সমাজে জাল এবং যঈফ হাদীছের প্রচলন ছাহাবী পরবর্তী সময় থেকেই শুরু হয়। ফলে জাল ও যঈফ হাদীছের প্রচার-প্রসার ঘটে বিভিন্ন জায়গায়। তাই ছাহাবী, তাবেঈ এবং তাবে তাবেঈগণ জাল ও যঈফ হাদীছের ব্যাপারে খুবই সজাগ ছিলেন এবং সেইসাথে তাঁরা এই ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। দ্বীন ইসলামের ক্ষতি সাধন এবং উম্মাহর ঐক্য বিনষ্টের একটি অন্যতম কারণ হিসেবেও সমাজে জাল ও যঈফ হাদীছ দায়ী। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে সংক্ষিপ্ত পরিসরে এ বিষয়ে আলোচনার প্রয়াস পাব ইনশা-আল্লাহ।
যঈফ হাদীছের পরিচয়:
ইবনে ছালাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন,كُلُّ حَدِيثٍ لَمْ يَجْتَمِعْ فِيهِ صِفَاتُ الْحَدِيثِ الصَّحِيحِ، وَلَا صِفَاتُ الْحَدِيثِ الْحَسَنِ الْمَذْكُورَاتُ فِيمَا تَقَدَّمَ، فَهُوَ حَدِيثٌ ضَعِيفٌ. ‘যেসব হাদীছে পূর্বে উল্লেখিত ছহীহ ও হাসান হাদীছের বৈশিষ্ট্যসমূহ সন্নিবেশিত হয়নি, তাকে যঈফ হাদীছ বলে’।[1] তায়সীরু মুছত্বলাহিল হাদীছ-এর লেখক ড. মাহমূদ ত্বহহান রাহিমাহুল্লাহ বলেন, هَـوَ مَـا لَـمْ يَـجْـمَـعْ صِـفَـةَ الْحَسَنِ بِـفَـقْـدِ شَـرْطٍ مِـنْ شُـرُوطِـهِ ‘যে হাদীছের মধ্যে হাসান হাদীছের শর্তসমূহের কোনো একটি শর্ত ছুটে যাওয়ার কারণে হাসান হাদীছের বেশিষ্ট্য পাওয়া না যায়, তাকে যঈফ হাদীছ বলে’।[2]
যঈফ হাদীছ বর্ণনার হুকুম:
যঈফ হাদীছ বর্ণনার হুকুমের ক্ষেত্রে উলামায়ে কেরামের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। বর্ণনা জায়েয হওয়ার ক্ষেত্রে ইবনে হাজার আসক্বালানী রাহিমাহুল্লাহ তিনটি শর্ত আরোপ করেছেন— (১) যঈফ হাদীছটি মারাত্মক পর্যায়ের যঈফ হবে না, (২) যঈফ হাদীছটি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ মনে করে আমল করা যাবে না এবং (৩) যঈফ হাদীছটি শরীআতের কোনো আমলের অনুগামী হবে।[3]
তবে এক্ষেত্রে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ যুগশ্রেষ্ঠ আলেম শায়খ ইমাম নাছিরুদ্দীন আলবানী রাহিমাহুল্লাহ বেশ কঠোরতা আরোপ করে আরো কয়েকটি নীতিমালা পেশ করেছেন তাঁর লিখিত ‘তামামুল মিন্নাহ ফিত তা‘লীক্বে আলা ফিক্বহিস সুন্নাহ’ কিতাবে। তিনি বলেছেন—
(খ) ফাযায়েলে আমলের ক্ষেত্রে যঈফ হাদীছ গ্ৰহণযোগ্য কিনা সেই ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে মতানৈক্য বিদ্যমান। তবে কতিপয় আলেমদের কাছে ফাযায়েলের ক্ষেত্রে যঈফ হাদীছের উপর আমল করা জায়েয। কিন্তু অধিকাংশ আলেমদের মতে কোনোমতেই যঈফ হাদীছের উপর আমল করা যাবে না। সেজন্য তাঁরা কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন।
(গ) যঈফ হাদীছের ক্ষেত্রে বলা যাবে না রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন অথবা তাঁর থেকে বর্ণিত হয়েছে, এই জাতীয় শব্দ ব্যবহার করা নিষেধ। শুধু ব্যবহার করতে পারবে ছীগাহে তামরীয তথা মাজহূলের ছীগাহ (কর্তাকে উহ্য রেখে বর্ণনা করা)।
জাল হাদীছের পরিচয়:
ড. মাহমূদ ত্বহহান রাহিমাহুল্লাহ বলেন,هُوَ الْكَذِبُ الْمُخْتَلَقُ الْمَصْنُوعُ الْمَنْسُوبُ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দিকে সম্পর্কিত বানোয়াট মিথ্যা হাদীছকে মাওযূ বা জাল হাদীছ বলে’।[6]
সকল আলেমের মতে জাল হাদীছ বর্ণনা করা হারাম। কেউ যদি জেনেশুনে জাল হাদীছ বর্ণনা করে, নিঃসন্দেহে সে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কঠোর হুঁশিয়ারি বাণীর আওতাভুক্ত হবে। কাবীরা গুনাহগার হবে এবং ইসলামী শরীআতের সাথে চরম ধৃষ্টতা প্রদর্শনকারী ব্যক্তিতে পরিণত হবে। তবে মানুষকে সতর্ক করার জন্য বলতে পারে।
হাদীছ কি ছহীহ, যঈফ, জাল হয়?
হাদীছ কি ছহীহ, যঈফ, জাল হয়— এ প্রশ্ন শুধু ‘আম জনতার নয়, বরং এ প্রশ্ন ‘আম জনতা থেকে শুরু করে এক শ্রেণির আলেমের মধ্যে এটা ঘুরপাক খায়। তারাও বলে, হাদীছ আবার যঈফ, জাল হয়? তাদের যুক্তি হলো, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সব কথাই গ্ৰহণযোগ্য ও অনুসরণীয়। তাঁর কথাতে কোনো দুর্বলতা নেই। বরং তিনি তাঁর গোটা জীবনে হক্ব বা সত্য কথা বলেছেন। তিনি কখনো মিথ্যা কিংবা দুর্বল কথা বলেননি। কথাটি নিঃসন্দেহে সঠিক যে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুখনিঃসৃত কথা বিশুদ্ধ। তাঁর কথার মধ্যে কোনো মিথ্যার লেশমাত্র পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু যখন কেউ স্বার্থের লোভ, কিংবা গোত্রপ্রীতি, নিজের নাম কামানোর উদ্দেশ্য করে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীছের সাথে নিজের বানানো কথা মিশ্রণ করে, তাহলে তো সেই কথা জাল হবেই। আদৌ সেই কথা কি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা, ভাষ্য বলে গণ্য হবে? নিঃসন্দেহে জবাব হবে— না। উদাহরণস্বরূপ, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছহীহ হাদীছে বলেছেন, أَنَا خَاتَمُ النَّبِيِّينَ لَا نَبِيَّ بَعْدِي ‘আমি সর্বশেষ নবী। আমার পরে আর কোনো নবী নেই’।[7] এই হাদীছটি বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু এই হাদীছকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণির ভণ্ড নবী দাবিদার ও তার দোসররা জাল হাদীছ তৈরি করে এই বিশুদ্ধ হাদীছের সাথে মিশ্রণ করে তাদের কল্পিত বানানো কথা— إلا أن يشاء الله ‘তবে যদি আল্লাহ চান’[8]— এই বক্তব্য ওই ছহীহ হাদীছের সাথে লাগিয়ে তারা নবী দাবিদারের পথকে উন্মুক্ত করতে ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালায়। জনসাধারণের বিবেককে নাড়া দেওয়ার মতো মূল জায়গায় হাত দিয়েছে তারা। কারণ হলো আল্লাহ চাইলে কী না সম্ভব। তিনি চাইলে তো সব সম্ভব। নবী-রাসূলও আবার পাঠানো সম্ভব। এভাবে মানুষকে প্রতারিত করার হীন প্রচেষ্টা চালানোর জন্য জাল হাদীছ তৈরি করে। ঠিক অনুরূপভাবে আরেকটি হাদীছ লক্ষণীয়—النَّظَرُ إِلَى وَجْهِ الْمَرْأَةِ الْحَسْنَاءِ وَالْخُضْرَةِ يَزِيدَانِ فِي الْبَصَرِ ‘সুন্দরী নারী ও সবুজ উদ্ভিদের দিকে দৃষ্টিপাত দৃষ্টিশক্তি বাড়িয়ে দেয়’।[9]
এই হাদীছ যে মিথ্যা, তা বলার কোনো অবকাশ রাখে না। মিথ্যা হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, নারীর দিকে তাকালে চোখের দৃষ্টি বৃদ্ধি পায়। অথচ ইসলামী শরীআতে বেগানা নারীর দিকে তাকানো হারাম। হঠাৎ একবার চোখ পড়লে দ্বিতীয়বার দৃষ্টি দিতে নিষেধ করা হয়েছে। কুরআন-হাদীছে বিধানও আছে। অথচ এই হাদীছ কি অদ্ভুত রকমের কথা বলছে। তা তো কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষও মানতে পারবে না।
হাদীছে জাল, যঈফ এবং এক শ্রেণির প্রতারক, মিথ্যুকের আবির্ভাব হবে বলেই রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মারাত্মকভাবে কঠোর হুঁশিয়ারি বাণী উচ্চারণ করেছেন তাঁর জীবদ্দশায়। খোদ শীআ সম্প্রদায় বহু হাদীছ জাল তৈরি করে সমাজে ছড়িয়ে দিয়েছে। তাহলে আপনি কীভাবে সব হাদীছকে ছহীহ-এর মানে রেখে আমল করবেন? নিঃসন্দেহে হাদীছের মানের তারতম্য বিদ্যমান। তাই হাদীছের মান জাল-যঈফ হয়— এটি নিঃসন্দেহে মানতে হবে, গ্ৰহণ করতে হবে। নইলে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বিশাল কঠোর হুঁশিয়ারি বিবরণ দিতেন না। দুনিয়ার জীবনে যেমন ভালোমন্দ যাচাই-বাছাই করে কিনতে সিদ্ধান্ত নেন, ঠিক তেমনি ইসলামী শরীআতে হাদীছের মধ্যে বিভিন্ন দল উপদল, গোত্রের আর শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে অনেকেই অনেক সময় মিথ্যা, জাল হাদীছ তৈরি করে সমাজে ছড়িয়ে দেয়। সুতরাং একথা সুস্পষ্ট যে, হাদীছ জাল-যঈফ হয়।
জালহাদীছ তৈরির কারণ:
(১) রাজনৈতিক কারণ: জাল হাদীছ তৈরির ক্ষেত্রে অন্যতম একটি কারণ হলো রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে শীআ সম্প্রদায়। তারা বহু হাদীছ জাল তৈরি করে সমাজে ছড়িয়ে দেয়। তারা মূলত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর খেলাফত ব্যবস্থা ও আহলে বাইতকে কেন্দ্র করে হাদীছ জাল করে। আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর খেলাফতকালে ইসলামের রাজধানী ইরাকের কূফা নগরীতে স্থানান্তরিত হয়। আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মৃত্যুর পর তারা তাঁর প্রশংসা বৃদ্ধি করার জন্য অসংখ্য মিথ্যা হাদীছ তৈরি করে।
তাদের জাল হাদীছের সীমা দেখলে আশ্চর্য হতে হয়। যেমন- খুমে কুয়ার ঘটনা। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ্জ থেকে ফিরে আসার পথে খুম কুয়া নামক একটি জায়গায় লক্ষাধিক ছাহাবীর সামনে আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাত ধরে বলেন,هَذَا وَصِيِّي وَأَخِي وَالْخَلِيفَةُ مِنْ بَعْدِي فَاسْمَعُوا لَهُ وَأَطِيعُوا ‘ইনি হলেন আমার অছিয়তপ্রাপ্ত ব্যক্তি, আমার ভাই এবং আমার পরবর্তী খলীফা। অতএব তোমরা তাঁর কথা শুনবে এবং আনুগত্য করবে’।[10]
পক্ষান্তরে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বিরোধিতায় হাদীছ বানায়, إِذَا رَأَيْتُمْ مُعَاوِيَةَ عَلَى مَنْبَرِي فَاقْتُلُوهُ ‘যখন তোমরা মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে আমার মিম্বারের উপর দেখবে, তখন তোমরা তাঁকে হত্যা করবে’।[11]
(২) বক্তা ও গল্পকার: বক্তা ও গল্পকারের মাধ্যমে জাল হাদীছ তৈরি হয়। তারা মানুষের কাছে বাহবা, সুনাম-সুখ্যাতি অর্জনের জন্য বিভিন্ন সময়ে জাল হাদীছ তৈরি করে সমাজে ছড়িয়ে দেয়। অর্থকড়ির লোভ, দুনিয়া উপার্জন ছাড়াও তারা প্রসিদ্ধি লাভের আশায় এমন হীন কাজ করতে মোটেও দ্বিধাবোধ করেনি। উল্লেখযোগ্য একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা— ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ ও ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন রাহিমাহুল্লাহ এক মসজিদে ছালাত আদায় করে দেখেন, একজন লোক জনগণকে একত্রিত করে হাদীছ বর্ণনা করে শুনাচ্ছে আর বলছে, এটা আহমাদ ইবনু হাম্বল ও ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন বর্ণনা করেছেন। তারা এটা শুনে পরস্পরের প্রতি তাকিয়ে বলেন, আপনি কি এটা ওনাকে বর্ণনা করে শুনিয়েছেন। উভয়ের জবাব— না। তখন তাঁরা ঐ ব্যক্তিকে ডেকে বলেন, আমি আহমাদ ইবনু হাম্বল ও আমি ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন, কই আমরা তো তোমাকে এই হাদীছ বর্ণনা করে শুনাইনি। তখন লোকটি বলল, আমি এতদিন ভেবেছিলাম আপনারা অনেক বড় জ্ঞানী, এখন তো দেখি আপনারা অনেক বোকা। লোকটি বলল, আমি ১৬ জন আহমাদ ও ইয়াহইয়া থেকে হাদীছ বর্ণনা করেছি। আপনারা ছাড়া কি দুনিয়াতে আহমাদ, ইয়াহইয়া নাই?[12]
(৩) আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য: আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে কতিপয় পরহেজগার, ইবাদতগুজার ব্যক্তি মানুষকে আল্লাহমুখী, পরকালমুখী করার জন্য জাল হাদীছ তৈরি করে। উদ্দেশ্য মানুষকে দুনিয়াবিমুখ করে আখেরাতমুখী করা ও ইবাদতে নিয়োজিত করা। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো— মাইসারা ইবনু আবদে রব্বী-এর ঘটনা। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো— এসব হাদীছ কোথায় থেকে এসেছে, কোথায় থেকে বর্ণনা করেন? যে অমুক সূরা পড়লে এত ছওয়াব, অমুক সূরা পড়লে এত প্রতিদান। তিনি বলেন, আমি মানুষকে আগ্ৰহী করার জন্য এসব বানিয়েছি।[13]
(৪) মাযহাবের পক্ষাবলন্বন করা: মাযহাবকে কেন্দ্র করে হাদীছ জাল তৈরি করা হয়। মাযহাবী কোন্দল, গোঁড়ামি এবং ইমামদের নিয়ে অতিভক্তি, সম্মান, শ্রদ্ধা করে তাঁরা এক ইমামের উপর আরেক ইমাম, এক মাযহাবের উপর আরেক মাযহাবকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য জাল হাদীছ তৈরি করে। এক্ষেত্রে শীআরাও পিছিয়ে ছিল না। শীআরা বলে, عَلِيٌّ خَيْرُ الْبَشَرِ مَنْ شَكَّ فِيهِ كَفَرَ ‘আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু হলেন মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। যে ব্যক্তি এই ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করবে, সে কাফের হয়ে যাবে!’[14]
ইমাম আবূ হানীফা রাহিমাহুল্লাহ-এর প্রতি অন্ধভক্তির জেরে হাদীছ বানিয়েছে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমার উম্মাতের মধ্যে মুহাম্মাদ ইবনু ইদরীস (শাফেঈ) নামে একজনের আবির্ভাব হবে। সে ইবলীসের চেয়েও ক্ষতিকর হবে’।[15] ‘আর আবূ হানীফা নামে একজন হবে যিনি হলেন আমার উম্মাতের সূর্য সমতুল্য’।[16]
তারা আরেক ধাপ এগিয়ে জাল হাদীছ তৈরি করে বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘সকল নবী আমার কারণে গর্ব করে থাকে এবং আমি আবূ হানীফা রাহিমাহুল্লাহ-এর কারণে গর্ব করে থাকি’।[17] এভাবে মাযহাবপ্রীতি, এক মাযহাবের উপর আরেক মাযহাবকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য জাল হাদীছ তৈরি করা হয়।
এই সকল হাদীছ পেশ করে মোল্লা আলী কারী হানাফী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘মুহাদ্দিছগণ সকলেই এই হাদীছগুলোকে জাল বলে আখ্যায়িত করেছেন’।[18]
(৫) ফিক্বহী বিরোধ: হাদীছ জাল তৈরির ক্ষেত্রে আরেকটি কারণ হলো, ফিক্বহী বিরোধ। ফিক্বহের ক্ষেত্রে মাযহাব অনুসরণকারীদের পারস্পরিক বিরোধের জেরে কিছু ব্যক্তি হাদীছ জাল তৈরি করে। যেমন—
(ক) হানাফী মাযহাবে ছালাতে রফউল ইয়াদায়েন আমল করা হয় না। অথচ এই আমল বাকী তিন মাযহাবে প্রসিদ্ধ। তাই হানাফী মাযহাবের ফিক্বহ রক্ষায় হাদীছ বানানো হয়। যেমন- مَنْ رَفَعَ يَدَيْهِ فِي الصَّلَاةِ فَلَا صَلَاةَ لَهُ ‘যে ব্যক্তি ছালাতে রফউল ইয়াদায়েন করবে, তার ছালাত নেই’।[19]
(খ) مَنْ قَرَأَ خَلْفَ الْإِمَامِ مُلِئَ فُوْهُ نَارًا ‘যে ব্যক্তি ছালাতে ইমামের পিছনে কিছু পাঠ করবে, তার মুখ জাহান্নামের আগুনে ভর্তি করা হবে’।[20]
(৬) সরকারের নৈকট্য অর্জন: সরকারের নৈকট্য অর্জনের জন্য কতিপয় দুর্বল ঈমানের অধিকারী ব্যক্তি জাল হাদীছ তৈরি করে। এক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ ঘটনা হলো— এক সময় গিয়াছ ইবনু ইবরাহীম নামে একজন আলেম আব্বাসীয় রাজা মাহদী-এর দরবারে প্রবেশ করে দেখেন যে, তিনি কবুতর নিয়ে খেলছেন। সঙ্গে সঙ্গে ওই আলেম একটি মাশহূর হাদীছ, لَا سَبَقَ إِلَّا فِي نَصْلٍ، أَوْ خُفٍّ، أَوْ حَافِرٍ ‘প্রতিযোগিতা নেই তিনটি বিষয়ে ছাড়া। তির নিক্ষেপ, উট চালানো এবং ঘোড়া সওয়ারীতে’।[21] ওই আলেম হাদীছের শেষে أَوْ جَنَاحٍ ‘অথবা পাখি’ শব্দটি যোগ করে দেন। আর তিনি বর্ণনা করে শুনান।
এটা শুনে বাদশাহ মাহদী তাকে তিরস্কার করেন এবং কবুতর যবেহ করার নির্দেশ দেন।
আল্লাহ তাআলা জাল হাদীছ বর্ণনা করা থেকে আমাদের রক্ষা করুন- আমীন!
মো. মাযহারুল ইসলাম
দাওরায়ে হাদীছ, মাদরাসা দারুস সুন্নাহ, মিরপুর, ঢাকা; শিক্ষক, হোসেনপুর দারুল হুদা সালাফিয়্যাহ মাদরাসা, খানসামা, দিনাজপুর।
[1]. মুক্বাদ্দমা ইবনে ছালাহ, পৃ. ২০।
[2]. তায়সীরু মুছত্বলাহিল হাদীছ, পৃ. ৫১।
[3]. প্রাগুক্ত।
[4]. ছহীহ মুসলিম, ‘মুক্বাদ্দমা’ পৃ. ৬।
[5]. আব্দুল আযীয ইবনে আব্দুর রহমান আল-উছাইম, তাহকীকুল কওল বিল আমালি বিল হাদীছিয যঈফ, পৃ. ২৫।
[6]. তায়সীরু মুছত্বলাহিল হাদীছ, পৃ. ১১১।
[7]. আবূ দাঊদ, হা/৪২৫২, হাদীছ ছহীহ।
[8]. আদ-দাখীল ফিত তাফসীর, পৃ. ৩৩১; আল-ফাওয়াইদুল মাজমূআহ, পৃ. ৩২০।
[9]. আবূ নুআইম, হিলইয়াতুল আওলিয়া, ৩/২০১-২০২; দায়লামী, ৪/১০৬।
[10]. আল-মানারুল মুনীফ, পৃ. ৫৭।
[11]. সিলসিলা যঈফা, হা/৪৯৩০।
[12]. ইবনুল জাওযী, আল মাওযূআত, ১/২১-২২।
[13]. তাদরীবুর রাবী, ১/২৮৩।
[14]. তায়সীরু মুছত্বলাহিল হাদীছ, পৃ. ৯১।
[15]. শারহু কিতাবি নাকদি মুতুনিস সুন্নাহ, ২/২।
[16]. তারীখু বাগদাদ, ৫/৩০৮।
[17]. আদ-দুররুল মুখতার, ১/৫২।
[18]. মাওযূআতে কাবীর, পৃ. ২৭।
[19]. ইবনুল ক্বাইয়িম, রাফউল ইয়াদায়েন ফিছ ছালাত, ১/৩।
[20]. ইবনু তাহির, আত-তাযকিরাহ, পৃ. ৯৩।
[21]. আবূ দাঊদ, হা/২৫৭৪।