(জুলাই’২১ সংখ্যায় প্রকাশিতের পর)
হে মানবজাতি! মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের ভয়াবহতাকে ভয় করো। নাস্তিক্যবাদ, অত্যাচার, অবিচার নির্যাতন বর্জনa কর। হঠাৎ কিয়ামতের আগমন ঘটলে, তা থেকে পলায়নও তোমার পক্ষে সম্ভব হবে না।*জাহান্নামের ভয়াবহতাকে তোমার স্মৃতিপটে স্থান দাও। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,إِنَّ غِلَظَ جِلْدِ الْكَافِرِ اثْنَانِ وَأَرْبَعُونَ ذِرَاعًا وَإِنَّ ضِرْسَهُ مِثْلُ أُحُدٍ وَإِنَّ مَجْلِسَهُ مِنْ جَهَنَّمَ كَمَا بَيْنَ مَكَّةَ وَالْمَدِينَةِ ‘জাহান্নামে কাফেরের গায়ের চামড়া পুরুত্ব হবে ৪২ গজ, তার মাড়ির দাঁত হবে উহুদ পাহাড়ের সমান বড় এবং মক্কা-মদীনার দূরত্বের সমান বিস্তৃত হবে তার বসার জায়গা (নিতম্বদেশ)’।[1]
হে মানবজাতি! অন্যায় কাজ ত্যাগ করে আমলে ছালেহ সম্পাদনে ব্রতী হও। কেননা, সৎকর্ম ছাড়া পরকালে তোমাকে কেউই মুক্তি দিতে পারবে না। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,يَا مَعْشَرَ قُرَيْشٍ أَوْ كَلِمَةً نَحْوَهَا اشْتَرُوا أَنْفُسَكُمْ لاَ أُغْنِى عَنْكُمْ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا يَا بَنِى عَبْدِ مَنَافٍ لاَ أُغْنِى عَنْكُمْ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا يَا عَبَّاسُ بْنَ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ لاَ أُغْنِى عَنْكَ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا وَيَا صَفِيَّةُ عَمَّةَ رَسُولِ اللَّهِ لاَ أُغْنِى عَنْكِ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا وَيَا فَاطِمَةُ بِنْتَ مُحَمَّدٍ سَلِينِى مَا شِئْتِ مِنْ مَالِى لاَ أُغْنِى عَنْكِ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا ‘হে কুরাইশ সম্প্রদায়! তোমরা নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হও। আল্লাহর দরবারে আমি তোমাদের জন্য কোনো উপকারে আসব না। হে আব্বাস ইবনু আব্দিল মুত্তালিব! আমি আল্লাহর নিকট তোমার কোনো উপকার করতে পারব না। হে আল্লাহর রাসূলের ফুফী ছাফিয়্যা! আমি আল্লাহর নিকট তোমার কোনো উপকার করতে পারব না। হে মুহাম্মাদ এর কন্যা ফাতেমা! আমার সম্পদ থেকে যা খুশি চাও, আমি আল্লাহর দরবারে তোমার কোনো উপকারে আসব না’।[2]
আল্লাহর আযাব থেকে কেউ কাউকে রক্ষা করতে পারবে না। তাই হে মানবজাতি! নিজেকে, নিজের পরিবারকে পরকালীন জীবনের কঠিন শাস্তি থেকে রক্ষা করতে আমলে ছালেহ করো। নাস্তিক্যবাদ, যুলম ও অন্যায় কর্ম পরিত্যাগ করো। মৃত্যু এবং পরকালের ভয়াবহ পরিণামকে স্মরণ করো। আপন কল্যাণে আত্মনিয়োগ করো। সূরা আন-নাবার প্রথম অংশে এ শিক্ষার কথাই বলা হয়েছে। পরকাল ও তাওহীদে বিশ্বাস করে একমাত্র আল্লাহর জন্য ইবাদত করো। কেননা পরকালের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা মুমিন-মুসলিমের একমাত্র দায়িত্ব।
২.মহানআল্লাহযমীনকেবিছানাস্বরূপবানিয়েছেন : মানুষের আরামে-আয়েশ, আনন্দময় গমনাগমন ও জীবিকা উপার্জনের জন্য মহান আল্লাহ যমীনকে বিছানাস্বরূপ করেছেন। তারা যেন আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে পারে। নিজেকে পরকালের শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারে। পারে কুফরী থেকে বাঁচাতে। মহান আল্লাহ বলেন,﴿أَلَمْ نَجْعَلِ الْأَرْضَ مِهَادًا - وَالْجِبَالَ أَوْتَادًا﴾ ‘আমি কি করিনি পৃথিবীকে বিছানা এবং পর্বতমালাকে পেরেক?’ (আন-নাবা, ৭৮/৬-৭)। দুনিয়ার সবকিছু মানবতার কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ - الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ فِرَاشًا وَالسَّمَاءَ بِنَاءً وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجَ بِهِ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًا لَكُمْ فَلَا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَنْدَادًا وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ
‘হে মানবমণ্ডলী! তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ইবাদত করো, যিনি তোমাদের ও তোমাদের পূর্ববর্তীদিগকে সৃষ্টি করেছেন। তাতে আশা করা যায়, তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পারবে। যিনি তোমাদের জন্যে যমীনকে শয্যা ও আকাশকে ছাদস্বরূপ করেছেন, আর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন। অতঃপর তা দ্বারা তোমাদের জীবিকাস্বরূপ ফল-ফসল উৎপাদন করেছেন। অতএব, তোমরা জেনেশুনে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না’ (আল-বাক্বারা, ২/২১-২২)।
হে বস্তুবাদী, হে নাস্তিক্যবাদী, হে যালিম! যারা অন্যায়-অপকর্ম করে যাচ্ছ, ইসলাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ, অতিশীঘ্রই ইসলামের ছায়াতলে প্রবেশ করো। নতুবা পরকালের শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। আল্লাহর দেওয়া নিয়ামত ভক্ষণ করছ, অথচ তাঁর শুকরিয়া আদায় করছ না। তোমার চোখের কথা চিন্তা করো, যার চোখ নেই তাকে দেখে। তোমার হাতের কথা চিন্তা করো, যার হাত নেই তাকে দেখে। তোমার পায়ের কথা চিন্তা করো, যার পা নেই তাকে দেখে। তোমার গাড়ি-বাড়ির কথা চিন্তা করো, তোমার পাশেই রাস্তায় পড়ে থাকা সেই অভুক্ত গরীব মানুষটি দেখো, যে দিনের পর দিন অনাহারে দিনাতিপাত করছে এবং এক মুষ্টি ভাতের জন্য কাতরাচ্ছে। অথচ তুমি তিন বেলা ভালো ভালো খাচ্ছ। এত কিছু পাওয়ার পরও কি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবে না। ধিক! তোমার জন্য।
হে যুবসমাজ! তোমার সময় এমনিতেই হেলায় কাটিয়ে দিয়ো না; আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে কাটাও। সূরা আন-নাবা এবং বাক্বারার আয়াতদ্বয় আমাদেরকে শিক্ষা দেয় যে, আমাদের পালনকর্তা, সৃষ্টিকর্তা, রিযিক্বদাতা, জীবনদাতা কল্যাণ-অকল্যাণ সবকিছুর মালিক একমাত্র আল্লাহ তাআলা। বিধায়, আমাদের সকল ইবাদত-বন্দেগী একমাত্র সত্য মা‘বূদের জন্য হতে হবে। অন্য কাউকেও এর সাথে অংশীদার করা যাবে না। তাঁকে ডাকতে হবে তাঁর গুণবাচক নামে। যদি তা না করতে পারি, তাহলে আল্লাহর যমীনে আমাদের থাকার কোনো অধিকার নেই। কারণ আমাদের বেঁচে থাকার জন্য মহান আল্লাহ আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন, তা দ্বারা ফল-ফসল উৎপন্ন করেন। আমাদের কল্যাণের জন্য, আমাদের খাবারের জন্য, কতই না পশু-পাখি আর জীবজন্তু সৃষ্টি করেছেন। ধরা যাক, গাভি— আমরা গাভির দুধ পান করি, আবার মজা করে তার গোশত খাই। আমাদের তিনি এই পশু-পাখি দান করেছেন, যাতে খাবার পর তাঁর শুকরিয়া আদায় করি, ইবাদত করতে পারি ও ভালোভাবে জীবন ধারণ করতে পারি। স্মরণ করুন মহান আল্লাহর কথা, ‘তিনি চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছেন। এতে তোমাদের জন্য শীত বস্ত্রের উপকরণ রয়েছে আর রয়েছে বহু উপকারিতা এবং এর কিছু সংখ্যককে তোমরা আহারে পরিণত করে থাকো। বিকেলে যখন তোমরা এদের চারণভূমি হতে নিয়ে আস এবং সকালে যখন এদের চারণভূমিতে নিয়ে যাও, তখন তোমরা এদের সৌন্দর্য উপভোগ করো। এরা তোমাদের বোঝা এমন শহর পর্যন্ত বহন করে নিয়ে যায়, যেখানে তোমরা প্রাণান্তকর পরিশ্রম ব্যতীত পৌঁছতে পারতে না। নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক অত্যন্ত দয়াদ্র, পরম দয়ালু। তোমাদের আরোহণ এবং শোভার জন্য তিনি ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা সৃষ্টি করেছেন এবং সৃষ্টি করবেন এমন অনেক কিছু যা তোমরা অবগত নও। সরল পথ আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছে, কিন্তু পথগুলোর মধ্যে কিছু বক্র পথও আছে। তিনি ইচ্ছা করলে তোমাদের সবাইকে সৎপথে পরিচালিত করতে পারতেন। তিনি তোমাদের জন্য আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন। এই পানি থেকে তোমরা পান করো এবং এ থেকেই উদ্ভিদ জন্মায়, যাতে তোমরা পশু চারণ করো। এ পানি দ্বারা তিনি তোমাদের জন্য উৎপাদন করেন ফসল, যায়তুন, খেজুর বৃক্ষ, আঙ্গুর ও সর্বপ্রকার ফল। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীলদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। তিনিই আমাদের কাজে নিয়োজিত করেছেন রাত্রি, দিন, সূর্য এবং চন্দ্রকে। নক্ষত্ররাজিও তাঁরই নির্দেশে কর্মে নিয়োজিত রয়েছে। নিশ্চয় এতে বোধশক্তিসম্পন্নদের জন্যে নিদর্শনাবলি রয়েছে। তোমাদের জন্যে পৃথিবীতে রং-বেরঙের যা কিছু সৃষ্টি করা হয়েছে, সেগুলোতে নিদর্শন রয়েছে তাদের জন্যে, যারা চিন্তা-ভাবনা করে। তিনিই কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন সমুদ্রকে, যাতে তা থেকে তোমরা তাজা মাংস আহার করতে পারো এবং তা থেকে আহরণ করতে পরিধেয় অলংকার। তুমি তাতে জলযানসমূহকে পানি চিরে চলতে দেখবে। যাতে তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ অন্বেষণ করো এবং যাতে অনুগ্রহ স্বীকার করো। তিনি পৃথিবীতে সুদৃঢ় পর্বত স্থাপন করেছেন, যাতে তা তোমাদেরকে নিয়ে হেলে-দুলে না পড়ে এবং নদী ও পথ তৈরি করেছেন, যাতে তোমরা পথ প্রদর্শিত হও। আর পথ নির্ণয়ক বহু চিহ্ন সৃষ্টি করেছেন, এবং নক্ষত্রের সাহায্যেও মানুষ পথ নির্দেশনা পায়। সুতরাং যিনি সৃষ্টি করে, তিনি কি সে লোকের সমতুল্য, যে সৃষ্টি করতে পারে না? তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? যদি তোমরা আল্লাহর নিয়ামতকে গণনা করো, শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয় আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (আন-নাহল,১৬/৫-১৮)।
হে মানবজাতি! উল্লিখিত আয়াতগুলোতে আল্লাহর নিদর্শন ও অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা মানুষের জন্যই এসব কিছু সৃষ্টি করেছেন, যাতে মানুষ কৃতজ্ঞ হয়। তার ইবাদত, চাওয়া-পাওয়া, ভয়-ভীতি, আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন-কল্পনা সবই যেন আল্লাহর উদ্দেশ্যে হয়। (চলবে)
হাফেয আব্দুল মতীন মাদানী
* এম. এ, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব; শিক্ষক,
আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, বীরহাটাব-হাটাব, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।
[1]. সুনানে তিরমিযী, হা/২৫৭৭, ছহীহ।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/২৭৫৩।