শবেবরাত কী?
‘শব’ ও ‘বরাত’ এখানে দুটি শব্দ। এই শব্দ দুটি সরাসরি এসেছে ফারসী থেকে। ‘শব’ শব্দের অর্থ ‘রাত’। ‘বরাত’ শব্দের অর্থ বলা হয় ‘সৌভাগ্য’। দুটিকে মিলিয়ে হচ্ছে সৌভাগ্য রাত বা রজনি। উপমহাদেশের কথিত ছূফী-সুন্নীরা শা‘বান মাসের ১৫তম রাতকে বিশেষ মর্যাদায় পালন করে, যা বিদআত। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে শা‘বান মাসের কোনো রাতকে সৌভাগ্যের রাত বলে ঘোষণা করা হয়নি; ইসলামে সৌভাগ্যের রাত হলো লায়লাতুল ক্বদর।
শবেবরাতের দালীলিক পর্যালোচনা :
ছূফী-সুন্নীরা কুরআনের সূরা আদ-দুখানের ৩ নং আয়াত দিয়ে শবেবরাত প্রমাণের ব্যর্থ প্রয়াস চালান। আয়াতটি হলো, ﴿إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ﴾ ‘নিশ্চয়ই আমি এটি (আল-কুরআন) এক বরকত ও কল্যাণময় রাতে নাযিল করেছি। নিশ্চয়ই আমি তো (জাহান্নাম থেকে) সতর্ককারী’ (আদ-দুখান, ৪৪/৩)।
সালাফে ছালেহীনের মতে, উক্ত আয়াতে ‘লায়লাতুম মুবারাকা’ হলো ‘লায়লাতুল ক্বদর’। তবে শুধু তাবেঈ ইকরিমা রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, তা হলো মধ্য শা‘বানের রজনি। তবে এ মতটি কুরআনের দলীল দ্বারাই বাতিল হয়ে যায়। কারণ মহান রব্বুল আলামীন মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে বলেছেন,﴿شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ﴾ ‘রামাযান মাস, যার মধ্যে বিশ্বমানবের জন্য পথ-প্রদর্শক এবং সু-পথের উজ্জ্বল নিদর্শন ও (হক্ব ও বাতিলের) প্রভেদকারী কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে’ (আল-বাক্বারা, ২/১৮৫)। এই আয়াতটি দ্ব্যর্থহীনভাবে জানাচ্ছে যে, কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময় রামাযান মাস। তাছাড়া সূরা ‘আল-ক্বদর’-এ স্পষ্টভাবে আছে পবিত্র কুরআন মর্যাদাপূর্ণ রাতে নাযিল হয়েছে অর্থাৎ ক্বদরের রাতে। যা ছহীহ হাদীছ দ্বারাও স্পষ্টভাবে প্রমাণিত।
তাহলে সূরা আদ-দুখানের যে আয়াতে বরকতময় রাত্রিতে কুরআন নাযিলের কথা বলা হয়েছে, তা হচ্ছে শবেক্বদর এবং সেটা হবে রামাযান মাসে। যদি কেউ বলে বা মনে করে যে, এই ‘লায়লাতুম মুবারাকা’ হলো রামাযান ছাড়া শা‘বান মাসে, তাহলে সে আল্লাহর নামে মিথ্যা বলে কুরআনকে বিকৃত এবং প্রশ্নবিদ্ধ করল।
শবেবরাত নিয়ে বিভিন্ন কিতাবে অসংখ্য জাল, যঈফ এবং সনদবিহীন হাদীছ রয়েছে। শা‘বানের মধ্যরজনির ফযীলত সম্পর্কিত সচরাচর যেসব হাদীছ পেশ করা হয়—
আলী ইবনে আবূ তালেব রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যখন মধ্য শা‘বানের রাত আসে, তখন তোমরা রাত জেগে ছালাত আদায় করবে আর দিবসে ছিয়াম পালন করবে। কেননা আল্লাহ তাআলা সূর্যাস্তের পর দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করে বলেন, আছে কি কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী? আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোনো রিযিক্ব প্রার্থনাকারী? আমি রিযিক্ব দান করব। আছে কি কোনো বিপদে নিপতিত ব্যক্তি? আমি তাকে সুস্থতা দান করব। এভাবে ফজর পর্যন্ত বলা হয়ে থাকে’।[1]
প্রথমত, এ হাদীছটি দুর্বল। কেননা এ হাদীছের সনদে (সূত্রে) ইবনু আবী সাবরাহ নামে এক ব্যক্তি আছেন, যিনি অধিকাংশ হাদীছবিশারদের নিকট হাদীছ জালকারী হিসাবে পরিচিত। এ যুগের বিখ্যাত মুহাদ্দিছ নাছিরুদ্দীন আলবানী রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, হাদীছটি সনদের দিক দিয়ে একেবারেই দুর্বল।
দ্বিতীয়ত, অপর একটি ছহীহ হাদীছের বিরোধী হওয়ার কারণে এ হাদীছটি গ্রহণযোগ্য নয়। সে ছহীহ হাদীছটি হাদীছে নুযূল নামে পরিচিত, যা ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম রহিমাহুমুল্লাহ তাদের কিতাবে বর্ণনা করেছেন।
আবু হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِينَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الآخِرُ يَقُولُ مَنْ يَدْعُونِى فَأَسْتَجِيبَ لَهُ مَنْ يَسْأَلُنِى فَأُعْطِيَهُ مَنْ يَسْتَغْفِرُنِى فَأَغْفِرَ لَهُ ‘মহান আল্লাহ প্রতি রাতের শেষ-তৃতীয়াংশে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করে বান্দাদেরকে বলতে থাকেন, যে আমার কাছে দু‘আ করবে, আমি তার দু‘আ কবুল করব। যে আমার কাছে চাইবে, আমি তাকে তা দান করব। যে আমার কাছে গুনাহ মাফ চাইবে, আমি তাকে মাফ করব’।[2]
আরেকটি হাদীছ পেশ করা হয়, উছমান ইবনু আবিল আছ রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যখন মধ্য শা‘বানের রাত আসে, তখন একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা দেয়, আছে কি কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী? আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কেউ কিছু চাইবার? আমি তাকে তা দিয়ে দিব’। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মুশরিক ও ব্যভিচারী বাদে সকল প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা কবুল করা হয়’।[3]
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বুঝা যায়, আল্লাহ প্রতি রাতে নিকট আসমানে নেমে আসেন। তিনি বান্দার প্রার্থনা কবুল করেন তবে মুশরিক ও হিংসুকদের ছাড়া। আর এসব হাদীছের কোথাও শবেবরাত নামে কিছুই নেই। যা উপমহাদেশে ভাগ্যরজনি নামে পরিচিত। এই রাতের জন্য বিশেষ কোনো ছালাত নেই। কেননা এই রাতের যে ফযীলতের কথা এসেছে, তা অন্যান্য দিনের মতোই। সুতরাং এই রাতকে ঘিরে নতুন নতুন বিদআতী আমল সৃষ্টি করা অযৌক্তিক।
ইমাম আবূ বকর আত-তারতূশী রহিমাহুল্লাহ তার কিতাব (الحوادث والبدع) ‘আল-হাওয়াদিছ ওয়াল বিদা’-এ উল্লেখ করেন, ইবনে ওয়াদ্দাহ রহিমাহুল্লাহ যায়েদ ইবনে আসলাম রযিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণনা করে বলেন, আমাদের কোনো উস্তায বা কোনো ফক্বীহকে মধ্য শা‘বানের রাতকে কোনো রকম গুরুত্ব দিতে দেখিনি। তারা মাকহূলের হাদীছের দিকেও তাকাননি এবং এ রাতকে অন্য রাতের চেয়ে আমলের ক্ষেত্রে মর্যাদাসম্পন্ন মনে করতেন না।
ছূফী-সুন্নীদের শবেবরাতের বিশ্বাস :
যারা শবেবরাতের দলীল দেয়, তাদের দলীল বিশ্লেষণে আমরা যা পেয়েছি তার সাথে ছূফী-সুন্নীরা যে শবেবরাত পালন করে তার কোনো মিল নেই। আসুন দেখি, ছূফী-সুন্নীরা এই রাতে কী বিশ্বাস করে এবং কী কী পালন করে।
(১) শবে বরাত মানে ভাগ্যরজনি এই রাতে সবার ভাগ্য নতুন করে লেখা হয়।
(২) এই রাতের দিনে অধিক ছওয়াবের আশায় ছিয়াম রাখা।
(৩) এই রাতে আল্লাহ সাধারণ ক্ষমা করেন।
(৪) এই রাতে বয়স ও রিযিক্ব নির্ধারণ করা হয়।
(৫) কবরবাসীকে আলোকিত করতে কবরে মোমবাতি, আগরবাতি জ্বালানো হয়।
(৬) অধিক ছওয়াবের আশায় এই দিনেই বেশি পরিমাণে দান-খয়রাত বিশেষ করে মৃতদের নামে বিশেষভাবে দান-খয়রাত করা এবং কাঙালিভোজের আয়োজন করা।
(৭) এই রাত লায়লাতুল ক্বদরের চাইতেও বেশি মর্যাদাবান মনে করা।
(৮) এই রাতে বিশেষ মর্যাদায় কবর যিয়ারত এবং ছওয়াবের নিয়্যতে বিভিন্ন মাযারে গিয়ে যিয়ারত করা।
(৯) এই রাতে শীআ-রাফেযীদের মিথ্যা ও কল্পিত ইমাম মাহদীর জন্মদিবস পালন করা।
(১০) এই রাতে হালুয়া, রুটি ও গোশত পাকানো এবং তা পাড়া-প্রতিবেশীদের মাঝে বিলানো।
(১১) এই রাতে আগরবাতি, মোমবাতি জ্বালানো, আলোকসজ্জা এবং আনন্দ উৎসবে পটকা ফুটানো।
(১২) এই দিনে সন্ধ্যায় গোসল করে নতুন কাপড় পরে সারা রাত ছালাত পড়া, সেই সাথে অধিক ছওয়াবের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মসজিদে গমন করা।
(১৩) এই রাতে সূরা ইয়াসীন তিনবার পাঠ করা। প্রথমবার বয়স বৃদ্ধির জন্য, দ্বিতীয়বার বালা-মুছীবত দূর করার জন্য এবং তৃতীয়বার কোনো মানুষের মুখাপেক্ষী না হওয়ার জন্য।
(১৪) এই মনে করা যে, এই দিনে উহুদের যুদ্ধে কাফেররা নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দাঁত মোবারক ভেঙেছিল।
(১৫) এই রাতে যমযমের পানি অন্যান্য দিনের চেয়ে বৃদ্ধি পায় ধারণা করা।
(১৬) গত এক বছরে মৃত মানুষের রূহগুলোর আগের রূহের সাথে যমীনে নেমে আসে।
(১৭) এই রাতে সূরা আদ-দুখান পাঠকারীর জন্য সারা দিন ৭০ হাজার ফেরেশতা দু‘আ করবে মনে করে তা পাঠ করা।
(১৮) এই দিনে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে হালুয়া-রুটি, মুরগি, পোলাও রান্না করে পাঠানো।
শবেবরাতের নামে এসবই কুরআন ও সুন্নাহ পরিপন্থী।
শবেবরাতের হালুয়া-রুটি :
শবেবরাতের দিন উহুদ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দন্ত মোবারক শহীদ হয়েছিল। এজন্য তিনি শক্ত খাবার খেতে না পারায় নরম খাদ্য হিসেবে হালুয়া-রুটি খেয়েছিলেন। তাই রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দাঁত ভাঙার ব্যথায় সমবেদনাস্বরূপ হালুয়া-রুটি খেতে হবে। এ যুক্তিটি হাস্যকর। কারণ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দাঁত ভেঙেছিল উহুদ যুদ্ধে। আর এ যুদ্ধ শা‘বান মাসে হয়নি, বরং তা হয়েছিল ৩য় হিজরীর শাওয়াল মাসের ১১ তারিখ শনিবার সকাল বেলায়।
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দাঁত ভাঙল শাওয়াল মাসে, আর আমরা শাওয়াল মাস আসার কয়েক মাস আগেই সেই দাঁত ভাঙার ব্যথা অনুভব করে হালুয়া-রুটি খাচ্ছি!
একেই উর্দূতে বলে, ‘নাখুন কাটকে শহীদ হোনা’। অর্থাৎ নখ কেটে শহীদ হওয়া বা শহীদ হওয়ার দাবি করা। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দাঁত যুদ্ধে ভেঙেছিল। এটা অনিচ্ছাকৃতভাবে হয়েছিল। কাজেই ঐ কারণে কারো ইচ্ছাপূর্বক নিজ দাঁত ভাঙা বা সেজন্য হালুয়া-রুটি খাওয়া একেবারেই অযৌক্তিক।[4]
শেষকথা :
উপরিউক্ত সকল তথ্য-প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত যে, শবেবরাত নামে বা সমর্থনে কোনো আমলই কুরআন ও ছহীহ হাদীছে নেই।
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।
[1]. ইবনু মাজাহ, হা/১৩৮৮; মিশকাত, হা/১৩০৮; মাওযূ‘, যঈফ তারগীব, হা/৬৩২; মাওযূ‘, সিলসিলা যঈফা, হা/২১৩২।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/১১৪৫, ৬৩২১, ৭৪৭৬; ছহীহ মুসলিম, ৬/২৩, হা/৭৫৮; আহমাদ, হা/৭৫৯৫।
[3]. ইমাম বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান।
[4]. মাসিক আল-ইতিছাম (৪র্থ বর্ষ, ৬ষ্ঠ সংখ্যা, এপ্রিল ২০২০), পৃ. ২৬।