(মিন্নাতুল বারী- ১৭তম পর্ব)
[যে হাদীছের ব্যাখ্যা চলছে : ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ বলেন, আমাকে হাদীছ শুনিয়েছেন ইয়াহইয়া ইবনু বুকায়র; তিনি বলেন, আমাকে হাদীছ শুনিয়েছেন লায়ছ; তিনি হাদীছ বর্ণনা করেন উকায়ল থেকে; তিনি ইবনু শিহাব থেকে, তিনি উরওয়া ইবনু যুবায়ের থেকে, তিনি আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা থেকে হাদীছ বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, সর্বপ্রথম রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট অহির সূচনা হয় ঘুমে সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে। তিনি যে স্বপ্নই দেখতেন সেটিই সকালের মতো তার সামনে সত্যরূপে উদ্ভাসিত হতো। অতঃপর তাঁর কাছে নির্জনতা প্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে তিনি হেরা গুহায় নির্জনে সময় কাটান এবং সেখানে বেশ কয়েক রাত্রি ইবাদতে মগ্ন থাকতেন- প্রয়োজনীয় পাথেয় নেওয়ার জন্য পরিবারের কাছে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত। তারপর তিনি খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা-এর নিকট ফিরে আসতেন, এবং অনুরূপভাবে পাথেয় নিয়ে যেতেন। এভাবেই একদিন তিনি হেরা গুহায় থাকা অবস্থায় তাঁর নিকট মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মহাসত্য (অহী) চলে আসে। ফেরেশতা তাঁর নিকটে এসে তাঁকে বলেন, পডুন! তিনি বলেন, আমি পড়তে জানি না। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ফেরেশতা আমাকে ধরলেন এবং এমনভাবে জোরে চাপ দিলেন যে, আমার খুব কষ্ট হলো। তারপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিলেন এবং বললেন, পড়ুন! আমি বললাম, আমি তো পড়তে জানি না। ফলে ফেরেশতা আমাকে দ্বিতীয়বার ধরলেন এবং এমনভাবে জোরে চাপ দিলেন যে, আমার খুব কষ্ট হলো। তারপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিলেন এবং বললেন, পড়ুন! আমি বললাম, আমি তো পড়তে জানি না। তিনি আমাকে তৃতীয়বার ধরে এমনভাবে জোরে চাপ দিলেন যে আমার খুব কষ্ট হলো। তারপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিলেন এবং বললেন, ‘পড়ুন! আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি (সব কিছু) সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাটবাধা রক্ত হতে। পড়ুন! আর আপনার প্রতিপালক মহাসম্মানিত’।
অতঃপর আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়াতগুলো নিয়ে ফিরে আসেন এসময় তাঁর বুক ধড়ফড় করছিল। তিনি খাদীজা বিনতু খুওয়াইলিদ রযিয়াল্লাহু আনহা-এর নিকট আসলেন এবং বললেন, আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দাও! আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দাও! অতঃপর তারা তাঁকে চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন। অতঃপর তাঁর ভয় কেটে গেলে তিনি খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা-কে পুরো ঘটনা জানালেন এবং বললেন, আমি আমার জীবনের ভয় পাচ্ছি। তখন খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা বললেন, কখনোই নয়! আল্লাহর কসম! মহান আল্লাহ আপনাকে কখনোই অপমানিত করবেন না। নিশ্চয় আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখেন, অপারগ ব্যক্তির বোঝা বহন করেন, নিঃস্বকে সহযোগিতা করেন, মেহমানেরআপ্যায়ন করেন, দুর্যোগগ্রস্ত মানুষকে সহযোগিতা করেন।
অতঃপর খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা তাকে সাথে নিয়ে তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাক্বা ইবনু নওফেলের কাছে নিয়ে যান, যিনি জাহেলী যুগে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং তিনি হিব্রু ভাষায় বই লিখতেন। আল্লাহ যতটুকু চেয়েছিলেন, তিনি হিব্রু ভাষায় ইঞ্জীল লিখেছিলেন। তিনি একজন বয়োঃবৃদ্ধ ছিলেন এবং দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছিলেন। খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহাতাঁকে বললেন, হে আমার চাচাতো ভাই! আপনার ভাতিজার কাছে শুনুন (তাঁর বৃত্তান্ত)! তখন ওয়ারাক্বা তাঁকে ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ভাতিজা, আপনি কী দেখেছেন? রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা দেখেছিলেন তাঁকে তা জানালেন। অতঃপর ওয়ারাক্বা তাঁকে বললেন, ইনিই সেই ‘নামূস’ (গোপন বার্তাবাহক অর্থাৎ জিবরীল) যাকে মহান আল্লাহ মূসার নিকট পাঠিয়েছিলেন। হায়! যদি আমি সে সময় যুবক থাকতাম এবং যদি আমি সেদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতাম যেদিন আপনার জাতি আপনাকে বের করে দিবে! তখন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তারা কি আমাকে বের করে দিবে? তিনিবলেন, হ্যাঁ, ইতোপূর্বে যে ব্যক্তিই এই বার্তা নিয়ে এসেছে, যে বার্তা নিয়ে আপনি এসেছেন, তাঁর সাথেই শত্রুতা করা হয়েছে। আপনার সে সময় পর্যন্ত যদি আমি বেঁচে থাকি, তবে আমি আপনাকে মযবূতভাবে সহযোগিতা করব। কিন্তু কিছুদিন পর ওয়ারাক্বা রযিয়াল্লাহু আনহু ইন্তেকাল করেন। আর অহি কিছু দিনের জন্য স্থগিত হয়ে যায়।
আব্দুল্লাহ ইবনু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ ও আবূ ছালেহ রহিমাহুল্লাহ অনুরূপ (অর্থাৎ فؤاده শব্দ)বর্ণনা করেছেন। হেলাল ইবনু রাদদাদ রহিমাহুল্লাহ যুহরী রহিমাহুল্লাহ থেকেও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। আর ইমাম যুহরী থেকে ইউনুস ও মা‘মার qفؤادهএর স্থলে بَوَادِرُهُশব্দ উল্লেখ করেছেন।]
কুরআনে প্রথম কোন আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে?
মূল হাদীছের শেষে উক্ত খণ্ডিত হাদীছ উল্লেখ করার পেছনে ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ-এর মূল কারণ হচ্ছে, সর্বপ্রথম কোন অহি অবতীর্ণ হয়েছে সেই বিতর্কের সমাধান করা এবং অহি সাময়িক স্থগিত হওয়ার পর পুনরায় কোন আয়াত অবতীর্ণের মাধ্যমে অহি নতুন করে শুরু করা হয় সেটা আলোকপাত করা। সেক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে একদল আলেমের মতে, প্রথম অবতীর্ণ হওয়া অহি হচ্ছে সূরা মুদ্দাছছির। তাদের দলীল নিম্নের হাদীছটি—
الْأَوْزَاعِيُّ قَالَ سَمِعْتُ يَحْيَى يَقُولُ سَأَلْتُ أَبَا سَلَمَةَ أَيُّ الْقُرْآنِ أُنْزِلَ قَبْلُ؟ قَالَ يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ فَقُلْتُ أَوِ اقْرَأْ؟ فَقَالَ سَأَلْتُ جَابِرَ بْنَ عَبْدِ اللهِ أَيُّ الْقُرْآنِ أُنْزِلَ قَبْلُ؟ قَالَ يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ فَقُلْتُ أَوْ اقْرَأْ؟ قَالَ جَابِرٌ أُحَدِّثُكُمْ مَا حَدَّثَنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ جَاوَرْتُ بِحِرَاءٍ شَهْرًا فَلَمَّا قَضَيْتُ جِوَارِي نَزَلْتُ فَاسْتَبْطَنْتُ بَطْنَ الْوَادِي، فَنُودِيتُ فَنَظَرْتُ أَمَامِي وَخَلْفِي وَعَنْ يَمِينِي وَعَنْ شِمَالِي فَلَمْ أَرَ أَحَدًا ثُمَّ نُودِيتُ فَنَظَرْتُ فَلَمْ أَرَ أَحَدًا ثُمَّ نُودِيتُ فَرَفَعْتُ رَأْسِي فَإِذَا هُوَ عَلَى الْعَرْشِ فِي الْهَوَاءِ يَعْنِي جِبْرِيلَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ فَأَخَذَتْنِي رَجْفَةٌ شَدِيدَةٌ فَأَتَيْتُ خَدِيجَةَ فَقُلْتُ دَثِّرُونِي فَدَثَّرُونِي فَصَبُّوا عَلَيَّ مَاءً فَأَنْزَلَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ: {يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ قُمْ فَأَنْذِرْ وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ}
ইমাম আওযাঈ রহিমাহুল্লাহ বলেন, আমি ইয়াহইয়াকে বলতে শুনেছি তিনি বলেন, আমি আবূ সালামাকে জিজ্ঞেস করেছি কুরআনের কোন আয়াতটি সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়েছে? তিনি উত্তরে বললেন, ইয়া আইয়ূহাল মুদ্দাছছির। আমি বললাম, না-কি ইক্বরা? তিনি বললেন, আমি জাবের ইবনু আব্দুল্লাহকে জিজ্ঞেস করেছিলাম পবিত্র কুরআনের সর্বপ্রথম কোন আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে? তিনি উত্তরে বললেন, ইয়া আইয়ূহাল মুদ্দাছছির। আমি বললাম, না-কি ইক্বরা? তখন জাবের বললেন, আমি তোমাকে সেই হাদীছ শুনাচ্ছি যা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে শুনিয়েছেন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি হেরা গুহায় এক মাস অবস্থান করলাম। আমার অবস্থান শেষ করে যখন আমি নেমে আসছিলাম এবং উপত্যকার মাঝামাঝি পৌঁছলাম তখন আমাকে ডাকার আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি আমার সামনে-পেছনে, ডানে-বামে তাকালাম কিন্তু সেখানে কাউকে দেখতে পেলাম না। আমাকে পুনরায় ডাকা হলো, আমি পুনরায় তাকালাম কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। অতঃপর আমাকে পুনরায় ডাকা হলো, আমি আমার মাথা উঁচু করে দেখতে পেলাম জিবরীল আলাইহিস সালাম খোলা বায়ুমণ্ডলে বিশাল আসনের উপর বসে আছেন। আমি ভয়ে কাঁপতে লাগলাম। আমি খাদীজার নিকট আসলাম এবং বললাম, আমাকে চাদর দিয়ে জড়িয়ে দাও! আমাকে চাদর দিয়ে জড়িয়ে দাও! তারা আমাকে চাদর দিয়ে জড়িয়ে দেন এবং আমার মাথায় পানি ঢালেন। অতঃপর মহান আল্লাহ আয়াত অবতীর্ণ করেন, ‘হে চাদরাবৃত ব্যক্তি! উঠুন! (মানুষকে) সতর্ক করুন! আপনার প্রতিপালকের বড়ত্ব করুন! আপনার বস্ত্র পরিষ্কার করুন![1]
উভয় হাদীছের মধ্যে বিরোধের সমাধান :
(১) ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ মূলত এই হাদীছের জবাব দেওয়ার জন্যই মূল হাদীছের শেষে আলোচ্য হাদীছটি পেশ করেছেন। আমরা গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলে দেখতে পাব, ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ-এর আলোচ্য হাদীছ এবং এই হাদীছ উভয়ের সনদ একই। উভয় হাদীছই জাবের রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে আবূ সালামা ইবনু আব্দুর রহমান বর্ণনা করেছেন। পার্থক্য হচ্ছে আবূ সালামা থেকে এই হাদীছ ইয়াহইয়া বর্ণনা করেছেন আর ইমাম বুখারীর আলোচ্য হাদীছ আবূ সালামা থেকে যুহরী বর্ণনা করেছেন। ইমাম বুখারী যুহরী থেকে যে বর্ণনা পেশ করেছেন সেখানে এমন কিছু দলীল রয়েছে, যা প্রমাণ করে এই হাদীছটি অহি বন্ধ হওয়ার পরের ঘটনা। প্রথম অহির ঘটনা নয়। যেমন—
(ক)
فَإِذَا المَلَكُ الَّذِي جَاءَنِي بِحِرَاءٍ جَالِسٌ عَلَى كُرْسِيٍّ.
‘আমি তখন সেই ফেরেশতাকে দেখতে পেলাম যাকে আমি হেরা গুহায় দেখেছি’। উক্ত বাক্য প্রমাণ করে মুদ্দাছছির অবতীর্ণ হওয়ার আগেও একবার রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই ফেরেশতাকে হেরা গুহায় দেখেছেন। তথা মুদ্দাছছির প্রথম অবতীর্ণ হওয়া অহি নয়, বরং তার পূর্বে হেরা গুহায় প্রথম অহি অবতীর্ণ হয়েছে আর তা হচ্ছে ইক্বরা।
(খ) ইয়াহইয়া ইবনু আবী কাছীরের এই বর্ণনায় বলা হয়েছে— প্রথম অহি তখন আসে যখন তিনি পাহাড় থেকে নেমে যাওয়ার পরে আওয়াজ শুনতে পান। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে পান না। তারপর তিনি খাদীজার নিকট ফিরে যান। তিনি তার মাথায় পানি ঢেলে দিলে তখন তাঁর কাছে প্রথম অহি মুদ্দাছছির আসে। উক্ত ঘটনাক্রম স্পষ্ট প্রমাণ করে, বর্ণনাকারী এই বর্ণনায় ভুল করেছেন। কেননা প্রথম অহি হেরা পাহাড়ের উপরেই এসেছে। খাদীজার নিকট যাওয়ার আগেই। দ্বিতীয়ত, প্রথম অহির সময় জিবরীল আলাইহিস সালাম তাকে সজোরে চেপে ধরার পর অহি অবতীর্ণ হয়। তিনি জিবরীলকে দেখতে পান। তাঁর সাথে কথা বলেন। অথচ এই হাদীছে জিবরীলকে দেখতে পাওয়ার কোনো বর্ণনা নাই। শুধু আওয়াজ শ্রবণের কথা রয়েছে। শুধু আওয়াজ শ্রবণের মাধ্যমে ফেরেশতাকে না দেখেই প্রথম অহির কল্পনা করা বিবেকপ্রসূত নয়। সুতরাং ইমাম বুখারীর আলোচ্য হাদীছই বেশি বিশুদ্ধ যেখানে আওয়াজ শ্রবণের পর মধ্য গগনে ফেরেশতাকে দ্বিতীয়বারের মতো দেখতে পান এবং তিনি চিনতে পারেন যে, এই সেই ফেরেশতা যিনি হেরা গুহায় তাঁর নিকটে এসেছিলেন।
(গ) আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা বর্ণিত বুখারীর হাদীছে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, ‘ইক্বরা’ অবতীর্ণ হওয়ার আগে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পড়তে জানতেন না। যা প্রমাণ বহন করে যে, ‘ইক্বরা’-ই প্রথম অবতীর্ণ আয়াত।
(ঘ) আর ‘মুদ্দাছছির’-এ মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘আনযির’ তথা মানুষকে সর্তক করুন! তাকে চাদরমুড়ি দেওয়া থেকে উঠে দাওয়াতী কাজ করতে বলেছেন। অথচ তিনি না পড়লে না জানলে কীভাবে মানুষকে সর্তক করবেন। সুতরাং আয়াতের অন্তর্ভুক্ত বাক্যবলিও প্রমাণ করে ‘ইক্বরা’ প্রথম অবতীর্ণ আয়াত। যেখানে মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তাঁর প্রতিপালকের সাথে পরিচিত করা হয়েছে।
(ঙ) সর্বোপরি আবূ সালামা থেকে এই হাদীছ ইয়াহইয়া বর্ণনা করেছেন আর ইমাম বুখারীর পেশ করা হাদীছ যুহরী বর্ণনা করেছেন। আর যুহরী ইয়াহইয়া ইবনু আবী কাছীর থেকে অনেক মযবূত। সুতরাং তাঁর বর্ণনা বেশি প্রাধান্য পাবে।
(চ) আর যদি ইয়াহইয়া ইবনু আবী কাছীরের বর্ণনাকেই বেশি বিশুদ্ধ মেনে নেওয়া হয়, তাহলে আমাদের উত্তর হবে উনি হয়তো প্রথম অবতীর্ণ পূর্ণাঙ্গ সূরার দৃষ্টিকোণ থেকে মুদ্দাছছিরের কথা বলেছেন। ‘আমভাবে প্রথম অবতীর্ণ অহির ক্ষেত্রে নয়। যেমনটি উক্ত হাদীছের অন্য সনদে পাওয়া যায়। যথা—
أي القرآن أنزل أول؟ قال: يا أيها المدثر قال: قلت: فأي آيتين أول سورة نزلت؟ قال: اقرأ باسم ربك الذي خلق.
আবূ সালামা জাবেরকে জিজ্ঞাসা করেন, কুরআনের প্রথম কি অবতীর্ণ হয়েছে? তিনি উত্তরে বললেন, ‘মুদ্দাছছির’। আমি বললাম, কোন আয়াত দুটি প্রথম অবতীর্ণ হয়েছে? তিনি উত্তরে বললেন, ‘ইক্বরা’।[2]
কত দিন অহি আসা বন্ধ ছিলএবং কেন?
উক্ত হাদীছের মূল আলোচ্য বিষয় অহির বিরতি। প্রথম অহির সময় সূরা আলাক্বের পাঁচ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর দীর্ঘদিন অহি আসা বন্ধ থাকে। এই বিরতির সময়কালকে ‘ফাতরাতুল অহি’ বলা হয়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর সাময়িকভাবে অহি স্থগিত হয়েছিল এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নাই। আর বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী দুইবার অহি স্থগিত হয়েছিল। প্রথমবার ‘ইক্বরা’-এর পরে এবং মুদ্দাছছিরের পূর্ব পর্যন্ত। দ্বিতীয়বার মুদ্দাচ্ছির, মুযাম্মিলের মতো কয়েকটি সূরা অবতীর্ণ হওয়ার পর সূরা যুহা অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বপর্যন্ত। তবে এই দুই বারে কত দিন করে অহি আসা স্থগিত ছিল, এই বিষয়ে পবিত্র কুরআন ও হাদীছে স্পষ্ট কোনো নাছ বা বক্তব্য নেই। স্পষ্ট নাছ না থাকার কারণে উলামায়ে কেরামের গবেষণায় বিভিন্ন মতের সৃষ্টি হয়েছে। ইবনু আশূর রহিমাহুল্লাহ বিভিন্ন মত পর্যালোচনার পর যে মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন তা হচ্ছে— প্রথমবার অহি বন্ধ ছিল ৪০ দিন এবং দ্বিতীয়বার অহি বন্ধ ছিল তিন থেকে চার দিন মাত্র।[3]
অহি বিরতির কারণ :
আমরা বাস্তব জীবনে দেখি, যখন কারো সাথে প্রথম প্রথম বন্ধুত্ব হয় তখন অভিমান করে কিছু দিন কথা না বললে সাক্ষাৎ ও কথা বলার আগ্রহ বাড়তে থাকে। বন্ধুত্ব আরো গাঢ় হয়। মহান আল্লাহ প্রথমবার অহি পাঠানোর পর অহি পাঠানো বন্ধ করেন মূলত এই কারণেই। যাতে করে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অন্তরে অহির প্রতি আগ্রহ ও অপেক্ষা বাড়তে থাকে। এই আগ্রহ ও অপেক্ষা এত বেশি হয় যাতে অহি আসা পুনরায় শুরু করলে উনি পূর্ণরূপে অহি ও রিসালাতের দায়িত্ব ও গুরুত্ব সবকিছু ১৬ আনা অনুভব করতে পারেন। আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত।
(চলবে)
আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক
ফাযেল, দারুল উলূম দেওবান্দ, ভারত; এম. এ. (অধ্যয়নরত), উলূমুল হাদীছ বিভাগ,
মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।
[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৬১।
[2]. ইবনুয যুরায়স আল-বাজালী, ফাযায়েলে কুরআন, ১/৩৮।
[3]. আত-তাহরীর ওয়াত তানবীর, ৩০/৩৯৬; ইবনু কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪/৪১।