সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজাহানের রব আল্লাহ তাআলার জন্য। ছালাত ও সালাম বর্ষিত হোক সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবার পরিজন এবং তার সকল ছাহাবীর ওপর।
অতঃপর, নিশ্চয় সদুপদেশ হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ মূল বিষয়, যা অন্তরসমূহকে জাগ্রত করে, গাফলতি থেকে উজ্জীবিত করে। আর এটা হলো অন্তরসমূহ ঠিক রাখার এবং অন্তরের রোগসমূহ চিকিৎসা করার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। আর এটা হলো সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের একটি চিহ্ন, যাতে থাকে মানুষকে উৎসাহ প্রদান ও ভীতি প্রদর্শন করা, আল্লাহ তাআলার দিকে আহ্বান করা, উপকারী নছীহত করা, যা অন্তরসমূহকে নরম করে দেয়। এর ফলে অন্তরসমূহ নাজাত পাওয়ার জন্য, ভয়ংকর জিনিস থেকে বাঁচার জন্য এবং আকাঙ্ক্ষিত জিনিস পাওয়ার জন্য আমল করতে তৎপর হয়ে ওঠে।
এটা হতে পারে শোনার মাধ্যমে, সেটা হলো রাসূলগণের নিকটে তাদের রবের পক্ষ থেকে যা অহী করা হয়েছে সেগুলো এবং তাদের জবান থেকে বের হওয়া নছীহতসমূহ, দিক-নির্দেশনা এবং হেদায়াতের কথা শোনা, পড়ার মাধ্যমে উপকৃত হওয়া। অনুরূপভাবে দ্বীন ও দুনিয়ার কল্যাণ সম্পর্কে নছীহতকারী ও দিক-নির্দেশকদের থেকে উপকৃত হওয়া।
আবার এটা কোনো কিছু দেখে উপদেশ গ্রহণের মাধ্যমে হতে পারে। সেটা হলো এই জগতের উপদেশ গ্রহণের স্থান, ঘটনা, বিভিন্ন পরীক্ষা, ভাগ্যের বিধিবিধান ও তার গতিপথ এই জগতে আল্লাহর বিভিন্ন রীতি দেখে চিন্তাভাবনা করা এবং উপদেশ গ্রহণ করার মাধ্যমে পরিতৃপ্ত হওয়া।
অন্তরসমূহের জন্য জ্ঞানার্জনের প্রয়োজনের চেয়ে উপদেশের প্রয়োজন কোনো অংশে কম নয়। বরং উপদেশ হলো জ্ঞানার্জনকে সুগম করার একটি পথ। কেননা যখন অন্তর নরম হবে, তখন উপকারী জ্ঞানার্জনের জন্য তার দূরদর্শিতার পথও খুলে যাবে। ফলে অন্তর আনন্দিত ও শান্ত হবে, বিবেক তার খোরাক পাবে এবং অন্তর প্রশান্ত হয়ে যাবে। এজন্য পবিত্র কুরআনের বৈশিষ্ট্য হলো উপদেশ। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَلَقَدْ أَنْزَلْنَا إِلَيْكُم آيَاتٍ مُبَيِّنَاتٍ وَمَثَلًا مِنَ الَّذِينَ خَلَوْا مِنْ قَبْلِكُمْ وَمَوْعِظَةً لِلْمُتَّقِينَ ‘আর অবশ্যই আমরা তোমাদের কাছে নাযিল করেছি সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ, তোমাদের পূর্ববর্তীদের থেকে দৃষ্টান্ত ও মুত্তাক্বীদের জন্য উপদেশ’ (আন-নূর, ২৪/৩৪)। আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, ‘হে লোকসকল! তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের কাছ থেকে এসেছে উপদেশ ও অন্তরসমূহে যা আছে তার আরোগ্য এবং মুমিনদের জন্য হেদায়াত ও রহমত’ (ইউনুস, ১০/৫৭)। অনুরূপভাবে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহও ছিল উপদেশ। আল্লাহ তাআলা ইনজীল সম্পর্কে বলেন,وَآتَيْنَاهُ الْإِنْجِيلَ فِيْهِ هُدًى وَنُورٌ وَمُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيهِ مِنَ التَّوْرَاةِ وَهُدًى وَمَوْعِظَةً لِلْمُتَّقِينَ ‘আর আমরা তাকে (ঈসাকে) ইনজীল দিয়েছিলাম, এতে রয়েছে হেদায়াত ও আলো; আর তা ছিল তাঁর সামনে অবশিষ্ট তাওরাতের সত্যতা প্রতিপন্নকারী এবং মুত্তাক্বীদের জন্য হেদায়াত ও উপদেশস্বরূপ’ (আল-মায়েদা, ৫/৪৬)। আল্লাহ তাআলা মূসা আলাইহিস সালাম-এর ওপর নাযিলকৃত ফলক সম্পর্কে বলেন,وَكَتَبْنَا لَهُ فِي الْأَلْوَاحِ مِنْ كُلِّ شَيْءٍ مَوْعِظَةً وَتَفْصِيلًا لِكُلِّ شَيْءٍ ‘আর আমরা তাঁর জন্য ফলকসমূহে সর্ববিষয়ে উপদেশ ও সকল বিষয়ের স্পষ্ট ব্যাখ্যা লিখে দিয়েছিলাম’ (আল-আ‘রাফ, ৭/১৪৫)।
আল্লাহ তাআলা তাঁর সম্মানিত কিতাবে অনেক স্থানে উপদেশ দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,يَعِظُكُمُ اللَّهُ أَنْ تَعُودُوا لِمِثْلِهِ أَبَدًا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ ‘আল্লাহ তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন, তোমরা যদি মুমিন হও তবে কখনো যাতে অনুরূপ আচরণের পুনরাবৃত্তি না কর’ (আন-নূর, ২৪/১৭)। কুরআন দিয়ে উপদেশ দেওয়া হলো অন্তর নরম হওয়ার, তাতে প্রভাব পড়ার সবচেয়ে বড় মাধ্যম এবং উপকৃত হওয়া ও জাগ্রত হওয়ার সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। কেননা কুরআন পুরোটাই হলো উপদেশ।
সদুপদেশকে আল্লাহ তাআলা নবীগণের দাওয়াতের একটি মাধ্যম বানিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ والْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّك هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ ‘আপনি মানুষকে দাওয়াত দিন আপনার রবের পথে হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে তর্ক করবেন উত্তম পন্থায়। নিশ্চয় আপনার রব তার পথ ছেড়ে কে বিপথগামী হয়েছে, সে সম্বন্ধে বেশি জানেন এবং কারা সৎপথে আছে তাও তিনি ভালোভাবেই জানেন’ (আন-নাহাল, ১৬/১২৫)।
আর এটা হবে যাদেরকে দাওয়াত দেওয়া হবে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী। তাদের মধ্যে এমন কেউ আছে, যে ব্যক্তি হক্ব অন্বেষণ করে ও তা পেতে চায়, তাকে হিকমতের সাথে আহ্বান করতে হবে। আবার অনেকে আছে, যারা গাফেল, এবং হক্বের বিপরীত জিনিস নিয়ে ব্যস্ত, তাকে হিকমতের সাথে সদুপদেশের মাধ্যমে আহ্বান করতে হবে। আবার অনেকে আছে অবাধ্য ও বিরোধী, তাদের সাথে উত্তম পন্থায় তর্ক করতে হবে। তারপরও তারা যদি যুলমের ওপর অটল থাকে, তাহলে পূর্বের পন্থাগুলোর সাথে কিছু কঠোরতাও করার প্রয়োজন পড়তে পারে। যেমনটি আল্লাহ তাআলা বলেন,وَلَا تُجَادِلُوا أَهْلَ الْكِتَابِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِلَّا الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْهُمْ ‘আর তোমরা উত্তম পন্থা ছাড়া কিতাবীদের সাথে বিতর্ক করবে না, তবে তাদের সাথে করতে পার, যারা তাদের মধ্যে যুলম করেছে’ (আল-আনকাবূত, ২৯/৪৬)।
আল্লাহ তাআলা তার নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে উপদেশ দেওয়ার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করার আদেশ করে বলেন,فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ وَعِظْهُمْ وَقُلْ لَهُمْ فِي أَنْفُسِهِمْ قَوْلًا بَلِيغًا ‘কাজেই আপনি তাদেরকে উপেক্ষা করুন, তাদেরকে সদুপদেশ দিন এবং তাদেরকে তাদের মৰ্ম স্পর্শ করে এমন কথা বলুন’ (আন-নিসা, ৪/৬৩)।
আর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের অবস্থার প্রতি লক্ষ রেখে নির্দিষ্ট দিনে নছীহত করতেন, আমরা যাতে বিরক্তবোধ না করি।[1] কেননা উপদেশের সৌন্দর্য আসে দুই দিক থেকে— ১. যথাসময়ে হওয়া। যেমন অনাবৃষ্টির পরে বৃষ্টি হওয়া। ২. অবস্থা অনুযায়ী হওয়া।
আর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রসিদ্ধ উপদেশ ইরবায ইবনু সারিয়্যাহ রযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। তাতে রয়েছে, ইরবায ইবনু সারিয়্যাহ রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন আমাদেরকে এমন উপদেশ দিলেন, যাতে অন্তরসমূহ ভীত হয়ে পড়ল এবং চক্ষু দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হতে লাগল। এতে আল্লাহ তাআলার সেই বাণীর সত্যায়ন রয়েছে যাতে তিনি বলেন,تَقْشَعِرُّ مِنْهُ جُلُودُ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ ثُمَّ تَلِينُ جُلُودُهُمْ وَقُلُوبُهُمْ إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ ‘এতে যারা তাদের রবকে ভয় করে, তাদের শরীর শিউরে ওঠে, তারপর তাদের দেহ, মন বিনম্র হয়ে আল্লাহর স্মরণে ঝুঁকে পড়ে’ (আয-যুমার, ৩৯/২৩)। অর্থাৎ ভয়ভীতিতে তাদের শরীর শিউরে উঠে। তারপর আনন্দ, উল্লাস এবং ঐ সত্তার ওপর সুধারণা, যার থেকেই একমাত্র কল্যাণ আসে, সেই সুধারণাতে তাদের অন্তরসমূহ নরম হয়ে যায়। ছাহাবী বলেন, আমরা বললাম, মনে হচ্ছে এটা বিদায়ী ভাষণ। সুতরাং আপনি আমাদেরকে অছিয়ত করুন। তখন তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আমি তোমাদেরকে আল্লাহর তাক্বওয়া অবলম্বন করার, (নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের) কথা শুনার ও মানার অছিয়ত করছি’।[2]
ছহীহ বুখারীর কিতাবুর রিক্বাক্বসহ হাদীছের অন্যান্য কিতাবসমূহে ছাহাবীগণকে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপদেশ দেওয়া সংক্রান্ত অনেক উজ্জ্বল উদাহরণ রয়েছে। অনুরূপভাবে ছাহাবা, তাবেঈগণ এবং ইমামগণ থেকে বর্ণিত আছারসমূহে, তাদের জীবনী ও লিখনীতে এধরনের অনেক নযির রয়েছে। যতই স্বর্ণযুগের নিকটে যাওয়া যাবে, ততই বরকতময় কথার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। কেননা সালাফগণের কথা কম হলেও তাতে রয়েছে অনেক বরকত। পক্ষান্তরে তাদের পরবর্তী সময়ে সালাফগণের চেয়ে মর্যাদা, জ্ঞান ও হিকমতে কম ব্যক্তিদের অবস্থা এর সম্পূর্ণ বিপরীত।
উপদেশ হলো সর্বযুগে ও সর্বস্থানেই সংস্কারকগণের পদ্ধতি। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَإِذْ قَالَ لُقْمَانُ لِابْنِهِ وَهُوَ يَعِظُهُ يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ ‘আর স্মরণ করুন, যখন লুক্বমান উপদেশ দিতে গিয়ে তার পুত্ৰকে বলেছিল, হে আমার প্রিয় বৎস! আল্লাহর সাথে কোনো শিরক করো না। নিশ্চয় শিরক বড় যুলম’ (লুক্বমান, ৩১/১৩)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,وَإِذْ قَالَتْ أُمَّةٌ مِنْهُمْ لِمَ تَعِظُونَ قَوْمًا اللَّهُ مُهْلِكُهُمْ أَوْ مُعَذِّبُهُمْ عَذَابًا شَدِيدًا قَالُوا مَعْذِرَةً إِلَى رَبِّكُمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ ‘আর স্মরণ করুন, যখন তাদের একদল বলেছিল, আল্লাহ যাদেরকে ধ্বংস করবেন কিংবা কঠোর শাস্তি দিবেন, তোমরা তাদেরকে সদুপদেশ দাও কেন? তারা বলেছিল, তোমাদের রবের কাছে দায়িত্বমুক্তির জন্য এবং যাতে তারা তাক্বওয়া অবলম্বন করে এজন্য’ (আল-আ‘রাফ, ৭/১৬৪)।
মানুষদেরকে কল্যাণকর বিষয় শিক্ষাদানকারী, তিনি যেই বিষয়ই শিক্ষা দান করুন না কেন তার কর্তব্য হলো দারসের সময়েই ছাত্র ও তাদের অনুসারীদের জন্য উপদেশের সংক্ষিপ্ত বার্তা দেওয়া এবং যারা সমসাময়িক যোগাযোগ মাধ্যমে আগ্রহী তাদের কর্তব্য হলো, এমন উপদেশের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া। কেননা হতে পারে একটি সত্য কথার দ্বারাই আল্লাহ তাআলা গাফেল অন্তরকে খুলে দিতে পারেন এবং সেই অন্তরের মৃত্যুর পর তাকে জীবিত করতে পারেন। সুতরাং উপকারী কথার বিষয়ে কার্পণ্য করো না। হাসান ইবনু ছালেহ বলেন, যাবীদ রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, আমি একটি কথা শুনেছিলাম। আল্লাহ তাআলা তাঁর মাধ্যমে আমাকে ৩০ বছর উপকৃত করেছিলেন। এমন কত মানুষ রয়েছে, একটি কথা শুনার মাধ্যমে যাদের দূরদর্শিতা আলোকিত হয়ে গেছে, ফলে তারা জীবনকে পরিবর্তন করে দ্বীনের ওপর অটল থেকেছেন এবং বিভ্রান্তি ও ফাসাদ ছেড়ে দিয়েছেন।
বর্তমান সময়ে সদুপদেশের প্রয়োজন ও গুরুত্ব আরো বেশি। কেননা এই সময়ে বস্তুবাদ ও প্রবৃত্তি প্রাধান্য বিস্তার করেছে, অন্তরসমূহ শক্ত হয়ে পড়েছে ও তা দুনিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। বর্তমান সময়ে অধিকাংশ বিভ্রান্ত মানুষের বিভ্রান্তির মূল কারণ হলো অন্তর শক্ত হয়ে যাওয়া; আত্ম-অহংকার, কম জ্ঞান ও জানা থাকার জন্য নয়। ফলে তারা ইয়াহূদীদের পণ্ডিতদের মতো হয়ে পড়েছে। একারণে অন্তরসমূহকে উপদেশ দেওয়ার প্রয়োজন অনেক বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখানে যেই বিষয়টি অবহিত করা দরকার সেটি হলো যারা নাস্তিকতার সংশয় সন্দেহ তুলে ধরে, তাদের অধিকাংশের এমনটি হয় অন্তর গাফেল হওয়ার কারণে এবং অন্তরের ওপর মরিচা প্রাধান্য লাভ করার কারণে। তাই তাদেরকে শুরুতেই সদুপদেশ দিয়ে, তারপর প্রমাণ পেশ করাই ভালো হবে। কেননা উপদেশ যখন তার উপকারে আসবে, তখন সেটি সঠিক প্রমাণসমূহ গ্রহণের বাধাকে দূর করে দিবে। আল্লাহ তাআলার এই বাণী নিয়ে চিন্তাভাবনা করো, যেখানে তিনি বলেন, فَاقْصُصِ الْقَصَصَ لَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ ‘সুতরাং আপনি বৃত্তান্ত বর্ণনা করুন যাতে তারা চিন্তাভাবনা করে’ (আল-আ‘রাফ, ৭/১৭৬)। সুতরাং উপদেশ চিন্তাভাবনা করার আগেই হতে হবে।
উপদেশের এত প্রয়োজন থাকার পরেও আমরা শুধু সামান্য সংখ্যক সত্যবাদী উপদেশদাতাকেই পাই। বরং উপদেশ দেওয়ার বিষয়টি তুচ্ছতাচ্ছিল্যের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর যখন এমন তাচ্ছিল্য হয়ে থাকে জ্ঞান ও ফিক্বহের দিকে নিজেদেরকে সম্পৃক্তকারী ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো নিয়ে ব্যস্ত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে, তখন এটা আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করে। তারা বলে যে, এগুলো হলো আবেগময় উপদেশ, এটা আমাদের জন্য উপযুক্ত কোনো সূক্ষ্ম ইলমী, গভীর চিন্তানির্ভর, তদন্ত ও অনুসন্ধান করা সম্বোধন নয়। এগুলো শুধু সাধারণ, সরল মানুষদের জন্যই উপযুক্ত। কিন্তু এরা জানে না যে, জ্ঞান ও ফিক্বহের দিকে সম্পৃক্তকারী ব্যক্তিরা এই ধরনের উপদেশের বেশি মুখাপেক্ষী, বিশেষ করে এই পৃথিবীর শেষ সময়ে, যা শক্ত অন্তরকে নরম করে দিবে। কেননা তাদের অনেকের থেকে বারবার এই অভিযোগ আসে যে, তাদের অন্তর শক্ত হয়ে গেছে।
ইবনুল জাওযী রহিমাহুল্লাহ বলেন, ফিক্বহ ও হাদীছ শ্রবণ নিয়ে ব্যস্ত এমন অনেককেই আমি দেখেছি, মর্মস্পর্শী বক্তব্য এবং সালাফে ছালেহীনের জীবনীর দিকে দৃষ্টি দেওয়া ছাড়া অন্য কিছু তাদের অন্তর সংশোধনের জন্য যথেষ্ট হয়নি।
কিছু উপদেশদাতার মধ্যে এবং উপদেশবাণীর মধ্যে মিথ্যা কথা, মিথ্যা স্বপ্নের বর্ণনা, ইসরাঈলী বর্ণনা, অসম্ভব ও বিভিন্ন ধরনের কিছু কাহিনী ঢুকে পড়েছে। এগুলোর কারণে এই বিষয়কে তুচ্ছজ্ঞান করা সঠিক হবে না। বরং জরুরী ভিত্তিতে এটা এর স্থান ও বিষয়গুলোকে সঠিক ও পরিষ্কার করার দাবি রাখে। আর মিথ্যা ও নতুন উদ্ভাবনকৃত বিষয়গুলো থেকে এই বিষয়টিকে রক্ষা করার জন্য কঠোর নজরদারি করতে হবে, যাতে করে এর উজ্জ্বলতা, সৌন্দর্য ও পরিচ্ছন্নতা আবার ফিরে আসে। আর উপদেশদাতার কর্তব্য হলো, সে যেন উপদেশের শর্ত ও আদবসমূহ দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে, সংবাদ সঠিক কি-না এই দিকে খেয়াল রাখে, সেই সংবাদ হোক কোনো দলীল অথবা কোনো ঘটনা। এছাড়াও তার নিয়্যত যেন সঠিক থাকে। অবস্থা, স্থান ও সময়সহ অন্যান্য বিষয়গুলো যেন বিবেচনা করে, যাতে করে আল্লাহ তাআলার অনুমতিতে এর ফলাফল আসে।
উপদেশ পরিত্যাগ করা এবং উপদেশদাতাকে তাচ্ছিল্য করাটা শুধু আমাদের এই যুগের ঘটনা নয়। বরং এটা পূর্ব যুগ থেকেই চলে আসছে। এটা হলো রাসূলগণ ও সংস্কারকদের বিরোধীদের রীতি। তারা এটাকে হক্ব শোনা ও তা দিয়ে উপকৃত হওয়া থেকে বিরত থাকার একটি মাধ্যম বানিয়েছে। পবিত্র কুরআনে এর অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন, আল্লাহ তাআলা হূদ আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন যে, যখন তিনি তাঁর জাতিকে (আদ জাতি) নছীহত করলেন, আর তিনি তাদেরকে বলেছিলেন,إِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ ‘আমি তোমাদের ওপর এক মহান দিনের আযাবের ভয় করছি’ (আশ-শুআরা, ২৬/১৩৫)। তখন তাঁর জাতির লোকদের উত্তর ছিল,قَالُوا سَوَاءٌ عَلَيْنَا أَوَعَظْتَ أَمْ لَمْ تَكُنْ مِنَ الْوَاعِظِينَ * إِنْ هَذَا إِلَّا خُلُقُ الْأَوَّلِينَ ‘তারা বলল, তুমি উপদেশ দাও বা না দাও, উভয়ই আমাদের জন্য সমান। এটা তো কেবল পূর্ববর্তীদেরই চরিত্র’ (আশ-শুআরা, ২৬/১৩৬-১৩৭)।
এটা হলো শয়তানের একটি প্রবেশপথ ও আলেমদেরকে ওয়াসওয়াসা দেওয়ার একটি মাধ্যম। ইবনুল জাওযী রহিমাহুল্লাহ বলেন, আলেমদেরকে দেওয়া শয়তানের ওয়াসওয়াসার অন্তর্ভুক্ত হলো, সে তাদের সামনে উপদেশদাতাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার বিষয়টিকে সুন্দর করে তুলে ধরে এবং তাদের নিকট উপস্থিত হতে বাধা দেয়। ফলে তারা উপদেশদাতাকে বলে, এরা তো কাহিনী বর্ণনাকারী! এখানে শয়তানের উদ্দেশ্য হলো, তারা যেন এমন স্থানে উপস্থিত না হয়, যেখানে তাদের অন্তর নরম ও ভীত হবে। قُصَّاص বা কাহিনী বর্ণনাকারী এটা নামের দিক থেকে কোনো নিন্দনীয় নয়। কেননা আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন,نَحْنُ نَقُصُّ عَلَيْكَ أَحْسَنَ الْقَصَصِ ‘আমরা আপনার কাছে উত্তম কাহিনী বর্ণনা করছি’ (ইউসুফ, ১২/৩)। আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, فَاقْصُصِ الْقَصَصَ ‘আপনি তাদের সামনে কাহিনী বর্ণনা করুন’ (আল-আ‘রাফ, ৭/১৭৬)। কিন্তু এর মাধ্যমে কাহিনী বর্ণনাকারীদের নিন্দা করা হয়। কেননা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা ইলমী দিক বর্ণনা না করে শুধু বিস্তৃত কাহিনী বর্ণনা করে। তারপর তাদের অধিকাংশরাই যেই বর্ণনা করে সেগুলোর মধ্যে মিথ্যা বর্ণনাও যোগ করে দেয়। আবার তারা যেই বর্ণনার ওপর নির্ভর করে, সেগুলোর বেশিরভাগই অসম্ভব। পক্ষান্তরে কাহিনী যদি সত্য হয় এবং তা উপদেশ হয়, তাহলে সেটি প্রশংসনীয়। আর ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল রহিমাহুল্লাহ বলতেন, মানুষ সত্যবাদী কাহিনী বর্ণনাকারীর কতই না মুখাপেক্ষী!
আমরা আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করছি, তিনি যেন আমাদের অন্তর ও আমলসমূহের ত্রুটি-বিচ্যুতিকে সংশোধন করে দেন, আমাদেরকে যেন সঠিক পথ প্রদর্শন করেন এবং আমাদেরকে যেন উপকারী জ্ঞান ও সৎ আমল করার তাওফীক্ব দান করেন- আমীন!
ছালাত, সালাম ও বরকত নাযিল হোক আমাদের নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবার পরিজন এবং সকল ছাহাবীর ওপর।
মূল : উস্তায ড. আব্দুল্লাহ ইবনু উমার আদ-দিমাইজী
অনুবাদ : আল-ইতিছাম গবেষণা পর্ষদ
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৮; ছহীহ মুসলিম, হা/২৮২১।
[2]. তিরমিযী, হা/২৬৭৬, হাদীছ ছহীহ।