কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ঈদুল আযহা : করণীয় ও বর্জনীয়

post title will place here

ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।

দুর্বল! ভীরু! চুপ রহো, ওহো খাম্‌খা ক্ষুব্ধ মন!

ধ্বনি ওঠে রণি দূর বাণীর,–

আজিকার এ খুন কোর্‌বানির!

কুরবানীর সূচনাকাল অতি প্রাচীন। আমাদের আদি পিতা আদম আলাইহিস সালাম-এর যুগ থেকেই কুরবানীর প্রচলন। আদম আলাইহিস সালাম-এর দুই পুত্র হাবীল ও কাবীল। কাবীল হাবীলের চেয়ে বয়সে বড়। একদা উভয়েই আল্লাহ তাআলার জন্য কুরবানী করেছিল। কিন্তু কী জন্য করেছিল তার বর্ণনায় বিশুদ্ধভাবে কিছু পাওয়া যায় না। ইমাম ইবনু কাছীর রহিমাহুল্লাহ তার তাফসীরে এ সম্পর্কে কয়েকটি বর্ণনা নিয়ে এসেছেন, যেগুলো বিশুদ্ধ নয়। তাই বলা যায়, তখন কুরবানীর বিধান ছিল ও একদা তারা উভয়ে কুরবানী করেছিল। কাবীলের কুরবানী কবুল না হওয়ায় হাবীলের সাথে হিংসা করে সে তাকে হত্যা করে। তবে একথা প্রসিদ্ধ যে, দুনিয়ার প্রাথমিক অবস্থায় আদম ও হাওয়া আলাইহিমাস সালাম-এর একটি ছেলে ও একটি মেয়ে একসাথে জন্মগ্রহণ করত। পরবর্তী গর্ভে অনুরূপ একটি ছেলে ও একটি মেয়ে জন্মগ্রহণ করত। তখন পূর্ব গর্ভের ছেলে-মেয়ের সাথে পরবর্তী গর্ভের ছেলে-মেয়ের বিবাহ দেওয়া হতো। হাবীলের যমজ বোন সুন্দরী ছিল না। কিন্তু কাবীলের যমজ বোন সুন্দরী ছিল। তৎকালীন শরীআত অনুযায়ী হাবীলের বিবাহ কাবীলের যমজ বোনের সাথে আর কাবীলের বিবাহ হাবীলের যমজ বোনের সাথে হবার কথা। কিন্তু কাবীল তা মানতে অস্বীকৃতি জানাল।

আদম আলাইহিস সালাম কাবীলকে বুঝালেন। কিন্তু সে বুঝতে চেষ্টা করল না। অবশেষে আদম আলাইহিস সালাম উভয়কে আল্লাহ তাআলার নামে কুরবানী পেশ করার নির্দেশ দিলেন এবং বললেন, যার কুরবানী কবুল হবে, কাবীলের যমজ বোনকে তার সাথে বিবাহ দেওয়া হবে। হাবীল ছিল মেষপালক, ফলে হাবীল একটি মোটাতাজা মেষ কুরবানীর জন্য পেশ করল। আর কাবীল ছিল কৃষক, সে কিছু গমের শীষ কুরবানীর জন্য পেশ করল। আসমান থেকে আগুন এসে হাবীলের কুরবানী জ্বালিয়ে দিল, যা কবুল হবার নিদর্শন। কাবীলের কুরবানী গ্রহণ করা হলো না। ফলে হিংসায় সে হাবীলকে হত্যা করার মনস্থ করল। তবে উক্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে তারা কুরবানী করেছিল বলে এর কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না।[1]

মহান আল্লাহ বলেন,وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آدَمَ بِالْحَقِّ إِذْ قَرَّبَا قُرْبَاناً فَتُقُبِّلَ مِنْ أَحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنْ الآخَرِ قَالَ لأَقْتُلَنَّكَ قَالَ إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللهُ مِنْ الْمُتَّقِينَ ‘আদমের দুই পুত্রের (হাবীল ও কাবীলের) বৃত্তান্ত তুমি তাদেরকে যথাযথভাবে শোনাও, যখন তারা উভয়ে কুরবানী করেছিল, তখন একজনের কুরবানী কবুল হলো এবং অন্যজনের কুরবানী কবুল হলো না। (তাদের একজন) বলল, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। (অপরজন) বলল, আল্লাহ তো সংযমীদের কুরবানীই কবুল করে থাকেন’ (আল-মায়েদাহ, ৫/২৭)। এভাবে কুরবানীর প্রচলন প্রত্যেক জাতির মধ্যেই ছিল। মহান আল্লাহ বলেন,وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكاً لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللهِ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الأَنْعَامِ فَإِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَلَهُ أَسْلِمُوا وَبَشِّرْ الْمُخْبِتِينَ ‘আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানীর নিয়ম করে দিয়েছি; যাতে আমি তাদেরকে জীবনোপকরণস্বরূপ যেসব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছি, সেগুলোর উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। তোমাদের উপাস্য একমাত্র উপাস্য। সুতরাং তোমরা তাঁরই নিকট আত্মসমর্পণ করো। আর সুসংবাদ দাও বিনীতগণকে’ (আল-হজ্জ, ২২/৩৪)

ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর কুরবানীর আদর্শ হওয়ার ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانظُرْ مَاذَا تَرَى قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِن شَاء اللهُ مِنَ الصَّابِرِينَ- فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ- وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَا إِبْرَاهِيمُ- قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ- إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْبَلَاء الْمُبِينُ- وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ – وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآخِرِينَ ‘অতঃপর যখন সে তার সাথে চলাফেরা করার বয়সে পৌঁছল, তখন সে বলল, হে প্রিয় বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবেহ করছি। অতএব দেখো তোমার কী অভিমত? সে বলল, হে আমার পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, আপনি তাই করুন। আমাকে ইনশা-আল্লাহ আপনি অবশ্যই ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন। অতঃপর তারা উভয়ে যখন আত্মসমর্পণ করল এবং সে তাকে (ইসমাঈলকে) কাত করে শুইয়ে দিল, তখন আমি তাকে আহ্বান করে বললাম, হে ইবরাহীম! তুমি তো স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করে দেখালে। আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আর আমি তার পরিবর্তে যবেহ করার জন্য এক মহান জন্তু দিয়ে তাকে মুক্ত করে নিলাম। আর তার জন্য এ বিষয়টি পরবর্তীদের জন্য স্মরণীয় করে রাখলাম’ (আছ-ছাফফাত, ৩৭/১০২-১০৮)

উল্লেখ্য, স্বপ্ন দেখে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর তিন দিন সকালে উট কুরবানী করার কথা বিশুদ্ধ নয়।

ইসলামী শরীআতে যিলহজ্জের ১০ তারিখ মুসলিম উম্মাহর জন্য পবিত্র ঈদের দিন। এ দিনের কয়েকটি নাম হলো—

 (১) يَوْمُ النَّحْرِ (২) يَوْمُ الْأُضْحِيَّةِ (৩) يَوْمُ عِيْدِ الْأَضْحَى (৪) يَوْمُ الْحَجِّ الْأَكْبَرِ.

يَوْمُ النَّحْرِ এর يَوْمٌ অর্থ দিন এবং النَّحْرِ অর্থ কুরবানী দেওয়া। অর্থাৎ يَوْمُ النَّحْرِ অর্থ কুরবানীর দিন। যেহেতু এ দিনে মহান আল্লাহর নির্দেশে কুরবানী করা হয়ে থাকে, তাই একে يَوْمُ النَّحْرِ বলা হয়। যেমন আল্লাহ তাআলা কুরআনে النَّحْرِ শব্দ প্রয়োগে কুরবানীর নির্দেশ দিয়ে বলেন,إِنَّآ أَعْطَيْنٰكَ الْكَوْثَرَ - فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ ‘নিশ্চয় আমি আপনাকে আল-কাউছার দান করেছি। অতএব, আপনার রবের উদ্দেশ্যেই ছালাত আদায় করুন এবং নহর (কুরবানী) করুন’ (আল-কাউছার, ১০৮/১-২)

এ দিনের অপর কয়েকটি নামের প্রথম নামটি হলো, يَوْمُ الْأُضْحِيَّةِ উযহিয়্যাহ (اَلْأُضْحِيَّةِ) শব্দ দ্বারা কুরবানীর পশুকে বুঝানো হয়।

এ দিনের অপর নাম হলো, يَوْمُ عِيْدِ الْأَضْحَىٰ যার মধ্যে الْأَضْحَىٰ অর্থ পূর্বাহ্ন। যেহেতু এ দিনে কুরবানীর পশুটিকে পূর্বাহ্নে যবেহ করা হয় বা প্রত্যুষে ঈদের ছালাত আদায় করা হয়, তাই এ দিনকে বলা হয়, يَوْمُ عِيْدِ الْأَضْحَىٰ।

এ দিনের অপর নাম হলো, يَوْمُ الْحَجِّ الْأَكْبَرِ। হাজীগণ এ দিনে ১টি ফরয এবং ৪টি ওয়াজিব মিলিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মোট পাঁচটি কাজ করার মধ্য দিয়ে হজ্জ সম্পাদন করে থাকেন বিধায় এ দিনকে يَوْمُ الحَجِّ الْأَكْبَرِ বলা হয়। যেমন ইবনু উমার রযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَقَفَ يَوْمَ النَّحْرِ بَيْنَ الْجَمَرَاتِ فِى الْحَجَّةِ الَّتِى حَجَّ فَقَالَ أَىُّ يَوْمٍ هَذَا قَالُوا يَوْمُ النَّحْرِ قَالَ هَذَا يَوْمُ الْحَجِّ الأَكْبَرِ ‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ্জ আদায়কালে নহরের দিন জামরাতের মধ্যবর্তী স্থলে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘এটি কোন দিন? লোকেরা বললেন, আজ কুরবানীর দিন। তিনি বললেন, ‘আজ বড় হজ্জের দিন’।[2]

এ দিনের গুরুত্ব বর্ণনা করে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,‏‏إِنَّ أَعْظَمَ الْأَيَّامِ عِنْدَ اللّٰهِ تَبَارَكَ وَتَعَالَى يَوْمُ النَّحْرِ ثُمَّ يَوْمُ الْقَرِّ ‘প্রাচুর্য্যময় মহান আল্লাহর কাছে সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন দিন হলো কুরবানীর দিন, তারপর মেহমানদারীর দিন, সেটি হলো দ্বিতীয় দিন’।[3]

ঈদুল আযহায় আমাদের গুরুত্বপূর্ণ করণীয় :

(১) যিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখ অর্থাৎ ঈদুল আযহার দিন এবং তার পরবর্তী আইয়ামুত তাশরীকের তিন দিন যথাক্রমে ১১, ১২ ও ১৩ তারিখের দিনগুলোতে আমাদের প্রথম করণীয় হলো, ‘বেশি বেশি তাকবীর দেওয়া এবং আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লার যিকর করা’। যিলহজ্জ মাসের চাঁদ উদিত হওয়ার পর থেকে ১৩ তারিখের সূর্যাস্তের আগমুহূর্ত পর্যন্ত দুটি নিয়মে তাকবীর পাঠ করার সুন্নাহ আমল ছহীহ সুন্নাহতে পাওয়া যায়। ফিক্বহের পরিভাষায় সেগুলোকে (ক) আত-তাকবীর আল-মুত্বলাক্ব (اَلتَّكْبِيْرُ الْمُطْلَقُ) এবং (খ) আত-তাকবীর আল-মুক্বায়্যাদ (اَلتَّكْبِيْرُ الْمُقَيَّدُ) বলা হয়।

(ক) আত-তাকবীর আল-মুত্বলাক্ব (اَلتَّكْبِيْرُ الْمُطْلَقُ): যিলহজ্জ মাসের চাঁদ উদিত হওয়ার পর থেকে ১৩ তারিখের সূর্যাস্ত পর্যন্ত তাকবীর পাঠের নির্দেশ ছহীহ সুন্নাহতে রয়েছে, যাকে আত-তাকবীর আল-মুত্বলাক্ব বলা হয়। এ সময়ের মধ্যে পঠিত তাকবীরগুলো কোনো সুনির্ধারিত সময়, স্থান, সংখ্যা বা শর্ত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। অর্থাৎ তাকবীরগুলো সাধারণভাবে এ সময়সীমার মধ্যে যেকোনো সময়েই পাঠ করা সুন্নাত।

(খ) আত-তাকবীর আল-মুক্বায়্যাদ (اَلتَّكْبِيْرُ الْمُقَيَّدُ): যিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখ ফজরের পর থেকে ঈদুল আযহা এবং তার পরবর্তী আইয়ামুত তাশরীকের তিন দিন যথাক্রমে ১১, ১২ ও ১৩ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত প্রতি ওয়াক্তের ফরয ছালাত শেষে একাকী ও সশব্দে তাকবীর পাঠ করা সুন্নাত, যাকে ফিক্বহের পরিভাষায় আত-তাকবীর আল-মুক্বায়্যাদ বলা হয়। আল্লাহ তাআলা এ প্রসঙ্গে বলেন, وَاذْكُرُوْا اللّٰهَ فِىٓ أَيَّامٍ مَّعْدُوْدٰتٍ ‘আর স্মরণ করো আল্লাহকে নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনে’ (আল-বাক্বারা, ২/২০৩)। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ বলেন, ইবনে আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,وَالْأَيَّامُ المَعْدُوْدَاتُ: أَيَّامُ التَّشْرِيْقِ ‘নির্দিষ্ট দিনগুলো বলতে আইয়্যামুত-তাশরীককে বুঝানো হয়েছে’।[4]

আত-তাকবীর আল-মুত্বলাক্ব (اَلتَّكْبِيْرُ الْمُطْلَقُ), আত-তাকবীর আল-মুক্বায়্যাদ (اَلتَّكْبِيْرُ الْمُقَيَّدُ) উভয় নিয়মে এ মর্মে ছহীহ সুন্নাহতে বর্ণিত তাকবীরগুলো হলো—

(ক) اللّٰهُ أَكْبَرُ، اللّٰهُ أَكْبَرُ، لَا إِلَهَ إِلَّا اللّٰهُ، وَاللّٰهُ أَكْبَرُ، اللّٰهُ أَكْبَرُ، وَلِلّٰهِ الْحَمْدُ অর্থাৎ ‘আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান। আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো উপাস্য নেই। আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য’।[5]

(খ) اللّٰهُ أَكْبَرُ اللّٰهُ أَكْبَرُ، اللّٰهُ أَكْبَرُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللّٰهُ، وَاللّٰهُ أَكْبَرُ اللّٰهُ أَكْبَرُ وَلِلّٰهِ الْحَمْدُ অর্থাৎ ‘আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান। আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো উপাস্য নেই। আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য’।[6]

(গ) اللّٰهُ أَكْبَرُ كَبِيرًا وَالْحَمْدُ لِلّٰهِ كَثِيرًا وَسُبْحَانَ اللّٰهِ بُكْرَةً وَأَصِيلاً অর্থাৎ ‘আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, বড়। সব প্রশংসা আল্লাহর। আর সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁরই পবিত্রতা বর্ণনা করতে হবে’।[7]

(ঘ) سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ سُبْحَانَ اللهِ الْعَظِيمِ অর্থাৎ ‘আমরা আল্লাহ তাআলার প্রশংসাসহ তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করছি, মহান আল্লাহ অতীব পবিত্র’।[8]

আইয়ামুত তাশরীকের দিনগুলোতে ভালো খাবার গ্রহণের এবং ঈদের আনন্দ ও উৎসবের দিন, পাশাপাশি এ দিনগুলোতে বেশি বেশি আল্লাহর যিকরেরও দিন। মানুষের শারীরিক বিকাশের জন্য যেমন আনন্দ-উৎসব এবং ভালো খাবারের প্রয়োজন হয়, তেমনি আত্মিক উন্নয়নের জন্যও প্রয়োজন হয় অধিক পরিমাণে আল্লাহর স্মরণ তথা যিকর। যদি কেবল আল্লাহ তাআলার স্মরণ ভুলে অনবরত খাদ্য গ্রহণ এবং আনন্দ-উৎসবে মেতে থাকা হয়, তবে ব্যক্তিজীবনে আত্মিক উৎকর্ষতার পরিবর্তে আত্মিক সংকীর্ণতা নেমে আসে, ফলে যমীনে পাপাচার বেড়ে যায়। এজন্য রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল আযহা পরবর্তী আইয়ামুত তাশরীকের দিনগুলোতে অধিক পরিমাণে মহান আল্লাহর স্মরণের প্রতি গুরুত্বারোপ করে বলেন, أَلاَ وَإِنَّ هَذِهِ الأَيَّامَ أَيَّامُ أَكْلٍ وَشُرْبٍ وَذِكْرِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ ‘জেনে রেখো, এ দিনগুলো পানাহারের দিন এবং মহান আল্লাহকে স্মরণ করার দিন’।[9]

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজ সমাজের অধিকাংশ মানুষ আইয়ামুত তাশরীকের দিনগুলোতে অধিক বা মজাদার খাবার গ্রহণ, আনন্দ-উৎসব করা, আত্মীয়স্বজনের বাড়ি বেড়াতে যাওয়া এবং কোথাও ঘুরতে যাওয়ার মতো বিভিন্ন আনন্দ ও বিনোদনমূলক কাজে এমনভাবে লিপ্ত হয়ে পড়েন যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ সুন্নাতকে হৃদয়ঙ্গম করে এ দিনগুলোতে যিকির-আযকার করা তো দূরের কথা, বরং তারা নিয়মিত ছালাতের জামাআতে হাযির হতেও ব্যর্থ হন। আগে নিয়মিত জামাআতে যতটা ছালাত আদায় করতেন, এ দিনগুলোতে ততটা তারা আর করেন না এবং পুরো সমাজেই গান-বাজনা, অশ্লীল নৃত্য, বিভিন্ন স্পটে ছবি তোলা, অশ্লীল ও বাজে সঙ্গ গ্রহণ করাসহ মহান আল্লাহর নানাবিধ নাফরমানীমূলক কাজে জড়িত হয়ে পড়েন। সারা বছরের এই অবসর দিনগুলো আত্মীয়স্বজনসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের কাছে ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরার এবং মহান আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের এক মোক্ষম সুযোগ, যা আমরা সহজেই হাতছাড়া করি। আল্লাহ আমাদেরকে বিষয়গুলো উপলদ্ধি করার এবং সুন্নাহর প্রতি যত্নশীল হওয়ার তাওফীক্ব দান করুন।

(২) ঈদের দিনের আরেকটি সুন্নাত হলো, পায়ে হেঁটে ঈদের ছালাতে উপস্থিত হওয়া (اَلذِّهَابُ إِلىٰ مُصَلَّى الْعِيْدِ مَاشِياً إنْ تَيَسَّرَ)। তাই যথাসম্ভব যানবাহন এড়িয়ে পায়ে হেঁটে ঈদগাহে রওনা দেওয়া উচিত, তবে কোনো ওযর থাকলে ভিন্ন কথা।[10]

(৩) ঈদগাহে পৌঁছানোর পুরো সময় জুড়ে মহান আল্লাহর তাকবীর ঘোষণা করা সুন্নাত।[11] সম্ভব হলে এক রাস্তা দিয়ে ঈদের ছালাতে উপস্থিত হয়ে আরেক রাস্তা দিয়ে ফিরে আসা উচিত, যা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অন্যতম আরেকটি সুন্নাত।[12]

(৪) ঈদের ছালাত মাঠে আদায় করা উত্তম। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববী যেখানে এক রাকআত ছালাত আদায় করা অন্য যেকোনো মসজিদের তুলনায় ১০০০ গুণ উত্তম,[13] তা রেখে ঈদের ছালাত মাঠে আদায় করেছেন, এজন্য উলামায়ে কেরামও এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, ঈদের ছালাত ঈদগাহে আদায় করা উত্তম।

স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, ঈদের ছালাত যদি কোনো কারণে মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়, তবে ছালাতের উদ্দেশ্যে মসজিদে প্রবেশের পর বসার পূর্বেই দুই রাকআত সুন্নাত ছালাত তথা ‘তাহিয়্যাতুল মাসজিদ’ আদায় করতে হবে।[14] এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত, যা প্রতিবার মসজিদে প্রবেশের পর বসার পূর্বেই আদায় করতে হয়। আর যদি ঈদের ছালাত ঈদগাহে অনুষ্ঠিত হয়, তবে ঈদের ছালাত অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে ক্বাযা ছালাত ব্যতীত অন্য কোনো ছালাত আদায় করা যাবে না।[15]

(৫) ঈদের ছালাত আদায়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পাঁচ ওয়াক্ত ফরয ছালাত। ঈদুল আযহার দিনের ফজর ছালাতের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কেননা ঈদুল আযহার দিন যেমন শ্রেষ্ঠতম দিন তেমনি এর ফজরও শ্রেষ্ঠতম। উপরন্তু এ দিনের ফজরের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা শপথ করেছেন। তিনি বলেন, وَالْفَجْرِ - وَلَيَالٍ عَشْرٍ - وَالشَّفْعِ وَالْوَتْرِ ‘শপথ ফজরের, শপথ ১০ রাতের, শপথ জোড় ও বেজোড়ের’ (আল-ফজর, ৮৯/১-৩)

উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় একাধিক মত পাওয়া যায়। তবে মাসরূক, মুজাহিদ ও মুহাম্মাদ ইবনু কা‘ব রহিমাহুমুল্লাহ এ আয়াতে কারীমার ব্যাখ্যায় বলেন,الْمُرَادُ بِهِ فَجْرُ يَوْمِ النَّحْرِ خَاصَّةً، وَهُوَ خَاتِمَةُ اللَّيَالِي الْعَشْرِ অর্থাৎ এর দ্বারা বিশেষভাবে ঈদুল আযহার সকালবেলাকে বুঝানো হয়েছে। আর ওটা হলো ১০ রাত্রির সমাপ্তি।[16]

সুতরাং যারা ঈদুল আযহার দিন ফজর আদায় করেননি, তাদের উপর কর্তব্য হলো ফরযের প্রতি গুরুত্বারোপ করে আগে ফজর আদায় করে নেওয়া। অতঃপর ঈদের ছালাত আদায় করা। কেননা মহান আল্লাহর ফরয বিধান লঙ্ঘন করে সুন্নাত ছালাত আদায় করার কোনো অর্থই নেই।

(৬) ঈদের দিনের আরেকটি সুন্নাত হলো, মুসলিমদের সাথে ঈদের ছালাতে অংশ নেওয়া এবং খুৎবা শোনা।[17] ঈদের ছালাত সুন্নাত না ওয়াজিব, এ বিষয়ে আহলুল ইলমের মাঝে মতভেদ রয়েছে। তাদের মধ্যে কারো কারো মতে, এটি সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। তবে শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রহিমাহুল্লাহ-সহ অপরাপর ইমামগণের মতে, ঈদুল আযহার ছালাত আদায় করা ওয়াজিব। তাদের দলীল হলো, فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ ‘কাজেই আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্যে ছালাত আদায় করুন এবং কুরবানী করুন’ (আল-কাউছার, ১০৮/২)। এই দলীলের আলোকে এ মতটিই বেশি শক্তিশালী। অতএব, কুরবানীর আগে অবশ্যই ছালাত আদায় করতে হবে। এটি পবিত্র কুরআনুল কারীমের একটি নির্দেশ। আর ছালাত আদায় শেষে খুৎবা শুনাটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত।

(৭) ঈদের দিনের আরও সুন্নাত হলো, التَّهْنِئَةُ بِالْعِيْدِ অর্থাৎ ‘একে অপরের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করা’। শুভেচ্ছা বিনিময়ের ক্ষেত্রে সুন্নাত হলো একে অপরের সাথে সাক্ষাতের প্রারম্ভে এই দু‘আ করা, تَقَبَّلَ اللهُ مِنَّا وَمِنْكُمْ অর্থাৎ ‘মহান আল্লাহ আমাদের ও আপনাদের নেক আমলগুলো কবুল করে নিন’।[18] অথবা تَقَبَّلَ اللهُ مِنَّا وَمِنْكَ অর্থাৎ ‘আমাদের আমল ও আপনার আমল কবুল করে নিন’।[19] শু‘বা রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‌لَقِيَنِي ‌يُونُسُ ‌بْنُ ‌عُبَيْدٍ ‌فِي ‌يَوْمِ ‌عِيدٍ فَقَالَ: تَقَبَّلَ اللَّهُ مِنَّا وَمِنْكَ অর্থাৎ ‘আমি ইউনুস ইবনু উবাইদ-এর সাথে ঈদের দিনে সাক্ষাৎ করেছি অতঃপর তিনি আমাকে বললেন, تَقَبَّلَ اللّٰهُ مِنَّا وَمِنْكَ।[20]

এভাবে স্বাগত জানানো ভালো। তবে ঈদ মোবারক (عِيْدٌ مُبَارَكٌ) বা এ ধরনের কোনো ভালো অর্থপূর্ণ শব্দ দিয়েও স্বাগত জানানোর ব্যাপারে প্রশস্ততা রয়েছে।

(৮) ঈদুল আযহার দিনের একটি উত্তম আমল হলো, কুরবানীর পশু মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহর নামে যবেহ করা (ذَبْحُ الْأُضْحِيَّةِ)। নিজের কুরবানীর পশু নিজেই যবেহ করা উত্তম।[21] যবেহের সময় নিজের বা অন্যের পক্ষ থেকে একনিষ্ঠভাবে একমাত্র মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে এই দু‘আ পড়ে কুরবানী দিতে হবে, بِسْمِ اللّٰهِ وَاللهُ أَكْبَرُ অর্থাৎ ‘আল্লাহর নামে শুরু করছি; আল্লাহই মহান’।[22]

যবেহের সময় উক্ত দু‘আটি পাঠ করা ওয়াজিব। এটি ইচ্ছাকৃতভাবে পাঠ না করে কোনো যবেহ করলে, মহান আল্লাহর নিকট তা কবুল হবে না। যবেহর ক্ষেত্রে পাঠ করা যায়, এমন আরো কিছু মাসনূন দু‘আ রয়েছে, তবে এক্ষেত্রে একমাত্র মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে অন্তরের একনিষ্ঠ নিয়্যত এবং উল্লিখিত দু‘আটিই যথেষ্ট। কুরবানীর পশু যে কেউ যবেহ করতে পারেন। এমনকি হিজাব রক্ষা করে যদি কোনো মহিলা যবেহ করেন, তবে তাতেও কোনো অসুবিধা নেই।[23] অন্যদের ডেকে তাদের দিয়ে কুরবানী করানোর নিয়ম রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ছাহাবায়ে কেরাম রযিয়াল্লাহু আনহুম, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন ও সালাফে ছালেহীন রহিমাহুমুল্লাহ-এর যুগে প্রচলন ছিল না। এটা উচিতও নয়। তাঁরা কুরবানীতে এমন বিশেষ কোনো দু‘আ পাঠ করতেন না, যা যে কারো পক্ষে পাঠ করা সম্ভব নয়, উপরন্তু মনের ভেতরের সকল প্রকার সংকীর্ণতা ও ভয় ঝেড়ে ফেলে একটি সুন্নাত ও গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত মনে করে একমাত্র মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে তাক্বওয়ার সাথে ও একনিষ্ঠ নিয়্যতে নিজের পশু নিজেই কুরবানী করার গুরুত্ব অপরিসীম। এতে উপর্যুক্ত দু‘আগুলো ব্যতীত বিশেষ কোনো দু‘আ পাঠেরও অপরিহার্যতা নেই। কেননা আল্লাহ তাআলা ভালো করেই জানেন যিনি কুরবানী দিচ্ছেন তার মনের অবস্থা, তার কুরবানীর উদ্দেশ্য, কুরবানীর পশু হালাল অর্থে না হারাম অর্থে ক্রয়কৃত, লোক দেখানোর উদ্দেশ্য না মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্য ইত্যাদি।

কুরবানী ঈদুল আযহার দিনসহ আইয়ামে তাশরীকের শেষ দিন পর্যন্ত মোট চার দিন করা যায়। তবে প্রথম দিনেই কুরবানী করে নেওয়া উত্তম।[24]

(৯) আশেপাশে কোথাও দুর্ভিক্ষ না থাকলে কুরবানীর গোশত তিন দিনের বেশি জমিয়ে রেখে খাওয়া যায়। তবে দুর্ভিক্ষ থাকলে তিন দিনের বেশি জমিয়ে রাখা যাবে না, বরং তা দরিদ্রদের মাঝে বিলিয়ে দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনের শেষ ১০টি বছর কুরবানী করেছেন। তন্মধ্যে একটি বছর দুর্ভিক্ষ থাকায় কুরবানীর পশু যবেহর পর তিন দিনের অধিক জমা করে রাখতে নিষেধ করেছিলেন। যাতে করে নিজে খেয়ে দুর্ভিক্ষকবলিতদের মাঝে অতিরিক্ত গোশত বিলিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু যখন দুর্ভিক্ষ চলে গেল, তখন তিনি এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন এবং কুরবানীর গোশত ভক্ষণ করা, জমা করা এবং দান করার ব্যাপারে ব্যক্তি স্বাধীনতা দিয়ে দেন। এ প্রসঙ্গে নুবাইশাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,إِنَّا كُنَّا نَهَيْنَاكُمْ عَنْ لُحُومِهَآ أَنْ تَأْكُلُوهَا فَوْقَ ثَلَاثٍ لِكَىْ تَسَعَكُمْ فَقَدْ جَاءَ اللّٰهُ بِالسَّعَةِ فَكُلُوا وَادَّخِرُوْا وَاتَّجِرُوْآ أَلَا وَإِنَّ هٰذِهِ الْأَيَّامَ أَيَّامُ أَكْلٍ وَشُرْبٍ وَذِكْرِ اللّٰهِ عَزَّ وَجَلَّ‏ ‘আমরা তোমাদেরকে তিন দিনের অধিক কুরবানীর গোশত খেতে নিষেধ করেছিলাম, যাতে গোশত তোমাদের সকলের নিকট পৌঁছে যায়। মহান আল্লাহ এখন তোমাদের দারিদ্র্য মোচন করেছেন। কাজেই এখন তোমরা তা খাও, জমা করে রাখো এবং ছাদাক্বা করে নেকী অর্জন করো। জেনে রেখো, এ দিনগুলো পানাহারের দিন এবং মহান আল্লাহকে স্মরণ করার দিন’।[25]

সুতরাং এ হাদীছের আলোকে এখনো যদি কোনো এলাকায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় বা দরিদ্রতা বহুলাংশে বেড়ে যায়, তবে সেখানে এর বিধান প্রযোজ্য হবে। তখন তিন দিনের মধ্যে খেয়ে ফেলতে হবে, না হয় অন্যদের দিয়ে দিতে হবে।

ঈদুল আযহার দিনের ভুলত্রুটি :

(১) আমাদের সমাজে ঈদুল আযহার দিনের ভুলত্রুটি অনেক, তন্মধ্যে অপব্যয় এবং অনর্থক ব্যয় করা অন্যতম (الْإِسْرَافُ وَالتَّبْذِيْرُ)।

(২) এদিনের আরেকটি ভুল হলো একজনের নেতৃত্বে জামাআতবদ্ধ হয়ে তাকবীর বলা (التَّكْبِيْرُ الْجِمَاعِيُّ)। অনেকে হজ্জে গিয়ে তালবিয়া পাঠ করার সময়ও জামাআতবদ্ধ হয়ে এ কাজ করেন। এটি একটি সুস্পষ্ট বিদআত। বরং সুন্নাত হলো একাকী ও সশব্দে নিজের তাকবীর নিজেই বলা।

(৩) এদিনের আরেকটি ভুল হলো, হিজাবের বিধান লঙ্ঘন করে নারী-পুরুষে একাকার হয়ে যাওয়া اِخْتِلَاطُ الرِّجَالِ بِالنِّسَاءِ। মনে হয় যেন এ দিনে পর্দা শিথিল করা হয়েছে, যা সঠিক নয়। বছরের শ্রেষ্ঠ দিন হিসেবে এ দিনে প্রতিটি ইবাদত মহান আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়, তেমনি এ দিনে মহান আল্লাহর বিধান লঙ্ঘনও তদ্রূপ কঠিন ও গুরুতর গুনাহের কাজ।

(৪) এদিনের আরো ভুলত্রুটি ও গুনাহের কাজ হলো গান শোনা (سِمَاعُ الْغِنَاءِ) এবং বৈধ কোনো প্রয়োজন ব্যতিরেকে অহেতুক ছবি তোলা।

(৫) এদিনের আরো ভুলত্রুটি ও গুনাহের কাজ হলো সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী না করা। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মাহকে এ বিষয়ে সচেতন করে বলেন,مَنْ كَانَ لَهُ سَعَةٌ وَلَمْ يُضَحِّ فَلَا يَقْرَبَنَّ مُصَلاَّنَا ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করে না, সে যেন আমাদের ঈদের মাঠের কাছেও না আসে’।[26]

(৬) ঈদের দিনে নির্দিষ্ট দু‘আগুলোর মাধ্যমে শুভেচ্ছা বিনিময় করাকে তাহনিয়াহ (التَّهْنِئَةُ) বলে। আমাদের দেশে অনেকেই ঈদের দিনে তাহনিয়াহ এর পরিবর্তে ঈদের দিনকে কেন্দ্র করে মুআনাকা (কোলাকুলি) করেন। এমনকি অনেকে দীর্ঘদিন পর ঈদের ছুটিতে বাড়িতে ফিরলেও মুআনাকা না করে ঈদের দিনের জন্য তা জমিয়ে রাখেন। মুআনাকা ঈদের দিনের কোনো সুন্নাত আমল নয়। বরং মুআনাকা এমন একটি সুন্নাত আমল, যা দীর্ঘদিন পর কোনো পরিচিত ব্যক্তির সাথে প্রথম সাক্ষাতে করা হয়ে থাকে। প্রতিনিয়ত কারো সাথে দেখা-সাক্ষাতে মুআনাকা করা বা কেবল ঈদের দিন মুআনাকা করা সুন্নাহসম্মত নয়। তবে ঈদের দিনে কারো সাথে দীর্ঘদিন পর দেখা হলে মুআনাকা করা যাবে।

(৭) অনেকেই ঈদের ছুটিতে বাড়িতে গেলে বাবা-মায়ের কবর যিয়ারত না করে তা কেবল ঈদের দিনের জন্য রেখে দেন। এটাও সুন্নাহসম্মত নয়। বাবা-মায়ের কবর যিয়ারত যেকোনো দিনে করা যায় এবং যত বেশি করা যায় তত ভালো। এর সাথে ঈদের দিনগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই।

হে দয়াময় আল্লাহ! আমাদের কুরবানীর গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপলদ্ধি করে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ অনুযায়ী কুরবানী করা, ইয়াউমুন নাহার ও আইয়ামুত তাশরীকের আমলগুলো করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

আবূ লাবীবা মুহাম্মাদ মাকছুদ

শিক্ষক, মাদরাসা ইশাআতুল ইসলাম আস-সালাফিয়্যাহ, রাণীবাজার, রাজশাহী।


[1]. তাফসীর ইবনু কাছীর ও ফাতহুল মাজীদ, আল-মায়েদাহ, ৫/২৭-এর তাফসীরের আলোকে।

[2]. আবূ দাঊদ, হা/১৯৪৫, হাদীছ ছহীহ।

[3]. আবূ দাঊদ, হা/১৭৬৫, হাদীছ ছহীহ।

[4]. ছহীহ বুখারী, ৪/১২২।

[5]. ইরওয়াউল গালীল, ৩/১২৫।

[6]. প্রাগুক্ত।

[7]. ছহীহ মুসলিম, হা/৬০১।

[8]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৬৮২।

[9]. আবূ দাঊদ, হা/২৮১৩, হাদীছ ছহীহ।

[10]. ইরওয়াউল গালীল, ৩/১২৫-১২৬; মিরআত, হা/১৪৬৭-এর ব্যাখ্যা, ৫/৭০।

[11]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ, হা/৫৬২৯, ৫৬৬৫, সনদ ছহীহ; ইরওয়াউল গালীল, ৩/১২১।

[12]. ছহীহ বুখারী, হা/৯৮৬; মিশকাত, হা/১৪৩৪।

[13]. ইবনু মাজাহ, হা/১৪০৬, হাদীছ ছহীহ।

[14]. ছহীহ ‍মুসলিম, হা/৭১৪; ইবনু মাজাহ, হা/১০১২।

[15]. ছহীহ ‍মুসলিম, হা/৮৮৪; আবূ দাঊদ, হা/১১৫৯।

[16]. তাফসীর ইবনু কাছীর, ৮/৩৯০।

[17]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮৮৫; মুসনাদে দারেমী, হা/১৬৫১।

[18]. সুনানুল বায়হাক্বী, হা/৬০৯১, ৩/৩১৯।

[19]. আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/১২৩, ২২/৫২; ফাতহুল বারী, ২/৪৪৬।

[20]. ত্ববারানী, আদ-দু‘আ, হা/৯২৯।

[21]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৫৬৫; ছহীহ মুসলিম, হা/১৯৬৬।

[22]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৫৬৫; ছহীহ মুসলিম, হা/১৯৬৬; মিশকাত, হা/১৪৫৩।

[23]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৫০৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/৪৫৯৮।

[24]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২২৯৮৪।

[25]. আবূ দাঊদ, হা/২৮১৩, হাদীছ ছহীহ।

[26]. ইবনু মাজাহ, হা/৩১২৩, হাসান।

Magazine