কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

মাযারে দান-ছাদাক্বা : ইসলাম কী বলে?

post title will place here

ভারতীয় উপমহাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা মানতের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মাযারে প্রচুর পরিমাণ দান-ছাদাক্বা করে থাকে। মাযারের এই মানত ও দান করা সম্পর্কে ইসলামী কী বলে? তা আমরা আজ জানার চেষ্টা করব।

মানত কী?

শরীআতের পরিভাষায় মানত হলো নিজের উপর এমন আমল অবধারিত করে নেওয়া, যা তার উপর অবধারিত ছিল না।[1] মানত হচ্ছে আল্লাহ বা সৃষ্টিকর্তা কিংবা কারো নিকটে নিজেদের উদ্দেশ্য পূরণের উদ্দেশ্যে কোনো দৈহিক ইবাদত বা টাকা-পয়সা, পশু ইত্যাদি দান করার নিয়্যত করা। মোটকথা, নিজেদের বিপদে-আপদে উদ্ধার কিংবা ভবিষ্যৎ কোনো উদ্দেশ্য পূরণ ইত্যাদির জন্য অর্থ-সম্পদ পশু, দান করা কিংবা কোনো ইবাদতের নিয়্যত করাই হচ্ছে সহজ কথায় মানত। 

ইসলামে মানতের বিধান :

মানতের বিষয়টি সুদীর্ঘকাল থেকেই পৃথিবীতে প্রচলিত। শুধু আল্লাহর উদ্দেশ্যে যেকোনো ইবাদত, দৈহিক ইবাদত বা দান-ছাদাক্বা ইত্যাদি করার ব্যাপারে শর্তহীন মানত করা উত্তম এবং শর্তযুক্ত মানত করা মাকরূহ। উভয় অবস্থায় মানত করলে তা অবশ্যই পূরণ করতে হবে। 

সুতরাং আল্লাহর উদ্দেশ্যে শর্তহীন মানত করা ভালো। আর যেহেতু মানতে সৎ আমল করা নিজের উপর আবশ্যক করে নেওয়া হয়, এজন্য আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো উদ্দেশ্যে মানত করা সরাসরি শিরক। মানতের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সরাসরি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনু উমার রযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন আমাদের মানত করতে নিষেধ করেছেন। আর বলেছেন, মানত কোনো কিছুকে ফেরাতে পারে না। তবে মানতের মাধ্যমে কৃপণ ব্যক্তির সম্পদ বের করা হয়।[2] অন্য একটি হাদীছে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মানত আদম সন্তানকে এমন কিছু এনে দিতে পারে না যা তাক্বদীরে নির্ধারিত নেই অথচ সে যে মানতটি করে তাও আমি তাক্বদীরে নির্ধারিত করে দিয়েছি যাতে এর মাধ্যমে কৃপণের নিকট হতে (অর্থ-সম্পদ) বের করে নিই’।[3] 

উপরিউক্ত হাদীছ থেকে শিক্ষা হচ্ছে, শর্তযুক্ত মানত করা কখনোই সমীচীন নয়। মানতের মাধ্যমে বান্দা একপ্রকার আল্লাহর সাথে বিনিময়ের শর্ত যুক্ত করে দেয়। যেমন— যদি আমার এই লাভ হয়, তাহলে আমি এই টাকাটা দান করব। তাহলে ঐ কাজ না হলে টাকা দান করব না।

মানত কি তাক্বদীর পরিবর্তন করে?

মানুষের তাক্বদীরে কী আছে, কী নেই তা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। তিনি সৃ‌ষ্টির আগেই তাক্বদীর লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। মানতে সন্তান কামনা, বিপদ উদ্ধার, আয় উন্নতি ইত্যাদি উদ্দেশ্য নেওয়া হয়। অথচ এসব কিছু তাক্বদীরে পূর্ব থেকেই নির্ধারিত আছে। আগের উল্লিখিত হাদীছ অনুযায়ী রাসূল a-এর শিক্ষা হচ্ছে মানত কখনোই কারো তাক্বদীর পরিবর্তন করে না।

মাযারে দান কার উপকারে আসে?

সাধারণ মানুষ মাযারে টাকা-পয়সা দিলেও সেই অর্থ কখনোই কবরে শায়িত ব্যক্তির উপকারে আসে না। কেননা কবরে কারোরই অর্থ-সম্পদের প্রয়োজন নেই। তাই এসব দানের টাকা মূলত মাযার তদারককারীদের উপকারে আসে। তারাই হচ্ছে ঐ টাকার মালিক। তারা সেই টাকার কিছু অংশ বার্ষিক ওরশের আয়োজন করে কিছু মানুষকে খাওয়ায়, কিছু মাযার উন্নয়নে খরচ করে, আর সিংহভাগ টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়!

মানত যখন হারাম বা শিরক :

আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উদ্দেশ্যে বা অন্য কারো সন্তুষ্টির জন্য মানত করা সরাসরি শিরক। উপমহাদেশে ছূফীরা যিয়ারত এবং মানতের উদ্দেশ্যে মাযারে গিয়ে থাকে। তারা নিজেদের স্বার্থ লাভের জন্য মানতকে অর্থের মানদণ্ডে রূপান্তরিত করে এবং আল্লাহ ব্যতীত কবরে শায়িত ওলী-আওলিয়ার দিকে ফিরিয়ে দেয়। যার ফলে সাধারণ মানুষ আল্লাহর জন্য বা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দৈহিক ইবাদত মানত করা ছেড়ে দিয়ে, তাদের কথিত ওলী-আওলিয়ার মাযারে টাকা-পয়সা, অর্থ-সম্পদ, পশু ইত্যাদি মানত করা শুরু করে। আল্লাহকে ছেড়ে কবরে শায়িত ব্যক্তির সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে মানতের কারণে ছূফীরা সুস্পষ্ট শির্কে লিপ্ত হচ্ছে, যা কখনোই ইসলামী শরীআতে জায়েয নেই। আল্লাহ বলেন, وَإِذْ قَالَ لُقْمَانُ لِابْنِهِ وَهُوَ يَعِظُهُ يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ ‘যখন লুক্বমান তাঁর পুত্রকে উপদেশ দিয়ে বললেন, হে বৎস! আল্লাহর সাথে শরীক করো না। নিশ্চয় আল্লাহর সাথে শরীক করা মহাঅন্যায়’ (লুক্বমান, ৩১/১৩)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাঁর সাথে শিরক করার গোনাহ ক্ষমা করেন না। এছাড়া যে কোনো পাপ যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করে দেন’ (আন-নিসা, ৪/৪৮)

সুতরাং সর্বাবস্থায় বান্দাদের একমাত্র আল্লাহর কাছেই চাইতে হবে; একমাত্র তাঁরই জন্য ইবাদত-বন্দেগী করতে হবে। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো মৃত কবরবাসী পীর, মুর্শিদ, ওলী-আওলিয়া কখনোই কারো উপকার বা অপকার করতে পারে না। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এমন কোনো শিক্ষা নেই যে, মৃত ব্যক্তি কারো কথা শুনে তার উপকার বা অপকার করতে পারে। অতএব, মানতের মাধ্যমে কবরবাসীর জন্য টাকা-পয়সা, পশু ইত্যাদি দান-ছাদাক্বা করা হারাম এবং শিরক। 

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, ইসলামে মানত করা গেলেও তা শুধু আল্লাহর নামে, আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মানত করতে হবে। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে, উদ্দেশ্যে বা সন্তুষ্টির জন্য মানত করা যাবে না। সেই সাথে মানতের উদ্দেশ্যে মাযারে দান করা হলেও তা দান হিসাবে গ্রাহ্য হবে না। সুতরাং মৃত ব্যক্তিকে খুশী করার জন্য অথবা মৃত ব্যক্তিকে অসীলা হিসেবে গ্রহণ করে মাযারে মানত করা কখনোই ইসলামসম্মত নয়। বরং এটি সুস্পষ্ট শিরক। মহান আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন- আমীন!

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী

 পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।

[1]. আল-ফিক্বহুল মুইয়াসসার ফী যওইল কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ, পৃ. ৩৯২।

[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৬৩৯।

[3]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৬০৯, ৬৬৯৪; ছহীহ মুসলিম, হা/১৬৪০; আহমাদ, হা/৯৩৫১।

Magazine