ঘুম আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَمِنْ آيَاتِهِ مَنَامُكُمْ بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَابْتِغَاؤُكُمْ مِنْ فَضْلِهِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَسْمَعُونَ ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে রাতে ও দিনে তোমাদের নিদ্রা এবং আল্লাহর অনুগ্রহ অন্বেষণ। নিশ্চয়ই এতে বহু নিদর্শন রয়েছে সে সম্প্রদায়ের জন্য, যারা শোনে’ (আর-রূম, ৩০/২৩)। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে ঘুমের গুরুত্ব ও ঘুমের আদব বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করা হলো।
ঘুমের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা:
ঘুমের গুরুত্ব অপরিসীম। ঘুমের মাধ্যমে ক্লান্তি দূর হয়। মহান আল্লাহ বলেন, وَهُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ اللَّيْلَ لِبَاسًا وَالنَّوْمَ سُبَاتًا وَجَعَلَ النَّهَارَ نُشُورًا ‘তিনিই তোমাদের জন্য রাতকে করেছেন আবরণ, নিদ্রাকে করেছেন ক্লান্তি দূরকারী আর দিনকে করেছেন (নিদ্রারূপী সাময়িক মৃত্যুর পর) আবার জীবন্ত হয়ে উঠার সময়’ (আল-ফুরক্বান, ২৫/৪৭)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَمِنْ رَحْمَتِهِ جَعَلَ لَكُمُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ لِتَسْكُنُوا فِيهِ وَلِتَبْتَغُوا مِنْ فَضْلِهِ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ ‘আর তাঁর অনুগ্রহে তিনি তোমাদের জন্য রাত ও দিন করেছেন, যাতে তোমরা বিশ্রাম নিতে পারো, তাঁর অনুগ্রহ সন্ধান করতে পারো এবং যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা আদায় করতে পারো’ (আল-ক্বাছাছ, ২৮/৭৩)। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন, وَجَعَلْنَا نَوْمَكُمْ سُبَاتًا - وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ لِبَاسًا ‘আমরা তোমাদের ঘুমকে করেছি ক্লান্তি দূরকারী, রাত্রিকে করেছি আবরণস্বরূপ’ (আন-নাবা, ৭৮/৯-১০)।
নিদ্রার সবচেয়ে বড় সুফল হিসাবে এখানে বলা হয়েছে, سُبَاتًا বা ক্লান্তি দূরকারী। এই ক্লান্তি দৈহিক ও মানসিক উভয়টিই হতে পারে। ব্যথাতুর ব্যক্তি ঘুমিয়ে গেলে ব্যথা ভুলে যায়। শোকাতুর ব্যক্তি ঘুমিয়ে গেলে শোক ভুলে যায়। ঘুম থেকে উঠলে দেহমন তরতাজা হয়ে উঠে। আধুনিক বিজ্ঞান বলছে, কমপক্ষে ছয় মিনিট গভীর ঘুম হলে ক্লান্তি দূর হয়ে নবজীবন লাভ হয়। তাই ঘুম আল্লাহ প্রদত্ত এক অমূল্য মহৌষধ।[1] ঘুম নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাত। ইসলাম যেমন সারা রাত জেগে ইবাদত করাকে নিষেধ করেছে, তদ্রূপ ইবাদত বাদ দিয়ে সারা রাত ঘুমানোকেও নিষেধ করেছে।[2]
ঘুমানোর আদব:
(১) সকাল সকাল ঘুমানো: সকাল সকাল অর্থাৎ আগেভাগে ঘুমানো সুন্নাত। তাই সম্ভব হলে এশার ছালাতের কিছুক্ষণ পরই ঘুমিয়ে যাওয়া উত্তম। কেননা এশার পর কথা বলাকে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপছন্দ করতেন। আবূ বারযা রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন,كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَنْهَى عَنِ النَّوْمِ قَبْلَهَا وَالْحَدِيثِ بَعْدَهَا রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এশার ছালাতের পূর্বে ঘুমাতে ও ছালাতের পরে কথাবার্তা বলতে বারণ করতেন।[3]
(২) ওযূ করা: ঘুমানোর পূর্বে ওযূ করা সুন্নাত। কেননা ওযূ করে নিদ্রা যাপনকারীর জন্য ফেরেশতারা দু‘আ করে। ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, مَنْ بَاتَ طَاهِرًا بَاتَ فِي شِعَارِهِ مَلَكٌ فَلَا يَسْتَيْقِظُ إِلَّا قَالَ الْمَلَكُ اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِعَبْدِكَ فُلَانٍ ﻓَﺈِﻧَّﻪُ بَاتَ ﻃَﺎﻫِﺮًا ‘যে ব্যক্তি পবিত্র অবস্থায় নিদ্রা যাপন করবে, তার সাথে একজন ফেরেশতা নিযুক্ত থাকে। যখন সে পার্শ্ব পরিবর্তন করে, তখন ফেরেশতা বলে, আল্লাহ! এই বান্দাকে ক্ষমা করুন! কেননা সে পবিত্র অবস্থায় নিদ্রা যাপন করেছে’।[4] অন্য হাদীছে এসেছে, মুআয ইবনু জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَبِيتُ عَلى ذِكْرٍ طَاهِرًا فَيَتَعَارَّ مِنَ اللَّيْل فَيَسْأَلُ اللّهَ خَيْرًا إِلَّا أَعْطَاهُ إِيَّاهُ ‘যে মুসলিম রাত্রে পাক-পবিত্র অবস্থায় আল্লাহর যিকির করে ঘুমিয়ে যায়, তারপর রাতে জেগে উঠে আল্লাহর নিকট কল্যাণ কামনা করে, আল্লাহ তাকে (দুনিয়া ও আখেরাতে) অবশ্যই কল্যাণ দান করেন’।[5]
(৩)বিছানা ঝেড়ে ঘুমানো: আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কোনো ব্যক্তি শয্যাগ্রহণ করতে যায়, তখন সে যেন তার লুঙ্গির ভেতর দিক দিয়ে নিজ বিছানাটা ঝেড়ে নেয়। কারণ সে জানে না যে, বিছানার উপর তার অনুপস্থিতিতে পীড়াদায়ক কোনো কিছু আছে কিনা। তারপর পড়বে,بِاسْمِكَ رَبِّ وَضَعْتُ جَنْبِي وَبِكَ أَرْفَعُهُ إِنْ أَمْسَكْتَ نَفْسِي فَارْحَمْهَا وَإِنْ أَرْسَلْتَهَا فَاحْفَظْهَا بِمَا تَحْفَظُ بِهِ عِبَادَكَ الصَّالِحِينَ ‘হে আমার রব! আপনারই নামে আমার শরীরটা বিছানায় রাখলাম এবং আপনারই নামে আবার উঠাব। যদি আপনি ইতোমধ্যে আমার জান ক্ববয করে নেন, তাহলে তার উপর রহম করবেন। আর যদি তা আমাকে ফিরিয়ে দেন, তবে তাকে এমনভাবে হেফাযত করবেন, যেভাবে আপনি আপনার নেক বান্দাদের হেফাযত করে থাকেন’।[6]
(৪) আয়াতুল কুরসী পাঠ করে ঘুমানো: আয়াতুল কুরসী পাঠ করে ঘুমালে শয়তান তার নিকট আসতে পারে না। হাদীছে এসেছে, আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, এক রাতে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ফেতরার মাল পাহারায় নিযুক্ত করলেন। এমন সময় আমার নিকট এক ব্যক্তি এসেই অঞ্জলি ভরে খাদ্যশস্য উঠাতে লাগল। আমি তাকে ধরে ফেললাম ও বললাম, আমি তোমাকে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট নিয়ে যাব। সে বলল, আমি একজন অভাবী লোক। আমি নিদারুণ কষ্টে আছি। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, আমি তখন তাকে ছেড়ে দিলাম। ভোরে আমি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে গেলাম। তিনি আমাকে বলেন, ‘তোমার হাতে গত রাতে বন্দী লোকটির কী অবস্থা?’ আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! বন্দীটি তার নিদারুণ অভাব ও বহু পোষ্যের অভিযোগ করল। তাই আমি তার ওপর দয়া করলাম ও তাকে ছেড়ে দিলাম। তিনি তখন বললেন, ‘শোনো! সে তোমার কাছে মিথ্যা বলেছে। সে আবার আসবে’। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, আমি তার অপেক্ষায় রইলাম। (ঠিকই) সে আবার এলো। দুই হাতের কোষ ভরে খাদ্যশস্য উঠাতে লাগল এবং আমি তাকে ধরে ফেললাম। বললাম, আমি তোমাকে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে নিয়ে যাব। সে বলল, তুমি আমাকে এবারও ছেড়ে দাও। আমি বড্ড অভাবী মানুষ। আমি আর আসব না। এবারও আমি তার ওপর দয়া করলাম ও ছেড়ে দিলাম। ভোরে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, ‘তোমার বন্দীর খবর কী?’ আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! সে খুবই অভাবী। বহু পোষ্যের অভিযোগ করল। তাই আমি তার প্রতি দয়া প্রদর্শন করলাম ও তাকে ছেড়ে দিলাম। তিনি বললেন, ‘শোনো! তোমার কাছে সে মিথ্যা বলেছে। আবারও সে আসবে’। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, আমি তার অপেক্ষায় রইলাম। (ঠিকই) সে আবার এলো। আমি তাকে ধরে ফেললাম। আমি বললাম, তোমাকে আমি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট নিয়ে যাব। এটা তিনবারের শেষবার। তুমি ওয়াদা করেছিলে আর আসবে না। এরপরও তুমি এসেছ। সে বলল, এবারও যদি আমাকে ছেড়ে দাও, তাহলে আমি তোমাকে এমন কয়টি বাক্য শিখাব, যে বাক্যের দ্বারা আল্লাহ তোমার উপকার করবেন। তুমি শোয়ার জন্য বিছানায় গেলে আয়াতুল কুরসী পড়বে, তাহলে আল্লাহর তরফ থেকে সবসময় তোমার জন্য একজন রক্ষী থাকবে, ভোর হওয়া পর্যন্ত তোমার কাছে শয়তান ঘেঁষতে পারবে না। এবারও তাকে আমি ছেড়ে দিলাম। ভোরে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, ‘তোমার বন্দীর কী হলো?’ আমি বললাম, (হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম!) সে বলল, সে আমাকে এমন কয়টি বাক্য শিখাবে, যার দ্বারা আল্লাহ আমার উপকার করবেন। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘শোনো! এবার সে তোমার কাছে সত্য কথা বলেছে; অথচ সে খুবই মিথ্যুক। তুমি কি জানো, তুমি এই তিন রাত কার সাথে কথা বলেছ?’ আমি বললাম, না। তখন তিনি বললেন, ‘সে ছিল শয়তান’।[7]
(৫) সূরা বাক্বারার শেষ দুই আয়াত পড়া: এ প্রসঙ্গে হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, الآيَتَانِ مِنْ آخِرِ سُورَةِ الْبَقَرَةِ مَنْ قَرَأَهُمَا فِى لَيْلَةٍ كَفَتَاهُ ‘যে ব্যক্তি রাতে সূরা আল-বাক্বারার শেষ দুটি আয়াত পড়ে, সেটাই তার জন্য যথেষ্ট হবে’।[8]
(৬) সূরা আল-মুলক ও সূরা আস-সাজদা পড়া: ঘুমানোর পূর্বে সূরা আল-মুলক ও সূরা আস-সাজদা পড়া সুন্নাত। জাবের রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুমানোর জন্য বিছানায় শোয়ার পর সূরা আল-মুলক ও সূরা আস-সাজদা পড়ে শেষ না করা পর্যন্ত ঘুমাতেন না।[9] অন্য হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতি রাতে সূরা আল-মুলক পড়ে ঘুমাবে, আল্লাহ তাকে কবরের আযাব থেকে রক্ষা করবেন’।[10]
(৭) সূরা আল-ইখলাছ, আল-ফালাক্বওআন-নাসপড়া: এ মর্মে হাদীছে এসেছে, আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি রাতে (ঘুমানোর জন্য) বিছানায় যাওয়ার সময় দুই হাতের তালু একত্রিত করতেন। তারপর এতে সূরা আল-ইখলাছ, আল-ফালাক্ব ও আন-নাস পড়ে ফুঁক দিতেন। এরপর এ দুই হাত দিয়ে তিনি তাঁর শরীরের যতটুকু সম্ভব হতো, বুলিয়ে নিতেন। শুরু করতেন মাথা, চেহারা এবং শরীরের সম্মুখ ভাগ হতে। এভাবে তিনি তিনবার করতেন।[11]
(৮) তাসবীহ পড়া: হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু আমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘দুটি অভ্যাসে যাতে কোনো মুসলিম যত্নবান হলে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। অভ্যাস দুটি খুব সহজ, কিন্তু আমলকারী খুব কম। আর অভ্যাস দুটি হলো— (এক) প্রতি ওয়াক্ত ছালাতের পর দশবার সুবহানাল্লাহ, দশবার আল-হামদুলিল্লাহ ও দশবার আল্লাহু আকবার বলবে’। আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আমি ছালাতের পর স্বীয় হস্তে তা গণনা করতে দেখেছি। তারপর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘(পাঁচ ওয়াক্তে) মুখের উচ্চারণে ১৫০ বার এবং মীযানে দেড় হাজার হবে। (দুই) আর শয্যা গ্রহণকালে তুমি সুবহানাল্লাহ, আল-হামদুলিল্লাহ ও আল্লাহু আকবার ১০০ বার বলবে, ফলে তা মীযানে ১ হাজারে রূপান্তর হবে। তোমাদের মাঝে কে একদিন ও একরাতে ২ হাজার ৫০০ গুনাহে লিপ্ত হয়?’ (অর্থাৎ এতগুলো পাপও ক্ষমাযোগ্য হবে)। ছাহাবীগণ বলেন, কোনো ব্যক্তি সবসময় এরূপ একটি ইবাদত কেন করবে না? তিনি বলেন, ‘তোমাদের কেউ ছালাতে অবস্থানকালে তার কাছে শয়তান এসে বলতে থাকে, এটা মনে করো, ওটা মনে করো। ফলে সে ভুলে যায়। অনুরূপভাবে তোমাদের কেউ শয্যাগ্রহণ করলে শয়তান তার নিকট এসে তাকে ঘুম পাড়ায় এবং সে তাসবীহ না পাঠ করেই ঘুমিয়ে পড়ে’।[12] অন্য হাদীছে এসেছে, আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, একদিন ফাতেমা রাযিয়াল্লাহু আনহা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে একজন খাদেম চাইতে আসলেন। তিনি বললেন, ‘আমি কি তোমাকে এমন পথ দেখাব না, যা তোমার জন্য খাদেমের চেয়ে অনেক উত্তম হবে? তা হলো, তুমি প্রত্যেক ছালাতের সময় ও ঘুমানোর সময় ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আল-হামদুলিল্লাহ ও ৩৪ বার আল্লাহু আকবার বলবে’।[13]
(৯) দু‘আ পড়া: ঘুমানোর পূর্বে যিকির বা দু‘আ পড়ে ঘুমাতে হবে। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَنِ اضْطَجَعَ مَضْجَعًا لَا يَذْكُرِ اللهَ فِيهِ كَانَ عَلَيْهِ مِنَ اللّٰهِ تِرَةٌ ‘যে ব্যক্তি বিছানায় শুয়েছে অথচ আল্লাহর যিকির করেনি, আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী তা তার জন্য ক্ষতির কারণ হবে’।[14] নিম্নে শয্যা গ্রহণের কিছু দু‘আ উল্লেখ করা হলো—
দু‘আ-১: اَللهم بِاسْمِكَ أمُوتُ وَأحْيَا অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নামে মরি ও বাঁচি’।[15]
দু‘আ-২: اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِىْ أَطْعَمَنَا وَسَقَانَا وَكَفَانَا وَاٰوَانَا فَكَمْ مِمَّنْ لَا كَافِىَ لَه وَلَا مُؤْوِىَ অর্থ: ‘প্রশংসা শুধু আল্লাহর, যিনি আমাদেরকে খাওয়ালেন, পান করালেন, আমাদের প্রয়োজন পূরণ করলেন এবং আমাদেরকে আশ্রয় দিলেন। অথচ এমন অনেক লোক আছে যাদের না আছে কেউ প্রয়োজন মিটাবার আর না আছে কোনো আশ্রয়দাতা’।[16]
দু‘আ-৩:اَللّٰهُمَّ قِنِىْ عَذَابَكَ يَوْمَ تَجْمَعُ عِبَادَكَ أَوْ تَبْعَثُ عِبَادَكَ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমাকে তোমার শাস্তি হতে বাঁচিয়ে রেখো, যেদিন তুমি তোমার বান্দাদেরকে পুনরায় একত্রিত করবে; অথবা (বলেছেন) যেদিন তুমি তোমার বান্দাদেরকে কবর হতে উঠাবে’।[17]
দু‘আ-৪: اَللّٰهُمَّ رَبَّ السَّمَاوَاتِ وَرَبَّ الْأَرْضِ وَرَبَّ كُلِّ شَىْءٍ فَالِقَ الْحَبِّ وَالنَّوٰى مُنْزِلَ التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيْلِ وَالْقُرْاٰنِ أعوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ كُلِّ ذِىْ شَرٍّ أَنْتَ اٰخِذٌ بِنَاصِيَتِه أَنْتَ الْأَوَّلُ فَلَيْسَ قَبْلَكَ شَىْءٌ وَأَنْتَ الْاٰخِرُ فَلَيْسَ بَعْدَكَ شَىْءٌ وَأَنْتَ الظَّاهِرُ فَلَيْسَ فَوْقَكَ شَىْءٌ وَأَنْتَ الْبَاطِنُ فَلَيْسَ دُونَكَ شَىْءٌ اقْضِ عَنِّى الدَّيْنَ وَاغْنِنِىْ مِنَ الْفَقْرِ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! যিনি আসমানের রব, যমিনের রব তথা প্রতিটি জিনিসের রব, শস্যবীজ ও খেজুরদানা ফেড়ে গাছপালা উৎপাদনকারী; তাওরাত, ইঞ্জীল ও কুরআন অবতীর্ণকারী, আমি তোমার কাছে এমন প্রতিটি অনিষ্টকারীর অনিষ্ট হতে আশ্রয় চাই, যা তোমার অধিকারে রয়েছে। তুমিই প্রথম, তোমার আগে কেউ ছিল না। তুমিই শেষ, তোমার পরে আর কেউ থাকবে না। তুমি প্রকাশ্য, তোমার চেয়ে প্রকাশ্য আর কিছু নেই। তুমি অন্তর্যামী, তোমার চেয়ে গোপনীয় আর কিছু নেই। তুমি আমাকে ঋণমুক্ত করে দাও এবং দারিদ্র্য হতে বাঁচিয়ে রেখো’।[18]
দু‘আ-৫: بسمِ اللّٰهِ وَضَعْتُ جَنْبِى لِلّٰهِ اَللّٰهُمَّ اغْفِرْ لِىْ ذَنْبِىْ وَاخْسَأْ شَيْطَانِىْ وَفُكَّ رِهَانِىْ وَاجْعَلْنِىْ فِى النَّدِىِّ الْأَعْلٰى অর্থ: ‘আল্লাহর নামে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে আমি পার্শ্ব রাখলাম। হে আল্লাহ! তুমি আমার অপরাধ ক্ষমা করো। আমার কাছ থেকে শয়তানকে তাড়িয়ে দাও। আমার ঘাড়কে মুক্ত করো এবং আমাকে উচ্চাসনে সমাসীন করো’।[19]
দু‘আ-৬: اللَّهُمَّ خَلَقْتَ نَفْسِي وَأَنْتَ تَوَفَّاهَا لَكَ مَمَاتُهَا وَمَحْيَاهَا إِنْ أَحْيَيْتَهَا فَاحْفَظْهَا وَإِنْ أَمَتَّهَا فَاغْفِرْ لَهَا اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الْعَافِيَةَ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আপনি আমার জীবন সৃষ্টি করেছেন এবং আপনিই তাকে (আমার জীবনকে) মৃত্যুদান করেন। আপনার কাছে (নফসের) জীবন ও মরণ। যদি আপনি একে জীবিত রাখেন, তাহলে আপনি এর হেফাযত করুন। আর যদি আপনি এর মৃত্যু দান করেন, তাহলে একে ক্ষমা করে দিন। হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে সুস্থতা প্রার্থনা করছি।[20]
(১০) ডান কাত হয়ে শোয়া: হাদীছে এসেছে, বারা ইবনু আযেব রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন শয্যাগ্রহণ করতেন, তখন ডান পার্শ্বে শয়ন করতেন এবং এই দু‘আ পড়তেন,اَللهم أسْلَمْتُ نَفسِي إلَيْكَ، وَوَجَّهْتُ وَجْهِي إلَيْكَ، وَفَوَّضْتُ أمْرِي إلَيْكَ، وَألْجَأتُ ظَهْرِي إلَيْك، رَغْبَةً وَرَهْبَةً إلَيْكَ، لاَ مَلْجَأ وَلاَ مَنْجا مِنْكَ إِلاَّ إلَيكَ، آمَنْتُ بِكِتَابِكَ الَّذِي أنْزَلْتَ، وَنَبِيِّكَ الَّذِي أرْسَلْتَ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমি আমার প্রাণ তোমার প্রতি সমর্পণ করেছি, আমার মুখমণ্ডল তোমার প্রতি ফিরিয়েছি, আমার সকল কর্মের দায়িত্ব তোমাকে সোপর্দ করেছি, আমার পিঠকে তোমার দিকে লাগিয়েছি (তোমার উপরেই সকল ভরসা রেখেছি), এসব কিছু তোমার ছওয়াবের আশায় ও তোমার আযাবের ভয়ে করেছি। তোমার নিকট ছাড়া তোমার আযাব থেকে বাঁচতে কোনো আশ্রয়স্থল নেই। তুমি যে কিতাব অবতীর্ণ করেছ তার উপর এবং তুমি যে নবী প্রেরণ করেছ তার উপর ঈমান এনেছি’।[21]
(১১) আগুন বা বাতিনি ভিয়ে ঘুমানো: বাতি নিভিয়ে ঘুমানো সুন্নাত। ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, لاَ تَتْرُكُوا النَّارَ فِي بُيُوتِكُمْ حِينَ تَنَامُونَ ‘যখন তোমরা ঘুমাবে, তখন তোমাদের ঘরগুলোতে আগুন জ্বালিয়ে রেখো না’।[22] ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,إِذَا نِمْتُمْ فَأَطْفِئُوا سُرُجَكُمْ ‘যখন তোমরা ঘুমাতে যাবে, তখন বাতিগুলো নিভিয়ে দিয়ো’।[23]
পরিশেষে, আল্লাহ আমাদেরকে ঘুমানোর আদবগুলো পরিপূর্ণভাবে মেনে চলার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
মো. দেলোয়ার হোসেন
অধ্যয়নরত, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
[1]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল গালিব, তাফসীরুল কুরআন [৩০ তম পারা], (হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২য় সংস্করণ: মে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দ), পৃ. ৪৩-৪৪।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০৬৩; ছহীহ মুসলিম, হা/১৪০১; মিশকাত, হা/১৪৫।
[3]. আবূ দাঊদ, হা/৪৮৪৯, হাদীছ ছহীহ।
[4]. ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৫৯৭।
[5]. আবূ দাঊদ, হা/৫০৪২; মিশকাত, হা/১২১৫, হাদীছ ছহীহ।
[6]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৩২০; ছহীহ মুসলিম, হা/২৭১৪; মিশকাত, হা/২৩৮৪।
[7]. ছহীহ বুখারী, হা/২৩১১; তিরমিযী, হা/২৮৮০; মিশকাত, হা/২১২৩।
[8]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০৪০; ছহীহ মুসলিম, হা/৮০৭; মিশকাত, হা/২১২৫।
[9]. তিরমিযী, হা/২৮৯২, হাদীছ ছহীহ; মিশকাত, হা/২১৫৫।
[10]. ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১৫৮৯।
[11]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৯১৭; তিরমিযী, হা/৩৪০২; আবূ দাঊদ, হা/৫০৫৬।
[12]. তিরমিযী, হা/৩৪১০, হাদীছ ছহীহ; মিশকাত, হা/২৪০৬।
[13]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৭২৮; মিশকাত, হা/২৩৮৮।
[14]. আবূ দাঊদ, হা/৫০৫৯; মিশকাত, হা/২২৭২, হাদীছ ছহীহ।
[15]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৩১৪; মিশকাত, হা/২৩৮২।
[16]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৭১৫; আবূ দাঊদ, হা/৫০৫৩; তিরমিযী, হা/৩৩৯৬; মিশকাত, হা/২৩৮৬।
[17]. তিরমিযী, হা/৩৩৯৮, হাদীছ ছহীহ; মিশকাত, হা/২৪০০।
[18]. আবূ দাঊদ, হা/৫০৫১, হাদীছ ছহীহ; তিরমিযী, হা/৩৪০০; মিশকাত, হা/২৪০৮।
[19]. আবূ দাঊদ, হা/৫০৫৪, হাদীছ ছহীহ; মিশকাত, হা/২৪০৯।
[20]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৭১২; আহমাদ, হা/৫৫০২।
[21]. ছহীহ বুখারী, হা/২৪৭; ছহীহ মুসলিম, হা/২৭১০; মিশকাত, হা/২৩৮৫।
[22]. ছহীহ বুখারী, হা/৬২৯৩।
[23]. আবূ দাঊদ, হা/৫২৪৭, হাদীছ ছহীহ।