কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

দেনমোহর নিয়ে সামাজিক স্বেচ্ছাচারিতা

post title will place here

দেনমোহর হলো ইসলামী বিবাহের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা ছাড়া মুসলিম বিবাহ সম্পূর্ণ হয় না। আর এই দেনমোহর হচ্ছে একজন স্বামী কর্তৃক তার স্ত্রীকে দেওয়া একটি শারঈ অধিকার। কিন্তু বর্তমানে আমাদের মুসলিম সমাজে দেনমোহর নিয়ে ব্যাপক স্বেচ্ছাচারিতা এবং অনৈসলামিক কার্যকলাপ লক্ষণীয়। তাই আসুন, জানার চেষ্টা করি বর্তমানে দেনমোহর নিয়ে সামাজিক স্বেচ্ছাচারিতা এবং এর কারণ ও কুফল সম্পর্কে।

দেনমোহর কী?

ইসলামিক এবং সামাজিক নিয়মে নারী-পুরুষের মধ্যে বিবাহ বন্ধনের প্রেক্ষিতে স্বামী তার স্ত্রীকে যে সম্পদ কিংবা অর্থ প্রদান করে তাকে দেনমোহর বা মোহরানা বলে, যা আল্লাহ কর্তৃক সরাসরি নির্দেশিত। তাই এটা স্ত্রীর প্রতি স্বামীর নিছক কোনো দান বা করুণা নয়; বরং ইসলামী আইনে স্ত্রীর একটি পাকাপোক্ত অধিকার। মোটকথা, দেনমোহর বা মোহরানা হচ্ছে একজন নারীর সতীত্বের বিনিময়সহ আত্মমর্যাদা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। 

কুরআনের আলোকে দেনমোহর: আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে সুস্পষ্টভাবে মোহরানার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, وَآتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً فَإِنْ طِبْنَ لَكُمْ عَنْ شَيْءٍ مِنْهُ نَفْسًا فَكُلُوهُ هَنِيئًا مَرِيئًا ‘আর তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের মোহর দিয়ে দাও খুশিমনে। তারা যদি খুশি হয়ে তা থেকে অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা তোমরা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ করো’ (আন-নিসা, ৪/৪)। অর্থাৎ প্রতিটি স্বামীকেই বিয়ের আগে তার স্ত্রীকে খুশিমনে মোহরানা প্রদান করতে হবে, এটা বাধ্যতামূলক। তবে কোনো স্ত্রী যদি তার মোহরানা না নিয়ে তা মাফ করে দেয়, কিংবা মোহরানা নিয়ে কিছু বা সম্পূর্ণ অংশ তার স্বামীকে দিয়ে দেয়, তাহলে তা স্বামী গ্রহণ করে ভোগ করতে পারবে।

সুতরাং কুরআন মাজীদের আলোকে মোহরানা আদায় করতে হবে। আর তা স্বামী খুশিমনে যা দিতে পারে বা তার সামর্থ্যানুযায়ী। এখানে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিমাণ উল্লেখ নেই। তাই চাইলে একজন স্বামী তার স্ত্রীকে কোটি টাকা দেনমোহর দিতে পারেন। আবার চাইলে ৫০ হাজার টাকাও দেনমোহর দিতে পারেন, যদি স্ত্রী তাতে সম্মত হন। এক্ষেত্রে শরীআতের কোনো ধরাবাঁধা পরিমাণ নেই। তবে মূল উদ্দেশ্য হলো স্বামীর সামর্থ্য এবং স্ত্রীর সন্তুষ্টি। যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটা সমঝোতা হয়, তাহলে দেনমোহর নিয়ে শরীআতের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

হাদীছের আলোকে দেনমোহর: মুসলিম বিয়েতে দেনমোহর প্রদান এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, এই বিষয়ে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসংখ্য নির্দেশ দিয়েছেন। দিয়েছেন। হাদীছে এসেছে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, أَيُّمَا رَجُلٍ تَزَوَّجَ امْرَأَةً بِمَا قَلَّ مِنَ الْمَهْرِ أَوْ كَثُرَ لَيْسَ فِي نَفْسِهِ أَنْ يُؤَدِّيَ إِلَيْهَا حَقَّهَا، خَدَعَهَا، فَمَاتَ وَلَمْ يُؤَدِّ إِلَيْهَا حَقَّهَا، لَقِيَ اللَّهَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَهُوَ زَانٍ ‘যে কোনো পুরুষ কোনো নারীকে কম বা বেশি যে কোনো পরিমাণ দেনমোহরের বিনিময়ে বিয়ে করে, অথচ তার মনে স্ত্রীর অধিকার না দেওয়ার পরিকল্পনা লুক্কায়িত আছে, তাহলে সে তাকে ধোঁকা দেয়। আর স্বামী তার স্ত্রীর অধিকার না দেওয়া অবস্থায় মারা গেলে সে ব্যভিচারী হিসেবে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে’।[1] এই হাদীছে এটা স্পষ্ট যে, দেনমোহর একজন স্বামীর জন্য বাধ্যতামূলক। তাই এটা পরিশোধ করা কর্তব্য। কেউ যদি দেনমোহর পরিশোধ না করে, তাহলে তাকে ব্যভিচারী বা যেনাকারী হিসাবে ক্বিয়ামতে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।

অতএব, এই দেনমোহর আমরা যতটা সহজ কিংবা সরল মনে করছি, বিষয়টা কখনোই এত সহজ নয়। ইচ্ছা হলেই মনের খেয়াল-খুশিমতো দেনমোহর ধরে তা আর পরিশোধ না করার যে সংস্কৃতি আমাদের উপমহাদেশে চালু আছে, তা সরাসরি শরীআত বহির্ভূত। সুতরাং দেনমোহর কখনোই কোনো ছেলেখেলা নয় যে, বিয়ের সময় কাবিননামায় উল্লেখ করেই দায়িত্ব শেষ। দেনমোহরের দায়-দায়িত্ব সরাসরি আখেরাতের সাথে সম্পৃক্ত। আর এজন্য প্রতিটি স্বামীর জবাবদিহিতা এবং দায়বদ্ধতা রয়েছে।

দেনমোহর কত দিতে হয়?

মহান আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেনমোহরের কোনো সুনির্দিষ্ট পরিমাণ নির্ধারণ করে দেননি। তাই দেনমোহর হিসেবে যে-কোনো পরিমাণ অর্থ-সম্পদ নির্ধারণ করা যেতে পারে।

আমরা পবিত্র কুরআন থেকে আগেই জেনেছি যে, দেনমোহর হচ্ছে একজন স্বামী খুশিমনে তাঁর স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করে যা দিতে পারেন, কিংবা যতবেশি দিতে পারেন। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ কোনো সীমারেখা ইসলামে নেই। তবে আমাদের দেশে অনেকে খুশিমনে দেনমোহর নির্ধারণ (যদিও তা নগদে পরিশোধ করে না) করলেও অধিকাংশ বিয়েতে কনেপক্ষের (যৌক্তিক কিংবা অযৌক্তিক) দাবিকেই মেনে নেওয়া হয়। যদিও তা নগদে কখনোই পরিশোধ করা বা আদায় করা হয় না। তাই বিয়ের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের মুরব্বী কিংবা অভিভাবকরা স্ত্রীর পিতার পরিবারের অন্যান্য মহিলা সদস্যের ক্ষেত্রে যেমন- মেয়ের বোন, ফুফু, খালা, ইত্যাদির দেনমোহরের অনুপাতে নির্ধারণ করে থাকেন। আবার ছেলের পক্ষেরও ছেলের অন্যান্য ভাইয়ের স্ত্রীদের কত দেনমোহর দিয়েছে সেটাকেও বিবেচনা করে।

আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলের বিয়েগুলোতে অনেক সময় কাগজপত্র বা সরাসরি কাবিন করা হয় না। এক্ষেত্রে কোনো কারণে বিয়ের সময় দেনমোহর ঠিক করা থাকে না বা যথাযথ হয়ে থাকে না। যদিও শরীআতের দৃষ্টিতে এটা অবৈধ, তবে প্রচলিত আইনে দেনমোহর নির্দিষ্ট করা না থাকলে, কোনো কারণে সেই বিয়ে ভেঙে গেলে আদালত একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ দেনমোহরের অর্থ নির্ধারণ করতে পারেন।

দেনমোহরের বর্তমান প্রেক্ষাপট: দেনমোহর কিংবা মোহরানা নিয়ে আমাদের বর্তমান সমাজে যা চলছে, তা খুবই জঘন্য এবং নিকৃষ্টতম কাজ। যার সাথে প্রকৃত ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। এই দেনমোহরকে পুঁজি করে আমাদের সমাজে একধরনের অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে যে দেনমোহর নির্ভর ছিল স্বামীর সন্তুষ্টি এবং সামর্থ্যের উপর। এখন সেই দেনমোহরের হিসাব চলে গেছে সামাজিক স্ট্যাটাসের উপর।

এখনকার বিয়েগুলোতে দেনমোহরের হিসাব স্বামীর সামর্থ্য কিংবা ইসলামের ভিত্তির উপর নেই; বরং তা অনৈসলামিক ভিত্তি এবং অনৈতিক কার্যকলাপে রূপ নিয়েছে। ফলে এই দেনমোহর আর আদায়ের বিষয়ে নেই, বরং লোকদেখানো রিয়াতে পরিণত হয়েছে। যেকারণে দেনমোহর এখন প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছে। কে কার থেকে বেশি দেনমোহর দিতে পারে (আদায় নয়) কিংবা কার মেয়ে কতবেশি দেনমোহরে বিয়ে হয়েছে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। একারণে দিনদিন সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার পাশাপাশি ধর্মীয় এবং নৈতিক অবক্ষয়ও দেখা দিচ্ছে। মুসলিম বিয়েগুলোতে গণহারে অতিরিক্ত দেনমোহরের কারণে বিভিন্ন সামাজিক এবং ধর্মীয় বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে।

অতিরিক্ত দেনমোহরের কারণ: আমাদের দেশে অতিরিক্ত দেনমোহরের বিভিন্ন কারণ রয়েছে। যদিও দেনমোহর পাত্র নির্ধারণ করার কথা থাকলেও কনের পরিবারের পক্ষ থেকে সবসময়ই চেষ্টা করা হয় অতিরিক্ত দেনমোহর লিখে নেওয়ার। আর এর প্রধান কারণ হচ্ছে, বিবাহবিচ্ছেদ বা ডিভোর্স ঠেকানো। অর্থাৎ যতবেশি দেনমোহর ধরা যাবে, স্বামী ততবেশি ডিভোর্স দিতে ভয় পাবে। কিংবা স্ত্রী হাজারো অপরাধ করলেও দেনমোহরের টাকা আদায় করার অপারগতার কারণে স্বামী সহজে স্ত্রীকে ডিভোর্স দিবে না। একইসাথে কোনো কারণে ডিভোর্স হয়ে গেলেও যেন কনেপক্ষ ভালো একটি ক্ষতিপূরণ পায়। যদিও অতিরিক্ত দেনমোহর কখনোই একটি অশান্তির সংসারকে টিকিয়ে রাখতে পারে না।

এছাড়াও অতিরিক্ত দেনমোহরের কারণ হচ্ছে সামাজিক স্ট্যাটাস। অর্থাৎ মানুষের কাছে জাহির করার জন্যও অনেক স্বামী স্বেচ্ছায় এবং কনেপক্ষ জোরপূর্বক অতিরিক্ত দেনমোহর নিয়ে থাকেন। যদিও এই দেনমোহর আদায়ের বা উসুলে কোনো পক্ষকেই তৎপর দেখা যায় না। শুধু সামাজিকতা রক্ষার জন্যই অতিরিক্ত দেনমোহর ধরা হয়। 

অতিরিক্ত দেনমোহরের কুফল: আমাদের সমাজে আজ অতিরিক্ত দেনমোহরের ছড়াছড়ি। আর এই মাত্রাতিরিক্ত দেনমোহরের কারণেই অসংখ্য সংসার বর্তমানে হুমকির মুখে রয়েছে। এর ফলে সমাজে নানাবিধ সমস্যার দেখা দিয়েছে। যেমন—

(১) বিয়েতে কনেপক্ষের বাড়তি খরচ: যখন কনেপক্ষ অতিরিক্ত দেনমোহর দাবি করে, তখন তাদের দাবি মেনে নিয়ে বরপক্ষও নানান অজুহাতে কনেপক্ষ থেকে বিভিন্ন বিষয়ের উপর চাপ প্রয়োগ করে। বিশেষ করে খাওয়া-দাওয়া নিয়ে বেশ চাপে রাখে বরপক্ষ। এক্ষেত্রে তারা অতিরিক্ত বরযাত্রীর দাবি করে। ফলে কনেপক্ষকে নিজেদের সাধ্যে না থাকলেও অনেক মানুষের খানাপিনার আয়োজন করতে হয়। এছাড়াও প্রথম দু’চার বছর কনেপক্ষ থেকে বরপক্ষকে বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় দিবস উপলক্ষ্যে নানান কিছু বাধ্যতামূলক দিতে হয়। এসব খরচ সামলাতেও কনেপক্ষকে অনেক খরচপাতি করতে হয়।

(২) যৌতুকের প্রচলন: অতিরিক্ত দেনমোহরের সবচেয়ে খারাপ দিক হলো বরপক্ষকে যৌতুক দেওয়া। বরপক্ষ কনেপক্ষের দাবি মেনে অতিরিক্ত দেনমোহর দেওয়ার কারণে কনেপক্ষকে যাবতীয় যৌতুক দিতে বাধ্য করা হয়। আর এই যৌতুক দিতে গিয়ে দেখা যায় যে, দেনমোহরের টাকার চাইতে কনেপক্ষের খরচ আরও বেশি হয়ে যায়। 

(৩) বিয়ে করতে না পারা: অতিরিক্ত দেনমোহরের কারণে সমাজের বিয়ে উপযুক্ত ছেলেরা সহজে বিয়ে করতে পারছে না। এই কারণে যারা মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, তারা সহজেই বিয়ে করতে পারে না কিংবা সাহস করে না। এর ফলে সমাজে যুবকশ্রেণিদের মধ্যে নানান হতাশা ছড়িয়ে পড়ছে।

(৪) নৈতিক অবক্ষয়: অতিরিক্ত দেনমোহরের কারণে দিনদিন আমাদের সমাজে নৈতিক অবক্ষয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। আর এই অবক্ষয়ের মাধ্যমে সমাজে পরকীয়া বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুবক ছেলেরা বিয়ে করতে না পারার কারণে পাড়ার কিংবা আত্মীয়স্বজনের স্ত্রীদের সাথে পরকীয়ায় লিপ্ত হচ্ছে ফ্রিস্টাইলে। আর এতে নারী-পুরুষ উভয়েরই নৈতিক অবক্ষয় হচ্ছে।

(৫) অশ্লীলতা বৃদ্ধি: অতিরিক্ত দেনমোহর দিতে না পারার কারণে যুবক ছেলেরা বিয়ে করতে পারছে না। ফলে তারা তাদের যৌবন অতিবাহিত করার জন্য বিভিন্ন পতিতালয় কিংবা হোটেলে রাত্রিযাপন করছে। এছাড়াও অধিকাংশ ছেলে-মেয়ে বিয়ে করার নামে প্রেম করে প্রেমিকার সাথে অশ্লীলতায় মেতে আছে। শুধু তাই নয়, সরকারি আইনে নারীদের ১৮ বছরের নিচে বিয়ে না হওয়ার কারণে ছেলেমেয়েরা অবাধে বিভিন্ন পার্ক এবং পর্যটনকেন্দ্রে মেলামেশা করছে। এসব বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য অশ্লীলতা বয়ে আনছে।

(৬) বিয়ে করতে অনীহা: অতিরিক্ত দেনমোহর একজন পুরুষকে অর্থনৈতিক, সামাজিক, শারীরিক এবং নৈতিকভাবে পঙ্গু করে ফেলে। এর ফলে অনেক যুবক আর বিয়ে করতে আগ্রহী হয়ে উঠে না। কেননা বিয়ে করতে গেলেই অনেক খরচের ধাক্কা সামলাতে হয়। যা আমাদের সমাজের মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নমধ্যবিত্ত ছেলেদের দ্বারা সম্ভব হয়ে উঠে না। তাই তারা বিয়েতে দিনদিন অনাগ্রহী হয়ে উঠে। 

(৭) নারীদের স্বেচ্ছাচারিতা বৃদ্ধি: অতিরিক্ত দেনমোহরের কারণে দিনদিন নারীদের একটি শ্রেণির মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব উচ্ছৃঙ্খল নারীশ্রেণি সমাজ কিংবা ধর্মীয় কোনো বাধাকেই তোয়াক্কা করে না। এরা সংসার করার চাইতে সংসারে আগুন লাগাতে ব্যস্ত থাকে। এরা বিভিন্ন ছোটখাটো বিষয় নিয়ে সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করে স্বামীকে পরিবার থেকে আলাদা করে ফেলে। অন্যথা পরিবারে নানান অশান্তি সৃষ্টি করে নিজের জিদ বজায় রাখে। আর এসব নারীদের মূল শক্তি হচ্ছে অতিরিক্ত দেনমোহর। স্ত্রীর অত্যাচারে কিংবা যেকোনো অজুহাতে স্বামী সংসার করতে না চাইলে স্ত্রীকে অবশ্যই মোটা অংকের ক্ষতিপূরণসহ দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করতে হবে, যা অধিকাংশ স্বামীর পক্ষে পরিশোধ করা সম্ভব হয় না। ফলে স্বামীসহ পুরো পরিবার পরবর্তীতে ডিভোর্স দিতে চাইলেও টাকার জন্য দিতে পারে না।

অতিরিক্ত দেনমোহর দ্বীনের অংশ নয়: আমাদের বিয়েগুলোতে যে ব্যবস্থায় দেনমোহর আদায় করা ছাড়া নির্ধারণ করা হচ্ছে, তা খুবই নিকৃষ্ট একটি কাজ। অথচ ছাহাবীগণ উচ্চমূল্য দেনমোহর ধার্য করে আদায় করার পরও উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা তা অপছন্দ করতেন। এক‌টি হাদীছে এসেছে, যা আবুল আজফা রাহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, উমার ইবনুল খাত্ত্বাব রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেছেন, لَا تُغَالُوا صَدَاقَ النِّسَاءِ، فَإِنَّهَا لَوْ كَانَتْ مَكْرُمَةً فِي الدُّنْيَا، أَوْ تَقْوًى عِنْدَ اللَّهِ، كَانَ أَوْلَاكُمْ وَأَحَقَّكُمْ بِهَا مُحَمَّدٌ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، مَا أَصْدَقَ امْرَأَةً مِنْ نِسَائِهِ، وَلَا أُصْدِقَتِ امْرَأَةٌ مِنْ بَنَاتِهِ أَكْثَرَ مِنَ اثْنَتَيْ عَشْرَةَ أُوقِيَّةً ‘তোমরা নারীদের মোহরানা উচ্চহারে বাড়িয়ে দিয়ো না। কেননা, তা দুনিয়াতে যদি সম্মানের বস্তু অথবা আল্লাহ তাআলার নিকট তাক্বওয়ার বস্তু হতো, তবে এ ব্যাপারে আল্লাহর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের চেয়ে বেশি উদ্যোগী হতেন ও এগিয়ে থাকতেন। কিন্তু ১২ উকিয়ার বেশি পরিমাণ মোহরে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কোনো স্ত্রীকে বিয়ে করেননি অথবা তার কোনো কন্যাকে বিয়ে দেননি’।[2] এই হাদীছ থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, অতিরিক্ত দেনমোহর কখনোই আল্লাহর কাছে তাক্বওয়ার বিষয় নয়। কেননা এটাতে কোনো কল্যাণ থাকলে তা আমাদের রাসূলই ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই কাজে এগিয়ে থাকতেন। তার মানে এটা নয় যে, অতিরিক্ত দেনমোহর দেওয়া যাবে না।

তবে আমাদের দেশে যে সংস্কৃতি আজকাল সৃষ্টি হয়েছে, আদায় করা ছাড়া অতিরিক্ত দেনমোহর দেওয়া, এটার কথাই উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা ইঙ্গিত করেছিলেন। আজকাল আমরা দেনমোহরের নামে যা করছি তাতে দ্বীন ইসলামের কোনো অংশ নেই। বরং দ্বীনের সুযোগকে দুনিয়াবী হাতিয়ার বানিয়ে নিয়েছি, যা একধরনের মুনাফেক্বী। কেননা আমরা দেনমোহরের ওয়াদা করছি, অথচ আদায় করছি না কিংবা আদায় করার নিয়্যতও নেই, যা সরাসরি ওয়াদার বরখেলাফ। 

শেষ কথা: অতিরিক্ত দেনমোহর আজ আমাদের সমাজকে একটি ধ্বংসের পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। এতে গরীব মধ্যবিত্তশ্রেণির মানুষেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই আসুন, অতিরিক্ত দেনমোহর নির্ধারণ বন্ধ করে যৌক্তিক দেনমোহর আদায়ের চেষ্টা করি। আর এভাবেই আমরা সঠিকভাবে দ্বীন ইসলাম পালন করার চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দান করুন- আমীন! 

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী

 পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।

[1]. ত্ববারানী, আল-মু‘জামুল আওসাত, হা/১৮৫১; ছহীহ তারগীব, হা/১৮০৭।

[2]. ইবনু মাজাহ, হা/১৮৮৭, হাসান।

Magazine