উমরার ক্ষেত্রে তালবিয়ার শেষ সময় : মীক্বাত থেকে ইহরাম বাঁধার সময় হতে ত্বওয়াফ শুরু হওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তালবিয়া পাঠ করতে হবে। মুজাহিদ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু উমরার ইহরামে পাথরে চুম্বন দেওয়া অর্থাৎ ত্বওয়াফ শুরু হওয়া পর্যন্ত তালবিয়া পড়তেন। ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু কা‘বাঘর দেখে উমরার তালবিয়া বন্ধ করতেন। তারপর তাকবীর পাঠ করতেন। কিছু যিকির করতেন, অতঃপর পাথরে চুম্বন দিতেন।[1] আতা রাহিমাহুল্লাহ-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, উমরাকারী কখন তালবিয়া পড়া বন্ধ করবে? উত্তরে তিনি বলেন, ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, যখন হারামে প্রবেশ করবে, তখন তালবিয়া বন্ধ করতে হবে। ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, যখন পাথরের চুম্বন দিবে বা আল্লাহু আকবার বলে হাতের ইশারা করবে, তখন তালবিয়া বন্ধ করবে।[2] এই হাদীছগুলোতে উমরা হতে তালবিয়া বন্ধ করার সময় বুঝা যায়।
হজ্জের ক্ষেত্রে তালবিয়ার শেষ সময় : ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমরায় পাথরে চুম্বন দেওয়ার সময় তালবিয়া বন্ধ করতেন। আর হজ্জে বড় জামরায় পাথর মারার সময় তালবিয়া বন্ধ করতেন।[3]
عَنْ عِكْرِمَةَ قَالَ : أَفَضْتُ مَعَ الْحُسَيْنِ بْنِ عَلِيٍّ مِنَ الْمُزْدَلِفَةِ فَلَمْ أَزَلْ أَسْمَعُهُ يُلَبِّيْ حَتّٰى رَمٰى جَمْرَةَ الْعَقَبَةِ، فَسَأَلْتُهُ فَقَالَ : أَفَضْتُ مَعَ أَبِي مِنَ الْمُزْدَلِفَةِ فَلَمْ أَزَلْ أَسْمَعُهُ يُلَبِّيْ حَتّٰى رَمٰى جَمْرَةَ الْعَقَبَةِ، فَسَأَلْتُهُ فَقَالَ : أَفَضْتُ مَعَ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنَ الْمُزْدَلِفَةِ فَلَمْ أَزَلْ أَسْمَعُهُ يُلَبِّيْ حَتّٰى رَمٰى جَمْرَةَ الْعَقَبَةِ.
ইকরিমা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি হুসাইন ইবনে আলীর সাথে মুযদালিফা হতে গেলাম। বড় জামরায় পাথর মারা পর্যন্ত সর্বদা তার তালবিয়া পাঠ শুনতে থাকলাম। আমি তাকে সেই বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আমি আমার পিতা আলীর সাথে মুযদালিফা হতে মিনায় গেলাম, বড় জামরায় পাথর মারা পর্যন্ত সর্বদা তালবিয়া পাঠ করতে শুনলাম। সেই বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আমি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে মুযদালিফা হতে গেলাম, বড় জামরায় পাথর মারা পর্যন্ত সর্বদা আমি তালবিয়া পাঠ করতে শুনলাম।[4] ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَبّٰى حَتّٰى رَمٰى جَمْرَةَ الْعَقَبَةِ ‘রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বড় জামরায় পাথর মারা পর্যন্ত তালবিয়া পাঠ করলেন’।[5] এই হাদীছসমূহ প্রমাণ করে, বড় জামরায় পাথর নিক্ষেপের সময় হজ্জের তালবিয়া পড়া হতে বিরত থাকতে হবে।
তালবিয়ায় যেসব কাজ নিষিদ্ধ :
(১) সমস্বরে মিলিতকণ্ঠে তালবিয়া পাঠ করা যাবে না।
(২) তালবিয়া বাদ দিয়ে অন্য যিকির-আযকারে ব্যস্ত হওয়া যাবে না। কারণ ইহরাম বাঁধার পর হজ্জ-উমরার মূল প্রতীক হলো তালবিয়া পড়া। ছহীহ হাদীছে বর্ণিত, তালবিয়ার সাথে বিদআতী তালবিয়া অথবা পীর-মুরশিদের মনগড়া তালবিয়া পড়া যাবে না বা তাদের কোনো বাক্য সংযুক্ত করা যাবে না।
মক্কা মুকাররমায় প্রবেশ : মক্কায় পৌঁছার পর আবাসিক হোটেলে উঠে বা কোনো স্থানে অবস্থান করে ভালোভাবে পবিত্র হতে হবে। অসুস্থতার আশঙ্কা না থাকলে ভালোভাবে গোসল করে নিবে। তারপরে উমরার উদ্দেশ্যে মসজিদে হারামের দিকে বের হবে। নাফে‘ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, حَتَّى يَبْلُغَ الْمَحْرَمَ ، ثُمَّ يُمْسِكُ حَتَّى إِذَا جَاءَ ذَا طُوًى بَاتَ بِهِ حَتّٰى يُصْبِحَ ، فَإِذَا صَلَّى الْغَدَاةَ اغْتَسَلَ ، وَزَعَمَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَعَلَ ذَلِكَ ‘এমনকি (ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু) হারামের নিকট স্থানে পৌঁছলেন এবং তালবিয়া হতে বিরত হলেন। তারপর ‘যূ-তুওয়া’ নামক স্থানে রাতে অবস্থান করলেন। তিনি সকালে ফজরের ছালাত আদায় করলেন অতঃপর গোসল করলেন। তারপর তিনি বলেন, নবী করীম এরূপ করতেন’।[6] এই হাদীছ প্রমাণ করে মসজিদে হারামে প্রবেশের পূর্বে গোসল করা সুন্নাত।
মসজিদে হারামে প্রবেশ : কা‘বার চার পাশের ঘরগুলোকে মসজিদুল হারাম বলা হয়। মসজিদে প্রবেশের যে আদব, সেভাবেই প্রবেশ করতে হবে। প্রথমে ডান পা রেখে প্রবেশ করতে হবে এবং এ দু‘আ পড়তে হবে। আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, সুন্নাত হলো, যখন তুমি মসজিদে প্রবেশ করবে, তখন তুমি তোমার ডান পা দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করবে। আর যখন তুমি বের হবে, তখন তুমি তোমার বাম পা দিয়ে বের হবে।[7] এই হাদীছে মসজিদে প্রবেশের এবং বের হওয়ার নিয়ম বুঝা যায়। আমর ইবনুল আছ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মসজিদে প্রবেশ করতেন, তখন বলতেন,أَعُوذُ بِاللَّهِ الْعَظِيمِ وَبِوَجْهِهِ الْكَرِيمِ وَسُلْطَانِهِ الْقَدِيمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ ‘আমি বিতাড়িত শয়তান হতে মহান আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। যিনি করুণাময় এবং সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। হে আল্লাহ! তুমি আমার জন্য তোমার রহমতের দরজা খুলে দাও’।[8] হাদীছে বুঝা যায়, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই হাদীছটি মসজিদে প্রবেশের জন্য ব্যবহার করতেন।
মসজিদে হারামে প্রবেশ করে ত্বওয়াফের ইচ্ছা থাকলে ত্বওয়াফ করবে। ত্বওয়াফের ইচ্ছা না থাকলে ফরয ছালাতে দাঁড়াবে। ফরয ছালাতে না দাঁড়ালে, অবশ্যই দুই রাকআত দুখূলুল মাসজিদ পড়বে, তারপর বসবে। আবূ ক্বাতাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,إِذَا دَخَلَ أَحَدُكُمُ الْمَسْجِدَ فَلْيَرْكَعْ رَكْعَتَيْنِ قَبْلَ أَنْ يَجْلِسَ ‘যখন তোমাদের কোনো ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে, তখন যেন সে বসার পূর্বে দুই রাকআত ছালাত আদায় করে নেয়’।[9] এই হাদীছ প্রমাণ করে, মসজিদে বসার অনুমতি হলো দুই রাকআত ছালাত আদায় করা। দুখূলুল মাসজিদ পড়ার ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ কোনো সময় নেই। আছরের ছালাতের পরে হোক বা ফজরের ছালাতের পরে হোক কিংবা ঠিক দুপুরে হোক যেকোনো সময়ে মসজিদে প্রবেশ করলে দুই রাকআত ছালাত আদায় করেই বসতে হবে। নিষিদ্ধ সময় বলে অজুহাত পেশ করা যাবে না। কারণ এটা মসজিদের হক্ব। নিষিদ্ধ সময়গুলোতে অন্য কোনো নফল ছালাত আদায় করা যাবে না। মসজিদে হারামের বিষয়টি আরো ভিন্ন। জুবায়ের ইবনু মুত্বঈম রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,يَا بَنِى عَبْدِ مَنَافٍ لاَ تَمْنَعُوا أَحَدًا طَافَ بِهَذَا الْبَيْتِ وَصَلَّى أَيَّةَ سَاعَةٍ شَاءَ مِنَ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ ‘হে বনী আবদে মানাফ! তোমরা দিনে-রাতে যেকোনো সময়ে কাউকে এ মসজিদে হারামে ছালাত আদায় এবং ত্বওয়াফ করতে নিষেধ করো না’।[10] এই হাদীছে বুঝা যায়, মসজিদে হারামে কোনো নিষিদ্ধ সময় নেই। মসজিদে হারামে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা নফল ছালাত চলবে। ইমাম ইবনু মাজাহ এ ব্যাপারে একটি অনুচ্ছেদ উল্লেখ করেন যে, ‘মসজিদে হারামে সবসময় ছালাত জায়েয’।
কা‘বাঘর দেখে হাত তুলে দু‘আ করা যায় : কা‘বাঘর দেখে দুই হাত উঠিয়ে দু‘আ করা জায়েয কারণ এ মর্মে হাদীছটি হাসান।
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ لاَ تُرْفَعُ الأَيْدِي إِلاَّ فِي سَبْعَةِ مَوَاطِن إذَا قُمْتَ إلَى الصَّلاَةِ ، وَإِذَا رَأَيْتَ الْبَيْتَ وَإِذَا قُمْتَ عَلَى الصَّفَا وَالْمَرْوَةِ وَبِعَرَفَاتٍ وَبِجَمْعٍ وَعِنْدِ الْجِمَارِ.
ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, সাতটি স্থান ব্যতীত দুই হাত উঠানো যায় না। ১. ছালাত আরম্ভের সময়, ২. যখন কা‘বাঘর দেখতে পাবে, ৩. ছাফা পাহাড়ে উঠার সময়, ৪. মারওয়ার পাহাড়ে উঠার সময়, ৫. আরাফার মাঠে পাথর নিক্ষেপের সময়, ৬. মুযদালিফায় উপস্থিত হওয়ার সময় এবং ৭. মিনায় পাথর নিক্ষেপের সময়।[11]
মসজিদে হারাম দেখে নিম্নের দু‘আটি পড়া যায়,اللَّهُمَّ أَنْتَ السَّلاَمُ وَمِنْكَ السَّلاَمُ فَحَيِّنَا رَبَّنَا بِالسَّلاَمِ ‘হে আল্লাহ! তুমিই একমাত্র নিরাপত্তা প্রদানকারী। আর তোমার পক্ষ থেকেই নিরাপত্তা দেওয়া হয়ে থাকে। অতএব, তুমি আমাদেরকে নিরাপত্তা সহকারে জীবিত রাখো’।[12] এই হাদীছ প্রমাণ করে দু‘আটি কা‘বাঘর দেখে পড়া যায়।
(চলবে)
[1]. বায়হাক্বী, হা/৯৪৯১।
[2]. বায়হাক্বী, হা/৯৪৯২।
[3]. বায়হাক্বী, হা/৯৪৯৪।
[4]. মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হা/৫৩৭৯।
[5]. ছহীহ মুসলিম, হা/১২৮১; আবূ দাঊদ, হা/১৮১৫।
[6]. ছহীহ বুখারী, হা/১৫৭৩; শারহুস সুন্নাহ, ১/৪৬০।
[7]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বা, হা/৩৪৩৮; সিলসিলা ছহীহা, হা/২৪৭৮।
[8]. আবূ দাঊদ, হা/৪৬৬; মিশকাত, হা/৭৪৯।
[9]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৪৪; ছহীহ মুসলিম, হা/৭১৪; মিশকাত, হা/৭০৪।
[10].ইবনু মাজাহ, হা/১২৫৪; তিরমিযী, হা/৮৬৮; মিশকাত, হা/১০৪৫।
[11]. ইবনু মাজাহ, হা/১২৫৪; তিরমিযী, হা/৮৬৮; মিশকাত, হা/১০৪৫।
[12]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বা, হা/১৫৯৯৮; সুনানুল কুবরা, হা/৯৪৮১।