কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

হাদীছে বর্ণিত রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রিয় খাবারগুলো

রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দৈনন্দিন জীবনই হলো আমাদের জন্য অনুকরণীয়। তাঁর জীবনের দৈনন্দিন কাজের মধ্যে পানাহার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পানাহার বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই যে, তাঁর খাদ্য ও পানীয়ের পুরোটাই ছিল সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্যগুণে সমৃদ্ধ একেকটি উপাদেয় ডিশ। যা একজন মানুষকে সুস্থ-সবল জীবন ধারণের প্রতি উৎসাহিত করে। বক্ষ্যমান প্রবন্ধে আমরা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পছন্দের কিছু খাবারের উপর আলোকপাত করার প্রয়াস পাব।

খেজুর : রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খেজুর খেতে ভালোবাসতেন। পুষ্টিগুণে ভরপুর খেজুরে রয়েছে ভিটামিন, আঁশ, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও জিঙ্ক। খেজুর একজন সুস্থ মানুষের শরীরে আয়রনের চাহিদার প্রায় ১১ ভাগই পূরণ করে। খেজুরে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ায়।

عَنْ عَائِشَةَ رضي الله عنها قَالَتْ قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم بَيْتٌ لاَ تَمْرَ فِيهِ جِيَاعٌ أَهْلُهُ.

আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে বাড়িতে খেজুর নেই, সে বাড়ির অধিবাসীরা অভুক্ত’।[1] রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সন্তান প্রসবের পর প্রসূতি মাকেও খেজুর খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

এছাড়াও আজওয়া খেজুরের বিশেষত্ব বর্ণনা করে হাদীছে এসেছে, সা‘দ তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করে বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَنْ تَصَبَّحَ كُلَّ يَوْمٍ سَبْعَ تَمَرَاتٍ عَجْوَةً لَمْ يَضُرُّهُ فِى ذَلِكَ الْيَوْمِ سُمٌّ وَلاَ سِحْرٌ ‘যে ব্যক্তি প্রত্যেকদিন সকালবেলায় সাতটি আজওয়া খেজুর খাবে, সেদিন কোনো বিষ ও যাদু তার ক্ষতি করবে না’।[2]

কিশমিশ : রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিশমিশ খেতে ভালোবাসতেন। তিনি কিশমিশ ভেজানো পানি পান করতেন। কিশমিশের উপকারের কথা এক কথায় বলে শেষ করা যাবে না। কিশমিশে ভিটামিন, খনিজ, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস, পলিফেনলস এবং অন্যান্য বেশ কয়েকটি ফাইবার রয়েছে। কিশমিশ শরীরে যেমন শক্তি যোগায়, তেমনি রক্ত উৎপাদানেও সহায়তা করে।

ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য কিশমিশ ভিজিয়ে রাখা হতো এবং তিনি সেগুলো পান করতেন।[3]

ছারীদ : রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছারীদ নামক এক ধরনের ঐতিহ্যবাহী আরব্য খাবার ভালোবাসতেন। ছারীদ হলো গোশতের ঝোলে ভেজানো টুকরো টুকরো রুটি দিয়ে তৈরি বিশেষ এক খাদ্য আর হায়স হলো মাখন, ঘি ও খেজুর দিয়ে যৌথভাবে বানানো খাবার।

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رضي الله عنها عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم أَنَّهُ أُتِيَ بِقَصْعَةٍ مِنْ ثَرِيدٍ. فَقَالَ كُلُوا مِنْ جَوَانِبِهَا وَلَا تَأْكُلُوا مِنْ وَسَطِهَا فَإِنَّ الْبَرَكَةَ تَنْزِلُ فِي وَسَطِهَا.

ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে একটি পেয়ালায় করে ছারীদ বা ঝোলে ভিজানো রুটি আনা হলে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তোমরা চতুর্দিক থেকে খাও, মধ্য থেকে খেয়ো না। কেননা মধ্যেই বরকত বর্ষিত হয়’।[4]

মিষ্টান্ন ও মধু : রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিষ্টান্ন ও মধু পছন্দ করতেন। মিষ্টান্ন শরীরের ভিতর অ্যাসিড ক্ষরণের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। ফলে হজম ভালো হয়। মিষ্টি খাবার খেলে শরীরে সেরিটোনিন নামের হরমোন ক্ষরিত হয়। এই হরমোন নিউরোট্রান্সমিটার হিসেবে কাজ করে। ফলে মিষ্টি খাবার খেলে আমাদের মধ্যে সুখ ও আনন্দের অনুভূতি তৈরি হয়। এই অনুভূতি শরীরের সামগ্রিক সুস্থতার জন্য অত্যন্ত জরুরী। আর মধু মানুষের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত এক অপূর্ব নেয়ামত। মধুতে প্রায় ৪৫টি খাদ্য উপাদান থাকে। মধুতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, মিনারেল ও এনজাইম থাকে, যা শরীরকে বিভিন্ন রোগ-বালাই থেকে রক্ষা করে।

عَنْ عَائِشَةَ رضي الله عنها قَالَتْ كَانَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم يُعْجِبُهُ الْحَلْوَاءُ وَالْعَسَلُ.

আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট সর্বাধিক পছন্দনীয় দ্রব্য ছিল মিষ্টান্ন ও মধু।[5]

দুধ : রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুধ পছন্দ করতেন। দুধ একটি উপাদেয় খাবার। দুধকে বলা হয় সুপার ফুড। পৃথিবীর সব খাদ্যের সেরা খাদ্য দুধ। সর্বোচ্চ পুষ্টিমানের জন্যই দুধের শ্রেষ্ঠত্ব। মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষার মূল উপাদান দুধ। এতে আছে আমিষ, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস, ভিটামিন এ, ভিটামিন ডি, ভিটামিন বি-১২, নিয়ামিন, রিবোফ্লাভিন, অ্যামাইনো এসিড ইত্যাদি। দুধের অপরিহার্য উপাদান ল্যাকটোজ যা দৈহিক গঠন, বিকাশ ও মেধা বৃদ্ধিতে সহায়ক।

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أُتِيتُ بِثَلاَثَةِ أَقْدَاحٍ قَدَحٌ فِيهِ لَبَنٌ وَقَدَحٌ فِيهِ عَسَلٌ وَقَدَحٌ فِيهِ خَمْرٌ فَأَخَذْتُ الَّذِى فِيهِ اللَّبَنُ فَشَرِبْتُ فَقِيلَ لِى أَصَبْتَ الْفِطْرَةَ أَنْتَ وَأُمَّتُكَ.

আনাস ইবনু মালেক রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমার সম্মুখে তিনটি পেয়ালা তুলে ধরা হলো, একটি পেয়ালায় আছে দুধ, একটি পেয়ালায় আছে মধু আর একটিতে শারাব। আমি দুধের পেয়ালাটি গ্রহণ করলাম এবং পান করলাম। তখন আমাকে বলা হলো, আপনি এবং আপনার উম্মত স্বভাবজাত বস্তু গ্রহণ করেছেন’।[6]

মাখন : রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাখন খেতে ভালোবাসতেন। মাখন হলো একটি দুগ্ধজাত পণ্য। মূলত দুধ থেকে তার ঘন অংশটাকে আলাদা করে মাখন তৈরি করা হয়। মাখনের মধ্যে থাকে ভিটামিন এ, ডি, ই, কে এবং উৎকৃষ্ট মানের ম্যাঙ্গানিজ, জিঙ্ক, সেলেনিয়াম ও আয়োডিন। ভিটামিন ও খনিজের জন্যই এর পুষ্টিগুণ বাড়ে। দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে, হাড় সুগঠিত করতে, ত্বক ও চুলের পুষ্টিতে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে এবং রক্তসঞ্চালন বৃদ্ধিতে মাখন অত্যন্ত সহায়ক।

عَنِ ابْنَىْ بُسْرٍ السُّلَمِيَّيْنِ قَالاَ دَخَلَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَوَضَعْنَا تَحْتَهُ قَطِيفَةً لَنَا صَبَبْنَاهَا لَهُ صَبًّا فَجَلَسَ عَلَيْهَا فَأَنْزَلَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ عَلَيْهِ الْوَحْىَ فِى بَيْتِنَا وَقَدَّمْنَا لَهُ زُبْدًا وَتَمْرًا وَكَانَ يُحِبُّ الزُّبْدَ وَالتَّمْرَ.

সুলাইম গোত্রের বুসর-এর দুই পুত্রের সূত্রে বর্ণিত, তারা উভয়ে বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের এখানে এলেন। আমরা তার বসার জন্য আমাদের একটি চাদর পেতে দিলাম। পানি ছিটিয়ে আমরা তা তার জন্য নরম করে দিলাম। তিনি তার ওপর বসলেন। তখন আমাদের ঘরে মহান আল্লাহ তার ওপর অহী নাযিল করলেন। আমরা তার সামনে মাখন ও খেজুর পেশ করলাম। তিনি মাখন ও খেজুর পছন্দ করলেন।[7]

লাউ : সবজি জাতীয় তরকারির মধ্যে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লাউ খেতে পছন্দ করতেন। সকল অঞ্চলেই লাউ একটি জনপ্রিয় সবজি। লাউ ওযন কমাতে, হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে, হজমশক্তি বৃদ্ধিতে, ক্ষুধামন্দা দূর করতে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে খুব ভালো কাজ করে। আবার ত্বকের যত্নেও লাউ সমান উপকারী।

عَنْ أَنَسٍ قَالَ كَانَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم يُحِبُّ الْقَرْعَ.

আনাস রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লাউয়ের তরকারী পছন্দ করতেন।[8]

عَنْ مَالِكٍ عَنْ إِسْحَاقَ بْنِ أَبِى طَلْحَةَ أَنَّهُ سَمِعَ أَنَسَ بْنَ مَالِكٍ يَقُولُ إِنَّ خَيَّاطًا دَعَا رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لِطَعَامٍ صَنَعَهُ قَالَ أَنَسٌ فَذَهَبْتُ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَرَأَيْتُهُ يَتَتَبَّعُ الدُّبَّاءَ مِنْ حَوَالَىِ الْقَصْعَةِ قَالَ فَلَمْ أَزَلْ أُحِبُّ الدُّبَّاءَ مِنْ يَوْمِئِذٍ .

আনাস রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, একবার একজন দর্জি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে খাবারের দাওয়াত করেন। আমিও নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে সেই খাবারে অংশগ্রহণ করি। আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তরকারির বাটির বিভিন্ন দিক থেকে লাউয়ের টুকরো বেছে বেছে খেতে দেখেছি। আর সে দিন হতে আমি লাউ খুব পছন্দ করি।[9]

যয়তুন : রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যয়তুন ও যয়তুনের তেল (Olive) খেতেন এবং ব্যবহার করতেন। যয়তুন এক ধরনের ফল। যার বৈজ্ঞানিক নাম Olea Europaea। এটি পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের উপকূলীয় এলাকা বিশেষ করে লেবানন, সিরিয়া, তুরস্কের সামুদ্রিক অঞ্চল, ইরানের উত্তরাঞ্চল তথা কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণে ভালো জন্মে। যয়তুনকে অনেকেই জলপাই (Ceylon Olive) এর সাথে এক করে ফেলে, যদিও এ দুটি সম্পূর্ণ আলাদা ফল। পরিবেশগত কারণে আমাদের দেশে যে জলপাই হয়, সেগুলোর সাথে যয়তুন ফলের কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। যয়তুন ফল আকারে কিছুটা ছোট হয়। তবে গবেষকরা যয়তুন ফল ও জলপাই এর মধ্যে অনেক গুণগত মিল খুঁজে পেয়েছেন। সহজ কথায়, যয়তুন ও জলপাই এক নয়। তবে এদের গুণগত বৈশিষ্ট্যে অনেক মিল রয়েছে। এতে আছে প্রচুর পুষ্টিকর ও খনিজ উপাদান। যেমন সোডিয়াম, পটাসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, আয়োডিন, ভিটামিন, অ্যামাইনো এসিড, অলেইক এসিড ইত্যাদি। জলপাই রক্তের অতিরিক্ত কোলেস্টেরল দূর করে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে ও হার্টের সুরক্ষায় কাজ করে।

عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم كُلُوا الزَّيْتَ وَادَّهِنُوا بِهِ فَإِنَّهُ مِنْ شَجَرَةٍ مُبَارَكَةٍ.

উমার ইবনুল খাত্ত্বাব রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা যয়তুন খাও এবং যয়তুনের তেল গায়ে মাখো। কারণ তা বরকতপূর্ণ গাছ থেকে নির্গত হয়’।[10]

তরমুজ : রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফলের মধ্যে তরমুজ খেতে পছন্দ করতেন। তরমুজে শতকরা প্রায় ৯২ ভাগ পানি রয়েছে। যা আমাদের দেহের পানির চাহিদা মিটিয়ে শরীরকে সুস্থ ও সবল রাখে। তরমুজে রয়েছে ভিটামিন সি ও ভিটামিন এ। এছাড়াও রয়েছে সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, মিনারেল, অ্যামাইনো অ্যাসিড, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। তরমুজ কিডনি ও লিভার সুস্থ রাখতে কার্যকরী। এছাড়াও তরমুজ মনকে শান্ত রাখে, প্রবল গরমে দেয় ঠাণ্ডার প্রভাব।

عَنْ عَائِشَةَ رضي الله عنها قَالَتْ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَأْكُلُ الْبِطِّيخَ بِالرُّطَبِ فَيَقُولُ نَكْسِرُ حَرَّ هَذَا بِبَرْدِ هَذَا وَبَرْدَ هَذَا بِحَرِّ هَذَا.

আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাজা খেজুর দিয়ে তরমুজ খেতেন। তিনি বলতেন, ‘এর ঠাণ্ডা ওটার গরম কমাবে এবং এর গরম ওটার ঠাণ্ডা কমিয়ে দেবে’।[11]

শসা : রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবজির মধ্যে শসা পছন্দ করতেন। শসা একটি উপকারি খাবার। শসাতে ক্যালরি খুবই কম পরিমাণে থাকে। এতে পানির পরিমাণ বেশি থাকে। শসায় আছে খাদ্য আঁশ, ভিটামিন সি, পটাসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, মিনারেলস ও ফাইবার। শশার রয়েছে নানা ভেষজ গুণ। ত্বকের যত্নে, পরিপাকতন্ত্র সুস্থ রাখতে, অতিরিক্ত মেদ কমাতে শশার বিকল্প নেই।

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ جَعْفَرِ بْنِ أَبِى طَالِبٍ k قَالَ رَأَيْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم يَأْكُلُ الرُّطَبَ بِالْقِثَّاءِ.

আব্দুল্লাহ ইবনু জা‘ফর রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে শসার সাথে তাজা খেজুর খেতে দেখেছি।[12]

অন্য একটি হাদীছে আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার মায়ের ইচ্ছা ছিল আমাকে স্বাস্থ্যবতী বানিয়ে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে পাঠাবেন। এজন্য তিনি অনেক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন কিন্তু কোনো ফল হয়নি। শেষে তিনি আমাকে পাকা খেজুরের সঙ্গে শসা বা খিরা খাওয়াতে থাকলে আমি তাতে উত্তমরূপে স্বাস্থ্যের অধিকারী হই।[13]

সিরকা বা ভিনেগার : রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পানীয়ের মধ্যে সিরকা (আলাইহিমুস সালামiরযিয়াল্লাহু আনহুমআলাইহিস সালামরযিয়াল্লাহু আনহাছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামr) ভালোবাসতেন। ভিনেগার হলো অ্যাসিটিক অ্যাসিড ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ইথানলের গাঁজন প্রক্রিয়ায় উত্পাদিত একটি অ্যাসিডিক তরল। ওযন কমাতে, ক্লান্তি দূর করতে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে, হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে, হাইপার টেনশন নিয়ন্ত্রণে, অনিদ্রা দূর করতে ও হজম প্রক্রিয়া সচল করতে ভিনেগার ভালো কাজ করে।

عَنْ جَابِرٍ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ نِعْمَ الإِدَامُ الْخَلُّ.

জাবের রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘সিরকা কতই না উত্তম তরকারি’।[14]

عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم سَأَلَ أَهْلَهُ الأُدُمَ فَقَالُوا مَا عِنْدَنَا إِلاَّ خَلٌّ فَدَعَا بِهِ فَجَعَلَ يَأْكُلُ بِهِ وَيَقُولُ نِعْمَ الأُدُمُ الْخَلُّ نِعْمَ الأُدُمُ الْخَلُّ.

জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পরিবারের লোকদের কাছে সালুন (তরকারি) চাইলে তারা বললেন, সিরকা ছাড়া আমাদের কাছে অন্য কিছু নেই। তখন তিনি তাই আনতে বললেন এবং খেতে খেতে বললেন, ‘সিরকা কতই ভালো তরকারি, সিরকা কতই উত্তম তরকারি’।[15]

ছাগলের উরুর গোশত : গোশত জাতীয় খাদ্যের মধ্যে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাগলের উরু ও পাঁজরের গোশত খেতে পছন্দ করতেন।

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ أُتِىَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم بِلَحْمٍ فَرُفِعَ إِلَيْهِ الذِّرَاعُ وَكَانَتْ تُعْجِبُهُ فَنَهَسَ مِنْهَا.

আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে বকরীর সামনের উরু পরিবেশন করা হলো। তিনি তা খুবই পছন্দ করতেন। অতঃপর তিনি তা থেকে দাঁত দিয়ে কেটে খেলেন।[16]

মোরগের গোশত : গোশত জাতীয় খাদ্যের মধ্যে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মোরগের গোশত খেতেও ভালোবাসতেন। মোরগের গোশত খুবই সুস্বাদু একটি খাবার। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, শক্তি, শর্করা, আয়রন, সোডিয়াম ইত্যাদি।

عَنْ زَهْدَمٍ الْجَرْمِيِّ قَالَ دَخَلْتُ عَلَى أَبِي مُوسَى وَهُوَ يَأْكُلُ دَجَاجَةً فَقَالَ ادْنُ فَكُلْ فَإِنِّي رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَأْكُلُهُ.

যাহদাম আল-জারমী রহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবূ মূসা রযিয়াল্লাহু আনহু-এর সামনে গেলাম। তিনি তখন মুরগির গোশত খাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, আমার সামনে এগিয়ে এসো এবং খাবারে অংশগ্রহণ করো। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আমি মুরগির গোশত খেতে দেখেছি।[17] আবূ মূসা রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আমি মোরগের গোশত ভক্ষণ করতে দেখেছি।[18]

এ ছাড়া বিভিন্ন হাদীছ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মরুভূমিতে পাওয়া যায় এমন এক ধরনের পাখির গোশত, মাশরুম, বার্লি, গাজর, ডুমুর, ডালিম, সামুদ্রিক মাছ ইত্যাদি পছন্দ করতেন।

রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে পরিমিত আহার করার নির্দেশনা দিয়েছেন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মেরুদণ্ড সোজা রাখে এমন কয়েক গ্রাস খাবারই আদম সন্তানের জন্য যথেষ্ট, তার চেয়ে বেশি চাইলে পেটের এক-তৃতীয়াংশ খাদ্যের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানীয়ের জন্য এবং এক-তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য খালি রাখবে’।[19] নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় আসার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর পরিবারের লোকেরা এক নাগাড়ে তিন রাত গমের রুটি পেট পুরে খাননি।[20] তারপরও বিভিন্ন সময় হাদিয়াস্বরূপ, দাওয়াতে এবং আল্লাহ তাআলা তাকে যা খাওয়াতেন তার প্রতিটি খাবারই ছিল খুব পরিমিত, উপাদেয়, সুষম এবং পুষ্টিগুণে ভরপুর। তাঁর খাদ্যাভ্যাস থেকে আমাদের জন্য অনেক কিছু শেখার রয়েছে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সকল খাবার সুন্নাতী তরীক্বায় এবং খাবারের প্রতিটি দানা হালাল উৎস থেকে গ্রহণ করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

আব্দুল্লাহ আল-আমিন

 শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।


[1]. আবূ দাঊদ, হা/৩৮৩১, হাদীছ ছহীহ।

[2]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৪৪৫।

[3]. ছহীহ মুসলিম, হা/২০০৪।

[4]. মিশকাত, হা/৪২১১, হাদীছ ছহীহ।

[5]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৬১৪।

[6]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৬১০

[7]. আবূ দাঊদ, হা/৩৮৩৭, হাদীছ ছহীহ।

[8]. ইবনু মাজাহ, হা/৩৩০২, হাদীছ ছহীহ।

[9]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৩৭৯।

[10]. তিরমিযী, হা/১৮৫১, হাদীছ ছহীহ।

[11]. আবূ দাঊদ, হা/৩৮৩৬, হাসান।

[12]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৪৪০।

[13]. আবূ দাঊদ, হা/৩৯০৩, হাদীছ ছহীহ।

[14]. তিরমিযী, হা/১৮৩৯, হাদীছ ছহীহ।

[15]. ছহীহ মুসলিম, হা/২০৫২।

[16]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৩৪০; তিরমিযী, হা/১৮৩৭।

[17]. তিরমিযী, হা/১৮২৬, হাদীছ ছহীহ।

[18]. তিরমিযী, হা/১৮২৭, হাদীছ ছহীহ।

[19]. তিরমিযী, হা/২৩৮০।

[20]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৪১৬।

Magazine