ভূমিকা :
আরবী الرِّيَاءُ শব্দটি الرُّؤْيَة শব্দ থেকে নির্গত হয়েছে। الرِّيَاءُ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে— প্রদর্শন, আত্মপ্রদর্শন, ভান, কপটতা, মুনাফেক্বী, ভণ্ডামি প্রভৃতি।[1] আর اَلسُّمْعَةُ শব্দের অর্থ হচ্ছে— খ্যাতি, সুখ্যাতি, সুনাম ইত্যাদি।[2] মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে ইবাদত করাকে রিয়া বলা হয়। যাতে করে লোকেরা ইবাদতকারী ব্যক্তির প্রশংসা করে। الرِّيَاءُ এবং اَلسُّمْعَةُ এর মধ্যে পার্থক্য হলো— মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে যে আমল করা হয় তথা যা চোখ দিয়ে দেখা যায়, তাকে الرِّيَاءُ বলা হয়। যেমন— ছালাত, দান-খয়রাত ইত্যাদি। আর যে আমল মানুষকে শুনানোর উদ্দেশ্যে করা হয় তথা যা কানে শুনা যায়, তাকে اَلسُّمْعَةُ বলা হয়। যেমন— কুরআন তেলাওয়াত করা, ওয়ায করা, যিকির-আযকার করা ইত্যাদি। যেসব আমল মানুষ তাদের কথাবাতার্য় উল্লেখ করে এবং অন্যকে জানায়, তাও اَلسُّمْعَةُ এর মধ্যে গণ্য।
লৌকিকতা বা লোক দেখানোর জন্য আমল করার পরিণাম খুবই ভয়াবহ। লোক দেখানোর জন্য যে আমল করা হয় ইসলামে তা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ, যা শিরকে আছগার বা ছোট শিরক নামে পরিচিত। আর শিরক বলতেই অমার্জনীয় অপরাধ বোঝায়, যা মানুষের সকল নেক আমলকে নষ্ট করে দিতে পারে। কারণ, ইবাদত-বন্দেগী হতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। এ ব্যতীত অন্য কোনো উদ্দেশ্যে সম্পাদিত হলে তা নিষ্ফল বলে গণ্য হবে। ঐ ইবাদত কোনোই কাজে আসবে না। তাই প্রদর্শনীর উদ্দেশ্যে যে কোনো ধরনের আমল করা থেকে বিরত থাকা উচিত। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ ‘বিশুদ্ধচিত্ত একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করা ব্যতীত তাদেরকে আর কোনো নির্দেশ দেওয়া হয়নি’ (আল-বাইয়িনা, ৯৮/৫)। মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন,إِنَّ الْمُنَافِقِينَ يُخَادِعُونَ اللَّهَ وَهُوَ خَادِعُهُمْ وَإِذَا قَامُوا إِلَى الصَّلَاةِ قَامُوا كُسَالَى يُرَاءُونَ النَّاسَ وَلَا يَذْكُرُونَ اللَّهَ إِلَّا قَلِيلًا ‘নিশ্চয় মুনাফিক্ব (কপট) ব্যক্তিরা আল্লাহকে প্রতারিত করতে চায়। বস্তুত তিনিও তাদেরকে প্রতারিত করে থাকেন এবং যখন তারা ছালাতে দাঁড়ায়, তখন শৈথিল্যের সাথে নিছক লোক দেখানোর জন্য দাঁড়ায় এবং আল্লাহকে তারা অল্পই স্মরণ করে থাকে’ (আন-নিসা, ৪/১৪২)।
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনুল ক্বাইয়িম আলাইহিস সালাম বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা যেমন এক, তিনি ব্যতীত অন্য কোনো সত্য মা‘বূদ নেই। ঠিক তেমনি ইবাদত একমাত্র তাঁর জন্যই হওয়া চাই। তিনি এক এবং তাঁর কোনো শরীক নেই। তিনিই যেহেতু একমাত্র মা‘বূদ, সুতরাং ইবাদত একমাত্র তাঁরই করা উচিত। বিধায় যে আমল রিয়া বা লোক দেখানো চেতনামুক্ত এবং যা সুন্নাত মোতাবেক হয়, তাকেই কেবল সৎ আমল হিসেবে গণ্য করা হয়’।[3]
একজন মুসলিমের প্রতিটি ইবাদত আল্লাহর জন্যই নিবেদিত হবে। তাতে বিন্দুমাত্র অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকবে না। দুনিয়া হাছিল কিংবা কারো সুদৃষ্টি লাভের আশায় করার সুযোগ নেই। কাউকে দেখানোর বা শুনানোর মানসিকতা পোষণ করা বৈধ নয়। এরূপ ইচ্ছা থাকলে পরকালে তার কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। অনেক আমল করার পরও বিচারের মাঠে শূন্য হাতে উঠতে হবে। লৌকিকতা ও সুনাম অর্জনের নিমিত্তে করার অপরাধে সবই ধ্বংস হয়ে যাবে।
লোক দেখানো আমল শিরকের অন্তর্ভুক্ত :
সাধারণত মানুষ নিজের খ্যাতি অন্যকে জানাতে পছন্দ করে। তার সুনাম ও সুখ্যাতির কথা সবাই জানুক তা সে মনে মনে চায়। অথচ মানুষকে দেখানোর জন্য বা সুনাম অর্জনের জন্য আমল করা শরীআতে নিষিদ্ধ। এরূপ আমল শিরকের সমপর্যায়ভুক্ত। এমন কর্মকে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব বেশি ভয় পেতেন। তিনি এ বিষয়ে ছাহাবীদের কঠোর ভাষায় সাবধান করে গেছেন। মাহমূদ ইবনু লাবীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمُ الشِّرْكُ الأَصْغَرُ قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَمَا الشِّرْكُ الأَصْغَرُ قَالَ الرِّيَاءُ إِنَّ اللَّهَ تَبَارَكَ وَتَعَالَى يَقُولُ يَوْمَ تُجَازَى الْعِبَادُ بِأَعْمَالِهِمُ اذْهَبُوا إِلَى الَّذِينَ كُنْتُمْ تُرَاءُونَ بِأَعْمَالِكُمْ فِى الدُّنْيَا فَانْظُرُوا هَلْ تَجِدُونَ عِنْدَهُمْ جَزَاءً
‘তোমাদের ব্যাপারে আমি সবচেয়ে যে বিষয়ের বেশি ভয় পাই, তা হলো শিরকে আছগার। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! শিরকে আছগার কী? তিনি বললেন, রিয়া তথা লোক দেখানো আমল’। যখন (কিয়ামতে) লোকদের আমলসমূহের প্রতিদান প্রদান করা হবে, তখন আল্লাহ তাআলা সকলের উদ্দেশ্যে বলবেন, ‘তোমরা তাদের নিকটে যাও, যাদের দেখানোর জন্য দুনিয়াতে তোমরা আমল করেছিলে। অতঃপর দেখো, তাদের নিকট কোনো প্রতিদান পাও কি না’।[4] লোক দেখানো আমল শিরকের অন্তর্ভুক্ত, যা উল্লিখিত হাদীছের দ্বারা সুস্পষ্ট প্রমাণিত। এরূপ ব্যক্তিকে মহান আল্লাহ ব্যঙ্গ করে তাদের নিকটে ফিরে যেতে বলবেন, যাদের দেখানোর জন্য সে আমল করেছিল। যা তার জন্য ভীষণ লজ্জা ও লাঞ্ছনার কারণ হবে। এমন কাজকে গোপন শিরকও বলা হয়েছে। এ মর্মে অন্য হাদীছে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ أَبِى سَعِيدٍ قَالَ خَرَجَ عَلَيْنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَنَحْنُ نَتَذَاكَرُ الْمَسِيحَ الدَّجَّالَ فَقَالَ أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِمَا هُوَ أَخْوَفُ عَلَيْكُمْ عِنْدِى مِنَ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ قَالَ قُلْنَا بَلَى فَقَالَ الشِّرْكُ الْخَفِىُّ أَنْ يَقُومَ الرَّجُلُ يُصَلِّى فَيُزَيِّنُ صَلاَتَهُ لِمَا يَرَى مِنْ نَظَرِ رَجُلٍ.
আবূ সাঈদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একদা আমরা মসীহ দাজ্জাল সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম, এমন সময় রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিকট এসে বললেন, ‘সাবধান! আমি কি তোমাদের এমন একটি বিষয় সম্পর্কে অবহিত করব না, যা আমার নিকট তোমাদের জন্য মসীহ দাজ্জাল হতেও আশঙ্কাজনক?’ আমরা বললাম, বলুন, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! তিনি বললেন, ‘আর তা হলো ‘শিরকে খাফী’ অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি ছালাতে দাঁড়িয়ে এই কারণে ছালাতকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে যে, তার ছালাত কোনো ব্যক্তি দেখছে’।[5] মাহমূদ ইবনু লাবীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বের হয়ে বললেন,أَيُّهَا النَّاسُ إِيَّاكُمْ وَشِرْكَ السَّرَائِرِ قَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ وَمَا شِرْكُ السَّرَائِرِ قَالَ يَقُومُ الرَّجُلُ فَيُصَلِّي فَيُزَيِّنُ صَلاَتَهُ جَاهِدًا لِمَا يَرَى مِنْ نَظَرِ النَّاسِ إِلَيْهِ فَذَلِكَ شِرْكُ السَّرَائِرِ ‘হে লোকসকল! তোমরা গোপন শিরক থেকে বেঁচে থাকো। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! গোপন শিরক কী? তিনি বললেন, গোত্রের কোনো ব্যক্তি যখন ছালাত আদায় করে, তখন খুব সুন্দর করে আদায় করার চেষ্টা করে, যাতে করে মানুষ তার দিকে তাকিয়ে তাকে দেখে। আর এটিই গোপন শিরক’।[6]
মানুষকে দেখানোর জন্য কিংবা সুনাম অর্জনের জন্য কোনো আমল করা শিরকে আছগার হিসেবে গণ্য। আবার একে কোনো কোনো হাদীছে গোপন শিরক বলা হয়েছে। আর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় উম্মতের ক্ষেত্রে এ বিষয়টির অধিক ভয় পেতেন। বিষয়টি কানা দাজ্জালের ভয়ংকর ফেতনার চেয়েও মারাত্মক। কারণ এরূপ কাজ করতে মানুষ বেশি পছন্দ করে। একে কোনো অপরাধই মনে করে না। বরং এরূপ কর্মে সে আনন্দ উপভোগ করে। আর আমল করতে গিয়ে শিরক হয়ে গেলে ফলাফল খুবই ভয়াবহ হবে।
শায়খ উছায়মীন আলাইহিস সালাম বলেন, ইবাদত নষ্টকারী হিসেবে রিয়া দু’প্রকার। প্রথমত, যেটা মূল ইবাদতের মধ্যে হবে। এ ধরনের হলে তার আমল বাতিল ও অগ্রহণযোগ্য হবে। দ্বিতীয়ত, যা কোনো কারণবশত ইবাদতের মধ্যে পাওয়া যায়। এটা আবার দু’প্রকার : (ক) রিয়াটি দূর করা হবে। এতে কোনো ক্ষতি হবে না। (খ) রিয়াটি ইবাদতের সঙ্গে থাকবে। আর রিয়াটি যদি ইবাদতের সঙ্গে যুক্ত থাকে, তবে তা আবার দু’ধরনের : (১) যে সব ইবাদতের শেষ অবস্থা শুরু অবস্থার উপর নিভর্রশীল, যেমন— ছালাত। তাহলে উক্ত ইবাদতটি বাতিল বলে গণ্য হবে। (২) ইবাদতের শেষ অবস্থা যদি শুরুর উপর নির্ভরশীল না হয় বরং স্বতন্ত্র, যেমন— ছাদাক্বা। এ ক্ষেত্রে যেটি ইখলাছের সাথে করা হবে তা গ্রহণযোগ্য হবে, আর যেটি ইখলাছ ছাড়া শিরকের সাথে করা হবে তা বাতিল বলে গণ্য হবে।[7]
শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।
[1]. ড. মুহাম্মাদ ফজলুর রহমান, আল-মু‘জামুল ওয়াফী (ঢাকা : রিয়াদ প্রকাশনী, ৩৩তম মুদ্রণ, জানুয়ারি-২০২০), পৃ. ৫৩৩।
[2]. আল-মু‘জামুল ওয়াফী, পৃ. ৫৮০।
[3]. আল-ইরশাদু ইলা ছহীহিল ই‘তিক্বাদ ওয়ার রাদ্দি ‘আলা আহলিশ শিরকি ওয়াল ইলহাদ, পৃ. ১১২; ফাতহুল মাজীদ শারহু কিতাবিত তাওহীদ, পৃ. ৩৫৭।
[4]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩৬৮৬; বায়হাক্বী, শুআবুল ঈমান, হা/৬৮৩১; ত্বাবারানী কাবীর, হা/৪৩০১; কানযুল উম্মাল, হা/৭৪৭৭; বুলূগুল মারাম, হা/১৪৮৪; ছহীহুল জামে‘, হা/১৫৫৫; সিলসিলা ছহীহা, হা/৯৫১; মিশকাত, হা/৫৩৩৪, সনদ ছহীহ।
[5]. ইবনু মাজাহ, হা/৪২০৪; ছহীহুল জামে‘, হা/২৬০৭; কানযুল উম্মাল, হা/৭৪৬৮; ছহীহ আত-তারগীব, হা/৩০; মিশকাত, হা/৫৩৩৩, সনদ হাসান।
[6]. ছহীহ ইবনু খুযায়মা, হা/৯৩৭; বায়হাক্বী কুবরা, হা/৩৪০০; ছহীহুল জামে‘, হা/২৬০৭; ছহীহ আত-তারগীব, হা/৩১, সনদ হাসান।
[7]. আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনু ছালেহ আল-উছায়মীন, আল-ক্বাওলুল মুফীদ ফী কিতাবিত তাওহীদ (সঊদী আরব, ১৪২৪ হি.), ২য় খণ্ড, পৃ. ১২৫।