রাত শেষে ফিরে আসা ভোরের মতো প্রতীক্ষার প্রহর শেষে ফিরে এলো মাহে রামাযান। সর্বত্র বিরাজ করছে অন্যরকম ভালোলাগা। মুমিন হৃদয়ে বইতে শুরু করেছে বসন্তের হাওয়া। কারণ রামাযান মানে— ১১ মাসের অবাধ্যতার ইতিহাস মুছে ফেলে শুদ্ধতার পথে নতুন উদ্যমে চলতে শেখা। রামাযান মানে কালো থেকে ভালোর দিকে প্রত্যাবর্তন। রামাযান মানে আল-গাফফারের রহমে সিক্ত হওয়ার আরেকটি সুযোগ। নাজাতের সুগম পথ ও গুনাহ মাফের মোক্ষম সময় এই রামাযান মাস। এ মাসের আগমনে খুলে যাবে আসমানের বন্ধ দুয়ার। উন্মুক্ত হবে দয়াময়ের রহমের দরজা। খুলে দেওয়া হবে জান্নাতের কপাটসমূহ। মাসব্যাপী বন্ধ থাকবে জাহান্নামের দ্বার। শিকলে বন্দি থাকবে বিতাড়িত শয়তান। প্রিয় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অমিয় বাণী জানান দেয়— ‘যখন রামাযানের প্রথম রজনি আগমন করে, তখন শয়তান ও অবাধ্য জিনগুলোকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। জাহান্নামের দুয়ারসমূহ বন্ধ করা হয়, ফলে কোনো দরজাই আর খোলা থাকে না। আর জান্নাতের দুয়ারগুলো খুলে দেওয়া হয়, ফলে কোনো দরজাই আর বন্ধ থাকে না। আর একজন ঘোষক ঘোষণা দিতে থাকে, হে কল্যাণকামী! তুমি অগ্রসর হও। হে অকল্যাণকামী! ক্ষান্ত দাও। আল্লাহ তাআলা এই মাসে বহু জাহান্নামীকে মুক্তি দেন। আর এটা প্রত্যেক রাতেই হয়ে থাকে’।[1]
তাছাড়া এই মহিমান্বিত মাসেই রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছিল মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় আল-কুরআনের শাশ্বত বাণী। হেরা থেকে বিচ্ছুরিত হয়ে যার দ্যুতি ছড়িয়েছে তামাম দুনিয়ার মুমিন অন্তরে। আল্লাহ তাআলা বলেন,شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ ‘রামাযান মাস, এতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের পথনির্দেশক এবং সত্যাসত্যের পার্থক্য ও হেদায়াতের সুস্পষ্ট প্রমাণরূপে’ (আল-বাক্বারা, ২/১৮৫)।
শা‘বানের শেষ চাঁদ অস্তাচলে পা বাড়ালে সবার মাঝে পরিলক্ষিত হয় টানটান প্রস্তুতি। নতুন চাঁদ দেখার নিমিত্তে পাড়াগাঁয়ের শিশু-কিশোরদের মাঝেও তৈরি হয় উৎসবমুখর পরিবেশ।
প্রিয় পাঠক! তাক্বওয়ার মহিমায় উদ্ভাসিত হতে এবারের রামাযানকে ঘিরে আপনিও তৈরি করুন বিশেষ পরিকল্পনা।
রামাযানের সাধনা:
(১) ছিয়াম: ছুবহে ছাদিক্ব থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত একজন ব্যক্তির আল্লাহ তাআলার ভয়ে পানাহার, যৌনসম্ভোগ ও জাগতিক যাবতীয় পাপাচার থেকে বিরত থাকার মাঝেই ফুটে ওঠে তাক্বওয়ার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ছিয়াম ইসলামের অন্যতম রুকন বা স্তম্ভ এবং প্রতিপালকের সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। রামাযানের ছিয়ামকে মুসলিমদের জন্য আবশ্যক করে রব্বুল আলামীন বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য ছিয়াম ফরয করে দেওয়া হলো, যেমনভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরয করে দেওয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা তাক্বওয়ার অধিকারী হতে পার’ (আল-বাক্বারা, ২/১৮৩)। অধিকন্তু রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ‘যে ব্যক্তি ঈমানসহ পুণ্যের আশায় রামাযানের ছিয়াম পালন করে, তার পূর্বের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়’।[2]
সুতরাং মহান রবের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সর্বাগ্রে ছিয়াম সাধনায় ব্রতী হোন।
(২) শুধু তাঁরই ইবাদত করা: আল্লাহর একত্ব প্রতিষ্ঠায় অবিচল থাকুন। তাতে শিরকের আঁচড় লাগাবেন না। এক আল্লাহর জন্য নিবেদিত হোন। ইবাদতের কোনো অংশ যাতে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উদ্দেশ্যে না হয়, এ ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখুন। খ্যাতির লোভ ও লৌকিকতা পরিহার করে তাঁর নির্দেশিত পন্থায় ইবাদতের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য অর্জন করুন। কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেন,فَاعْبُدِ اللَّهَ مُخْلِصًا لَهُ الدِّينَ ‘কাজেই আল্লাহর ইবাদাত করুন তাঁর আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে’ (আয-যুমার, ৩৯/২)।
(৩) কুরআনের সাথে সখ্যতা: কুরআন তেলাওয়াতের প্রতি যত্নবান হোন। কুরআনের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলুন। যেহেতু এ মাসে নাযিল হয়েছে আল কুরআন। আর নবী মুছত্বফা ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, اقْرَءُوا الْقُرْآنَ فَإِنَّهُ يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ شَفِيعًا لأَصْحَابِهِ ‘তোমরা কুরআন পাঠ করো। কারণ এটি ক্বিয়ামতের দিন তার পাঠকারীর জন্য শাফাআতকারী হিসেবে আসবে’।[3]
(৪) ত্যাগের মহিমা: ক্ষুধার পর খাবার অত্যন্ত সুস্বাদু হয়। পিপাসার পর পানির মিষ্টতা অনুভূত হয়। প্রশান্তির ঘুম হয় পরিশ্রমের পর। আর প্রকৃত সফলতা অর্জিত হয় ত্যাগের বিনিময়ে। ত্যাগের জন্যই রামাযান। তাই সবসময় অন্যকে প্রাধান্য দিন। সবকিছু নিজের জন্য সাব্যস্ত করবেন না। আপনার ধনসম্পদ, খাবার-দাবার সর্বত্র আল্লাহর রাহে মানুষের জন্য বিলিয়ে দিন। ইফতার করান ছওম পালনকারীকে; সে ধনী হোক বা দরিদ্র। পারস্পরিক সম্প্রীতি, সহানুভূতি ও বন্ধুত্ব সৃষ্টি করুন। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, مَنْ فَطَّرَ صَائِمًا كَانَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِهِ ‘যে ব্যক্তি কোনো ছিয়াম পালনকারীকে ইফতার করায়, তার জন্যও ছিয়াম পালনকারীর সমপরিমাণ ছওয়াব রয়েছে’।[4]
(৫) ছাদাক্বা: রামাযান উপলক্ষ্যে আপনার দানের হাত প্রশস্ত করুন। সময়ের মর্যাদা গুণে রামাযান মাসে দানের অনন্য মহত্ত্ব ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এজন্য এই মাসে আল্লাহর হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবচেয়ে বেশি দান করতেন।
(৬) মুচকি হাসি: জাদুকরী মুচকি হাসি ভালোবাসার বায়না- সখ্যতার আগাম পত্র। মুসলিম ভাইয়ের সাথে মৃদু হেসে কথা বলার অভ্যাস করুন। দ্বিধাবোধ করবেন না। কারণ, হাদীছে এসেছে, تَبَسُّمُكَ فِي وَجْهِ أَخِيكَ لَكَ صَدَقَةٌ ‘তোমার হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে তোমার ভাইয়ের সামনে উপস্থিত হওয়া তোমার জন্য ছাদাক্বাস্বরূপ’।[5] তবে এই হাসি হওয়া চাই মন থেকে। হওয়া চাই স্বচ্ছ ও পবিত্র।
(৭) সুসম্পর্কের সাঁকো: আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখুন। যারা সম্পর্ক ছিন্ন করে, তাদের সাথে হৃদ্যতা গড়ুন। সুসম্পর্কের সাঁকোটা দীর্ঘ করুন। মজবুত করুন পারস্পরিক বন্ধুত্বের বন্ধন। সতর্ক থাকুন যাতে আপনার দ্বারা অন্য কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَاطِعٌ ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না’।[6]
(৮) ক্ষমার মাহাত্ম্য: মানুষের প্রতি উদার হোন। যারা আপনাকে কষ্ট দেয়, আপনার অকল্যাণ চায়, এই রামাযানে চোখ বন্ধ করে তাদেরকে ক্ষমা করে দিন। তাদের ভুলভ্রান্তিগুলো দাফন করে দিন। তাদের দেওয়া কষ্টগুলো ভুলে যান। মানুষকে ক্ষমা করুন দয়াময়ের ক্ষমার অধিকারী হবেন।
(৯) অবসর: অবসরের কাছে হেরে যাবেন না। নেক আমলে পূর্ণ করুন আপনার অবসর সময়। অযথা আড্ডাবাজি, গীবত, পরচর্চায় না জড়িয়ে বই পড়ুন। আল্লাহর যিকিরে আর্দ্র রাখুন জিহ্বা। তাসবীহ-তাহলীলে কাটুক আপনার প্রতিটি সময়। ছোট ছোট আমলগুলোকে গুরুত্ব দিন। নফল আমলে এগিয়ে যান আরও একধাপ। সারাক্ষণ আপনার জবানে উচ্চারিত হোক সুবাহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি...।
(১০) ক্বিয়ামুল লায়ল: নিঝুম রজনিতে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে সমস্ত বিশ্ব চরাচর। নিঃশব্দের ঢেউ খেলে যায় প্রকৃতির বুকে। নীরবতার ছায়া নেমে আসে পৃথিবীর আঙিনায়। এই সুযোগটাকেই কাজে লাগাতেন বিশ্বনবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আলাপ জুড়তেন রবের সাথে। দাঁড়াতেন রাতের মুছল্লায়। দীর্ঘক্ষণ ক্বিয়ামের ফলে পা দুটো ফুলে যেত। তিনি বলেন, وَأَفْضَلُ الصَّلاَةِ بَعْدَ الْفَرِيضَةِ صَلاَةُ اللَّيْلِ ‘ফরয ছালাতের পর সর্বোত্তম ছালাত হচ্ছে রাতের ছালাত’।[7]
তিনি রামাযানের ব্যাপারে বলেছেন আরও একটি চমৎকার কথা, مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ‘যে ব্যক্তি রামাযানের রাতে ঈমানসহ পুণ্যের আশায় রাত জেগে ইবাদত করে, তার পূর্বের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়’।[8]
তাই আপনিও শামিল হোন রাতের ছালাতে। আবেগে-অনুরাগে সিক্ত করুন আঁখিদ্বয়।
নিষিদ্ধ সীমারেখা: বাড়াব না পা
পবিত্র রামাযানের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার্থে একজন মুমিনের আল-কুরআন ও ছহীহ সুন্নায় বর্ণিত সকল গর্হিত কর্মকাণ্ড ও আচার-আচরণ থেকে বিরত থাকা একান্ত প্রয়োজন। সুতরাং-
(১) এই মহিমান্বিত মাসে কোনো প্রকার পাপ-পঙ্কিলতার পথে ধাবিত হবেন না।
(২) আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবেন না।
(৩) হাত, পা, মুখ ও অন্তরকে পঙ্কিলতা মুক্ত রাখতে সচেষ্ট হোন।
(৪) পরনিন্দা ও গীবত থেকে যথাসম্ভব বেঁচে থাকুন। কারণ আল্লাহ তাআলা বলেন, وَیلٌ لِّکُلِّ هُمَزَۃٍ لُّمَزَۃِ ‘দুর্ভোগ প্রত্যেক পিছনে ও সামনে নিন্দাকারীর জন্য’ (আল-হুমাযাহ, ১০৪/১)।
আর একজন মুমিনের জন্য নিজের জবানকে হেফাযত করা অতীব জরুরী। যেমন-
(১) অশ্লীল অনুষ্ঠান, সিনেমা, ম্যাগাজিন, বই ও ওয়েবসাইট ব্রাউজ করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন।
(২) ইফতার ও সাহরীতে খাবার বিনষ্ট করা ও অপচয় রোধ করুন।
(৩) ছালাত ও অন্যান্য ইবাদতের ক্ষেত্রে অলসতা ঝেড়ে ফেলুন।
(৪) ঠকবাজি, প্রতারণা, খেয়ানত, ঝগড়া-বিবাদ ও গালিগালাজ সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করুন।
(৫) মিথ্যা ও অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা পরিহার করুন। মিথ্যাকে ছোট করে দেখবেন না, প্রশ্রয় দিবেন না। সেটা ইচ্ছে করে হোক বা ঠাট্টার ছলে। বিশ্ব নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ফরমান বলে,مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ فَلَيْسَ للهِ حَاجَةٌ فِي أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই’।[9]
সর্বোপরি, এই রামাযানে তাক্বওয়ার মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে বিশ্বাসী চেতনা ও শুদ্ধাচারী প্রেরণায় উজ্জীবিত হোক প্রতিটি হৃদয়। আবার ফিরে আসুক পঙ্কিলতাহীন পবিত্রতার আবেশ জড়ানো অনাবিল স্নিগ্ধতার জোয়ার। আমলের দিনগুলো ফুরিয়ে যাবার আগেই ঝরে যাক কদর্যতার রেশ। সবশেষে রবের কাছে এই প্রত্যাশা। আল্লাহ কবুল করুন- আমীন!
আবদুল্লাহ বিন হাদী
কুল্লিয়া ২য় বর্ষ, মাদরাসা মুহাম্মাদীয়া আরাবীয়া, উত্তর যাত্রাবাড়ী, ঢাকা।
[1]. তিরমিযী, হা/৬৮২, হাদীছ ছহীহ।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯০১।
[3]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৭৫৯।
[4]. তিরমিযী, হা/৮০৭, হাদীছ ছহীহ।
[5]. তিরমিযী, হা/১৯৫৬, হাদীছ ছহীহ।
[6]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৯৮৪।
[7]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৪৫।
[8]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৭।
[9]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯০৩।