কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ক্বিয়ামতের মাঠে মানুষের আফসোসের কারণ

post title will place here

মৃত্যু প্রতিটি মানুষেরই অবধারিত একটি গন্তব্য। যে গন্তব্যে পৌঁছতে হবে পৃথিবীর সকল প্রাণীকেই। আর মানুষের রয়েছে মৃত্যুর পর আরেকটি জীবন। যে জীবনে তাকে পৃথিবীর কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে হবে। একজন মানুষও তার ব্যতিক্রম নয়। মৃত্যুর পর আখেরাতের ফয়সালার দিন অনেক মানুষই আফসোস করতে থাকবে। তাদের আফসোসগুলো কী হবে, তা আল্লাহ আগেই আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন। আজ আমরা জানার চেষ্টা করব ক্বিয়ামতের দিন কী কী কারণে মানুষ আফসোস করবে। একই সাথে আমাদেরও যাতে আফসোস করতে না হয়, সেই প্রস্তুতি সম্পর্কেও জানার চেষ্টা করব, ইনশা-আল্লাহ।

আমরা পবিত্র কুরআনে ক্বিয়ামতের দিন মানুষের আফসোস সম্পর্কে বিভিন্ন আয়াত দেখতে পাই। চলুন! আমরা তন্মধ্যে কিছু আয়াতের বিশ্লেষণ করি।

(১) শিরক করার কারণে আফসোস: শিরক করার কারণে ক্বিয়ামতের ময়দানে মানুষ আফসোস করতে থাকবে। আল্লাহ তাদের আফসোসের কথা বর্ণনা করেছেন এভাবে, ﴿يَا لَيْتَنِي لَمْ أُشْرِكْ بِرَبِّي أَحَدًا﴾ ‘হায় আফসোস! আমি যদি আমার রবের সঙ্গে কাউকে শরীক না করতাম!’ (আল-কাহফ, ১৮/৪২)

একজন মুসলিম এবং বিধর্মীর পার্থক্য হলো শিরক। একজন মুমিন তাওহীদে বিশ্বাসী হয়। অপরদিকে একজন কাফের-মুশরিক আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপন করে শিরক করে। অনেক মুসলিম আছেন, যারা ঈমান আনার পরও তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও বিশ্বাসের দ্বারা আল্লাহর সাথে শিরক করেন। তারা জানেন না তাদের ঈমান, আক্বীদা, আমল শিরকযুক্ত। তাদের কথা আল্লাহ এভাবে বলেছেন,﴿وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلَّا وَهُمْ مُشْرِكُونَ﴾ ‘তাদের অধিকাংশই আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এমন অবস্থায় যে, তারা সাথে সাথে শিরকও করে’ (ইউসুফ, ১২/১০৬)

এই আয়াত থেকে বুঝা যাচ্ছে, অধিকাংশ মুসলিম মুখে ঈমান আনলেও তাদের কর্মের দ্বারা শিরক করে থাকে প্রতিনিয়ত। আর শিরক এমন অপরাধ, যা আল্লাহ ক্ষমা করেন না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,﴿إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدِ افْتَرَى إِثْمًا عَظِيمًا﴾ ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাঁর সাথে শিরক করার গোনাহ ক্ষমা করেন না, এছাড়া যে কোনো গোনাহ তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে, সে অবশ্যই মহাপাপ রচনা করে’ (আন-নিসা, ৪/৪৮)

সুতরাং এই শিরক করার কারণে কোনো ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম দাবি করলেও তার জন্য ক্ষমা নেই। তাই তাদের আফসোস করা ছাড়া আর কোনো গতিই থাকবে না। অতএব, আমাদের উচিত শিরক সম্পর্কে বিস্তারিত জানা, যাতে ক্বিয়ামতের মাঠে হাজারো আমল নিয়ে হাযির হওয়া সত্ত্বেও আফসোস করতে না হয়।

(২) রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ না করার জন্য আফসোস: রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ অনুসরণই হচ্ছে ইসলাম। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ই হলেন একমাত্র আদর্শ। অথচ মুসলিম হওয়ার পরও অধিকাংশ মুসলিম জেনে বা না জেনে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শকে অবজ্ঞা করে। একই সাথে তাঁর অনুসরণ না করে অন্যদের অনুসরণ করে। যারা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ না করে অন্যদের অনুসরণ করে, তারা ক্বিয়ামতের ময়দানে আফসোস করতে থাকবে এভাবে,﴿يَا لَيْتَنَا أَطَعْنَا اللَّهَ وَأَطَعْنَا الرَّسُولَا﴾ ‘হায় আমাদের আফসোস! আমরা যদি আল্লাহর আনুগত্য করতাম এবং রাসূলের আনুগত্য করতাম!’ (আল-আহযাব, ৩৩/৬)। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿يَا لَيْتَنِي اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُولِ سَبِيلًا﴾ ‘হায়! আমি যদি রাসূলের সাথে পথ অবলম্বন করতাম’ (আল-ফুরক্বান, ২৫/২৭)

সুতরাং যারাই রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শের অনুসারী না হবে, তারা কখনোই ক্বিয়ামতের মাঠে পার পাবে না। তাই তারা আফসোস করতে থাকবে কেন আমরা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসারী হলাম না। আজ আমাদের উপমহাদেশে এমন হাজারো মুসলিম আছে, যারা তাদের নিজেদের আশেকে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিচয় দেয়। অথচ তাদের ঈমান, আক্বীদা ও আমলে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ অনুসরণ, আনুগত্য কিছুই নেই।

তারা তাদের বড় বড় পীর-আউলিয়াদের কথাকেই দ্বীন মনে করে। সুস্পষ্ট সুন্নাহর বিপরীতে বিদআতী আমল করে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহকে পিছনে ফেলে দিয়ে নিত্যনতুন আমল সৃষ্টি করে। তারা কখনোই ক্বিয়ামতের ময়দানে পার পাবে না। বরং রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই তাদের তাড়িয়ে দিবেন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,إِنِّيْ فَرَطُكُمْ عَلَى الْحَوْضِ مَنْ مَرَّ عَلَىَّ شَرِبَ وَمَنْ شَرِبَ لَمْ يَظْمَأْ أَبَدًا لَيَرِدَنَّ عَلَىَّ أَقْوَامٌ أَعْرِفُهُمْ وَيَعْرِفُوْنِيْ ثُمَّ يُحَالُ بَيْنِيْ وَبَيْنَهُمْ فَأَقُوْلُ إِنَّهُمْ مِنِّيْ فَيُقَالُ إِنَّكَ لاَ تَدْرِيْ مَا أَحْدَثُوْا بَعْدَكَ فَأَقُوْلُ سُحْقًا سُحْقًا لِمَنْ غَيَّرَ بَعْدِيْ ‘আমি তোমাদের পূর্বে হাউযের (হাউযে কাওছার) নিকটে পৌঁছে যাব। যে আমার নিকট দিয়ে অতিক্রম করবে, সে হাউযের পানি পান করবে। আর যে একবার পান করবে, সে আর কখনো পিপাসিত হবে না। নিঃসন্দেহে কিছু সম্প্রদায় আমার সামনে (হাউযে) আসবে। আমি তাদেরকে চিনতে পারব আর তারাও আমাকে চিনতে পারবে। এরপর আমার ও তাদের মাঝে আড়াল করে দেওয়া হবে। আমি তখন বলব, এরা তো আমারই উম্মত। তখন বলা হবে, তুমি জানো না তোমার (মৃত্যুর) পরে এরা কী সব নতুন নতুন কথা ও কাজ সৃষ্টি করেছিল। তখন আমি বলব, দূর হোক! দূর হোক (আল্লাহর রহমত থেকে), যারা আমার পরে (দ্বীনের) পরিবর্তন সাধন করেছে’।[1]

সুতরাং আমাদের উচিত রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশিত সঠিক ঈমান-আমল যাচাই করে তবেই তা পালন করা। তা না হলে ভুল পথে চলার কারণে আমাদেরও হাশরের মায়দানে আফসোস করতে হবে।

(৩) বন্ধুত্বের কারণে আফসোস: ইসলামে বন্ধু এবং বন্ধুত্বের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা দুনিয়ার বন্ধুই ক্বিয়ামতের মাঠে একসাথে থাকবে। তাই দুনিয়াতে ভালো বন্ধুর সাথে বন্ধুত্ব না করলে তাকে হাশরের মাঠে এভাবেই আফসোস করতে হবে,﴿يَا وَيْلَتَى لَيْتَنِي لَمْ أَتَّخِذْ فُلَانًا خَلِيلًا﴾ ‘হায়! আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম’ (আল-ফুরক্বান, ২৫/২৮)

অর্থাৎ দুনিয়াতে ভালো ঈমানদার, আবেদ মানুষের সাথে বন্ধুত্ব না করা এবং খারাপ, বেঈমান, মুনাফিক্ব, মুশরিকদের সাথে বন্ধুত্ব করার কারণে এক শ্রেণির মানুষ এভাবেই আফসোস করতে থাকবে। অথচ সেখানে আফসোস করে কখনোই কোনো লাভ হবে না। সুতরাং ক্বিয়ামতের আগেই আমাদের উচিত হবে, ভালো ঈমানদারের সাথে বন্ধুত্ব করা। বিশেষ করে যার ঈমান, আমল, আক্বীদা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ত্বরীক্বার সাথে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ। যাতে তার দ্বারা দ্বীন ইসলাম শেখা ও মানা যায়।

(৪) পাপাচারী হওয়া ও আমল না করার আফসোস: ক্বিয়ামতের মাঠে ঈমানের পাশাপাশি আমল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ঈমান ও আমল একে অপরের পরিপূরক। শুধু মুখে বিশ্বাস ও অন্তরের ঈমান দ্বারা কাউকে বিচার করা যাবে না। তাই প্রতিটি মানুষেরই ঈমানের পাশাপাশি সৎ আমল জরুরী। যে কারণে আখেরাতে এক শ্রেণির মানুষ আফসোস করবে এভাবে,﴿يَا لَيْتَنِي قَدَّمْتُ لِحَيَاتِي﴾ ‘হায়! যদি পরকালের জন্য কিছু অগ্রে পাঠাতাম’ (আল-ফজর, ৮৯/২৪)। অন্যত্র আছে,﴿يَا لَيْتَنِي لَمْ أُوتَ كِتَابِيَهْ﴾ ‘হায়! আমাকে যদি আমার আমলনামা না দেওয়া হতো’ (আল-হাক্কাহ, ৬৯/২৫)। অন্যত্র আরও আছে,﴿يَا لَيْتَنِي كُنْتُ تُرَابًا﴾ ‘হায়! আমি যদি মাটি হয়ে যেতাম’ (আন-নাবা, ৭৮/৪০)

অর্থাৎ যারা পরকালের জন্য কোনো আমলই করল না, তারা আফসোস করবে। একই সাথে ভালো আমল না করা এবং খারাপ আমলের কারণে যারা পাপী হবে, তাদের আমলনামা দেওয়া হবে বাম হাতে। তাদের আকাঙ্ক্ষা হবে, যদি আমলনামাই দেওয়া না হতো, তাহলে তারা শাস্তি থেকে বেঁচে যেত। সেই সাথে তাদের এই আকাঙ্ক্ষাও থাকবে যে, যদি তারা মাটি হয়ে মিশে যেতে পারত!

কেননা হাশরের মাঠে বিভিন্ন পশু-পাখিদেরও বিচার হবে। যারা দুনিয়ায় একে অন্যের সাথে অন্যায় করেছিল। তারা তাদের অন্যায়ের প্রতিশোধ নিবে এবং তাদের উভয়কেই মাটি করে দেওয়া হবে। তাই পাপীদের আফসোস হবে যদি তারা পশু-পাখিদের মতো মাটি হয়ে যেতে পারত, তাহলে তারাও নিষ্কৃতি পেত। অথচ পাপীদের শাস্তির কোনো শেষ সীমা থাকবে না। তারা চিরজীবী হবে এবং তারা অনবরত শাস্তি পেতেই থাকবে।

সুতরাং আমরা যারা নিজেদের মুমিন দাবি করি, তাদের আবশ্যিক কর্তব্য হলো পাপ ছেড়ে দিয়ে সৎ আমল করা। যাতে মৃত্যুর পর কোনো আফসোস করতে না হয়।

(৫) ঈমানদার না হওয়ার কারণে আফসোস: অনেক মুসলিমই জন্মগতভাবে মুসলিম হওয়ার কারণে ইসলাম, ঈমান, আমল, আক্বীদা ইত্যাদি সম্পর্কে জানার, বুঝার কিংবা যাচাইয়ের চেষ্টা করে না। তারা গতানুগতিকভাবেই মুসলিম থেকে যায়। ফলে তাদের ঈমান, আমলে শিরক-বিদআতের সংমিশ্রণ ঘটে। যা তাদেরকে ইসলাম থেকে বের করে দেয় তাদেরই অজান্তেই। এসব মানুষসহ যারাই পৃথিবীতে ইসলাম সম্পর্কে জেনে ঈমান আনতে পারেনি, তারা মৃত্যুর পর ক্বিয়ামতের মাঠে আফসোস করবে এভাবেই,﴿يَا لَيْتَنَا نُرَدُّ وَلَا نُكَذِّبَ بِآيَاتِ رَبِّنَا وَنَكُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ﴾ ‘হায়! যদি আমাদেরকে ফেরত পাঠানো হতো, তবে আমরা আমাদের রবের আয়াতসমূহ অস্বীকার করতাম না এবং আমরা মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত হতাম!’ (আল-আন‘আম, ৬/২৭)

অর্থাৎ যারাই বিভিন্ন কারণে আল্লাহর উপর ঈমান আনতে পারেনি, তারা সেদিন আফসোস করতে থাকবে এবং বলতে থাকবে, যদি আমাদের আবার দুনিয়ায় পাঠানো হতো, তাহলে আমরা অবশ্যই ঈমানদার হয়ে ফিরে আসতাম।

সুতরাং ঈমানদার হওয়া খুবই জরুরী ও অত্যাবশ্যকীয় বিষয়, যা আমরা এখনো দুনিয়ার বুকে বুঝতে পারছি না। শুধু মুসলিমের ঘরে জন্ম নিলেই ঈমানদার হওয়া যায় না। ঈমান জেনে, বুঝে বিশ্বাস এবং আমল করার বিষয়। সুতরাং প্রত্যেকেরই উচিত ইসলামকে জেনে, ঈমান এনে আমল করা।

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম, হাশরের মাঠে অধিকাংশ মানুষই বিভিন্ন কারণে আফসোস করতে থাকবে। যার মূল কারণই হলো সঠিকভাবে দলীলের ভিত্তিতে দ্বীন পালন না করা। গতানুগতিকভাবে দুনিয়াদারি করে দ্বীন-ধর্মের তোয়াক্কা না করা এবং পূর্বপুরুষদের অনুসরণ করে দ্বীন ইসলাম পালন করার কারণে মানুষদের হাশরের মাঠে আফসোসের শেষ থাকবে না। সুতরাং আমাদের প্রত্যেকের উচিত দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে জানা, যাচাই করা এবং সঠিক ইসলাম জেনেশুনে পালন করা। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন- আমীন!

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী

 পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।


[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/২২৯০।

Magazine