বিশ্ব আজ ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়ায় দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে শেকড় থেকে শিখরে। এই যে কিছুদিন পূর্বে যে বিষয়টি অকল্পনীয় ছিল, আজ তা বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে। যা আমাদের জীবনকে করে দিয়েছে সহজ থেকে সহজতর। চিকিৎসাবিজ্ঞানও বর্তমান সময়ে বেশ অগ্রগামী। নতুন নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কারে বিজ্ঞান বেশ সফল। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সারোগেসি। তবে মুসলিম হিসেবে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে একটি প্রশ্ন বা দায়বদ্ধতা থেকেই যায় যে, ইসলাম সারোগেসিকে অনুমোদন দেয় কি-না? সেই দায়বদ্ধতা থেকেই আমরা আজ সারোগেসি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব ইনশা-আল্লাহ।
Sআলাইহিমাস সালামrrরহিমাহুমুল্লাহরযিয়াল্লাহু আনহাছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামরযিয়াল্লাহু আনহুy শব্দটি ইংরেজি, সারোগেসি শব্দের অর্থ হলো গর্ভাশয় ভাড়া। এখান থেকেই সারোগেট মাদার অর্থাৎ ভাড়াটে মা। সারোগেসি হলো একটি আধুনিক প্রজনন ব্যবস্থা। এনএইচএস-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী- সারোগেসি এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে একজন নারী কোনো এক যুগলের জন্য গর্ভধারণ করে। যারা চিকিৎসা জটিলতায় বা শারীরিক কোনো কারণে গর্ভধারণ করতে অক্ষম। ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (IVF) পদ্ধতিতে নারীদেহ হতে ডিম্বাণু ও পুরুষদেহ হতে শুক্রাণু দেহের বাইরে টেস্টটিউবে নিষিক্ত করে তা সারোগেট নারীর গর্ভাশয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়।
সারোগেসি দুই রকমের হয়—
(১) পার্শিয়াল সারোগেসি : বাবার শুক্রাণু আর সারোগেট মায়ের ডিম্বাণু থেকে শিশুর জন্ম হয়। সন্তানধারণে এখানে কোনো ভূমিকাই পালন করেন না মা।
(২) ট্রু-সারোগেসি : মায়ের ডিম্বাণু নিয়ে ল্যাবে ভ্রূণ তৈরি করা হয়। এরপর সারোগেট মায়ের জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয় ভ্রূণটি। এটিই এখন প্রচলিত পদ্ধতি।
সারোগেসি কেন করা হয়?
প্রথমত, কেউ কেউ সারোগেসি করেন শারীরিক কোনো সমস্যার জন্য। আবার কেউ কেউ কষ্ট ও সময় যাতে না হয়, সেজন্য সারোগেসি করে থাকেন। সারোগেসি ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে ধনীরা বা তথাকথিত তারকারা বর্তমানে এটি গ্রহণ করছেন। তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, গর্ভকালীন সময়ে শারীরিক সৌন্দর্য, জনপ্রিয়তা এবং অভিনয় জগৎ থেকে ছিটকে না পড়া ইত্যাদি। এটি কোনো অবস্থাতেই জায়েয নয়; বরং হারাম।
দ্বিতীয়ত, অনেক চেষ্টার পরও যখন সন্তান লাভের আর কোনো পথ থাকে না, তখন সারোগেসিই হয় অন্যতম উপায়। তবে এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। যেমন—
১. অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও বারবার মিসক্যারেজ (গর্ভপাত) হওয়া।
২. আইভিএফ চিকিৎসায় গর্ভধারণ না হওয়া।
৩. মেনোপজ (নারীদের একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর পুরোপুরি মাসিক ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া)।
৪. জরায়ুতে অস্বাভাবিকতা বা অস্ত্রোপচারের কারণে জরায়ুতে জটিলতা তৈরি হওয়া।
সন্তান সকলেরই কাম্য। অনেক চেষ্টা করেও যখন সন্তান না আসে কিংবা সন্তানের প্রয়োজন যদি একান্তই হয়, তবে সন্তান গ্রহণের স্বাভাবিক পন্থা ব্যতীত ভিন্ন কোনো পন্থা অবলম্বনে সতর্ক থাকতে হবে। মুসলিমজাতির পিতা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও যাকারিয়া আলাইহিস সালাম বার্ধক্য বয়সে সন্তান লাভ করেছেন। তবে তারা এমন কোনো পন্থা অবলম্বন করেননি, যেটি শরীআতের সাথে সাংঘর্ষিক। মূলত আল্লাহ তাআলা তাঁর মুমিন বান্দাদের বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করে থাকেন; কখনো তাকে অনেক কিছু দিয়ে আবার কখনো না দিয়ে। হতে পারে সন্তান না পাওয়াটাই আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষাস্বরূপ। তাই বেশি বেশি দু‘আ করতে হবে, ধৈর্যধারণ করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে হারাম কোনো পন্থা অবলম্বন করা বৈধ নয়। কেননা মহান আল্লাহ, তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সালাফে ছালেহীন থেকে এর কোনো অনুমোদন নেই। হারাম পদ্ধতিতে কেন যাবেন? যেখানে আল্লাহ তাআলা মাছনা (দ্বিতীয় বিবাহ) নামক অন্য ব্যবস্থা রেখেছেন। আপনি চাইলেই যেটা করতে পারছেন। তবে এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, সন্তান না হওয়ায় স্ত্রীর সাথে রূঢ় আচরণ করে তালাক দেওয়া ভালো ব্যক্তিত্বের পরিচয় বহন করে না, বরং সীমালঙ্ঘনকারী হিসেবে বিবেচিত হবে।
ইসলামে সারোগেসির বিধান :
সঊদী আরবের সর্বোচ্চ ফতওয়া বোর্ডের ফতওয়া হলো, এটা ইসলামী শরীআতে হারাম। এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আইডেন্টিটি ক্রাইসিস (পরিচয়হীনতা)। কেননা এখানে শুধু মাতৃত্ব-পিতৃত্বের বিষয়টাই হারিয়ে যায় না, বরং নাসল (বংশধারা) এর পবিত্রতা বাধাগ্রস্ত করে। শুধু তাই নয়, প্রকৃত বাবা-মা কে হবেন তা নিয়েও জটিলতা সৃষ্টি হয়। এছাড়া পবিত্র কুরআনের বিধান অনুযায়ী জন্মদাত্রী নারীই হন সন্তানের মা। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,إِنْ أُمَّهَاتُهُمْ إِلَّا اللَّائِي وَلَدْنَهُمْ ‘তাদের মা তো শুধু তারাই, যারা তাদের জন্ম দিয়েছে’ (আল-মুজাদালাহ, ৫৮/২)।
আরবী একটি কায়দা রয়েছে যে,أَلْأَصْلُ فِي الْأَبْضَاعِ الْتَحْرِيْمُ অর্থাৎ ‘সহবাসের ক্ষেত্রে মূল হচ্ছে হারাম। যতক্ষণ না হালালভাবে আক্বদ হয়’। সারোগেসি প্রত্যক্ষভাবে যেনা না হলেও সেখানে এমন কিছু দায়বদ্ধতা থেকেই যায়, যা কোনোভাবেই হালাল হওয়ার সম্ভাবনা রাখে না। আল্লাহ তাআলা জৈবিক চাহিদা পূরণ, সন্তান গ্রহণের জন্য নির্দিষ্ট পন্থা এবং বংশ বিস্তারের মাধ্যম হিসেবে স্ত্রীকেই চিহ্নিত করেছেন। ঠিক তেমনিভাবে সন্তান গ্রহণের জন্য নিজের বিবাহিত স্ত্রীকেই চিহ্নিত করেছেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, نِسَاؤُكُمْ حَرْثٌ لَّكُمْ فَأْتُوا حَرْثَكُمْ أَنَّىٰ شِئْتُمْ অর্থাৎ ‘তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের শস্যক্ষেত্র। অতএব তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা গমন করো’ (আল-বাক্বারা, ২/২২৩)। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنَ الْمَاءِ بَشَرًا فَجَعَلَهُ نَسَبًا وَصِهْرًا وَكَانَ رَبُّكَ قَدِيرًا ‘আর তিনিই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন পানি হতে, তারপর তিনি তাকে বংশগত ও বৈবাহিক সম্পর্কশীল করেছেন। আর আপনার রব হলেন প্রভূত ক্ষমতাবান’ (আল-ফুরকান, ২৫/৫৪)।
অন্যত্র তিনি আরও ইরশাদ করেন,وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَافِظُونَ إِلَّا عَلَىٰ أَزْوَاجِهِمْ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُومِينَ ‘আর যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে রাখে সংরক্ষিত, নিজেদের স্ত্রী বা অধিকারভুক্ত দাসীগণ ছাড়া, এতে তারা নিন্দিত হবে না’ (আল-মুমিনূন, ২৩/৫-৬)। আল্লাহ তাআলা আরও ইরশাদ করেন,هُوَ الَّذِي خَلَقَكُم مِّن نَّفْسٍ وَاحِدَةٍ وَجَعَلَ مِنْهَا زَوْجَهَا لِيَسْكُنَ إِلَيْهَا فَلَمَّا تَغَشَّاهَا حَمَلَتْ حَمْلًا خَفِيفًا فَمَرَّتْ بِهِ فَلَمَّا أَثْقَلَت دَّعَوَا اللَّهَ رَبَّهُمَا لَئِنْ آتَيْتَنَا صَالِحًا لَّنَكُونَنَّ مِنَ الشَّاكِرِينَ ‘তিনিই তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন ও তার থেকে তার স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন, যাতে সে তার কাছে শান্তি পায়। তারপর যখন সে তার সঙ্গে সংগত হয়, তখন সে এক হালকা গর্ভধারণ করে এবং এটা নিয়ে সে অনায়াসে চলাফেরা করে। অতঃপর গর্ভ যখন ভারী হয়ে আসে, তখন তারা উভয়ে তাদের রব আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, যদি আপনি আমাদের এক পূর্ণাঙ্গ সন্তান দান করেন, তাহলে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব’ (আ‘রাফ, ৭/১৮৯)। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلاَ يَسْقِ مَاءَهُ وَلَدَ غَيْرِهِ ‘আল্লাহ ও আখেরাতের উপর যে লো ক ঈমান রাখে, সে যেন নিজের পানি (বীর্য) দিয়ে অন্যের সন্তানকে সিক্ত না করে’।[1]
সারোগেসিতে কি প্রকৃত মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়া যায়?
যদি এক কথায় উত্তরে আসি, তাহলে উত্তর হবে- অবশ্যই না। কেননা একজন মা পরম যত্নে প্রায় ৪০ সপ্তাহ গর্ভধারণ করেন এমনকি সন্তান প্রসবের সময় কঠিন যন্ত্রণা সহ্য করার পরও জন্মদানের সময়টা মায়ের কাছে শ্রেষ্ঠ অনুভূতি বলে মনে হয়। একথা সর্বজনবিদিত যে, সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ালে মা ও সন্তানের বন্ধন দৃঢ় হয়। সারোগেসি পদ্ধতির সন্তান তার মাকে কীভাবে প্রকৃত মায়ের ন্যায় ভালোবাসবে কিংবা সেই মায়ের সন্তানের প্রতি কেমন অনুভূতি কাজ করবে, যেখানে কষ্ট তো নেই, এমনকি দুগ্ধপান করানোর বিষয়টিও নেই।
শেষাংশে বলতে চাই, আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে যা গ্রহণ করতে বলেছেন, সেটা গ্রহণ করা আর যা নিষেধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাকার মধ্যেই প্রকৃত কল্যাণ নিহিত রয়েছে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সঠিকটা জানার ও মানার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
এ.এস.এম. মাহবুবুর রহমান
[1]. আবূ দাঊদ, হা/১৮৭৪; জামে আত-তিরমিযী, হা/১১৩১।