কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

পবিত্র রামাযানে কুরআন পাঠ ও শেখার গুরুত্ব

কুরআন এক অলৌকিক গ্রন্থ, যা হেদায়াত ও পথপ্রদর্শক হিসেবে প্রেরিত হয়েছে। পবিত্র কুরআন আল্লাহর বাণী, যা মানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর অবতীর্ণ হয়ে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ আছে। রামাযান মাসে কুরআন অবতরণের কারণেই রামাযান মাস পবিত্র কুরআনের মাস হিসেবে বিবেচিত। তাৎপর্যপূর্ণ ও মহিমান্বিত এ মাসে পবিত্র কুরআন নাযিল হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেছেন,﴿شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ﴾ ‘রামাযান মাস, যার মধ্যে বিশ্বমানবের জন্য পথপ্রদর্শক এবং সুপথের উজ্জ্বল নিদর্শন ও (হক্ব ও বাতিলের) প্রভেদকারী কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে’ (আল-বাক্বারা, ২/১৮৫)

কুরআন সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ আসমানী কিতাব, যা সর্বশ্রেষ্ঠ ফেরেশতা জিবরীল আলাইহিস সালাম-এর মাধ্যমে অবতীর্ণ হয়েছে। রামাযান মাস আল-কুরআন তেলাওয়াতের মাস, আল-কুরআন বুঝার মাস, আল-কুরআন শিক্ষা করার মাস, আল-কুরআন আত্মস্থ করার মাস, আল-কুরআন মুখস্থ করার মাস। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘রামাযানে জিবরীল আলাইহিস সালাম রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কুরআন পাঠ করে শোনাতেন’।[1]

রামাযান মাসের ক্বদরের রাতে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি কুরআন অবতরণের ধারাবাহিকতা শুরু হয়ে সুদীর্ঘ ২৩ বছরে পরিপূর্ণ হয়েছে। শুরুটা মহিমান্বিত ক্বদরের রাতে হওয়ার কারণে আল্লাহ বলেন, ﴿إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ﴾ ‘নিঃসন্দেহে ক্বদরের (রামাযানের এক বিশেষ) রাতে আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি’ (আল-ক্বদর, ৯৭/১)

যে মানুষ যত বেশি কুরআনের পাশে থাকবে, তার সম্মানও তত বেশি হবে। কুরআন পড়া বা শিক্ষা দেওয়ার কাজে নিয়োজিত উত্তম সম্পদ অর্জন করার অন্তর্ভুক্ত। হাদীছে এসেছে,

عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ قَالَ خَرَجَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَنَحْنُ فِي الصُّفَّةِ فَقَالَ «أَيُّكُمْ يُحِبُّ أَنْ يَغْدُوَ كُلَّ يَوْم إِلَى بطحان أَو إِلَى العقيق فَيَأْتِي مِنْهُ بِنَاقَتَيْنِ كَوْمَاوَيْنِ فِي غَيْرِ إِثْمٍ وَلَا قَطْعِ رحم» فَقُلْنَا يَا رَسُول الله نُحِبُّ ذَلِكَ قَالَ «أَفَلَا يَغْدُو أَحَدُكُمْ إِلَى الْمَسْجِدِ فَيَعْلَمُ أَوْ يَقْرَأُ آيَتَيْنِ مِنْ كِتَابِ الله عز وَجل خير لَهُ من نَاقَة أَو نَاقَتَيْنِ وَثَلَاثٍ خَيْرٌ لَهُ مِنْ ثَلَاثٍ وَأَرْبَعٍ خَيْرٌ لَهُ مِنْ أَرْبَعٍ وَمِنْ أَعْدَادِهِنَّ مِنَ الْإِبِل.

উক্ববা ইবনু আমের রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা (একদিন) মসজিদের প্রাঙ্গণে বসেছিলাম। এ সময়ে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বের হয়ে আসলেন ও (আমাদেরকে) বললেন, তোমাদের কেউ প্রতিদিন সকালে ‘বুত্বহান’ অথবা ‘আক্বীক্ব’ বাজারে গিয়ে দুটি বড় কুঁজওয়ালা উটনী কোন অপরাধ সংঘটন ও আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা ছাড়া নিয়ে আসতে পছন্দ করবে? একথা শুনে আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের প্রত্যেকেই একাজ করতে পছন্দ করবে। তখন তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যদি তাই হয়, তাহলে তোমাদের কেউ কোনো মসজিদে গিয়ে সকালে আল্লাহর কিতাবের দুটি আয়াত (মানুষকে) শিক্ষা দেয় না বা (নিজে) শিক্ষাগ্রহণ করে না কেন? অথচ এ দুটি আয়াত শিক্ষা দেওয়া তার জন্য দুটি উটনী অথবা তিনটি আয়াত শিক্ষা দেওয়া তার জন্য তিনটি উটনী অথবা চারটি আয়াত শিক্ষা দেওয়া তার জন্য চারটি উটনীর চেয়েও উত্তম। সারকথা- কুরআনের যে কোনো সংখ্যক আয়াত, একই সংখ্যক উটনীর চেয়ে উত্তম।[2]

পবিত্র রামাযান মাসে একটা সময় বের করে যদি নিয়মিতভাবে কুরআন পড়া হয়, তবে ৩০ দিনে পুরো কুরআন শেষ করা যাবে। ছহীহ ও শুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াতে অনেক ছওয়াবের অধিকারী হওয়া যায়। ৩০ দিনে ৩০ পারা কুরআন তেলাওয়াতের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত শেষে প্রতি ওয়াক্ত×২পাতা এভাবে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত×২ পাতা= ১০ পাতা মিলে এক দিনে এক পারা তেলাওয়াত করা সম্ভব হয়। এভাবে ৩০ দিনে এক খতম কুরআন কখন তেলাওয়াত হয়ে যাবে, টেরই পাওয়া যাবে না। কুরআন শিক্ষার মাধ্যমে দুনিয়া ও আখেরাতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা যায়। উছমান রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সেই, যে নিজে কুরআন শিক্ষা করে ও অপরকে শিক্ষা দেয়’।[3]

সবচেয়ে বড় হেদায়াত আল-কুরআন প্রত্যাখ্যানকারীদের ক্বিয়ামতের দিন মূক ও বধির অবস্থায় উঠানো হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ﴿وَنَحْشُرُهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَى وُجُوهِهِمْ عُمْيًا وَبُكْمًا وَصُمًّا مَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ كُلَّمَا خَبَتْ زِدْنَاهُمْ سَعِيرًا﴾ ‘আমি কিয়ামতের দিন তাদেরকে সমবেত করব তাদের মুখে ভর দিয়ে চলা অবস্থায়, অন্ধ অবস্থায়, মূক অবস্থায়, বধির অবস্থায়। তাদের আবাসস্থল জাহান্নাম। যখন জাহান্নামের আগুন নির্বাপিত হওয়ার উপক্রম হবে, আমি তখন তাদের জন্য অগ্নি আরও বাড়িয়ে দেব’ (বানী ইসরাঈল, ১৭/৯৭)। কুরআন শিক্ষা না করা গাফেলদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার শামিল। আল্লাহ তাআলা বলেন, ﴿أُولَئِكَ كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ أُولَئِكَ هُمُ الْغَافِلُونَ﴾ ‘এরা চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায়, বরং এরা তাদের চেয়েও আরও অধম ও নিকৃষ্ট। এরাই হলো গাফেল’ (আল-আ‘রাফ, ৭/১৭৯)

কুরআন শিক্ষা করা থেকে যারা বিমুখ হয়ে থাকবে কুরআনের সাথে সম্পর্কহীন যাদের জীবন, কতই না দুর্ভাগ্য তাদের জীবন। তাদের পরিণতি সম্পর্কে আল-কুরআনে বলা হয়েছে,﴿وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنْكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَى - قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِي أَعْمَى وَقَدْ كُنْتُ بَصِيرًا - قَالَ كَذَلِكَ أَتَتْكَ آيَاتُنَا فَنَسِيتَهَا وَكَذَلِكَ الْيَوْمَ تُنْسَى﴾ ‘আর যে আমার যিকির (কুরআন) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, নিশ্চয় তার জীবনযাপন হবে সঙ্কুচিত এবং আমি ক্বিয়ামতের দিন তাকে অন্ধ অবস্থায় উঠাবো। সে বলবে, হে আমার রব, কেন আপনি আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন? অথচ আমিতো ছিলাম দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন! তিনি বলবেন, অনুরূপভাবে তোমার নিকট আমার আয়াতসমূহ এসেছিল, অতঃপর তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবে আজ তোমাকে ভুলে যাওয়া হলো’ (ত্বো-হা, ২০/১২৪-১২৬)

তাই আসুন! প্রতিজ্ঞাববদ্ধ হই, আমরা যারা ছহীহ ও শুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত করতে পারি না, এই রামাযান মাস থেকে নতুনভাবে শুরু করি। মহান রব্বুল আলামীন আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন!

শাজাহান কবীর শান্ত

প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত), রঘুনাথপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কালিগঞ্জ, সাতক্ষীরা।


[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৩২২০।

[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৯০৯; মিশকাত, হা/৮০৩।

[3]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০২৭।

Magazine