ভূমিকা : নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিতা-মাতা জান্নাতী নাকি জাহান্নামী- এটি আক্বীদার সাথে জড়িত একটি বিষয়। অনেক মানুষের সামনে এ বিষয়ে কথা বললে খুব আশ্চর্য হন! আর এ বিষয়ে অনেকে সঠিক সিদ্ধান্ত মেনে নিতে নারাজ। আবার অনেকে এ বিষয়টিকে অনর্থক বলে মুখ খুলতে চান না। আবার কেউ কেউ নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিতা-মাতাকে জান্নাতী প্রমাণ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। আজকে আমরা এ বিষয়ে কুরআন ও ছহীহ হাদীছ এবং সালাফদের বুঝগুলো জানার জন্য চেষ্টা করবো ইনশা-আল্লাহ।
নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিতা জাহান্নামী :
১ম দলীল :
عَنْ أَنَسٍ أَنَّ رَجُلًا قَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ أَيْنَ أَبِيى قَالَ فِى النَّارِ فَلَمَّا قَفّٰى دَعَاهُ فَقَالَ ﺇِنَّ أَبِى وَأَبَاكَ فَى النَّارِ.
আনাস রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার পিতা কোথায় আছেন (জান্নাতে না জাহান্নামে)? রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘জাহান্নামে’। বর্ণনাকারী বলেন, লোকটি যখন চলে যেতে লাগলেন, তিনি তাকে ডাকলেন এবং বললেন, ‘আমার পিতা এবং তোমার পিতা জাহান্নামে’।[1]
এই হাদীছের অধীনে :
(১) ইমাম মুসলিম রহিমাহুল্লাহ অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন, بَابُ: بَيَانِ أَنَّ مَنْ مَاتَ عَلَى الْكُفْرِ فَهُوَ فِى النَّارِ وَلَا تَنَالُه شَفَاعَةٌ وَلَا تَنْفَعُه قَرَابَةُ الْمَقَرَّبِيْنَ ‘কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণকারী জাহান্নামী, সে কোনো শাফাআত পাবে না এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভকারী বান্দার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্কও তার উপকারে আসবে না’।[2]
(২) ইমাম আবূ দাঊদ রহিমাহুল্লাহ অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন, بَابٌ: فِى ذَرَارِىِّ الْمُشْرِكِيْن ‘মুশরিকদের শিশু সন্তান সম্পর্কে’।[3]
এ বিষয়ে আবূ দাঊদের ভাষ্যকার শামসুল হক্ব আযীমাবাদী রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিতা-মাতাকে জীবিতকরণ, ঈমান আনয়ন ও নাজাত প্রাপ্তি সম্পর্কে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে, তার অধিকাংশই মিথ্যা ও জাল এবং বাকীগুলো খুবই দুর্বল।[4]
২য় দলীল :
عَنْ سَالِمٍ عَنْ أَبِيْهِ قَالَ جَاءَ أَعْرَابِىُّ ﺇِلَى النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ﺇِنَّ أَبِى كَانَ يَصِلُ الرَّحِمَ وَكَانَ وَكَانَ، فَأَيْنَ هُوَ قَال فِى النَّارِ قَال فَكَأنَّهُ وَجَدَ مِنْ ذَلِكَ فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَيْنَ أَبُوْكَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَيْثُمَا مَرَرْتَ بِقَبْرِ مُشْرِكٍ فَبَشِّرْهُ بِالنَّارِ قَال فَأَسْلَمَ الْأَعْرَابِىُّ بَعْدُ وَقَالَ كَلَّفَنِى رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَعَبًا مَا مَرَرْتُ بِقَبْرِ كَافِرٍ ﺇِلَّا بَشَّرْتُهُ بِالنَّارِ.
সালেম তার পিতা (ইবনু উমার রযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বলেন, এক বেদুঈন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার পিতা আত্মীয়তার সম্পর্ক বহাল রাখতেন এবং তিনি এই এই কাজ করতেন। তিনি কোথায় আছেন (জান্নাতে না জাহান্নামে)? তিনি বলেন, ‘জাহান্নামে’। রাবী বলেন, এতে তিনি ব্যথিত হলেন। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার পিতা কোথায় আছেন? রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তুমি যখন কোনো মুশরিকের কবর অতিক্রম কর, তখন তাকে জাহান্নামের সুসংবাদ দিয়ো’। রাবী বলেন, সেই বেদুঈন পরে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং বলেন যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিশ্চয় আমাকে একটি কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন— আমি যখনই কোনো কাফেরের কবর অতিক্রম করবো, তখনই তাকে জাহান্নামের দুঃসংবাদ দিবো।[5]
অনেকে বলেন যে, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিতা-মাতা জান্নাতী না জাহান্নামী এ সম্পর্কে প্রশ্নই করা যাবে না। তাদের এই দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা। উপরের হাদীছই তার জাজ্বল্য প্রমাণ।
নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাতা জাহান্নামী :
১ম দলীল :
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ زَارَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَبْرَ أُمِّهِ فَبَكَى وَأَبْكَى مَنْ حَوْلَهُ فَقَالَ اسْتَأْذَنْتُ رَبِّى فِى أَنْ أَسْتَغْفِرَ لَهَا فَلَمْ يَأَذَنْ لِى وَاسْتَأَذَنْتُ رَبِّى فِى أَنْ أَزُورَ قَبْرَهَا فَأَذِنَ لِى فَزُورُوا الْقُبُوْرَ فَأِنَّهَا تُذَكِّرُكُمْ الْمَوْتَ.
আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার মায়ের কবর যিয়ারত করেন। তিনি কান্নাকাটি করেন এবং তার সাথীদেরও কাঁদান। অতঃপর তিনি বলেন, ‘আমি আমার রবের নিকট তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনার অনুমতি চাইলে তিনি আমাকে অনুমতি দেননি। আমি আমার রবের নিকট তার কবর যিয়ারতের অনুমতি চাইলে তিনি আমাকে অনুমতি দেন। অতএব, তোমরা কবর যিয়ারত করো। কেননা তা তোমাদের মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়’।[6]
এই হাদীছের অধীনে :
(১) ইমাম মুসলিম রহিমাহুল্লাহ অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন,بَاب: اسْتِئْذَانِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَبَّهُ عَزَّ وَجَلَّ فِى زِيَارَةِ قَبْرِ أُمِّهِ ‘নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মাতার কবর যিয়ারতের জন্য আল্লাহর নিকট অনুমতি চাওয়া সম্পর্কে’।[7]
(২) ইমাম ইবনু মাজাহ রহিমাহুল্লাহ অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন, بَاب: مَا جَاءَ فِى زِيَارَةِ قُبُوْرِ الْمُشْرِكِيْنَ ‘মুশরিকদের কবর যিয়ারত সম্পর্কে’।[8]
(৩) ইমাম নাসাঈ রহিমাহুল্লাহ অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন, زِيَارَةُ قَبْرِ الْمُشْرِكِ ‘মুশরিকদের কবর যিয়ারত করা’।[9]
২য় দলীল :
عَنْ عَلِىٍّ قَالَ سَمِعْتُ رَجُلًا يَسْتَغْفِرُ لِأَبَوَيْهِ وَهُمَا مُشْرِكَانِ. فَقُلْتُ أَتَسْتَغْفِرُلَهُمَا وَهُمَا مُشْرِكَانِ فَقَالَ أَوَلَمْ يَسْتَغْفِرْ ﺇِبْرَاهِيْمُ لِأَبِيْهِ فَأَتَيْتُ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَذَكَرْتُ ذَلِكَ لَهُ، فَنَزَلَتْ (وَمَا كَانَ اسْتِغْفَارُ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ إِلَّا عَن مَّوْعِدَةٍ وَعَدَهَا إِيَّاهُ فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُ أَنَّهُ عَدُوٌّ لِّلَّهِ تَبَرَّأَ مِنْهُ إِنَّ إِبْرَاهِيمَ لَأَوَّاهٌ حَلِيمٌ).
আলী রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি এক লোককে বলতে শুনলাম, সে তার পিতা-মাতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছে অথচ তারা উভয়ই মুশরিক। তখন আমি তাকে বললাম, তুমি কি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছ, অথচ তারা মুশরিক! তখন সে বলল, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কি আপন পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেননি? এরপর আমি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে এ ঘটনা তাঁর কাছে উল্লেখ করলাম। তখন এ আয়াত অবতীর্ণ হলো,﴿وَمَا كَانَ اسْتِغْفَارُ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ إِلَّا عَن مَّوْعِدَةٍ وَعَدَهَا إِيَّاهُ فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُ أَنَّهُ عَدُوٌّ لِّلَّهِ تَبَرَّأَ مِنْهُ ﴾ ‘ইবরাহীমের পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনার ব্যাপারটি কেবল তার প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে ছিল, যা তিনি তাঁর পিতাকে দিয়েছিলেন। অতঃপর যখন তাঁর কাছে এ ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, সে আল্লাহর শত্রু, তখন তিনি তার থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করলেন’ (আত-তাওবা, ৯/১১৪)।[10]
এই হাদীছের অধীনে :
ইমাম নাসাঈ রহিমাহুল্লাহ অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন,بَاب: النَّهْىُ عَنِ الْاِسْتِغْفَارِ لِلْمُشْرِكِيْنَ ‘মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার নিষেধাজ্ঞা’।[11]
মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ بِالْحَقِّ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَلَا تُسْأَلُ عَنْ أَصْحَابِ الْجَحِيمِ ‘নিশ্চয় আমরা আপনাকে প্রেরণ করেছি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে। আর আপনি জাহান্নামীদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবেন না’ (আল-বাক্বারা, ২/১১৯)। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ত্ববারী রহিমাহুল্লাহ (৩১০ হি.) তাবেঈ মুহাম্মাদ ইবনু কা‘ব কুরাযী রহিমাহুল্লাহ থেকে উদ্ধৃত করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, لَيْتَ شِعْرِي مَا فَعَلَ أَبَوَايَ؟ فَنَزَلَتْ ‘আমার পিতা-মাতার কী অবস্থা তা যদি আমি জানতে পারতাম!’- তখন এ আয়াতটি নাযিল করা হয়’।[12] এরপর ইমাম ত্ববারী রহিমাহুল্লাহ বলেন,فَإِنْ ظَنَّ ظَانٌ أَنَّ الْخَبَرَ الَّذِي رُوِيَ عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ كَعْبٍ صَحِيحٌ، فَإِنَّ فِي اسْتِحَالَةِ الشَّكِّ مِنَ الرَّسُولِ عَلَيْهِ السَّلَامُ فِي أَنَّ أَهْلَ الشِّرْكِ مِنْ أَهْلِ الْجَحِيمِ، وَأَنَّ أَبَوَيْهِ كَانَا مِنْهُمْ، مَا يَدْفَعُ صِحَّةَ مَا قَالَهُ مُحَمَّدُ بْنُ كَعْبٍ إِنْ كَانَ الْخَبَرُ عَنْهُ صَحِيحًا ‘যদি কোনো ধারণাকারী ধারণা করেন যে, মুহাম্মাদ ইবনু কা‘ব থেকে বর্ণিত এ হাদীছটি ছহীহ, তবে তার এ ধারণা সঠিক হবে না। কারণ, মুশরিকরা যে জাহান্নামী এবং তার পিতা-মাতা যে তাদের অন্তর্ভুক্ত এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো সন্দেহ থাকাই অসম্ভব বিষয়। আর এটিই মুহাম্মাদ ইবনু কা‘ব এর কথার বিশুদ্ধতাকে প্রতিহত করে, যদি বর্ণনাটি তাঁর থেকে ছহীহ সূত্রে বর্ণিত হয় (অর্থাৎ যদি বর্ণনাটি মুহাম্মাদ ইবনু কা‘ব থেকে ছহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়, তবে তার কথাটি সঠিক নয় আর যদি বর্ণনাটি তার থেকে ছহীহ সূত্রে বর্ণিত না হয়, তবে তা যে সঠিক নয়, তা বলাই বাহুল্য)’।[13]
ইমাম ফাখরুদ্দীন রাযী রহিমাহুল্লাহ (৬০৬ হি.) এ মত সমর্থন করে বলেন, وَهَذِهِ الرِّوَايَةُ بَعِيدَةٌ لِأَنَّهُ عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ كَانَ عَالِمًا بِكُفْرِهِمْ، وَكَانَ عَالِمًا بِأَنَّ الْكَافِرَ مُعَذَّبٌ، فَمَعَ هَذَا الْعِلْمِ كَيْفَ يُمْكِنُ أَنْ يَقُولَ: لَيْتَ شِعْرِي مَا فَعَلَ أَبَوَايَ. ‘এ বর্ণনাটি অগ্রহণযোগ্য। কারণ, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কাফের হওয়ার বিষয় জানতেন এবং কাফেররা যে শাস্তি পাবে তাও জানতেন। কাজেই এরূপ জ্ঞান থাকার পরেও কীভাবে তিনি বলবেন, আমার পিতা-মাতা কেমন আছেন, তা যদি জানতাম?’[14]
জ্ঞাতব্য : সম্প্রতি ‘জনৈক বক্তা’ একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বলেন, কেউ যদি বলে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাবা-মা কাফের ছিল, কুরআন হাতে নিয়ে আল্লাহর কসম করে বলি, ‘সে কাফের’।
এবার আসুন! আমরা দেখি, এ সম্পর্কে ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ কী বলেছেন!
নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিতা-মাতা সম্পর্কে ইমাম আযম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ-এর বক্তব্য :
وَوَالِدَا رَسُوْلِ اللهِ صَلَى اللهُ تَعَالَى عَلَيْهِ وَأَلِهِ وَسَلَّمَ مَاتَا عَلَى الْكُفْرِ (وَفِيْ نُسْخَةٍ زِيْدَ) وَرَسُوْلُ اللهِ صَلَى اللهُ تَعَالَى عَلَيْهِ وَأَلِهِ وَسَلَّمَ مَاتَ عَلَى الْاِيْمَانِ وَأَبُوْ طَالِبٍ عُمُّهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَبُوْ عَلِي (رَضِيَ اللهُ عَنْهُ) مَاتَ كَافِرًا.
‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিতা-মাতা কুফরের উপর মৃত্যুবরণ করেন। (কোনো কোনো পাণ্ডলিপিতে অতিরিক্ত রয়েছে : এবং রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈমানের উপর মৃত্যুবরণ করেন।) তার চাচা অর্থাৎ আলী রযিয়াল্লাহু আনহু-এর পিতা আবূ তালেব কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন’।[15]
‘আল-ফিক্বহুল আকবার’ গ্রন্থের প্রসিদ্ধতম ব্যাখ্যা দশম-একাদশ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধতম হানাফী ফক্বীহ ও মুহাদ্দিছ মোল্লা আলী কারী রহিমাহুল্লাহ (১০১৪ হি./১৬০৬ খ্রি.) প্রণীত ‘শারহু ফিক্বহিল আকবার’। এ গ্রন্থেরও কোনো নুসখায় কথাটি আছে আবার কোনো নুসখায় নেই। ভারত (থানবী প্রকাশনী, দেওবন্দ) থেকে প্রকাশিত ‘শারহুল ফিক্বহিল আকবার’ এ বাক্যগুলো এভাবেই আছে। শায়খ মারওয়ান মুহাম্মাদ আশ-শাআর এর সম্পাদনায় লেবাননের ‘দারুন নাফাইস’ কর্তৃক প্রকাশিত ‘শারহুল ফিক্বহিল আকবার’ গ্রন্থেও বাক্যগুলো আছে। তবে পাকিস্তান (কাদীমী কুতুবখানা, আরামবাগ, করাচি) থেকে প্রকাশিত মোল্লা আলী ক্বারী রহিমাহুল্লাহ-এর ‘শারহুল ফিক্বহিল আকবার’ এ বাক্যটি নেই।[16]
খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহিমাহুল্লাহ বলেন, আল-ফিক্বহুল আকবারের পাণ্ডলিপিগুলো প্রসিদ্ধ হানাফী আলেমগণ সংরক্ষণ ও অনুলিপি করেছেন। এখানে দু’টি সম্ভাবনা বিদ্যমান: (ক) ইমাম আযম বাক্যগুলো লিখেছেন, কিন্তু পরবর্তী যুগের কোনো কোনো লিপিকার হানাফী আলেম বাক্যগুলো অশোভনীয় হওয়ায় তা ফেলে দিয়েছেন। (খ) বাক্যগুলো তিনি লিখেননি, পরবর্তী যুগের কোনো লিপিকার হানাফী আলেম অতিরিক্ত বাক্যগুলো সংযোজন করেছেন।
প্রথম সম্ভাবনাই স্বাভাবিক। পরবর্তী যুগে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিতা-মাতার বিষয়ে এ সংযোজন করার কোনো প্রয়োজনীয়তা হানাফী আলেমদের ছিল বলে প্রতীয়মান হয় না। কিন্তু এ বাক্যগুলো পরবর্তী যুগের অনেক হানাফী আলেমই অশোভনীয় বলে গণ্য করেছেন।[17]
আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহিমাহুল্লাহ আরো বলেন, কোনো কোনো আলেম মত প্রকাশ করেছেন যে, হয়তো বক্তব্যটি নিম্নরূপ ছিল, وَوَالِدَا رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَاتَا عَلَى الْكُفْرِ ‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিতা-মাতা কুফরের উপর মৃত্যুবরণ করেননি’। পাণ্ডলিপিকারের ভুলে (ما) শব্দটি পড়ে যাওয়ায় অর্থ সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে গিয়েছে। তবে এটি দূরবর্তী সম্ভাবনা। কারণ, এক্ষেত্রে ‘কুফরের উপর মৃত্যুবরণ করেননি’ না বলে ‘ঈমানের উপর মৃত্যুবরণ করেছেন’ বলা ছিল স্বাভাবিক।[18]
তাদের দাবির পক্ষে কয়েকটি হাদীছ :
হাদীছ-১ : আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, বিদায় হজ্জের সময়ে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেদনার্ত ছিলেন। একসময় তিনি আনন্দিত চিত্তে আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা-এর নিকট আগমন করেন। তিনি কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ذَهَبْتُ لِقَبْرِ أُمِّي ﺁمِنَةَ فَسَأَلْت اللهَ رَبِّي أَنْ يُحْيِيَهَا فَأَحْيَاهَا فَأَمَنَتْ بِي أَوْ قَالَ فَاَمَنَتْ وَرَدَّهَا اللهُ عَزَّ وَجَلَّ ‘আমি আমার আম্মা আমেনার কবরের নিকট গমন করি এবং আল্লাহর কাছে দু‘আ করি তাকে জীবিত করতে। তখন আল্লাহ তাকে জীবিত করেন, তিনি আমার উপর ঈমান আনয়ন করেন, অতঃপর আল্লাহ তাকে ফিরিয়ে নেন’। কোনো কোনো বর্ণনায় পিতা-মাতার কথা বলা হয়েছে।[19]
তাহক্বীক্ব : ইবনুল জাওযী, মোল্লা আলী ক্বারী, শাওক্বানী ও অন্যান্য মুহাদ্দিছ রহিমাহুমুল্লাহ হাদীছটিকে জাল বলে উল্লেখ করেছেন। ইবনু কাছীর রহিমাহুল্লাহ বলেন, হাদীছটি মুনকার ও অত্যন্ত দুর্বল এবং হাদীছের রাবীগণ দুর্বল ও অজ্ঞাত পরিচয়। ইবনু আসাকির রহিমাহুল্লাহও একই কথা বলেছেন। ইমাম সুয়ূতী রহিমাহুল্লাহ উল্লেখ করেছেন যে, হাদীছটি নিশ্চিতরূপেই দুর্বল। তিনি বলেন, মুহাদ্দিছগণ একমত যে, হাদীছটি দুর্বল, কেউ কেউ একে জাল বলেছেন। এ বিষয়ে আবূ দাঊদের ভাষ্যকার শামসুল হক্ব আযীমাবাদী রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিতা-মাতাকে জীবিতকরণ, ঈমান আনয়ন ও নাজাত প্রাপ্তি সম্পর্কে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে, তার অধিকাংশই মিথ্যা ও জাল এবং বাকীগুলো খুবই দুর্বল।[20] মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী রহিমাহুল্লাহ এ বিষয়ে পৃথক একটি বই রচনা করেন। যার নাম হলো أدلة معتقد أبي حنيفة الأعظم في أبوي الرسول عليه السلام অর্থাৎ ‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিতা-মাতা বিষয়ে ইমাম আযম আবূ হানীফার আক্বীদার পক্ষে দলীলসমূহ’। এ গ্রন্থের শুরুতে তিনি বলেছেন, ‘ইমাম আযম তার “আল-ফিক্বহুল আকবার” নামক নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে বলেছেন, ‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিতা-মাতা কুফরের উপর মৃত্যুবরণ করেন’। ব্যাখ্যাকার বলেন, এ কথা দ্বারা তিনি দু’টি মত খণ্ডন করেছেন— (ক) যারা বলেন যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিতা-মাতা ঈমানের সাথে মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের মত এবং (খ) যারা বলেন যে, তারা কুফরের উপর মৃত্যুবরণ করেন, অতঃপর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জন্য আল্লাহর কাছে দু‘আ করেন, তখন আল্লাহ তাদের দু’জনকে পুনর্জীবিত করেন এবং তারা দু’জন ইসলাম গ্রহণ করে ইসলামসহ মৃত্যুবরণ করেন— তাদের মত তিনি খণ্ডন করেছেন। এ বিষয়ে আমি আল্লাহর সাহায্য ও তাওফীক্বে বলি যে, এ বিষয়ে ইমাম আযমের বক্তব্য বুঝতে হলে কোনো ‘যন্নী’ বা ধারণা প্রদানকারী প্রমাণের উপর নির্ভর করা যাবে না; বরং ক্বাতঈ বা সুনিশ্চিত বিশ্বাস প্রদানকারী প্রমাণের উপর নির্ভর করতে হবে। কারণ, বিষয়টি আক্বীদা বা বিশ্বাসসংশ্লিষ্ট, যে বিষয়ে ‘যন্নী’ বা ধারণা জ্ঞাপক প্রমাণের উপর নির্ভর করা যায় না। আর এ বিষয়ে দুর্বল-অনির্ভরযোগ্য দু-চারটি হাদীছ বা কাল্পনিক বর্ণনা যথেষ্ট নয়। কারণ, নির্ভরযোগ্য মূলনীতিতে একথা নির্ধারণ ও নিশ্চিত করা হয়েছে যে, কোনো মানুষের জন্য অন্য কোনো ব্যক্তিকে জান্নাতী বা শাস্তিপ্রাপ্ত (জাহান্নামী) বলে নিশ্চিত করা বৈধ নয়। কেবল যদি কুরআনুল কারীমের সুস্পষ্ট বক্তব্য, মুতাওয়াতির হাদীছ বা উম্মতের আলেমগণের ইজমা দ্বারা সুনিশ্চিত হয় যে, উক্ত ব্যক্তি ঈমানসহ মৃত্যুবরণ করেছেন, অথবা জীবনের শেষ মুহূর্তে কাফের থেকে কুফরসহ মৃত্যুবরণ করেছেন, তাহলেই কেবল তাকে জান্নাতী বা জাহান্নামী বলে নিশ্চিত করা যায়। উপরের বিষয়টি বুঝার পরে আমি আমার জ্ঞান অনুসারে কুরআন, হাদীছ ও উম্মতের ইমামগণের ইজমার আলোকে ইমাম আযমের বক্তব্য প্রমাণ করব’।[21] শারহু ফিক্বহিল আকবার গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে মোল্লা আলী ক্বারী রহিমাহুল্লাহ বলেন,
هَذَا رَدُّ عَلَى مَنْ قَالَ أَنَّهُمَا مَاتَا عَلَى الْاِيْمَانِ أَوْ مَاتَا عَلَى الْكُفْرِ ثُمَّ أَحْيَاهُمْ اللهُ تَعَالَى فَمَاتَا فِيْ مَقَامِ الْاِيْمَانِ. وَقَدْ أَفْرَدْتُ لِهَذِهِ الْمَسْأَلَةِ رِسَالَةً مُسْتَقِلَّةً وَدَفَعْتُ مَا ذَكَرَهُ السُّيُوْطِيُّ فِيْ رَسَائِلِهِ الثَّلَاثَةِ، فِيْ تَقْوِيَةِ هَذِهِ الْمَقَالَةِ بِالْأَدِلَّةِ الْجَامِعَةِ الْمُجْتَمِعَةِ مِنَ الْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ وَالْقِيَاسِ وَﺇِجْمَاعِ الْأُمَّةِ. وَمِنْ غَرِيْبِ مَا وَقَعَ فِيْ هَذِهِ الْقَضِيَّةِ ﺇِنْكَارُ بَعْضِ الْجَهَلَةِ مِنَ الْحَنَفِيَّةِ عَلَى مَا فِيْ بَسْطِ هَذَا الْكَلَامِ بَلْ أَشَارَ ﺇِلَى أَنَّهُ غَيْرُ لِأَئِقٍ بِمَقَامِ الْاِمَامِ الْأَعْظَمِ. وَهَذَا بِعَيْنِهِ كَمَا قَالَ الضَّالُّ جَهْمُ بْنُ صَفْوَانَ: وَدِدْتُ أَنْ أَحُكَّ مِنَ الْمُصْحَفِ قَوْلَهُ تَعَالَى: ثُمَّ اسْتَوَاى عَلَى الْعَرْشِ.........وَقَوْلِ الرَّافِضِيﱢ الْأَكْبَرِ ﺇِنَّهُ بَرَيْءٌ مِنَ الْمُصْحَفِ الَّذِيْ فِيْهِ نَعْتُ الصِّدﱢيْقِ الْأَكْبَرِ.
‘এ কথা দ্বারা তাদের মত প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, যারা বলেন যে, তারা উভয়ে ঈমানের উপর মৃত্যুবরণ করেছিলেন, অথবা কুফর অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন, পরে আল্লাহ তাদেরকে জীবিত করেন এবং তারা ঈমানসহ মৃত্যুবরণ করেন। এ বিষয়ে আমি পৃথক বই রচনা করেছি, তাতে আমি ইমাম সুয়ূতীর তিনটি বইয়ের বক্তব্য খণ্ডন করেছি। এ বইয়ে আমি কুরআন, হাদীছ, ক্বিয়াস ও ইজমার বক্তব্য দিয়ে ইমাম আযমের এ মত জোরদার করেছি। এ সম্পর্কিত একটি মজার বিষয় হলো— কিছু অজ্ঞ হানাফী এ বিষয়ক আলোচনা আপত্তিকর বলে মনে করেন। বরং তারা বলেন, এ ধরনের কথা বলা ইমাম আযমের মযার্দার পরিপন্থী। তাদের এ কথা অবিকল (জাহমী মতের প্রতিষ্ঠাতা) বিভ্রান্ত জাহম ইবনু ছাফওয়ানের কথার মতো। সে বলত, ‘আমার মনে চায় যে, আল্লাহর বাণী ‘অতঃপর তিনি আরশে উঠলেন’ কথাটি আমি কুরআনের পৃষ্ঠা থেকে মুছে ফেলে দিই’। অনুরূপভাবে তাদের কথা অবিকল সেই প্রধান রাফেযী- শীআর কথার মতো, যে বলে, ‘যে কুরআনের মধ্যে ছিদ্দীক্বে আকবারের প্রশংসা বিদ্যমান, সে কুরআনের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই’। (অর্থাৎ জাহম যেমন মূর্খতাবশত বলত যে, ‘আল্লাহ আরশের উপর উঠলেন’ কথাটি আল্লাহর মযার্দার পরিপন্থী এবং প্রধান রাফেযী ব্যক্তিত্ব যেমন মনে করে যে, ছিদ্দীক্বে আকবারের প্রশংসা কুরআনের মযার্দার পরিপন্থী, তেমনি এ অজ্ঞ হানাফী ভেবেছে যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিতা-মাতা বিষয়ক আবূ হানীফার বক্তব্যটি তার মযার্দার পরিপন্থী)।[22]
মোল্লা আলী ক্বারী রহিমাহুল্লাহ-এর এ বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ-এর বক্তব্যের মধ্যে এ বাক্যটি বিদ্যমান থাকার বিষয়ে তিনি সুনিশ্চিত ছিলেন এবং তার ব্যাখ্যাগ্রন্থের মধ্যেও বাক্যটি বিদ্যমান ছিল।
হাদীছ-২ : আলী রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, خَرَجْتُ مِنْ نِكَاح وَلَمْ أَخْرُجْ مِنْ سِفَاحٍ مِنْ لَدُنْ ﺁدَمَ ﺇِلَى أَنْ وَلَدَتْنِي أَبِي وَأُمِّي، لَمْ يُصِبْنِي مِنْ سِفَاحِ الْجَاهِلِيَّةِ شَيْءٌ ‘আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে আমার পিতা-মাতা আমাকে জন্ম দেওয়া পর্যন্ত বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে আমার জন্ম, কোনো অবৈধ সম্পর্কের মাধ্যমে আমার জন্ম হয়নি। জাহেলী যুগের কোনো অবৈধতা-অশ্লীলতা আমাকে স্পর্শ করেনি’।[23]
তাহক্বীক্ব : ইমাম বায়হাক্বী রহিমাহুল্লাহ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিতা-মাতা ও পিতামহের জাহান্নামী হওয়ার অর্থে অনেকগুলো হাদীছ উদ্ধৃত করেন। এরপর তিনি বলেন,
وَكَيْفَ لَا يَكُونُ أَبَوَاهُ وَجَدُّهُ بِهَذِهِ الصِّفَةِ فِي الْآخِرَةِ، وَكَانُوا يَعْبُدُونَ الْوَثَنَ حَتَّى مَاتُوا، وَلَمْ يَدِينُوا دِينَ عِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ عَلَيْهِ السَّلَامُ؟ وَأَمْرُهُمْ لَا يَقْدَحُ فِي نَسَبِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؛ لِأَنَّ أَنْكِحَةَ الْكُفَّارِ صَحِيحَةٌ، أَلَا تَرَاهُمْ يُسْلِمُونَ مَعَ زَوْجَاتِهِمْ فَلَا يَلزَمُهُمْ تَجْدِيدُ الْعَقْدِ، وَلَا مُفَارَقَتُهُنَّ إِذَا كَانَ مِثْلُهُ يَجُوزُ فِي الْإِسْلَامِ.
‘তার পিতা-মাতা ও পিতামহ মৃত্যু পর্যন্ত মূর্তিপূজা করেছেন এবং তারা ঈসা আলাইহিস সালাম-এর দ্বীনও গ্রহণ করেননি। ফলে তারা আখেরাতে জাহান্নামী হবেন না কেন? এ বিষয়টি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বংশের পবিত্রতার পরিপন্থী নয়। কারণ, কাফেরদের বিবাহ বিশুদ্ধ। এজন্য তো কাফেররা যখন তাদের স্ত্রীদের সাথে একত্রে ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন নতুন করে বিবাহ পড়ানোর দরকার হয় না এবং স্ত্রীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ারও কোনো বিধান নেই, যদি এরূপ বিবাহ ইসলামে বৈধ থাকে’।[24]
সপ্তম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ ফক্বীহ ও মুহাদ্দিছ ইমাম নববী রহিমাহুল্লাহ (৬৭৬ হি.) ‘আমার পিতা ও তোমার পিতা জাহান্নামী’ হাদীছটিকে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিতা-মাতার কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণের নিশ্চিত প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করে বলেন,
فِيهِ أَنَّ مَنْ مَاتَ عَلَى الْكُفْرِ فَهُوَ فِي النَّارِ وَلَا تَنْفَعُهُ قَرَابَةُ الْمُقَرَّبِينَ وَفِيهِ أَنَّ مَنْ مَاتَ فِي الْفَتْرَةِ عَلَى مَا كَانَتْ عَلَيْهِ الْعَرَبُ مِنْ عِبَادَةِ الْأَوْثَانِ فَهُوَ مِنْ أَهْلِ النَّارِ وَلَيْسَ هَذَا مُؤَاخَذَةٌ قَبْلَ بُلُوغِ الدَّعْوَةِ فَإِنَّ هَؤُلَاءِ كَانَتْ قَدْ بَلَغَتْهُمْ دَعْوَةُ إِبْرَاهِيمَ وَغَيْرِهِ مِنَ الْأَنْبِيَاءِ صَلَوَاتُ اللَّهِ تَعَالَى وَسَلَامُهُ عَلَيْهِمْ.
‘এ হাদীছে নির্দেশনা রয়েছে, যে ব্যক্তি কুফরী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে, সে জাহান্নামী। আল্লাহর প্রিয়ভাজনদের আত্মীয়তা তার কোনো উপকার করবে না। এ হাদীছে আরো নির্দেশনা রয়েছে, আরবের মানুষগণ যেরূপ মূর্তিপূজায় লিপ্ত ছিল, সেরূপ কর্মের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি রাসূলবিহীন ‘ফাতরাতের’ সময়ে মৃত্যুবরণ করেছে, সে ব্যক্তিও জাহান্নামী। এরূপ ব্যক্তিদের জাহান্নামে যাওয়ার অর্থ এ নয় যে, তাদেরকে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছানোর পূর্বেই শাস্তি দেওয়া হলো। কারণ, এদের কাছে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও অন্যান্য নবীর দাওয়াত পৌঁছেছিল’।[25]
আল্লামা খলীল আহমাদ সাহারানপুরী রহিমাহুল্লাহ (১৩৪৬ হি.) বলেন,
قَدْ بَالغَ السُّيُوطِيُّ فِيْ ﺇِثْبَاتِ ﺇِيْمَانِ أَبَوَيْ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ الْقَارِي الجمهور عَلَى أَنَّ وَالِدَيْهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَاتَا كَافِرَيْنِ وَهَذَا الْحَدِيْثُ أَصَحُّ مَا رُوِيَ فِيْ حَقِّهِمَا......فَعَلَى تَقْدِيْرِ صِحَّتِهِ لَا يَصْلُحُ أَنْ يَكُوْنَ مُعَارِضًا لِحَدِيْثِ مُسْلِمٍ مَعَ أَنَّ الْحُفَّاظَ طعَنُوْا فِيْهِ وَمَنَعُوْا جَوَازَهُ بِأَنَّ ﺇِيْمَانَ الْيَأسِ غَيْرُ مَقْبُوْلٍ ﺇِجْمَاعًا كَمَا يَدُلُّ عَلَيْهِ الْكِتَابُ وَالسُّنًّةُ وَبِأَنَّ الْاِيْمَانَ الْمَطْلُوْبَ مِنَ الْمُكَلَّفِ ﺇِنَّمَا هُوَ الْاِيْمَانُ الْغَيْبِيُّ..... وَهَذَا الْحَدِيْثُ الصَّحِيْحُ صَرِيْحٌ أَيْضًا فِيْ رَدﱢ مَا تَشَبَّثَ بِهِ بَعْضَهُمْ بِأَنَّهُمَا كَانَا مِنْ أَهْلِ الْفَتْرَةِ وَلَا عَذَابَ عَلَيْهِمْ.
‘সুয়ূত্বী রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিতা-মাতার ঈমানের বিষয়টি প্রমাণে অতি চেষ্টা করেছেন। মোল্লা আলী ক্বারী বলেছেন, অধিকাংশ আলেম একমত যে, তারা কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। এ ব্যাপারে এ হাদীছটি সবচেয়ে বিশুদ্ধ দলীল।..... (পুনর্জীবিত করার) হাদীছটি ছহীহ বলে মেনে নিলেও ছহীহ মুসলিমের (আমার ও তোমার পিতা জাহান্নামী) হাদীছটির বিপরীতে দাঁড় করানো যায় না। সর্বোপরি প্রাজ্ঞ মুহাদ্দিছ (পুনর্জীবিত করার) এ হাদীছটির বিশুদ্ধতার ব্যাপারে আপত্তি করেছেন। তারা এ ঘটনার সম্ভাবনাও অস্বীকার করেছেন। কারণ, মুসলিম উম্মাহর ইজমা যে, নৈরাশ্যের পরে ঈমান— অর্থাৎ মৃত্যু আগমনের পরে ঈমান গ্রহণযোগ্য নয়। কুরআন ও হাদীছে তা সুস্পষ্ট বলা হয়েছে। এছাড়া ঈমান তো গায়েবী বিষয়ের উপরই হয়ে থাকে। মৃত্যুর পরে তো সব গায়েবী বিষয় প্রত্যক্ষ হয়ে যায়; এরপর তো আর ঈমান বিল গায়েব থাকে না।..... (আমার পিতা ও তোমার পিতা জাহান্নামে) হাদীছটি সুস্পষ্টভাবে তাদের বক্তব্যও প্রত্যাখ্যান করে, যারা দাবি করে যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিতা-মাতা ‘ফাতরাত’ বা রাসূলবিহীন যুগে থাকার কারণে তাদের শাস্তি হবে না’।[26]
এভাবে ইমাম নববী ও অন্যান্য ওলামায়ে কেরাম রহিমাহুমুল্লাহ এ হাদীছের উপর নির্ভর করে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিতা-মাতার ‘ফাতরাত’-বাসী হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তারা দাবি করেছেন যে, আরবের মুশরিকরা ‘রাসূলবিহীন’ ছিলেন না; বরং ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর দাওয়াত তাদের নিকট পৌঁছেছিল।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে এ বিষয়ে সঠিক বুঝ দান করুন- আমীন!
[প্রবন্ধটি ‘আল-ফিকহুল আকবার’ অনুবাদ গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত ও পরিমার্জিত।]
আব্দুল মালেক বিন ইদ্রিস
বি.এ, অনার্স, হাদীছ বিভাগ, ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/২০৩; আবূ দাঊদ, হা/৪৭১৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/১২১৯২, ১৩৮৩৪; সিলসিলা ছহীহা, হা/২৫৯২।
[2]. ছহীহ মুসলিম, ‘ঈমান’ অধ্যায়, হা/২০৩।
[3]. আবূ দাঊদ, ‘সুন্নাহ’ অধ্যায়, হা/৪৭১৮।
[4]. আওনুল মা‘বূদ, ১২/৩২৪, হা/৪৭১৮-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।
[5]. ইবনু মাজাহ, হা/১৫৭৩; সিলসিলা ছহীহা, হা/১৮, সনদ ছহীহ।
[6]. ছহীহ মুসলিম, হা/৯৭৬; আবূ দাঊদ, হা/৩২৩৪; নাসাঈ, হা/২০৩৪; ইবনু মাজাহ, হা/১৫৭২; মুসনাদে আহমাদ, হা/৯৩৯৫; ইরওয়াউল গালীল, হা/৭৭২; বায়হাক্বী, মা‘রেফাতুস সুনান ওয়াল আছার, হা/২৩৫১; মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ, হা/১১৮০৭; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৩১৬৯; নাসাঈ, সুনানুল কুবরা, হা/২১৬১; মুস্তাদরাক হাকেম, হা/১৩৯০; বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা, হা/৭৪০৪; বায়হাক্বী, সুনানুছ ছুগরা, হা/১১৭৬; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৩৫৪২; মিশকাত, হা/১৭৬৩।
[7]. ছহীহ মুসলিম, ‘জানাযা’ অধ্যায়, হা/৯৭৬।
[8]. ইবনু মাজাহ, ‘জানাযা’ অধ্যায়, হা/১৫৭২।
[9]. নাসাঈ, ‘জানাযা’ অধ্যায়, হা/২০৩৪।
[10]. তিরমিযী, হা/৩১০১; নাসাঈ, হা/২০৩৬; নাসাঈ, সুনানুল কুবরা, হা/২১৬৩; মুসনাদে বাযযার, হা/৮৯৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৭১; মুসনাদে আবী ইয়া‘লা, হা/৩৩৫।
[11]. নাসাঈ, ‘জানাযা’ অধ্যায়, হা/২০৩৬।
[12]. তাফসীরে ত্ববারী, ২/৫৫৮-৫৬০।
[13]. তাফসীরে ত্ববারী, ২/৫৫৮-৫৬০।
[14]. ফখরুদ্দীন রাযী, মাফাতীহুল গায়েব, ৪/২৮।
[15]. ফিকহুল আকবার, (আস-সুন্নাহ পাবলিকেশন্স, ঝিনাইদহ) পৃ. ৪৬৮ (অনুবাদ অংশটুকু আছে, পৃ. ৪৭০)।
[16]. খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহিমাহুল্লাহ, আল-ফিকহুল আকবার, (আস-সুন্নাহ পাবলিকেশন্স, ঝিনাইদহ) পৃ. ৪৭৮।
[17]. প্রাগুক্ত।
[18]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭৮-৪৭৯।
[19]. ইবনু শাহীন উমার ইবনু আহমাদ (৩৮৫ হি.), খত্বীব বাগদাদী, (৪৬৩ হি.), ইবনু আসাকির (৫৭১ হি.) প্রমুখ মুহাদ্দিছগণ হাদীছটি তাদের স্ব স্ব কিতাবে উদ্ধৃত করেছেন।
[20]. আওনুল মা‘বূদ, ১২/৩২৪, হা/৪৭১৮-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।
[21]. মোল্লা আলী ক্বারী, আদিল্লাতু মু‘তাকাদি আবী হানীফা, পৃ. ৬১-৬৪।
[22]. মোল্লা আলী ক্বারী, শারহু ফিক্বহিল আকবার, পৃ. ১৩১।
[23]. বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা, ৭/১৯০; আলবানী, ছহীহুল জামে‘, ১/৬১৩, হা/৩২২৫।
[24]. বায়হাক্বী, দালায়িলুন নবুঅত, ১/১১২, ১১৯-১২২।
[25]. ইমাম নববী, শারহু ছহীহ মুসলিম, ৩/৭৯।
[26]. সাহারানপুরী, বাযলুল মাজহূদ, ৫/২১৪।