আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের মাঝে রিযিক্ব বণ্টন করেছেন এবং তাদের অংশ নির্ধারণ করেছেন। অংশ নিধার্রণের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ তাঁর জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার যথাযথ ব্যবহার করেছেন। আল্লাহ তাআলা বান্দাদেরকে রিযিক্ব অন্বেষণ এবং তা পাওয়ার কারণগুলো নিজের মাঝে বাস্তবায়নের নির্দেশ প্রদান করেছেন। যা বান্দার পাবার কথা নয়, সে কখনোই তা পাবে না এবং যে রিযিক্ব তার জন্য নির্ধারিত তা অন্য কেউ গ্রহণ করতে পারবে না। এ ব্যাপারে বান্দাকে সন্তুষ্ট থাকা এবং ঈমান রাখার প্রতি আল্লাহ তাআলা আদেশ করেছেন।[1] সুতরাং বান্দা যমীনে চেষ্টা অব্যাহত রাখবে এবং ঐ সমস্ত কাজ করবে যা রিযিক্ব বৃদ্ধির কারণ। ফলে রিযিক্ব বৃদ্ধি পাবে। আর যদি বান্দা এর বিপরীত কাজ করে তাহলে তার রিযিক্ব সংকীর্ণ হয়ে যাবে এবং বরকত কমে যাবে।[2]
প্রথম কারণ: আল্লাহর প্রতি যথাযথ ভরসা না করা
আল্লাহ তাআলার প্রতি যথাযথ ভরসা করা রিযিক্ব পাবার অন্যতম কারণ। আর আল্লাহ তাআলার প্রতি পূর্ণ ভরসা না করা এবং রিযিক্ব নিয়ে বিচলিত হওয়ার কারণে রিযিক্ব সংকীর্ণ হয়ে যায়। রিযিক্ব পরিচালনার দায়িত্ব বান্দার কাঁধে অর্পিত— এই ধারণার কারণে বান্দা সবচেয়ে বেশি রিযিক্ব থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,لَو أنَّكُم كنتُم تَوكَّلُونَ على اللهِ حقَّ تَوكُّلِهِ لرُزِقْتُمْ كما تُرزَقُ الطَّيرُ تغدو خِماصًا وتروحُ بطانًا ‘যদি তোমরা আল্লাহ তাআলার প্রতি যথাযথ ভরসা করো, তবে তোমরা অবশ্যই রিযিক্ব প্রাপ্ত হতে, যেভাবে পাখিদেরকে রিযিক্ব দেওয়া হয়ে থাকে। পাখিরা সকালবেলা খালি পেটে বাসা থেকে বের হয় এবং সন্ধ্যাবেলায় ভরা পেটে বাসায় ফেরে’।[3]
উক্ত হাদীছের অর্থ হলো— বান্দা যখন আল্লাহ তাআলার উপর ভরসার ক্ষেত্রে উঁচু স্তরে পৌঁছতে পারবে, তখন সে কম চেষ্টা করেও রিযিক্ব প্রাপ্ত হবে।[4] অনুরূপ আল্লাহ তাআলা ঐ বান্দার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন যে কেবল আল্লাহর উপর ভরসা করে। আর এজন্যই রিযিক্বের রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া ব্যক্তির উপর অবশ্যক হলো আল্লাহর প্রতি ভরসাকে অন্তরে নবায়ন করা এবং সকল কাজের পূর্বে কেবল আল্লাহর প্রতি ভরসাকেই অগ্রগামী করা।[5]
দ্বিতীয় কারণ: পাপাচার ও আল্লাহ তাআলার অবাধ্যাচরণ
শারীআর বিপুল পরিমাণ নছ প্রমাণ করে যে, পাপাচার ও রবের অবাধ্যাচরণ হলো, রিযিক্ব সংকীর্ণ হওয়া এবং দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ হতে বঞ্চিত হবার অন্যতম কারণ। এসব নছ আরও প্রমাণ করে, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, আল্লাহর ভয়, তওবা, ইস্তেগফার করা অফুরন্ত রিযিক্ব পাওয়া এবং তা চলমান রাখার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।[6] আল্লাহ তাআলা বলেন,وَلَو أَنَّ أَهلَ القُرى آمَنوا وَاتَّقَوا لَفَتَحنا عَلَيهِم بَرَكاتٍ مِنَ السَّماءِ وَالأَرضِ وَلـكِن كَذَّبوا فَأَخَذناهُم بِما كانوا يَكسِبونَ ‘আর যদি সেসব জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং তাক্বওয়া অবলম্বন করত তবে অবশ্যই আমরা তাদের জন্য আসমান ও যমীনের বরকতসমূহ উন্মুক্ত করে দিতাম, কিন্তু তারা মিথ্যারোপ করেছিল; কাজেই আমরা তাদের কৃতকর্মের জন্য তাদেরকে পাকড়াও করেছি’ (আল-আ‘রাফ, ৭/৯৬)।
সুতরাং রিযিক্ব বৃদ্ধির মাধ্যম হলো, তাক্বওয়া অবলম্বন করা, সকল অপরাধ থেকে দূরে থাকা, নতুনভাবে তওবা করা, বেশি বেশি ইস্তেগফার করা এবং পাপকর্ম সম্পাদন না করার এমন দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা যে, পাপের পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে যেন রিযিক্ব বাধা প্রাপ্ত না হয়।
তৃতীয় কারণ: অবৈধ উপার্জন
নিশ্চয় বান্দার রিযিক্ব নির্ধারিত। অবৈধ বা হারাম পথে যা তার নিকট পৌঁছেছে, হালাল ভাবেই তা তার নিকট পৌঁছাত, যদি সে শরীআতসিদ্ধ পন্থা অবলম্বন করত। রিযিক্বের উৎসের ক্ষেত্রে হারাম পথ[7] অবলম্বন করায় ব্যক্তি তার উপার্জিত হালাল সম্পদও ধ্বংস করে এবং তা হারাম সম্পদের অকল্যাণে ডুবিয়ে দেয়।[8] আর এজন্যই বান্দার উপর আবশ্যকীয় কর্তব্য হলো উপার্জনের ক্ষেত্রে অবৈধ পন্থা পরিহার করা এবং বৈধভাবে উপার্জনের উত্তম পথ অনুসন্ধান করা। কারণ দিনশেষে তার রিযিক্বের ফলাফল একই হয়ে থাকে, সে হারাম বা হালাল যে পথই অবলম্বন করুক না কেন। যদি মানুষ হারাম সম্পদের মাধ্যমে সম্পদশালী হয়ে ওঠে তবে এটা কেবল তার দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য ধ্বংস এবং বিনাশেরই কারণ।[9]
চতুর্থ কারণ: সম্পদের হক্ব আদায় না করা
নিশ্চয় সম্পদের আবশ্যকীয় হক্ব[10] আদায় করাটা সম্পদে বারাকাহ, তা বৃদ্ধি হওয়া এবং সম্পদ স্থায়ী হওয়ার অন্যতম কারণ। বৈধ পথে খরচ করার মাধ্যমে সম্পদ আরও বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَمَا أَنفَقْتُم مِّن شَيْءٍ فَهُوَ يُخْلِفُهُ وَهُوَ خَيْرُ الرَّازِقِينَ ‘আর তোমরা যা কিছু ব্যয় করবে তিনি তার প্রতিদান দিবেন। তিনি শ্রেষ্ঠ রিযিক্বদাতা’ (সাবা, ৩৪/৩৯)।
আর যাকাত প্রদান করা থেকে বিরত থাকা, ছাদাক্বা আটকে রাখার ফলে রিযিক্ব সংকীর্ণ হয়, কমে যায় এবং বারাকাহ নষ্ট হয়ে যায়।[11]
পঞ্চম কারণ: আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করণ
নিশ্চয় আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা রিযিক্ব সংকীর্ণ হওয়ার অন্যতম কারণ। অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছেন যে, আত্মীয়তার সম্পর্ক সুদৃঢ় করার মাধ্যমে রিযিক্বে প্রশস্ততা আসে, তিনি বলেন,مَنْ سَرَّهُ أَنْ يُبْسَطَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ أَوْ يُنْسَأَ فِى أَثَرِهِ فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ ‘যে পছন্দ করে, তার রিযিক্ব প্রশস্ত হোক এবং হায়াত দীর্ঘ হোক, সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে।[12]
আত্মীয়স্বজনের প্রয়োজন অনুপাতে কিছু খরচ করা, উপঢৌকন প্রদান করা, দেখতে যাওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে আত্মীয়তার সম্পর্ক দৃঢ় হয়, নরম ও উত্তম কথাবার্তার মাধ্যমেও আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় থাকে। এছাড়াও আত্মীয়স্বজনদের সুখে বা দুঃখে অংশ নেওয়া, ছোট বড় কাজে সাহায্য করা, উপার্জনের পথ সংকীর্ণ হয়ে গেলে ব্যক্তির উপর আবশ্যক হলো উপার্জনের পথ খুঁজে দিতে উদাসীন না হওয়া। আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা আল্লাহ তাআলার অন্যতম ইবাদত এবং দুনিয়া ও আখেরাতে অশেষ নেকী অর্জনের মাধ্যম।[13]
ষষ্ঠ কারণ: রিযিক্ব অন্বেষণে উদাসীন হওয়া
ইসলাম কাজের প্রতি উৎসাহিত করেছে এবং রিযিক্ব অন্বেষণ করার আহ্বান জানিয়েছে, যে ব্যক্তি কাজ করে না, অচিরেই সে নিঃস্ব হয়ে যাবে এবং জীবনযাপনের প্রয়োজন মিটাতে অন্যের কাছে হাত পাতবে।[14] ব্যক্তির ইখলাছপূর্ণ নিয়্যতের সহিত নিজেকে কাজে আত্মনিয়োগ করা আল্লাহ তাআলার ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তাআলা বলেন,هُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ ذَلُولًا فَامْشُوا فِي مَنَاكِبِهَا وَكُلُوا مِنْ رِزْقِهِ ‘তিনিই তো তোমাদের জন্য যমীনকে সুগম করে দিয়েছেন; অতএব তোমরা এর দিক-দিগন্তে বিচরণ করো এবং তাঁর দেওয়া রিযিক্ব থেকে আহার করো’ (আল-মুলক, ৬৭/১৫)।
বাস্তবতা প্রমাণ করে, কাজ ছেড়ে বসে থাকা বা রিযিক্ব অন্বেষণে চেষ্টা না করাটা রিযিক্ব কমে যাওয়া বা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মূল কারণ। এজন্যই আল্লাহ তাআলা কাজ এবং কর্মচারীর মর্যাদাকে সমুন্নত করেছেন।[15]
মূল: আল-খানসা হামীদ ছালেহ
অনুবাদ: শুআইব বিন আহমাদ
শিক্ষার্থী, শরীআহ বিভাগ, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।
[1]. কিতাব: নূর ওয়া হিদায়াহ, পৃ. ১২৭-১২৮।
[2]. প্রাগুক্ত।
[3]. তিরমিযী, হা/২৩৪৪।
[4]. আদ-দুরারুল মুনতাক্বত মিনাল কালেমাতিল মুলক্বাত, পৃ. ৩৩৮।
[5]. দুরুসুশ শায়খ মুহাম্মাদ হাসসান, পৃ ১০।
[6]. কিতাবু আর-রিযিক্ব আবওয়াবুহু ওয়া মাফাতিহুহু, পৃ. ১১।
[7]. যেমন: চুরি করা, লুণ্ঠন করা, ইয়াতীমের সম্পদ ভক্ষণ করা এবং সূদী লেনদেন করা।
[8]. কিতাবু ইত্তিক্বাঈল হারাম ওয়া আশ-শুবহাত ফী ত্বলাবি আর-রিযিক্ব, পৃ. ৭৬।
[9]. প্রাগুক্ত।
[10]. যেমন: যাকাত, ছাদাক্বা ইত্যাদি।
[11]. দালীলুল ওয়ায়েজ ইলা আদিল্লাতিল মাওয়ায়িজ, পৃ. ৩২৩।
[12]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৫৭।
[13]. কিতাবু মাজাল্লাতিল বুহূছ আল-ইসলামিয়্যাহ, পৃ. ২৬৭।
[14]. কিতাবুল ইসলাম ওয়া আত-তাওয়াযুন আল-ইক্বতিছদি বায়নাল আফরাদ ওয়া আদ-দুয়াল, পৃ. ৬৩।
[15]. কিতাবু মাক্বাছিদু আশ-শারীআহ আল-ইসলামিয়্যাহ, পৃ. ২৮।