কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

অমনোযোগী পুত্রের প্রতি পিতার হৃদয় নিংড়ানো উপদেশ (পর্ব-২)

উপদেশ-৬ : আলস্য ঝেড়ে জেগে ওঠো

বাবা! অতীত অলসতার হীনমন্যতা যেন তোমাকে কল্যাণ থেকে নিরাশ না করে। কেননা, অনেক মানুষই আলস্যের দীর্ঘ ঘুম শেষে নতুনভাবে জেগে উঠেছে।

শায়খ আবূ হাকিম রহিমাহুল্লাহ বলেন, শৈশবে আমি বিদ্যার্জনের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে দুরন্তপনায় ব্যস্ত ছিলাম। আমার পিতা আবূ আব্দুল্লাহ রহিমাহুল্লাহ আমাকে ডেকে বললেন, বাবা! আমি তো তোমার জন্য চিরকাল বেঁচে থাকব না। সুতরাং এই নাও ২০ দীনার, তা দিয়ে একটি রুটির দোকান খুলে উপার্জনের পথ করো। শুনে আমি বললাম, এ কেমন কথা? তিনি বললেন, তাহলে একটি পোশাকের দোকান দাও। আমি বললাম, আমি প্রধান বিচারপতি আবূ আব্দুল্লাহ আদ-দামেগানীর ছেলে, তাহলে কীভাবে আপনি আমাকে এ কথা বলছেন? তিনি বললেন, আমি তো তোমাকে পড়াশুনা করতে দেখছি না। আমি বললাম, কিছু সময় আপনি আমাকে পাঠদান করুন। অতঃপর তিনি আমাকে কিছুক্ষণ পাঠদান করলেন। এরপর থেকে আমি জ্ঞান অন্বেষণে কঠোর মনোনিবেশ করি। ফলে আল্লাহ তাআলা আমার জ্ঞানের চক্ষু খুলে দেন।

আবূ মুহাম্মদ আল-হিলওয়ানী রহিমাহুল্লাহ-এর একজন শাগরেদ আমার কাছে বলেছেন, ‘২১ বছর বয়সে আমার পিতা মারা যান। তখন আমি দুরন্তপনায় উস্তাদ ছিলাম। একদা আমি আমার ওয়ারিছ সূত্রে পাওয়া বাড়ির বিষয়ে সমাধা করতে আসলাম। তখন তাদেরকে বলতে শুনলাম, আরে! আরে! বেখেয়ালী এসেছে! একথা শুনে আমি নিজেকে বললাম, আমার ব্যাপারে একথা বলা হচ্ছে? তখন আমি আমার মায়ের কাছে এসে বললাম, আমাকে খোঁজার প্রয়োজন হলে শায়খ আবূল খাত্ত্বাবের মজলিসে খোঁজ করবেন। এরপর আমি সর্বদা শায়খের কাছে থাকতে শুরু করলাম। প্রস্রাব-পায়খানার প্রয়োজন ছাড়া কখনও বের হতাম না। একসময় আমি বিচারক হয়ে গেলাম।

লেখক বলেন, ‘আমি তাকে দেখেছি তিনি ফতওয়া দিতেন এবং বাহাছ-মুনাযারা (ডিবেট) করতেন।

উপদেশ-৭ : জীবন গঠনের প্রাত্যহিক রুটিন

হে বৎস! সর্বদা ফজরের সময় ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়াকে নিজের জন্য আবশ্যক করে নাও এবং এই সময়ে দুনিয়াবী বিষয় নিয়ে কোনো কথা বলবে না। কেননা, সালাফে ছালেহীন এই সময়ে দুনিয়াবী বিষয়ে কোনো কথা বলতেন না।

(ক) ঘুম থেকে উঠার সময় এই দু‘আ বলো—

اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِيْ أَحْيَانِيْ بَعْدَ مَا أَمَاتَنِيْ وَإِلَيْهِ النُّشُوْرُ.

‘সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। যিনি আমাকে মৃত্যু দেওয়ার পর জীবন দিয়েছেন এবং তাঁরই কাছে পুনরুত্থিত হতে হবে’।[1]

 اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِيْ يُمْسِكُ السَّمَاءَ أَنْ تَقَعَ عَلَى الْأَرْضِ إِلَّا بِإِذْنِهِ إِنَّ اللهَ بِالنَّاسِ لَرَءُوْفٌ رَحِيْمٌ.

‘সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। যিনি আসমান স্থির রাখেন যাতে তা তাঁর হুকুম ছাড়া জমিনে পতিত না হয়। নিশ্চয়ই আল্লাহ মানুষের প্রতি করুণাময় ও অতিদয়ালু’ (আল-হজ্জ, ২২/৬৫)

(খ) তারপর পবিত্রতা অর্জন করে ফজরের সুন্নাত আদায় করো এবং অবনত মস্তকে মসজিদের দিকে যাও। আর চলতে চলতে এই দু‘আ পড়ো—

اَللهم إِنِّيْ أَسْأَلُكَ بِحَقِّ السَّائِلِيْنَ عَلَيْكَ وَبِحَقِّ مَمْشَايَ هٰذَا إِنِّيْ لَمْ أَخْرُجْ أَشَرًا وَلَابَطَرًا وَلَا رِيَاءً وَلَا سُمْعَةً خَرَجْتُ اتِّقَاءَ سَخَطِكَ وَابْتِغَاءَ مَرْضَاتِكَ وَأَسْأَلُكَ أَنْ تُجِيْرَنِيْ مِنَ النَّارِ وَأَنْ تَغْفِرَلِيْ ذُنُوْبِيْ، إِنَّهُ لَايَغْفِرُ الذُّنُوْبَ إِلَّا أَنْتَ.

‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে দু‘আ করছি যাচ্ঞাকারীদের অধিকারের অসীলায়[2], আমার এই পদচারণার অসীলায়, নিশ্চয়ই আমি দাম্ভিকতা-অহংকার, লৌকিকতা প্রদর্শন ও সুনাম অর্জনের জন্য বের হইনি। আমি বের হয়েছি আপনার ক্রোধ থেকে বাঁচার জন্য এবং আপনার সন্তুষ্টির সন্ধানে। আমি আপনার কাছে দু‘আ করছি, আপনি আমাকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করুন এবং আমার গুনাহগুলো ক্ষমা করুন। নিশ্চয়ই আপনি ছাড়া কেউ গুনাহসমূহ ক্ষমা করতে পারে না’।[3]

(গ) ইমামের ডান পাশে ছালাত আদায়ের প্রত্যয় গ্রহণ করো। ছালাত শেষ হলে তুমি এই দু‘আ পাঠ করো—

لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَاشَرِيْكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ يُحْيِيْ وَيُمِيْتُ بِيَدِهِ الْخَيْرُ وَهُوَ عَلىٰ كُلِّ شَيْئٍ قَدِيْرٌ .

‘আল্লাহ ছাড়া কোনো প্রকৃত উপাস্য নেই। তিনি এক, তাঁর কোনো অংশীদার নেই। রাজত্ব তাঁরই। সকল প্রশংসা তাঁরই। তিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যু দান করেন। তাঁরই হাতে সকল কল্যাণ রয়েছে। তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান’।[4] উক্ত দু‘আটি ১০ বার পড়বে।

(ঘ) অতঃপর বলো, سُبْحَانَ الله‘আমি আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করছি’ (১০ বার), اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য’ (১০ বার) এবং اَللهُ أَكْبَرُ ‘আল্লাহ মহান’ (১০ বার)।[5]

(ঙ) অতঃপর আয়াতুল কুরসী পাঠ করো।[6]

(চ) আল্লাহ সুবহানাহু তাআলার কাছে ছালাত কবুলের জন্য দু‘আ করো।

(ছ) এগুলো সঠিকভাবে আদায় করার পর সূর্য উদিত হয়ে কিরণ ছড়ানো পর্যন্ত বসে বসে আল্লাহর যিকির করো।

(জ) অতঃপর সাধ্যমতো ছালাত আদায় করো। সেটা আট রাকআত হলে ভালো হয়।

উপদেশ-৮ : সকল নফল আমল অপেক্ষা জ্ঞানার্জন উত্তম

(ক) যখন চাশতের (পূর্বাহ্নের) সময় তোমার পড়া পুনঃপাঠ করবে তখন চাশতের আট রাকআত ছালাত আদায় করে নিয়ো। অতঃপর আছর পর্যন্ত কিতাব অধ্যয়নে অথবা গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নোট করায় মনোনিবেশ করো। আছরের পর থেকে মাগরিব পর্যন্ত পড়ায় ফিরে যাও। মাগরিবের ফরয ছালাতের পর পৃথক দুই পারা তেলাওয়াতের মাধ্যমে দুই রাকআত ছালাত আদায় করো। এশার ছালাত আদায়ান্তে পাঠে ফিরে যাও। তারপর ডান কাতে শয়ন করে سُبْحَانَ اللهِ পড়বে ৩৩ বার, اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ পড়বে ৩৩ বার, اَللهُ أَكْبَرُ পড়বে ৩৪ বার।[7] অতঃপর এই দু‘আটি পাঠ করবে, اللهم قِنِيْ عَذَابَكَ يَوْمَ تَجْمَعُ عِبَادَكَ ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাকে আপনার সেই দিনের শাস্তি হতে রক্ষা করুন, যে দিন আপনি আপনার সকল বান্দাকে একত্রিত করবেন’।[8]

(খ) ঘুম থেকে চোখ খুললে তুমি বুঝবে যে, আত্মার যতটুকু ঘুমের প্রয়োজন তা মিটে গেছে। অতএব, ওযূ করে রাত্রের অন্ধকারে যতটুকু পার ছালাত আদায় করো। প্রথমে হালকা করে দুই রাকআত ‍দিয়ে শুরু করো। অতঃপর কুরআনের দুই পারা দিয়ে দুই রাকআত ছালাত আদায় করো। তারপর তোমার পড়ায় ফিরে যাও। কেননা, জ্ঞান অর্জন করা সকল নফল আমলের চেয়ে উত্তম।

উপদেশ-৯ : বিপদ ও প্রতিবন্ধকতা থেকে দূরে থাকো

নিঃসঙ্গতা অবলম্বন করো। কেননা, নিঃসঙ্গতাই সকল কল্যাণের মূল। খারাপ সঙ্গী থেকে দূরে থাকো। বইকে তোমার নিত্যদিনের সঙ্গী হিসাবে গ্রহণ করো। সালাফে ছালেহীনের জীবনী নিয়ে গবেষণা করো। কোনো বিষয়ে মৌলিক জ্ঞান না অর্জন করা পর্যন্ত তা নিয়ে গভীর গবেষণায় মগ্ন হয়ো না। ইলম ও আমলের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের জীবনী অধ্যয়ন করো। জ্ঞানের ক্ষেত্রে সামান্যে তুষ্ট হয়ো না। কবি বলেন (গদ্যানুবাদ), পূর্ণতায় পৌঁছতে সক্ষম ব্যক্তিদের অপূর্ণতার মতো আর কোনো দোষ মানুষের মাঝে দেখিনি।

জেনে রাখো বৎস! বিদ্যা নিম্নশ্রেণির মানুষকে উপরে উঠিয়ে দিতে পারে। অনেক বিদ্বান এমন ছিলেন যাদের না ছিল উল্লেখযোগ্য কোনো বংশ পরিচয়, আর না ছিল বর্ণনা করার মতো চেহারার সৌন্দর্য। তাদের অন্যতম ছিলেন আত্বা ইবনু আবী রবাহ। তিনি দেখতে ছিলেন কালো বর্ণের, শারীরিক গঠন ছিল অপছন্দনীয়। একদা হজ্জের মাসআলা জিজ্ঞেস করার জন্য খলীফা সুলাইমান ইবনু আব্দুল মালিক দুই পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে তার কাছে এসে তার কাছে বসলেন। তখন ইমাম আত্বা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে তাদের কাছে হজ্জের মাসআলাগুলো বর্ণনা করছিলেন। খলীফা এ অবস্থা দেখে তার পুত্রদ্বয়কে বললেন, ‘তোমরা যাও, জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার গাফলতি করো না। এই কালো লোকটির সামনে আমাদের (জ্ঞানের) দীনতার কথা কোনোদিন ভুলব না।

তিনি ছাড়াও হাসান বাছরী, ইবনু সীরীন, মাকহূলসহ আরো অনেক জগদ্বিখ্যাত বিদ্বানগণ ছিলেন দাস। ইলম ও তাক্বওয়ার গুণেই তারা মর্যাদার স্বর্ণশিখরে আরোহন করেছিলেন।

উপদেশ-১০ : অল্পে তুষ্ট হও, সম্মানিত হবে

হে বৎস! দুনিয়ার পেছনে ছুটা কিংবা দুনিয়াদারদের কাছে হাত পাতা থেকে নিজের মান-সম্মান রক্ষার ব্যাপারে সচেষ্ট হও। অল্পে তুষ্ট হও, সম্মানিত হবে। বলা হয়, ‘যে ব্যক্তি রুটি-সবজিতে তুষ্ট হয়, তাকে কেউ গোলাম বানাতে পারে না’।

জনৈক বেদুঈন বাছরা অতিক্রমকালে বাছরাবাসীকে জিজ্ঞেস করলেন, এই গ্রামের সর্দার কে? তাকে বলা হলো, ‘হাসান আল-বাছরী’। সে বলল, কোন গুণের কারণে তিনি তাদের নেতৃত্ব দেন? তারা বলল, তিনি দুনিয়াদারদের দুনিয়া থেকে অমুখাপেক্ষী, আর দুনিয়াবাসী তার জ্ঞানের মুখাপেক্ষী।

শুনে রাখো বাবা! আমার পিতা ছিলেন বড় সম্পদশালী। তিনি রেখে গিয়েছিলেন অঢেল সম্পদ। আমি যখন যৌবনে পদার্পণ করলাম তখন আমার অভিভাবকগণ[9] আমাকে ২০ দীনার ও দুটি ঘর প্রদান করে বলেছিলেন, এগুলো তোমার পিতার রেখে যাওয়া সম্পদ। আমি দীনারগুলো নিয়ে তা দিয়ে কিতাবাদি ক্রয় করেছিলাম এবং ঘর দুটি বিক্রি করে এর মূল্য ইলম অর্জনের পথে খরচ করেছিলাম। আমার কাছে কোনো সম্পদ অবশিষ্ট ছিল না। কিন্তু অর্থকড়ি না থাকলেও তোমার পিতা কোনোদিন ইলম অর্জনের পথে অপমানিত হয়নি। আবার অন্যান্য বক্তার মতো দেশে দেশে ঘুরেও বেড়ায়নি। অথবা কারো কাছে কিছু চেয়ে কোনোদিন চিরকুটও লিখে পাঠায়নি। তারপরও তার সবকিছু ঠিকমতো চলছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তাআলা তার উপায় বের করে দেন এবং এমন জায়গা থেকে রিযিক্বের ব্যবস্থা করে দেন, যার কল্পনা সে করত না’ (আত-তালাক, ৬৫/২-৩)

উপদেশ-১১ : তাক্বওয়া যথাযথ হলে সকল কল্যাণ তোমার হাতে ধরা দিবে

প্রিয় বৎস! যখন তোমার মাঝে যথাযথ তাক্বওয়া তৈরি হবে তখন সকল কল্যাণ তোমার হাতে এসে ধরা দিবে। একজন তাক্বওয়াবান ব্যক্তি লোক দেখানোর জন্য কোনো কিছু করে না এবং দ্বীনের ক্ষতি হয় এমন বিষয়ের মুখোমুখিও হয় না। যে ব্যক্তি আল্লাহর হালাল-হারামের সীমারেখা মেনে চলবে, আল্লাহ তাকে হেফাযত করবেন। আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহু-কে বলেন, ‘তুমি আল্লাহকে স্মরণ রাখো, তিনিও তোমাকে হেফাযত করবেন। আল্লাহকে স্মরণ রাখো, তাহলে তাকে তোমার সামনে পাবে’।[10]

কলিজার টুকরা! জেনে রাখো, ইউনুস আলাইহিস সালাম-এর সৎকর্মের ভাণ্ডার থাকায় তার মাধ্যমে তিনি কঠিন বিপদ থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সে যদি তাসবীহ পাঠ না করত, তাহলে ক্বিয়ামত পর্যন্ত সে মাছের পেটেই থেকে যেত’ (আছ-ছাফফাত, ৩৭/১৪৩-১৪৪)। অন্যদিকে ফেরাউনের সৎকর্ম না থাকায় সংকটকালে বিপদ থেকে রক্ষা পায়নি; বরং তাকে বলা হয়েছিল, ‘এখন ঈমান আনছো? অথচ ইতোপূর্বে তুমি নাফরমানী করেছিলে’ (ইউনুস, ১০/৯১)। সুতরাং তাক্বওয়াকে তোমার সৎকর্মের ভাণ্ডার বানাও, জীবনের বাঁকে বাঁকে তুমি এর প্রভাব অনুভব করতে পারবে। হাদীছে এসেছে, ‘কোনো যুবক যদি যৌবনে আল্লাহকে ভয় করে, তাহলে বার্ধক্যে আল্লাহ মর্যাদা বাড়িয়ে দিবেন’।[11]

মহান আল্লাহ বলেন, ‘যখন সে যৌবনে উপনীত হলো, তখন আমি তাকে প্রজ্ঞা এবং জ্ঞান দান করলাম। আর এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি’ (ইউসুফ, ১২/২২)। তিনি আরও বলেন, ‘নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে এবং ধৈর্যধারণ করে তার জেনে রাখা উচিত, আল্লাহ সৎকর্মশীলদের প্রতিদান বিনষ্ট করবেন না’ (ইউসুফ, ১২/৯০)

জেনে রাখো বৎস, সবচেয়ে বড় সৎকর্ম হচ্ছে হারাম (বেগানা নারী) জিনিস থেকে দৃষ্টি নিচু রাখা, অতিরিক্ত কথা হতে জিহ্বাকে সংযত রাখা, হালাল-হারামের সীমারেখার ব্যাপারে সতর্ক থাকা এবং প্রবৃত্তির উপর আল্লাহকে প্রাধান্য দেওয়া। তুমি তো ঐ তিন ব্যক্তির ঘটনা জানো, যারা গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল। অতঃপর একটি পাথর পড়ে তাদের ‍গুহার মুখ বন্ধ করে দিয়েছিল। তখন তাদের একজন বলেছিল, হে আল্লাহ! আমার পিতা-মাতা এবং সন্তানাদি ছিল। আমি আমার সন্তানদের পূর্বে তাদেরকে দুধ পান করানোর জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম। এ কাজ যদি আমি তোমার সন্তুষ্টির জন্য করে থাকি, তাহলে পাথরখণ্ডটি গুহার মুখ থেকে দূর করে দাও। অতঃপর পাথরটির এক-তৃতীয়াংশ সরে গেল। দ্বিতীয়জন বলেছিল, হে আল্লাহ! আমি একজন শ্রমিক রেখেছিলাম। সে তার পারিশ্রমিকে সন্তুষ্ট না হয়ে চলে গিয়েছিল। অতঃপর আমি তার পারিশ্রমিক দিয়ে ব্যবসা করেছিলাম। একদিন এসে সে আমাকে বলল, আপনি কি আল্লাহকে ভয় করেন না? আপনি কি আমার পারিশ্রমিক দিবেন না? আমি বলেছিলাম, ঐ যে দেখ গরুর পাল ও রাখালেরা, ঐ সবগুলো তোমার, তুমি নিয়ে যাও। এ কাজ যদি আমি তোমার সন্তুষ্টির জন্য করে থাকি, তাহলে পাথরখণ্ডটি গুহার মুখ থেকে দূর করে দাও। অতঃপর পাথরের দুই-তৃতীয়াংশ সরে গেল। তৃতীয়জন বলেছিল, হে আল্লাহ! আমি আমার এক চাচাতো বোনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। তার সাথে যেনার কাজ করার জন্য তার কাছাকাছি হলে সে আমাকে বলেছিল, আল্লাহকে ভয় করো, অন্যায়ভাবে আমার মোহর খুলে ফেলো না (আমার সতীত্ব নষ্ট করো না)। এ কথা শুনে আমি তার থেকে উঠে চলে আসি। এ কাজ যদি আমি তোমার সন্তুষ্টির জন্য করে থাকি, তাহলে পাথরখণ্ডটি গুহার মুখ থেকে সরিয়ে দাও। তারপর পাথরটি গুহার মুখ থেকে পরিপূর্ণ সরে গেল। তখন তারা বের হয়ে আসে।[12]

সুফিয়ান ছাওরী রহিমাহুল্লাহ-কে স্বপ্নযোগে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনার প্রতিপালক আপনার সাথে কীরূপ আচরণ করেছেন? তিনি বললেন, আমাকে কবরস্থ করার সঙ্গে সঙ্গে আমি নিজেকে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সামনে দেখতে পেলাম। তারপর আমি ভিতরে প্রবেশ করলাম। তখন একজনকে বলতে শুনলাম, আপনিই কি সুফিয়ান? আমি বললাম, হ্যাঁ। আমিই সুফিয়ান। সে বলল, আপনার কি ঐ দিনের কথা মনে পড়ে যেদিন আপনি নিজ প্রবৃত্তির উপরে আল্লাহকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন? আমি বললাম, হ্যাঁ। তখন আমাকে জান্নাতের ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হলো।

(চলবে)

মূল : আবুল ফারজ ইবনুল জাওযী রহিমাহুল্লাহ

অনুবাদ : আব্দুল কাদের বিন রইসুদ্দীন

 শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।


[1]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩৩৩৪, হাদীছ ছহীহ।

[2]. এটি বৈধ অসীলা নয়।

[3]. ইবনু মাজাহ, হা/৭৭৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/১১১৭২; হাদীছটি যঈফ।

[4]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮০১৯।

[5]. আবূ দাঊদ, হা/৫০৬৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/৬৯১০।

[6]. আত-তারগীব, হা/১৫৯৫; মিশকাত, হা/৯৭৪।

[7]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৭০৫; ছহীহ মুসলিম, হা/২৭২৭।

[8]. তিরমিযী, হা/৩৩৯৮, হাদীছ ছহীহ; আবূ দাঊদ, হা/৫০৪৫।

[9]. পিতার মৃত্যুর পর অন্যরা আমার দেখভাল করত।

[10]. মুসনাদে আহমাদ, ১/২৯৩; তিরমিযী, হা/২৫১৬।

[11]. ছয়দুল খাত্বির, পৃ. ৫২৮; হিলয়্যাতুল আওলিয়া, ৪/১৩৯।

[12]. ছহীহ বুখারী, হা/২২৭২; ছহীহ মুসলিম, হা/২৭৪৩।

Magazine