যুগে যুগে পৃথিবীতে এমন কিছু কীর্তিমান পুরুষের আবির্ভাব ঘটে, যারা পৃথিবীকে আলোকিত করেন তাঁদের জ্ঞানের ফোয়ারা দিয়ে। অল্প সময়ের জন্য তাঁরা পৃথিবীতে আসেন, এমন এক সম্পর্কের বন্ধন রেখে চলে যান, অনন্তকাল ধরে বেঁচে থাকেন পৃথিবীর মানুষের মধ্যে। এমন একজন কীর্তিমান ব্যক্তি ছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। যাঁর সৃষ্টি ছিল সার্বজনীন সামগ্রিকতায় পূর্ণ। যাঁর সৃষ্টি থেকে জ্ঞানপিপাসুরা পেয়েছে তাদের মনের খোরাক, মুসলিমরা পেয়েছে তাদের চেতনার সামগ্রী। তাঁর শিশু সাহিত্য পড়ে শিশুরা ভেবেছে তিনি তাদের একজন; অসহায় ও দঃখী মানুষ ভেবেছে তিনি তাদেরই মতো কোনো দুঃখীজন। যুককেরা তাঁর লেখায় পেয়েছে যৌবনের গান, বিদ্রোহীরা পেয়েছে সাহসের যোগান।
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একজন মুসলিম বিদ্রোহী কবি। তাঁর অনেক কবিতায়, প্রবন্ধে মুসলিমদের নিমিত্তে লিখিছেন এবং নিজেকে মুসলিম কবি হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। যদিও তার কিছু লেখনী ও ব্যক্তিগত জীবন ছিল বিতর্কিত ও সমালোচিত। তবে এখানে শুধু তাঁর কিছু ইসলামী রচনা ও ইসলামপ্রেমের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হবে।
১৯২২ সালে যখন নজরুল ইসলাম ‘নবযুগ’ পত্রিকার চাকরি ছেড়ে দিয়ে দেওঘরে চলে যান, দেওঘর স্টেশনে নামার পর একটি মজার ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। একদল পাণ্ডা এসে ধরে বসল তাঁকে। নিয়ে যাবে তাদের আখড়ায়। কিছুতেই যখন ছুটতে পারছিলেন না, তখন নজরুল ইসলাম বললেন, আমি তো মুসলমান, তোমরা আমাকে নিয়ে যেতে চাও কেন? নজরুলের কথা শুনেও পাণ্ডারা বিশ্বাস করল না। পাণ্ডাদের একজন বলল, না বাবু, আপনি ঝুট বাত বলতেয়াছেন, আপনি ঠিক হিন্দু লোক আছেন। নজরুল কিছুটা বিরক্তির সুরে বললেন, আরে কী মুশকিল, আমি হিন্দু হতে যাব কোন দুঃখে? আমার নাম কাজী নজরুল ইসলাম। আমি মুসলমান, আমার বাপ মুসলমান, আমার দাদা মুসলমান, আমার চৌদ্দ পুরুষ মুসলমান। এবার বলো, এরপরও কি তোমরা আমাকে তোমাদের আখড়ায় নিয়ে যেতে চাও? এবার হতাশ হলো পাণ্ডারা, বিশ্বাস করল নজরুলের কথা। একজন মুসলমানকে আখড়ায় নিয়ে যাওয়ার আগ্রহ তাদের নেই। পাণ্ডাদের কাছ থেকে ছাড় পেয়ে নজরুল তাঁর গন্তব্যে পৌঁছলেন।
নজরুল ইসলাম আমাদের শিখিয়ে গেছেন পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আপন স্বাতন্ত্র্যে ঝলসে উঠতে। এই স্বাতন্ত্র্য তাঁর নিজের মধ্যেও ছিল। তাঁর লেখার মাঝেই ফুটে উঠেছে তাঁর সেই পরিচয়। নিজের পরিচয় সম্পর্কে তিনি কোনো অস্পষ্টতা রেখে যাননি। তিনি বলেন,
‘আল্লাহ আমার প্রভু,
আমার নাহি নাহি ভয়।
আমার নবী মোহাম্মাদ,
যাঁহার তারিফ জগৎময়।
আমার কিসের শঙ্কা,
কুরআন আমার ডঙ্কা,
ইসলাম আমার ধর্ম,
মুসলিম আমার পরিচয়।’
(সংক্ষিপ্ত)
এই কবিতায় দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে তিনি নিজেকে মুসলিম বলে দাবি করেছেন। কেবল কবিতা আর গানে নয়, ‘আমার লীগ কংগ্রেস’ প্রবন্ধে তিনি পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, ‘আল্লাহ আমার প্রভু, রাসূলের আমি উম্মত, আল-কুরআন আমার পথ প্রদর্শক’। মহান আল্লাহর প্রতি কবির ঈমানকে আরও জোরালোভাবে স্পষ্ট করেছেন। তার ‘মোবারকবাদ’ কবিতায়-
‘আল্লাহ ছাড়া কারও কাছে কভু শির করিয়ো না নিচু,
এক আল্লাহ কাহারও বান্দা হবে না, বলো।’
ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘ইসলাম ধর্ম এসেছে পৃথিবীতে পূর্ণ শান্তি, সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে’। এ শান্তি ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালানো একজন মুসলিমের মৌলিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনের জন্যই যে তিনি কর্মক্ষেত্রে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন, সেকথাও তিনি অকপটে ব্যক্ত করেছেন তাঁর বিভিন্ন কবিতায়, গানে এমনকি প্রবন্ধ ও অভিভাষণে। তিনি তাঁর জাতীয় পরিচয় দিয়েছেন এভাবে-
‘ধর্মের পথে শহীদ যারা
আমরা সেই সে জাতি
সাম্য মৈত্রী এনেছি আমরা
বিশ্বে করেছি জ্ঞাতি।’
তিনি মহাগ্রন্থ আল-কুরআন গভীরভাবে অনুধাবনের চেষ্টা করেন; সাথে তাঁর মনে ছিল জিহাদী জাযবা। তিনি এক অভিভাষণে বলেন, ‘আল্লাহর সৃষ্টি এই পৃথিবী আজ অসুন্দর, নির্যাতনে, বিদ্বেষে পূর্ণ হয়ে উঠেছে। মানুষ আল্লাহর খলীফা অর্থৎ প্রতিনিধি-ভাইসরয়। মানুষ আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। এই পৃথিবীর রাজরাজেশ্বর একমাত্র আল্লাহ। যারা এই পৃথিবীতে নিজেদের রাজত্বের দাবি করে তারা শয়তান। সে শয়তানের সংহার করে, আমরা আল্লাহর রাজত্বের প্রতিষ্ঠা করব’।
ঘুণেধরা মুসলিমসমাজকে তাদের অতীত ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করার নিমিত্তে তরুণ-যুবসমাজকে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে জিহাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে নজরুল লিখেছেন,
‘বাজিছে দামামা, বাঁধো রে আমামা
শির উঁচু করি মুসলমান।
দাওত এসেছে নয়া জমানার
ভাঙা কিল্লায় ওড়ে নিশান॥
মুখেতে কলমা হাতে তলোয়ার,
বুকে ইসলামি জোশ দুর্বার,
হৃদয়ে লইয়া এশ্ক্ আল্লার
চল আগে চল বাজে বিষাণ।’
কবি নজরুল ভীরু-কাপুরুষ হয়ে পড়া মুসলিম জাতির মাঝে সাহসের সঞ্চার করার জন্য একটি গানের মধ্যে বলেন,
‘উঠুক তুফান পাপ-দরিয়ায়-
আমি কি তায় ভয় করি
পাক্কা ঈমান-তক্তা দিয়ে
গড়া যে আমার তরী॥
দাঁড় এ তরীর নামাজ, রোজা, হজ্ব ও জাকাত,
উঠুক না মেঘ, আসুক বিপদ-যত বজ্রপাত,
আমি যাব বেহশত-বন্দরেতে রে
এই যে কিশতীতে চড়ি॥’
মুসলিমদের পুনর্জাগরণের জন্য আল্লাহর কাছে তিনি প্রার্থনা করে বলেছেন,
‘তওফিক দাও খোদা ইসলামে,
মুসলিম জাঁহা পুন হোক আবাদ।’
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম একটা স্তম্ভ হলো যাকাত। যাকাত ধনী ও গরীবের মধ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক। সমাজের মানুষের মাঝে সাম্য প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে যাকাত প্রদানের কোনো বিকল্প নেই। ধনী যেমন যাকাত দিবে, গরীব মুসলিম সেটা গ্রহণ করবে। এভাবে সকল মুসলিম মিলে একটি ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হবে। যাকাতের ইঙ্গিত দিয়ে কবি বলেন,
‘বুক খালি ক’রে আপনারে সাজ দাও যাকাত,
ক’রো না হিসাবী, আজি হিসাবের অঙ্কপাত!’
ধনীরা যদি আল্লাহর হুকুম মেনে সময়মতো যাকাত প্রদান করত, তাহলে মানুষের দরিদ্রতা অনেকাংশে কমে যেত। মানুষকে যাকাত প্রদানে উৎসাহ দিয়ে ইসলামী রেনেসাঁর কবি নজরুল বলেছেন,
‘দে জাকাত দে জাকাত তোরা দেরে জাকাত
তোর দিল খুলবে পরে ওরে আগে খুলুক হাত॥
দেখ পাক কোরআন শোন নবীজীর ফরমান
ভোগের তরে আসেনি দুনিয়ায় মুসলমান
তোর একার তরে দেননি খোদা দৌলতের খেলাত॥
তোর দরদালানে কাঁদে ভুখা হাজারো মুসলিম
আছে দৌলতে তোর তাদেরও ভাগ বলেছেন রহিম
বলেছেন রহমানুর রাহিম, বলেছেন রসুলে কারিম।’
জাহেলি যুগে নারীদের কোনো অধিকার ছিল না, মর্যাদা ছিল না, তাদেরকে ভোগ্য পণ্যরূপে ব্যবহার করা হতো। তাদের মুক্তির দূত হিসেবে আগমন করেন নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। ইসলামই প্রথম তাদেরকে পূর্ণ মর্যাদা দেয়, অধিকার দেয়। নারীর ওপর পুরুষের যেমন অধিকার আছে, তেমনি পুরুষের ওপর নারীরও অধিকার আছে। কবি নজরুল তার কবিতায় সেটিই প্রমাণ করে বলেন,
‘নারীরে প্রথম দিয়াছি মুক্তি নর- সম অধিকার
মানুষে গড়া প্রাচীর ভাঙ্গিয়া করিয়াছি একাকার,
আঁধার রাতের বোরখা উতারি এনেছি আশায় ভাতি।
আমরা সেই সে জাতি॥’
মুসলিমদের ধর্মীয় উৎসব ঈদ। ঈদ হলো মুসলিম জাতির আত্মার মিলন। ইসলাম শান্তির বাণী নিয়ে ধনী-গরীব সকলের গৃহে আনন্দের প্লাবন বইয়ে দেয়। ঈদ এমন একটি উৎসব, যেখানে মুসলিম জামাআত সকল বাধা, শঠতা ভুলে গিয়ে এক কাতারে শামিল হয়। কবির ভাষায়,
‘ইসলাম বলে, সকলের তরে মোরা সবাই,
সুখ-দুখ সম-ভাগ করে নেব সকলে ভাই।’
মুসলিমদের ধর্মীয় দুটি উৎসবের একটি হলো ঈদুল আযহা। এই ঈদে ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা ইবরাহীমী সুন্নাত পালন করার জন্য পশু কুরবানী করে। একদা মৌলভী তরিকুল আলম এক প্রবন্ধ লিখে বললেন, কুরবানীতে অকারণে পশু হত্যা করা হয়, এমন ভয়াবহ রক্তপাতের কোনো মানে নাই। নজরুল ‘কোরবানি’ কবিতায় এর তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন,
‘ঐ খুনের খুঁটিতে কল্যাণ-কেতু, লক্ষ্য ঐ তোরণ!
আজ আল্লার নামে জান কোরবানে ঈদের পূত বোধন।
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্বোধন।’
মুসলিম উম্মাহ আজ বিভিন্ন দল, মত, ইজম, মতবাদে ক্ষতবিক্ষত। মুখে আল্লাহর আধিপত্য স্বীকার করলেও ইসলামের রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধারণ না করে ইসলাম থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে; বরংচ ইয়াহূদী-খ্রিষ্টানদের বস্তাপচা মতবাদসমূহ ও তন্ত্র-মন্ত্রকে আঁকড়ে ধরছে। মুসলিম জাতির এই করুণ ও দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা দেখে কবি নজরুল দুঃখ করে বলেছেন,
‘জাগে না সে জোশ লয়ে আর মুসলমান
করিল জয় যে তেজ লয়ে দুনিয়া জাহান॥
নাহি সাচ্চাই সিদ্দিকের,
উমরের নাহি সে ত্যাগ আর,
নাহি সে বেলালের ইমান,
নাহি আলির জুলফিকার,
নাহি আর সে জেহাদ লাগি
বীর শহিদান॥
নাহি আর বাজুতে কুওত
নাহি খালেদ-মুসা-তারেক,
নাহি বাদশাহি তখ্ত তাউস,
ফকির আজ দুনিয়ার মালিক,
ইসলাম কেতাবে শুধু,
মুসলিম গোরস্থান॥’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন বাংলা সাহিত্যের মধ্যাহ্ন আকাশের সূর্যের মতো তাঁর আলোকরশ্মি ছড়িয়ে দিয়েছেন, নজরুল তখন বিজয় কেতন উড়িয়ে বাংলা সাহিত্যে তাঁর আগমনী বার্তা ঘোষণা করেছেন। কবি যে কাব্য চর্চা করেছেন তা নিজেকে কবি হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নয়; তাঁর এ কাব্য চর্চাও ছিল এ দায়িত্বানুভূতিতে পরিপূর্ণ। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমার কবিতা আমার শক্তি নয়, আল্লাহর দেওয়া শক্তি আমি উপলক্ষ্য মাত্র। বীণার বেণুতে সুর বাজে কিন্তু বাজান যে গুণী, সমস্ত প্রশংসা তাঁরই। আমার কবিতা যারা পড়েছেন তারাই সাক্ষি; আমি মুসলিমদেরকে সংঘবদ্ধ করার জন্যই তাদের জড়ত্ব, অলস্য, কর্মবিমুখিতা, ক্লৈব্য, অবিশ্বাস দূর করার জন্য আজীবন চেষ্টা করেছি’।
তিনি বাংলার মুসলিমদের সর্বদা শির উঁচু করে দাঁড়াবার জন্য আহ্বান করেন। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নিকট মাথা নত করাকে ঘৃণা করতেন। মুসলিম জাতির জাগরণের বাণী শুনিয়েছেন তিনি ঘুমন্ত জাতিকে। স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তাদের দায়িত্বের কথা। বিশ্বের নেতৃত্ব গ্রহণের জন্যই আল্লাহ এ মুসলিম জাতিকে দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি তাঁর গানে কবিতায় সে কথায় নানাভাবে মুসলিমদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
পরিশেষে এতটুকুই বলতে চাই, কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একজন মুসলিম বিদ্রোহী কবি। বাংলার আপামর জনসাধারণের মানসপটে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন, সাথে ইসলামের বিজয়বাণী উচ্চারণেও তাঁর বলিষ্ঠ শব্দস্রোত মুসলিম সমাজকে আন্দোলিত করেছে।
দু‘আ করি আল্লাহ তার ভুলত্রুটি ক্ষমা করে উত্তম প্রতিদান দান করুন- আমীন!
মো. আকরাম হোসেন
শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।