ভূমিকা:
মুসলিম উম্মাহ এক সময় ছিল জ্ঞানের আলোকবর্তিকা, ন্যায়বিচারের প্রতীক ও সভ্যতার পথপ্রদর্শক। কিন্তু বর্তমানে মুসলিমদের ভাঙন, অনৈক্য, দলাদলি ও বিভাজনের কারণে তারা বিশ্ব রাজনীতিতে প্রান্তিক হয়ে পড়েছে। এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে অমুসলিম শক্তিগুলো। তারা কৌশলে মুসলিমদের বিভক্ত করে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করছে।
১. ঐক্যের গুরুত্ব সম্পর্কে কুরআনের নির্দেশনা: আল্লাহ তাআলা বলেন, وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا ‘তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ (আলে ইমরান, ৩/১০৩)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ ‘নিশ্চয়ই মুসলিমরা পরস্পর ভাই ভাই’ (আল-হুজুরাত, ৪৯/১০)। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা পরস্পরের প্রতি হিংসা করো না, বিদ্বেষ পোষণ করো না এবং পেছনে কথা বলো না। তোমরা আল্লাহর বান্দা, ভাই ভাই হয়ে যাও’।[1]
২. ইতিহাসে মুসলিম ঐক্যের শক্তি ও ভাঙনের ফল:
(ক) খুলাফায়ে রাশেদীনের খেলাফত: খুলাফায়ে রাশেদীনের সময় মুসলিমরা রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিকভাবে শক্তিশালী ছিল। ঐক্যের ফলেই ইসলাম ৩০ বছরের মধ্যে আরব উপদ্বীপ ছাড়িয়ে পারস্য, বাইজান্টাইন ও মিসর পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
(খ) আন্দালুস (স্পেন): প্রথমে মুসলিমরা ঐক্যবদ্ধভাবে ৭১১ সালে আন্দালুস জয় করে। পরবর্তীতে রাজ্য বিভাজন, মুসলিম রাজাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব (Taif States) এবং খ্রিষ্টানদের সহায়তা চাওয়া মুসলিম স্পেনের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।[2]
৩. বর্তমান বাস্তবতায় মুসলিম উম্মাহর অনৈক্য ও তার পরিণতি:
(ক) মাযহাবগত ও দলীয় বিভাজন: শীআ-সুন্নী বিভাজন, মাযহাব ও মতবাদের নামে একে অপরকে অবিশ্বাস করা হচ্ছে। এর ফলে মুসলিম দেশে গৃহযুদ্ধ, হিংসা ও রক্তপাত বেড়েছে। যেমন- ইরাক, ইয়ামান, লেবানন, বাহরাইন প্রভৃতি দেশ।[4]
(খ) রাজনৈতিক বিভক্তি: ওআইসি (OIরাযিয়াল্লাহু আনহু) এর মতো সংগঠন থাকলেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়। যেমন- ফিলিস্তীন, রোহিঙ্গা, কাশ্মীর ইস্যুতে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর দ্বৈতনীতি।
(গ) সাংস্কৃতিক ও মানসিক বিভাজন: পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব, মিডিয়া আগ্রাসন এবং ইসলামী ঐতিহ্য থেকে দূরে সরে যাওয়া মুসলিমদেরকে আত্মপরিচয়ের সংকটে ফেলেছে।
৪. অমুসলিমদের কীভাবে লাভ হচ্ছে?
(ক) রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ: বিভক্ত মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ বা অভ্যন্তরীণ বিরোধের অজুহাতে অমুসলিম শক্তিগুলো সামরিক ও কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ করে। যেমন- আমেরিকার ইরাক আক্রমণ (২০০৩), সিরিয়ায় রাশিয়া ও আমেরিকার হস্তক্ষেপ।
(খ) অর্থনৈতিক শোষণ: মুসলিম দেশগুলোর তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ব্যবহার করে অমুসলিম বহুজাতিক কোম্পানিগুলো লাভ করছে; অথচ মুসলিম দেশগুলো নিজেরাই পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী।
(গ) মিডিয়া যুদ্ধ: ইসলামের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর জন্য পশ্চিমা মিডিয়াগুলো সক্রিয়। মুসলিমদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও বিভাজন তৈরি করতে ‘ইসলামোফোবিয়া’ ব্যবহার করা হচ্ছে।[5]
৫. মুসলিম উম্মাহর ঐক্য পুনর্গঠনে করণীয়:
(ক) ইসলামী শিক্ষার প্রচার: মসজিদ, মাদরাসা ও মিডিয়ার মাধ্যমে ইসলামের একতা ও মাহাত্ম্যের বার্তা ছড়াতে হবে।
(খ) মাযহাবগত সহনশীলতা: মতভেদ থাকবেই, কিন্তু তা যেন বিভাজনের কারণ না হয়। পারস্পরিক শ্রদ্ধা বজায় রেখে সংলাপ ও বোঝাপড়া বাড়াতে হবে।
(গ) তরুণদের জাগরণ: নতুন প্রজন্মকে ঐতিহাসিক শিক্ষা ও নেতৃত্ব গড়ার অনুপ্রেরণা দিতে হবে। তাদের প্রযুক্তি, নেতৃত্ব ও ইসলামী মূল্যবোধসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে হবে।
(ঘ) OIC ও মুসলিম সংস্থাগুলোর পুনর্গঠন: এই সংস্থাগুলোর কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে একটি অভিন্ন নীতি প্রণয়ন করতে হবে।
উপসংহার:
মুসলিম উম্মাহর ভেতরে ঐক্য ফিরিয়ে আনাই বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জরুরী চ্যালেঞ্জ। ঐক্য ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয় এবং বিভক্তি মানেই পরাজয়। যেমনটা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা সম্মিলিতভাবে থাকো, কেননা বিভক্তি শয়তানের কাজ’।[6]
আজ আমাদের সামনে দুটি পথ— বিভাজনে ধ্বংস হওয়া কিংবা ঐক্যে আবারও সম্মান অর্জন করা। আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন- আমীন!
মো. শাহাবুদ্দিন
সহকারী শিক্ষক, বেল্লারমাঠ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সাজিয়ালি, যশোর।
[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৬৪।
[2]. Hugh Kennedy, Muslim Spain and Portugal, (Routledge, 1996); Ibn Khaldun, Muqaddimah.
[3]. David Fromkin, A Peace to End All Peace, 1989; Ottoman Archives and League of Nations records (1919–1924).
[4]. Vali Nasr, The Shia Revival: How Conflicts within Islam Will Shape the Future.
[5]. Edward Said, Covering Islam: How the Media and the Experts Determine How We See the Rest of the World.
[6]. আবূ দাঊদ, হা/৪৫৯৭।
