কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

রসিকতা হোক পরিমিত

মানুষের মনকে সুস্থ রাখার জন্য প্রয়োজন আনন্দময় জীবন। আর আনন্দময় জীবনের জন্য প্রয়োজন হাস্য-রসিকতা। জ্ঞানীরা বলেন, আনন্দ ও চিত্ত-বিনোদন মানুষকে সুখী ও সমৃদ্ধ জীবন গড়তে সহায়তা করে। পার্থিব জীবনকে করে সফল ও স্বার্থক।*

আজকাল মনোবিজ্ঞানীরাও মানুষের সুস্থতার জন্য আনন্দ ও চিত্ত-বিনোদনকে খুব গুরুত্ব দিচ্ছেন। তবে এটা যে কোনো ব্যক্তির সাথে হতে পারে; ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীসহ যে কোনো ব্যক্তির সাথে। একজনের হাস্যোজ্জ্বল বা রসিকতাপূর্ণ চেহারায় অন্য একজনের গাম্ভীর্যপূর্ণ চেহারাও আনন্দময় হয়ে ওঠে। এককথায় একে অপরের সাথে মিলেমিশে থাকার জন্য রসিকতার প্রয়োজনীয়তা অন্যরকম। এ রসিকতা করতে কোনো বাধা নেই। অন্তত স্বভাবধর্ম ইসলাম মানব প্রকৃতির এ প্রবণতায় বাধ সাধে না। তবে হ্যাঁ, ইসলাম যেহেতু ভারসাম্যপূর্ণ ধর্ম এবং সর্বক্ষেত্রে পরিমিতিবোধের চর্চা ও মাত্রাজ্ঞানের তা‘লীম তার অনন্য বৈশিষ্ট্য। তাই এক্ষেত্রেও তার শিক্ষা হলো, রঙ্গ-রসিকতার অনুমোদন আছে ঠিকই, কিন্তু সাবধান! মাত্রা অতিক্রম করা যাবে না। সীমার মধ্যে থেকে সবকিছু করতে হবে। অর্থাৎ রসিকতার অনুমতিও দেওয়া, ক্ষেত্র বিশেষে উৎসাহও প্রদান করা হয়েছে, তবে বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘন থেকে বিরত থাকতে হবে।

রসিকতা যে ইসলামে অনুমোদিত, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ প্রিয় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো কখনো রসিকতা করতেন। হাদীছ গ্রন্থসমূহে এর একাধিক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। যেমন- আনাস ইবনু মালিক রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, একদা এক ব্যক্তি নবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার জন্য একটি বাহনের ব্যবস্থা করুন। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি তোমাকে বাহন হিসেবে উটনীর একটি বাচ্চা দেব। লোকটি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি উটনীর বাচ্চা দিয়ে কী করব? রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আরে উট কী উটের বাচ্ছা ছাড়া অন্য কিছু প্রসাব করে!?[1]

প্রিয় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ জাতীয় রসিকতার ঘটনা আরও আছে। একটা ঘটনা বড় চমৎকার, যা না বললে নয়। সেটি আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যাহির নামক এক গ্রাম্য ছাহাবী গ্রামের বিভিন্ন জিনিস নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হাদিয়া দিতেন। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাকে শহরের বিভিন্ন জিনিস দিয়ে বিদায় করতেন। তিনি বলতেন, যাহির হলো আমাদের গ্রাম আর আমরা তার নগর। তিনি তাঁকে খুবই ভালোবাসতেন। তো একদিনের কথা, যাহির রাযিয়াল্লাহু আনহু বাজারে তার পণ্য বিক্রি করছিলেন। এ অবস্থায় প্রিয় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে উপস্থিত হলেন। তিনি পেছন দিক থেকে প্রিয় ছাহাবীকে জড়িয়ে ধরলেন। যাহির তাঁকে দেখতে পাচ্ছিলেন না। তিনি (বিরক্ত হয়ে) বলে উঠলেন, কে তুমি? আমাকে ছেড়ে দাও। তারপর পেছন ফিরে তাকালেন। দেখলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। প্রিয় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ রসিকতা তাঁর হৃদয়ে ভালোবাসার কত বড় যে ঝড় তুলেছিল, তা সহজেই অনুমিত হয়। সুতরাং সে ঝড়ের কবলে তিনি নিজেকে সঁপে দিলেন। কাল বিলম্ব না করে নিজেকে আরও পেছন দিকে নিয়ে যেতে থাকলেন। এভাবে একদম সেঁটে গেলেন পরম প্রিয়জনের বুকের সাথে। নবীজীও তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখলেন। তারপর রসিকতার মাত্রা যোগ করে বললেন, কে কিনবে? এই গোলামটি বিক্রি করব। যাহির দেখতে সুশ্রী ছিলেন না। বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রাসূল! দাম সস্তা হবে। আমাকে কেউ কিনতে চাইবে না। প্রিয় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (সান্ত্বনা দিয়ে আসল কথাটিই) বলে ফেললেন, কিন্তু আল্লাহর কাছে তুমি সস্তা নও। তাঁর কাছে তোমার দাম অনেক।[2] অন্য এক হাদীছে বর্ণিত আছে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এক বৃদ্ধা এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আল্লাহর কাছে দু‘আ করুন, তিনি যেন আমাকে জান্নাত দান করেন। তখন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (রসিকতা করে) বলেন, ‘হে অমুকের মা! কোনো বৃদ্ধা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এই কথা শুনে বৃদ্ধা কাঁদতে কাঁদতে ফিরে যাচ্ছিলেন। তখন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাহাবীদের বললেন, তাকে গিয়ে বলো, বরং সে যুবতী ও চিরকুমারী হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে।[3]

রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও রসিকতা করতেন, যেমনটা পূর্বে বলা হয়েছে, কিন্তু তার রসিকতায় মিথ্যার কোনো ছোঁয়া থাকত না। একবার তো ছাহাবায়ে কেরাম প্রশ্নই করে বসলেন যে, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি যে আমাদের সাথে রসিকতা করেন অথচ এক হাদীছে আপনি আমাদের এটা করতে নিষেধ করেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তবে আমি (রসিকতাচ্ছলেও মিথ্যা বলি না)। কেবল সত্যই বলি।[4] তাঁর প্রতিটি রসিকতার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, তাঁর প্রতিটি রসিকতাই সত্য নির্ভর; সেখানে মিথ্যার লেশমাত্র নেই। যেমন- একবার তিনি আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বলেছিলেন, ‘ওহে দুই কানওয়ালা’![5]

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, আমাদের সমাজে এমন অনেক ব্যক্তিকে দেখা যায়, যারা এই রসিকতার ছলে বহু মিথ্যা বা কাল্পনিক কথা বলে ফেলে, যা কখনো একজন মুমিনের ক্ষেত্রে শোভা পায় না। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মিথ্যানির্ভর ইচ্ছা বা কৌতুক কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়’।[6] অন্য এক রেওয়ায়েতে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মানুষকে হাসানোর জন্য যে ব্যক্তি মিথ্যা বলে, তার জন্য ধ্বংস, তার জন্য ধ্বংস, তার জন্য ধ্বংস’।[7] অর্থাৎ এই মিথ্যা তাকে পাপের দিকে নিয়ে যায় আর পাপ তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। হাদীছে এসেছে, ‘তোমরা মিথ্যা পরিহার করো। কেননা মিথ্যা পাপের পথে পরিচালিত করে আর পাপ মানুষকে জাহান্নামের পথ দেখায়’।[8]

আবার আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অনেক সময় ছোট শিশুদের সঙ্গেও মজা করতে দেখা যায়। যেমন- আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সঙ্গে অবাধে মিশতেন। এমনকি তিনি আমার ছোট ভাইকে কৌতুক করে বলতেন, ‘হে আবূ উমায়ের! তোমার নোগায়েরের কী হয়েছে? অর্থাৎ তোমার নুগায়ের পাখিটার কী অবস্থা? খেলার পাখিটা মারা গেলে আবূ উমায়ের অনেক কষ্ট পান। তাই রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য পাখিটির অবস্থা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। এভাবে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তার সঙ্গে কথা বলার কারণে তার দুঃখ দূর হয়, সে আনন্দ পায়।[9]

তবে শিশুদের সঙ্গে রসিকতা করতে হলে অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করা কর্তব্য। এমন কোনো রসিকতা করা যাবে না, যার দ্বারা তারা ভুল শিক্ষা পায়। রসিকতা করে শিশুদের ডাকার সময় আমাদের অনেকে বিভিন্ন জিনিস (চকলেট, কলা ইত্যাদি) দেওয়ার অঙ্গীকার করে থাকেন, কিন্তু পরবর্তীতে সেটা তাকে দেওয়া হয় না, যা সুস্পষ্ট ধোঁকার অন্তর্ভুক্ত। এই জাতীয় প্রলোভন ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। প্রথমত ধোঁকার কারণে এতে গুনাহ হয়, দ্বিতীয়ত শিশুটি অনৈতিক শিক্ষা পায়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো শিশুকে (কিছু দেওয়ার জন্য) ডাকল, এদিকে এসো! অতঃপর তাকে তা দিল না, তবে তা মিথ্যা’।[10] তাই হাসি-মস্কারা বা রসিকতা হতে হবে সম্পূর্ণ সত্যনির্ভর এবং ধোঁকামুক্ত।

আবার হাস্যরসাত্মক কিছু বলতে বা লিখতে গিয়ে অনেকে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা জাতির ট্রল করে বসে, যা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। একদিন আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা হাসির ছলে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জনৈক ব্যক্তির চালচলন নকল করে দেখালেন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাতে বিরক্তি প্রকাশ করেন।[11] এর দ্বারা বুঝা যায়, রসিকতার অনুমোদন ইসলাম দিয়েছে, তবে অবশ্যই তা যেন নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে থাকে; কোন অবস্থাতেই এমনটি যেন না হয়, যাতে করে সেখানে মিথ্যার মিশ্রণ ঘাটে অথবা কোন ব্যক্তি বা বিশেষ কোন গোষ্ঠী কষ্ট পায়।

মোটকথা, রসিকতাকে অবশ্যই সব ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া মুক্ত হতে হবে। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে শব্দচয়ন, বিষয়বস্তু নির্ধারণ এবং উপস্থাপনা শালীন ও মার্জিত হতে হবে। স্বার্থক ও কল্যাণকর রসিকতা চর্চার জন্য সতর্কতা ও সচেতনতার বিকল্প কোনো কিছু নেই।

মনে রাখতে হবে, রসিকতার ক্ষেত্রে পরিমিতিবোধের প্রতি তীক্ষ্ন দৃষ্টি রাখতে পারা ব্যক্তির ভদ্রতা ও সৌজন্যবোধ এবং উন্নত রুচিশীলতার পরিচায়ক। অন্যথা এরকম ইসলাম অনুমোদিত সুন্দর একটি বিনোদন ব্যবস্থা যেকোন মানুষের জন্য জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হয়ে যেতে পারে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সঠিকভাবে বুঝার ও আমল করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

উছমান ইবনে আব্দুল আলীম

মুহাদ্দিছ, দারুল উলূম মোহাম্মদপুর কওমি মাদ্রাসা, চাটমোহর, পাবনা।


[1]. সুনানে আবূ দাঊদ, হা/৪৯৯৮, আলবানী হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন।

[2]. শামায়েলে তিরমিযী, হা/২৩০, হাদীছটি ছহীহ।

[3]. শামায়েলে তিরমিযী, হা/২৪১, হাদীছটি হাসান।

[4]. জামে‘ তিরমিযী, হা/১৯৯০, আলবানী হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন।

[5]. শামায়েলে তিরমিযী, হা/২৩৫, হাদীছটি ছহীহ।

[6]. সুনানে ইবনু মাজাহ, হা/৪৬, হাদীছটি ছহীহ।

[7]. আবূ দাঊদ, হা/৪৯৯০, আলবানী হাদীছটিকে হাসান বলেছেন।

[8]. সুনানে তিরমিযী, হা/১৯৭১, আলবানী হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন।

[9]. ছহীহ মুসলিম, হা/২১৫০; শামায়েলে তিরমিযী, হা/২২৮।

[10]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৯৮৩৬।

[11]. তিরমিযী, হা/২৫০২, আলবানী হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন।

Magazine