কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

বর্তমানে প্রচলিত পহেলা বৈশাখ

post title will place here

সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা আমাদের এই বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। ২ মাস পরপর ঋতু পরিবর্তনের কারণে এই দেশ একেক সময় একেকটি রূপ ধারণ করে। আর এই ঋতুতে কিছু দিনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। আমরা যেমন বাঙালি, তার চেয়ে বড় কথা হলো আমরা মুসলিম। প্রত্যেকটি উৎসব পালন করার আগে আমাদের দেখা উচিত এটি ইসলাম সমর্থন করে কিনা? এধরনের উৎসবের মধ্যে একটি হচ্ছে পহেলা বৈশাখ— যা আমরা প্রতি বছর পালন করে থাকি।

বৈশাখ পরিচিতি: প্রতি বছর এপ্রিল মাসে আমরা বাংলাদেশীরা একটি উৎসব পালন করে থাকি, তা হলো ১৪ এপ্রিল। অর্থাৎ সেটি বাংলা বর্ষের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ। আমাদের দেশে প্রচলিত বাংলা সন মূলত ইসলামী হিজরী সনেরই একটি রূপ। ভারতে ইসলামী শাসনামলে হিজরী পঞ্জিকা অনুসারেই সকল কাজকর্ম পরিচালিত হতো। আর হিজরী পঞ্জিকা চন্দ্রমাসের উপর নির্ভরশীল। চন্দ্রবৎসর সৌরবৎসরের চেয়ে প্রায় ১১ দিন কম হয়। কেননা সৌরবৎসর ৩৬৫.২৫ দিন, আর চন্দ্রবৎসর ৩৫৪.৩৭ দিন। আর এ কারণেই চন্দ্রবৎসর ঋতুগুলো ঠিক থাকে না। কিন্তু বিশেষ করে চাষাবাদ ও এজাতীয় অনেক কাজ ঋতুর সাথে সম্পৃক্ত। এজন্য ভারতের মোগল সম্রাট আকবরের সময়ে প্রচলিত চন্দ্রনির্ভর হিজরী পঞ্জিকাকে সৌরপঞ্জিকায় রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

পহেলা বৈশাখের ইতিহাস: মোগল সম্রাট আকবর তার দরবারের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লাহ সিরাজীকে হিজরী চন্দ্রবর্ষ পঞ্জিকাকে সৌরবর্ষ পঞ্জিতে রূপান্তরিত করার দায়িত্ব প্রদান করেন। ৯৯২ হিজরী মোতাবেক ১৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আকবর এ হিজরী সৌরবর্ষ পঞ্জির প্রচলন করেন। তবে যেহেতু তিনি ২৯ বছর পূর্বে তার সিংহাসনে আরোহণ করেন, তাই সেই সময় থেকে পঞ্জিকা প্রচলনের নির্দেশ দেন। এজন্য ৯৬৩ হিজরী সাল থেকে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু করা হয়। ইতিপূর্বে চৈত্র মাস ছিল প্রথম মাস। কিন্তু ৯৬৩ হিজরী সালের মুহাররম মাস ছিল বাংলা বৈশাখ মাস। এজন্য বৈশাখ মাসকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং পহেলা বৈশাখকে নববর্ষ ধরা হয়।

পহেলা বৈশাখে কার্যাবলি: সেই সময় থেকেই বাংলা নববর্ষ উপলক্ষ্যে পহেলা বৈশাখে কিছু আয়োজন করা হতো। প্রজারা চৈত্র মাসের শেষ পর্যন্ত খাজনা পরিশোধ করতেন এবং পহেলা বৈশাখে জমিদারগণ প্রজাদের মিষ্টিমুখ করাতেন এবং সাথে কিছু আনন্দ-উৎসবের ব্যবস্থা করতেন। এছাড়া বাংলার সকল ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসার পুরনো হিসাব শেষে করতেন এবং পহেলা বৈশাখে ‘হালখাতা’ করতেন। আর এর মাধ্যমে আবার বছরের নতুন হিসাব পুনরায় শুরু করতেন। পহেলা বৈশাখে কার্যাবলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, যা ব্যক্তি, জাতি, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় নিয়মের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।

বর্তমান সময়ের পহেলা বৈশাখ: বর্তমানে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে যেসমস্ত কাজ করা হচ্ছে, তা পূর্বের কোনো বাঙালিরা করেননি, এমনকি তারা এই ধরনের নিকৃষ্ট কাজের চিন্তাভাবনাও করেননি। বর্তমানে বাংলাদেশে যেভাবে পহেলা বৈশাখ পালন করা হচ্ছে, তা ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে চরমভাবে সাংঘর্ষিক। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতিদের অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

পোশাকে নোংরামি: পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার পোশাক। পোশাকে থাকছে ঢোল, তবলা, গিটার ও নানান ধরনের বাদ্য যন্ত্র, যা ইসলামে সম্পূর্ণরূপে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। আর সুন্দর, সামাজিক, তাক্বওয়াশীল পোশাক পরিধান করার কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,يَا بَنِي آدَمَ قَدْ أَنْزَلْنَا عَلَيْكُمْ لِبَاسًا يُوَارِي سَوْآتِكُمْ وَرِيشًا وَلِبَاسُ التَّقْوَى ذَلِكَ خَيْرٌ ذَلِكَ مِنْ آيَاتِ اللَّهِ لَعَلَّهُمْ يَذَّكَّرُون ‘হে আদম সন্তান! আমি তোমাদের উপর পোশাক অবতীর্ণ করেছি, তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করার জন্য এবং শোভাবর্ধনের জন্য। আর তাক্বওয়ার পোশাক হচ্ছে সর্বোত্তম পোশাক। ওটা আল্লাহর নিদর্শনসমূহের মধ্যে একটা যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে’ (আল-রাফ, ৭/২৬)

মানুষ আজকে লোক দেখানোর জন্য পোশাক পরিধান করছে। পুরুষের পোশাক নারীরা আবার নারীদের পোশাক পুরুষরা পরিধান করছে। যেটাকে ইসলামী শরীআতে সম্পূর্ণরূপে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। হাদীছে এসেছে,

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ i قَالَ لَعَنَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمُتَشَبِّهِينَ مِنَ الرِّجَالِ بِالنِّسَاءِ وَالْمُتَشَبِّهَاتِ مِنَ النِّسَاءِ بِالرِّجَالِ.

ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐসব পুরুষকে লা‘নত করেছেন, যারা নারীর বেশ ধরে এবং ঐসব নারীকে যারা পুরুষের বেশ ধরে’।[1]

বিভিন্ন দিবস পালন করতে গিয়ে যে সমস্ত পোশাক পরিধান করা হয়, তার বেশিরভাগই বিধর্মীদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ পোশাক। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের পোশাকের ব্যাপারে কঠিন ভাষায় উল্লেখ করে বলেন, مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ ‘যে ব্যক্তি কোনো জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে তাদের দলভুক্ত গণ্য হবে’।[2]

বর্তমানে যে সমস্ত পোশাক মেয়েরা ব্যবহার করছে, তার প্রায় ৯০ ভাগ মহিলা পাতলা, আঁটোসাঁটো এবং আকৃষ্টকারী পোশাক পরিধান করছে। অথচ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এগুলোর নিষেধাজ্ঞা জারী করে বলেন, ‘দুই শ্রেণির জাহান্নামীকে আমি দেখিনি। প্রথম শ্রেণি- যাদের হাতে থাকবে গরুর লেজের ন্যায় ছড়ি, তা দ্বারা তারা লোকদেরকে প্রহার করবে। দ্বিতীয় শ্রেণি- ঐ সকল নারী, যারা পোশাক পরিহিতা অথচ উলঙ্গ। পুরুষদেরকে নিজেদের দিকে আকৃষ্টকারিণী এবং নিজেরাও পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট। তাদের মাথা হবে লম্বা গ্রীবাবিশিষ্ট উটের কুঁজের ন্যায়। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং তার সুগন্ধিও পাবে না। অথচ জান্নাতের সুগন্ধি এত এত দূর থেকে পাওয়া যাবে।[3]

পোশাকের ব্যাপারে সর্বশেষ কথা হলো, কোনো প্রাণীর ছবিযুক্ত কোনোকিছু ব্যবহার করা যাবে না। আবূ তালহা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, ‘যে বাড়িতে কুকুর থাকে এবং প্রাণীর ছবি থাকে, সে বাড়িতে ফেরেশতা প্রবেশ করে না’।[4]

দিবসের নামে অশ্লীলতা: বর্তমান বিশ্বে আমারা দেখতে পাচ্ছি যে, নির্দিষ্টভাবে কোনো দিবস পালন করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি শিরক, বিদআত, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও মাদক গ্রহণের মতো ধ্বংসাত্মক কাজগুলো বেশি হচ্ছে। যেমন: ইংরেজি ক্যালেন্ডারের শেষ দিন থার্টিফাস্ট নাইট ও প্রথম দিন নিউ ইয়ার বা নববর্ষ পালন করতে গিয়ে আমাদের বেহায়াপনার শেষ থাকে না। ছাত্র-ছাত্রী, কিশোর-কিশোরী ও যুবক-যুবতিরা অতি সহজে বিভিন্ন ধরনের কাবীরা গুনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ে। অথচ আল্লাহ তাআলা এ থেকে মুক্ত থাকার ব্যাপারে বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ عَلَيْهَا مَلَائِكَةٌ غِلَاظٌ شِدَادٌ لَا يَعْصُونَ اللَّهَ مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেরা জাহান্নামের আগুন থেকে আত্মরক্ষা করো এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করো। যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। যার উপর নিয়োজিত রয়েছেন কঠোর হৃদয়সম্পন্ন ফেরেশতাগণ, তারা আল্লাহ যা নির্দেশ করেন তা বাস্তবায়নে অবাধ্য হন না, আর তাদের যা নির্দেশ প্রদান করা হয়, তারা তাই করেন’ (আত-তাহরীম, ৬৬/৬)। কোনো পরিবারের স্ত্রী, কন্যা ও সন্তানাদি তখনই ঐসব পাপ করার সুযোগ পায়, যখন তার অভিভাবক এ বিষয়ে চুপ থাকে অথবা সুযোগ দেয় বা সহযোগিতা করে। যে ব্যক্তি তার স্ত্রী-সন্তানদের বেহায়াপনা ও অশ্লীলতার সুযোগ দেয়, তাকে দাইয়ূস বলা হয়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এদের ব্যাপারে বলেন,ثَلَاثَةٌ قَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِمُ الْجَنَّةَ مُدْمِنُ الْخَمْرِ وَالْعَاقُّ وَالدَّيُّوثُ الَّذِي يُقِرُّ فِي أَهْلِهِ الْخَبَثَ ‘তিন শ্রেণির ব্যক্তির জন্য আল্লাহ তাআলা জান্নাত হারাম করেছেন— ১. মাদকাসক্ত, ২. পিতা-মাতার অবাধ্য এবং ৩. দাইয়ূস, যে তার পরিবারের মধ্যে অশ্লীলতার স্বীকৃতি দেয়’।[5] রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এজন্য সকল প্রকার দায়িত্বশীলকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। রাষ্ট্রনেতা তার প্রজাদের সম্পর্কে দায়িত্বশীল আর তাকে তার পরিচালনার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হবে। একজন পুরুষলোক তার পরিবারের ব্যাপারে দায়িত্বশীল, তাকে তাদের পরিচালনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। একজন মহিলা তার স্বামীর ঘরের সার্বিক ব্যাপারে দায়িত্বশীলা, তাকে সেটার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। একজন গোলাম তার মালিকের সম্পদের সংরক্ষক আর তাকে সেটার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে’।[6]

সুতরাং প্রত্যেক প্রকার দায়িত্বশীলের উচিত, সকল প্রকার ভালো কাজে সহযোগিতা করা এবং খারাপ কাজে সামর্থ্যানুযায়ী বাধা প্রদান করা। আর যদি কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি অশ্লীলতা ছড়াতে চায়, তবে আল্লাহ তাআলা তাদের ব্যাপারে বলেন,إِنَّ الَّذِينَ يُحِبُّونَ أَنْ تَشِيعَ الْفَاحِشَةُ فِي الَّذِينَ آمَنُوا لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ ‘যারা চায় যে, মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রচার ঘটুক তাদের জন্য দুনিয়াতে ও আখেরাতে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আর আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না’ (আন-নূর, ২৪/১৯)

সুধী পাঠক! আসুন আমরা বর্তমানে প্রচলিত পহেলা বৈশাখ ও থার্টিফাস্ট নাইটসহ সকল প্রকার অশ্লীলতায় পরিপূর্ণ আচার-অনুষ্ঠান ও সব ধরনের কাবীরা গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকি। মহাল আল্লাহ আমাদের সকলকে হেফাযত করুন- আমীন!

* চারঘাট, রাজশাহী।

[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৮৮৫; মিশকাত, হা/৪৪২৯।

[2]. আবূ দাঊদ, হা/৪০৩১; মিশকাত, হা/৪৩৪৭, হাসান।

[3]. ছহীহ মুসলিম, হা/২১২৮।

[4]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৯৫৭।

[5]. আহমাদ, হা/৫৩৭২; মিশকাত, হা/৩৬৫৫। হাদীছটি ছহীহ।

[6]. ছহীহ বুখারী, হা/৫২০০; ছহীহ মসলিম, হা/১৮২৯।

Magazine