ হানীফা রাহিমাহুল্লাহ-এর দ্ব্যর্থহীন এ বক্তব্যটি ছূফী ও কবরপূজারীদের মতো মূর্তিপূজারী মুশরিকদের মূল শেকড় কেটে দিয়েছে।[4] এমনিভাবে যুগে যুগে অন্য হানাফী বিদ্বানগণও এ ব্যাপারে আপসহীন বক্তব্য দিয়ে গেছেন। মুহাম্মাদ আবেদ সিন্দী হানাফী বলেন, ‘এমন যেন না বলে, হে কবরবাসী! হে অমুক! আমার প্রয়োজন পূরণ করুন। অথবা আপনিই আল্লাহর কাছে আমার প্রয়োজনটুকু চান। অথবা আপনি আল্লাহর নিকটে আমার জন্য শাফাআত করুন। বরং যেন এভাবে বলে, হে আমার সেই সত্তা, যার কোনো শরীক নেই! আপনিই আমার এই প্রয়োজন পূরণ করুন’।[5] এভাবে হানাফী মাযহাবসহ অন্য তিন মাযহাবের আলেম-উলামাও এসব শরীআতনিষিদ্ধ অসীলার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেছেন। অতএব, এসবের দায়ভার তাদেরকেই গ্রহণ করতে হবে, যারা এগুলোর চর্চা করছে। এরা আসলে হানাফী নয়; বরং কবর ও ব্যক্তিপূজারী।
আসলে ইসলামের দৃষ্টিতে অসীলা কী? —সেটাই আমরা বুঝিনি। যার কারণে এই পদস্খলন। মহান আল্লাহ বলেছেন, يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَابْتَغُوا إِلَيْهِ الْوَسِيلَةَ وَجَاهِدُوا فِي سَبِيلِهِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, তাঁর অসীলা বা নৈকট্য অনুসন্ধান করো এবং তাঁর পথে জিহাদ করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো’ (আল-মায়েদা, ৫/৩৫)। এখানে অসীলা বলতে কখনই উপরে বর্ণিত অসীলা নয়। অন্যান্য আলেম-উলামার মতো হানাফী আলেম-উলামাও অসীলার উক্ত অর্থ করেননি। হানাফীসহ অন্যান্য আলেম-উলামার মতে, অসীলা হচ্ছে— هُوَ التَّقَرُّبُ إِلَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ بِفِعْلِ الطَّاعَاتِ، وَتَرْكِ الْمُنْكَرَاتِ ‘আনুগত্যের কাজ সম্পাদন ও মন্দ কাজ বর্জনের মাধ্যমে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টাই হচ্ছে অসীলা’।[6] ইসলামের দৃষ্টিতে অসীলা দুই প্রকার :
১. বৈধ অসীলা : সৎআমলকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের অসীলা বা মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করার নাম বৈধ অসীলা। আর যে কোনো আমল সৎ হওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে, শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তা সম্পাদন করা এবং তাতে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদর্শিত পদ্ধতি তথা সুন্নাতের অনুসরণ থাকা। যেমন : আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকে অসীলা হিসেবে গ্রহণ, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতের অনুসরণকে অসীলা হিসেবে গ্রহণ অথবা আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ যে কোনো আমলকে অসীলা হিসেবে গ্রহণ। এই অসীলা সম্পর্কেইতো মহান আল্লাহ বলেছেন, ﴿وَابْتَغُوْا إِلَيْهِ الْوَسِيْلَةَ﴾ ‘আর তোমরা তাঁর নিকট অসীলা অন্বেষণ করো’ (আল-মায়েদা, ৫/৩৫)। সুতরাং কেউ এভাবে প্রার্থনা করতে পারে, হে আল্লাহ! আপনার প্রতি আমার একনিষ্ঠতা এবং আমা কর্তৃক আপনার রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগতের মাধ্যমে আপনি আমাকে সুস্থতা ও রিযিক্ব দান করুন। যেমনটি পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেওয়া তিন ব্যক্তিকে একখণ্ড পাথর এসে গুহায় আটকিয়ে দিলে তারা তাদের সৎআমলকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে গুহার মুখ থেকে পাথর সরিয়ে দেওয়ার জন্য মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেছিলেন এবং আল্লাহ তাদের প্রার্থনা কবুল করেছিলেন।[7] অনুরূপভাবে কোনো সৎব্যক্তির দু‘আকে অসীলা বা মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা বৈধ। ফলে কেউ কোনো সৎব্যক্তিকে বলতে পারে, আপনি আমার জন্য একটু দু‘আ করবেন। যেমনিভাবে ছাহাবীগণ রাযিয়াল্লাহু আনহুম বৃষ্টি প্রার্থনার জন্য আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-এর দু‘আর শরণাপন্ন হয়েছিলেন এবং আল্লাহ তাঁদের জন্য বৃষ্টি বর্ষণ করেছিলেন।[8]
২. অবৈধ অসীলা : আল্লাহ বা তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত নয়— এমন অসীলাকে অবৈধ অসীলা বলে। যেমন : মৃত ব্যক্তিকে অসীলা হিসেবে গ্রহণ করে তার কাছে সাহায্য ও শাফাআত চাওয়া। আর এই অসীলা হারাম হওয়ার ব্যাপারে ইমামগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন— যদিও সেই মৃত ব্যক্তি নবী কিংবা অলী হন।
আল্লাহ আমাদের ছহীহ বুঝ দান করুন এবং আমরণ তাওহীদের উপর অবিচল রাখুন- আমীন!
(৬) খানকা-মাযারে মানত করা : বাংলাদেশে হাজার হাজার খানকা, মাযার ও পীরের দরগাহ রয়েছে। এসব আস্তানায় চলে হরেক রকম শিরক, কুফর, বিদআত, কুসংস্কার ও নোংরামি চর্চা। বহুসংখ্যক খানকা, মাযার ও পীরের দরগায় নানান আশায় বুক বেঁধে মানুষ গরু, ছাগল, টাকা-পয়সাসহ অনেক কিছু মানত করে। আর এভাবে চলে বিনাপুঁজির রমরমা ব্যাবসা। আর যারা এর সাথে জড়িত, তাদের প্রায় সবাই হানাফী বলে এটাকে হানাফী আক্বীদা-আমল বলে মানুষ মনে করে। এটাকে হানাফী আক্বীদা মনে করার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, যুগে যুগে কিছু নামধারী আলেম একাজকে প্রমোট করে এসেছে। কবরপূজারীদের একজন বড় আলেম কুযাঈ মৃতের জন্য মানত সম্পর্কি একটি অধ্যায় রচনা করেন এভাবে,فَصْلٌ فِيْ تَوْضِيْحِ بُطْلَانِ الْقَوْلِ بِأَنَّ الذَّبْحَ لِلْمَيِّتِ وَالنَّذْرِ لَهُ شِرْكٌ، وَتَحْقِيْقٌ أَنَّ ذَلِكَ [أَيْ النَّذْرَ لِلْمَيِّتِ] مِنَ الْقُرَبِ الْوَاصِلِ نَفْعُهَا إِلَى الْحَيِّ وَالْمَيِّتِ جَمِيْعاً ‘অধ্যায় : মৃত ব্যক্তির জন্য জবাই করা, তার জন্য মানত করা শিরক মর্মের বক্তব্যটি স্পষ্ট বাতিল। সঠিক কথা হচ্ছে, মৃতের জন্য মানত করা এমন নৈকট্য হাছিলের মাধ্যম, যার ফায়দা জীবিত-মৃত সবার কাছেই পৌঁছে’।[9] আরেকজন কবরপূজারী আলেম ক্বব্বানী বলেছেন,فَإِنْ ذَبَحَ لِلْكَعْبَةِ أَوْ لِلرُّسُلِ تَعْظِيْماً لِكَوْنِهَا بَيْتَ اللهِ أَوْ لِكَوْنِهِمْ رُسُلَ اللهِ، جَازَ ‘কা‘বা আল্লাহর ঘর হওয়ার কারণে বা রাসূলগণ আল্লাহর রাসূল হওয়ার কারণে যদি কা‘বার উদ্দেশ্যে বা রাসূলগণের উদ্দেশ্যে এতদুভয়ের সম্মানার্থে (পশু) জবাই করে, তাহলে তা জায়েয’।[10]
নাঊযুবিল্লাহ মিন যালিক। এটা ইমাম আবূ হানীফা রাহিমাহুল্লাহ-এর আক্বীদা বা হানাফী আক্বীদা হওয়া তো দূরের কথা, এটা কোনো মুসলিমের আক্বীদা হতে পারে না। সেকারণে যুগে যুগে ইসলামিক স্কলারগণ এটাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন; এমনকি হানাফী বিদ্বানগণও। হানাফী বিদ্বান ক্বাসেম ইবনে কুতলূবুগা রাহিমাহুল্লাহ বলেন, وَأَمَّا النَّذْرُ الَّذِي يُنْذِرُهُ أَكْثَرُ الْعَوَامّ عَلَى مَا هُوَ مُشَاهَدٌ كَأَنْ يَكُونَ لِإِنْسَانٍ غَائِبٌ أَوْ مَرِيضٌ، أَوْ لَهُ حَاجَةٌ ضَرُورِيَّةٌ فَيَأْتِي بَعْضَ الصُّلَحَاءِ فَيَجْعَلُ سُتْرَةً عَلَى رَأْسِهِ فَيَقُولُ يَا سَيِّدِي فُلَانٌ إنْ رُدَّ غَائِبِي، أَوْ عُوفِيَ مَرِيضِي أَوْ قُضِيَتْ حَاجَتِي فَلَكَ مِنْ الذَّهَبِ كَذَا، أَوْ مِنْ الْفِضَّةِ كَذَا، أَوْ مِنْ الطَّعَامِ كَذَا، أَوْ مِنْ الْمَاءِ كَذَا، أَوْ مِنْ الشَّمْعِ كَذَا، أَوْ مِنْ الزَّيْتِ كَذَا فَهَذَا النَّذْرُ بَاطِلٌ بِالْإِجْمَاعِ لِوُجُوهٍ ‘অধিকাংশ সাধারণ জনগণ যে মানত করে, যেটা আমরা দেখে থাকি, যেমন— কারো কেউ হারিয়ে গেলে বা অসুস্থ হলে বা জরুরী কোনো প্রয়োজন পড়লে সে কোনো নেককার ব্যক্তির কাছে এসে মাথায় পর্দা দিয়ে বলে, হে আমার অমুক নেতা! যদি আমার হারানো ধন ফিরিয়ে দেওয়া হয় বা আমার রোগী আরোগ্য লাভ করে বা আমার প্রয়োজন পূরণ করা হয়, তাহলে আপনাকে এত এত সোনা, রূপা, খাদ্য-পানীয়, মোমবাতি, তেল ইত্যাদি দিবো— তবে এই মানত কয়েকটি কারণে ইজমার ভিত্তিতে বাতিল’।[11] ইবনে কুতলূবুগা রাহিমাহুল্লাহ-এর বক্তব্যের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন পরবর্তীকালের অনেক হানাফী বিদ্বান। যেমন— ইবনু নুজাইম, যাকে আবূ হানীফা আছ-ছানী বলা হয়, খয়রুদ্দীন রমলী, আলাউদ্দীন হাছকাফী, ইবনে আবেদীন, রশীদ আহমাদ গাঙ্গোহী, শুকরী আল-আলূসী, আলী মাহফূয হানাফী প্রমুখ।[12]
প্রিয় পাঠক! মনে রাখবেন, মানত একটি ইবাদত, যা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উদ্দেশ্যে নিবেদিত হলে শিরক হয়ে যাবে। মহান আল্লাহ নেককার বান্দাদের প্রশংসায় বলেন,﴿يُوفُونَ بِالنَّذْرِ﴾ ‘তারা মানত পূর্ণ করে’ (আদ-দাহর, ৭৬/৭)। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, مَنْ نَذَرَ أَنْ يُطِيعَ اللَّهَ فَلْيُطِعْهُ، وَمَنْ نَذَرَ أَنْ يَعْصِيَهُ فَلاَ يَعْصِهِ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্যের মানত করবে, সে যেন তার আনুগত্য করে। আর যে তার অবাধ্যতার মানত করবে, সে যেন তার অবাধ্যতা না করে’।[13]
সুতরাং মানত হতে হবে একনিষ্ঠভাবে কেবল আল্লাহর জন্য। যদি তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়, তাহলে তা শিরকে আকবার বা বড় শিরকে পরিণত হবে, যা ব্যক্তিকে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের করে দিবে। আর যদি খানকা-মাযার-কবরে গিয়ে জবাই করে, কিন্তু আল্লাহর জন্যই করে, কবরবাসীর জন্য না করে, তাহলে তাও হারাম হবে। কারণ তা শিরকের দুয়ার উন্মুক্ত করে দেয়।[14] আল্লাহর জন্য মানত করলেও যদি তা কবরের নিকট জবাই করা হয়, তবে তা না জায়েয হওয়ার ব্যাপারে চার মাযহাবের উলামায়ে কেরাম একমত হয়েছেন।[15]
এতকিছুর পরও কি আপনি খানকা-মাযারে ও পীরের দরবারে গরু, ছাগল, খাদ্য-খাবার, টাকা-পয়সা ইত্যাদি নিয়ে হাযির হবেন?
(চলবে)
বি. এ. (অনার্স), উচ্চতর ডিপ্লোমা, এম. এ. এবং এম.ফিল., মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব; অধ্যক্ষ, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।
[1]. ইবনে আবেদীন, রদ্দুল মুহতার আলাদ-দুর্রিল মুখতার, (দারুল ফিকর, বৈরূত, ২য় প্রকাশ : ১৪১২ হি./১৯৯২ খৃ.), ৬/৩৯৬; আলূসী, জালাউল আইনাইন ফী মুহাকামাতিল আহমাদাইন, (মাত্ববাআতুল মাদানী, প্রকাশকাল : ১৪০১ হি./১৯৮১ খৃ.), পৃ. ৫৫১।
[2]. রদ্দুল মুহতার আলাদ-দুর্রিল মুখতার, ৬/৩৯৬।
[3]. ইমাম মালেক রাহিমাহুল্লাহ-কে যখন আল্লাহ কর্তৃক আরশের উপর সমুন্নত হওয়ার ধরন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তখন তিনি বলেছিলেন,اَلِاسْتِوَاءُ مَعْلُوْمٌ وَالْكَيْفُ مَجْهُوْلٌ وَالْإِيْمَانُ بِهِ وَاجِبٌ وَالسُّؤَالُ عَنْهُ بِدْعَةٌ ‘এর অর্থ জানা আছে। তবে তার ধরন জানা নেই। এর প্রতি ঈমান রাখা ওয়াজিব এবং ধরন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা বিদআত। আমি তোমাকে বিদআতী দেখতে পাচ্ছি’। অতঃপর তিনি প্রশ্নকারীকে সেখান থেকে বের করে দেওয়ার আদেশ করেছিলেন (যাহাবী, আল-আরশ, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ২য় প্রকাশ : ১৪২৪ হি./২০০৩ খৃ.), ১/১৮৯)।
[4]. জুহূদু উলামাইল হানাফিয়্যাহ ফী ইবত্বালি আক্বাইদিল কুবূরিয়্যাহ, ২/১১২৩।
[5]. ত্বওয়ালি‘উল আনওয়ার শারহু তানবীরিল আবছার মা‘আদ দুর্রিল মুখতার (এই লিঙ্ক থেকে সংগৃহীত: http://www.saaid.net/kutob/11.htm)।
[6]. দ্রষ্টব্য : জুহূদু উলামাইল হানাফিয়্যাহ ফী ইবত্বালি আক্বাইদিল কুবূরিয়্যাহ, ৩/১৪৪৭-৪৮।
[7]. ছহীহ বুখারী, হা/২১২৮; ছহীহ মুসলিম, হা/৬৬৯৯।
[8]. ছহীহ বুখারী, হা/৯৫৫ ও ৩৪৪৫।
[9]. আল-বারাহীন আস-সাত্বে‘আহ, পৃ. ৪৫৬-৪৭০, ভায়া : জুহূদু উলামাইল হানাফিয়্যাহ ফী ইবত্বালি আক্বাইদিল কুবূরিয়্যাহ, ৩/১৫৪৬।
[10]. ফাছলুল খিত্বাব, পৃ. ৩০, ভায়া : জুহূদু উলামাইল হানাফিয়্যাহ ফী ইবত্বালি আক্বাইদিল কুবূরিয়্যাহ, ৩/১৫৪৫।
[11]. আল-বাহরুর রয়েক্ব শারহু কানযিদ দাক্বাইক্ব, ২/৩২০।
[12]. জুহূদু উলামাইল হানাফিয়্যাহ ফী ইবত্বালি আক্বাইদিল কুবূরিয়্যাহ, ৩/১৫৫০।
[13]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৬৯৬।
[14]. ফাওযান, ই‘আনাতুল মুস্তাফীদ বিশারহি কিতাবিত তাওহীদ, (মুআসসাসাতুর রিসালাহ, ৩য় প্রকাশ: ১৪২৩ হি./২০০২ খৃ.), ১/২৮৩।
[15]. দ্রষ্টব্য : তাবঈনুল হাক্বায়েক্ব, ১/২৪৬; মাওয়াহিবুল জালীল, ২/২২৮; আল-মাজমূ‘, ৫/৩২০; আল-ইনছাফ, ২/৫৬৯।