কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

হক্বের মানদণ্ড (পর্ব-৪)

তাদের দাবি অনুযায়ী ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ আব্দুল্লাহ ইবনু উনাইস রযিয়াল্লাহু আনহু–এর সাক্ষাৎ লাভ করেছেন।

তাহক্বীক্ব : তাদের এই মিথ্যা দাবির তাহক্বীক্বে আব্দুল্লাহ ইবনু উনাইস রযিয়াল্লাহু আনহু ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ-এর জন্মের ২৬ বছর পূর্বে ৫৪ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। অর্থাৎ তাঁর মৃত্যুর ২৬ বছর পর ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন। তবে কারো মতে, আব্দুল্লাহ ইবনু উনাইস রযিয়াল্লাহু আনহু ৭৪ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। এই বর্ণনা মতে ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ-এর ৬ বছর পূর্বে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এই মর্মে আসক্বালানী রহিমাহুল্লাহ তাঁর কিতাব ‘তাক্বরীবুত তাহযীব’–এ বলেছেন, عبد الله بن أنيس الجهني أبو يحيى المدني حليف الأنصار صحابي شهد العقبة واحدا ومات بالشام في خلافة معاوية سنة أربع وخمسين ووهم من قال سنة ثمانين ‘আনছারদের মিত্র আব্দুল্লাহ ইবনু উনাইস আল-জুহানী আবূ ইয়াহইয়া আল-মাদানী একজন ছাহাবী। যিনি একবার ‘আক্বাবা’-তে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি মুআবিয়া রযিয়াল্লাহু আনহু–এর খেলাফতের সময়ে ৫৪ হিজরীতে সিরিয়াতে মৃত্যুবরণ করেন। আর যারা বলেছেন, ৮০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের কথায় সংশয় রয়েছে।[1]

ইমাম নববী রহিমাহুল্লাহ বলেন, ইবনু আব্দুল বার রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, তিনি ৭৪ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। কেউ কেউ বলেছেন, ৫৪ হিজরীতে।[2] আব্দুল্লাহ ইবনু উনাইস রযিয়াল্লাহু আনহু–এর মৃত্যু মর্মে যে বর্ণনাই গ্রহণ করা হোক না কেন তার মৃত্যু ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ–এর জন্মের পূর্বে হয়েছে এ কথাই প্রমাণিত। সুতরাং কীভাবে বলা যায় যে, ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ আব্দুল্লাহ ইবনু উনাইস আল-জুহানী রযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে সাক্ষাৎ করেছেন এবং তার থেকে একটি হাদীছ শুনেছেন? (অর্থাৎ সরাসরি মিথ্যা দাবি মাত্র)। যদি কেউ প্রশ্ন উত্থাপন করে যে, ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ–এর জন্মের পূর্বে যে আব্দুল্লাহ ইবনু উনাইস মৃত্যুবরণ করেছেন তিনি হলেন আব্দুল্লাহ আল-জুহানী। আর ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ যে আব্দুল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করেছেন তিনি ভিন্ন আব্দুল্লাহ।

জবাব : যারা ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ-এর সাথে আব্দুল্লাহ ইবনু উনাইস রযিয়াল্লাহু আনহু–এর সাক্ষাতের দাবি করেছেন তারা এই আব্দুল্লাহকেই উদ্দেশ্য নিয়েছেন অন্য কেউ নয়। কেননা কেবল তিনিই কূফা নগরীতে গিয়েছিলেন। কেননা লেখক পূর্বে উল্লেখ করেছেন যে, ত্বহত্ববীর মধ্যে উল্লেখ আছে ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ ১৪ বছর বয়সে ৯৪ হিজরীর পরে আব্দুল্লাহ ইবনু উনাইস রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে হাদীছ শুনেছেন…। রাদ্দুল মুহতার ও অন্যান্য গ্রন্থেও একই কথা বর্ণিত হয়েছে। আর এটাই বাস্তবতা যে, ঐ আব্দুল্লাহ কূফী নয়; বরং জুহানী। কেননা জুহানী ব্যতীত অন্য কোনো আব্দুল্লাহ ইবনু উনাইস কূফা নগরীতে গমন করেননি। মুহাক্বিক্ব ইবনুল আবেদীন আশ-শামী রাদ্দুল মুহতার গ্রন্থে বলেছেন,وأجيب بأن هذا الإسم لخمسة من الصحابة فلعل المراد غير الجهني و رد بأن غيره لم يدخل الكوفة ‘আব্দুল্লাহ নামে পাঁচ জন ছাহাবী রয়েছেন। সম্ভবত এখানে জুহানী ব্যতীত অন্য আব্দুল্লাহ উদ্দেশ্য।

জবাব : আব্দুল্লাহ ইবনু উনাইস আল-জুহানী ব্যতীত অন্য কোনো আব্দুল্লাহ নামের ছাহাবী কূফা নগরীতে প্রবেশ করেননি।[3] ‘তানভীরুল হক্ব’–এর লেখক শাহ পাক পাটনী এই হাদীছটি ত্বহত্ববী থেকে নকল করে বলেছেন, ৯৪ হিজরীতে ১৪ বছর বয়সে কূফা নগরীতে আব্দুল্লাহ থেকে উক্ত হাদীছটি শুনেছেন। এখন প্রশ্ন হলো– আব্দুল্লাহ তো ৫৪ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেছেন, তাহলে ৯৪ হিজরীতে ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ–এর সাথে তার সাক্ষাৎ (হাদীছ শ্রবণ করা) কী করে সম্ভব?! দ্বিতীয়ত, যে সনদে উক্ত হাদীছটি ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণনা করা হয়েছে সে সনদের মধ্যে দুই জন মাজহূল (অপরিচিত) বর্ণনাকারী রয়েছে। এ জন্য মুহাক্বিক্ব বিদ্বানগণ উক্ত বর্ণনাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ইবনুল আবেদীন আশ-শামী রহিমাহুল্লাহ রাদ্দুল মুখতার গ্রন্থে বলেছেন, অনেকে আব্দুল্লাহ আল-জুহানীর সূত্রে ইমাম আবূ হানীফা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, আমি ৮০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করি। আর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু উনাইস আল-জুহানী রযিয়াল্লাহু আনহু ৯৪ হিজরীতে কূফা নগরীতে আগমন করেন। আমি তাকে দেখেছি ও তার থেকে হাদীছ শুনেছি। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, حبك الشئ يعمي ويصم ‘কোনো কিছুর অতিমাত্রার ভালোবাসা মানুষকে অন্ধভক্ত ও বধির বানিয়ে দেয়’। আপত্তি হচ্ছে– ১. এই হাদীছের সনদে দুই জন মাজহূল (অপরিচিত) বর্ণনাকারী রয়েছে এবং ২. ইবনু উনাইস রযিয়াল্লাহু আনহু ৫৪ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেছেন।[4]

তাহলে বুঝা গেল, জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ এবং আব্দুল্লাহ ইবনু উনাইস রযিয়াল্লাহু আনহুমা ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ–এর জন্মের আগেই মৃত্যুবরণ করেছেন। সকল মুহাক্বিক্বের কথা বাদ দিলেও শুধু ইমাম নববী রহিমাহুল্লাহ–এর বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, উল্লেখিত দুই জন ছাহাবী ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ-এর জন্মের পূর্বে মৃত্যুবরণ করেছেন। ইনছাফের সাথে বলুন তো মৃত ছাহাবীর সাথে সাক্ষাতের দাবি করা বিবেক ও দলীলের বিপরীত নয় কি?! আবার ইমাম নববীর বক্তব্যকে সাক্ষাৎ প্রমাণে দলীল হিসাবে পেশ করা কত বড় মিথ্যা অপবাদ! আর লেখক শাহ পাটনী কতবড় সাহসী যে, নিজেই নিজের বিবেক ও দলীলের সাথে সংঘর্ষ করছে। আর অনুবাদকারী তার উপর নির্ভর করে ধোঁকা খেয়েছেন।

আয়েশা বিনতু আজরাদ (রহ.)–এর সাথে ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ–এর সাক্ষাৎ যদিও প্রমাণিত বলে মেনে নেওয়া হয়, তবুও তার সাথে সাক্ষাতের কারণে ইমাম আবূ হানীফা তাবেঈর স্বীকৃতি পাবে না। কেননা আয়েশা বিনতু আজরাদ ছাহাবী ছিলেন না। শায়খুল ইসলাম হাদীছ এবং আসমাউর রিজালের হাফেয মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ আবূ আব্দুল্লাহ আয-যাহাবী তুর্কিমানীর (যার মর্যাদা সম্পর্কে ছোট-বড় সকল আলেম অবগত) বক্তব্য সেটিই প্রমাণ করে। অনুরূপ শায়খুল ইসলাম হাফেযুল হাদীছ ইবনু হাজার আসক্বালানী রহিমাহুল্লাহ–এর বক্তব্য দ্বারাও প্রমাণিত। ইবনুল আবেদীন আশ-শামী রহিমাহুল্লাহ বলেন,بنت عجرد اسمها عائشة واعترض بأن حاصل كلام الذهبي وشيخ الإسلام ابن حجر العسقلاني أن هذه لا صحبة لها وأنها لا تكاد تعرف ‘বিনতু আজরাদ অর্থাৎ আজরাদের মেয়ে আয়েশার ব্যাপারে আপত্তি রয়েছে। ইমাম যাহাবী এবং শায়খুল ইসলাম ইবনু হাজার আসক্বালানী রহিমাহুল্লাহ-এর বক্তব্যের সারমর্ম হচ্ছে, সে তার সাহচর্য লাভ করেনি এবং চেনার প্রশ্নও আসে না’।[5] সুতরাং ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ আয়েশা বিনতু আজরাদ থেকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন এমন কথা অগ্রহণযোগ্য। শামী রহিমাহুল্লাহ বলেছেন,

بذالك رد ما روي عنها هذا الحديث الصحيح "أكثر جند الله في الأرض الجراد لا آكله ولا أحرمه.

এর দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয় যে, ‘ইমাম আবূ হানীফা আয়েশা থেকে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।[6] যুক্তির নিরীখে ও স্বাভাবিকভাবে ওয়াছেলা ইবনুল আসক্বা‘র সাথে ইমাম আবূ হানীফার সাক্ষাৎ অসম্ভব। নির্ভরযোগ্য কোনো ইমাম তার থেকে কোনো হাদীছ বর্ণনা না করাও প্রমাণ করে যে, ছাহাবীর সাথে ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ-এর সাক্ষাতের বিষয়টি প্রত্যাখ্যাত। স্বাভাবিকভাবে অসম্ভবের কারণ হলো— সর্ববম্মতিক্রমে ওয়াছেলা রযিয়াল্লাহু আনহু ৮৫ হিজরীতে সিরিয়ার দামেশক নগরীতে মৃত্যুবরণ করেন। ইমাম আবূ হানীফার বয়স তখন মাত্র পাঁচ বছর। আর ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ পাঁচ বছর বয়সে ওয়াছেলা রযিয়াল্লাহু আনহু–এর সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে দামেশক গিয়েছিলেন, তা প্রমাণিত নয়। যুক্তির দাবিতেও এটা অসম্ভব যে, তিনি পাঁচ বছর বয়সে এমন সফর করতে পারেন! ওয়াছেলা রযিয়াল্লাহু আনহু-এর মৃত্যু এবং মৃত্যুর স্থান সম্পর্কে ইবনু হাজার আসক্বালানী এবং ইমাম নববী রহিমাহুমাল্লাহ-এর নিম্নোক্ত বক্তব্যই স্পষ্ট প্রমাণ :

واثلة بن الأسقع ابن كعب الليثي صحابي مشور نزل الشام وعاش إلي سنة خمس وهو ابن ثمان و تسعين قال له أبو مسهر وقال سعيد بن خالد توفى سنة ثلث و ثمانين وهو ابن مائة وخمس سنين.

‘ওয়াছেলা ইবনুল আছক্বা‘ (ইবনু কা‘ব আল-লায়ছী) একজন প্রসিদ্ধ ছাহাবী ছিলেন। তিনি শাম দেশে আগমন করেছিলেন এবং তিনি সেখানে পাঁচ বছর অবস্থান করেন। তখন তার বয়স ৯৮ বছর। আবূ মুসহিরও এমনটি বলেছেন। আর সাঈদ ইবনু খালেদ বলেছেন, তিনি ৮৩ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেছেন। তখন তার বয়স ১০৫ বছর।[7]

ওয়াছেলা ইবনুল আসক্বা‘র মৃত্যু ও বয়স বিষয়ে বর্ণিত মতগুলোর মধ্য হতে আমরা ইমাম নববী ও হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী রহিমাহুমাল্লাহ-এর মতটি গ্রহণ করলাম। আর বাকি দুটি মতও আমাদের পক্ষে। বিশেষ করে সাঈদ ইবনু খালেদের মতটি বেশি গ্রহণযোগ্য। কেননা এই মতের ভিত্তিতে স্পষ্ট হয় যে, ওয়াছেলা ইবনুল আছক্বা‘ রযিয়াল্লাহু আনহু–এর মৃত্যুর সময় ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ–এর বয়স মাত্র তিন বছর ছিল।

লেখক শাহ পাক পাটনী এবং তার মতালম্বীদের দাবি অনুযায়ী আব্দুল্লাহ ইবনু জায’ রযিয়াল্লাহু আনহু–এর সাথে ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ ৯৬ হিজরীতে সাক্ষাৎ করেছেন যা বিবেক বহির্ভূত অসম্ভব বিষয়। কেননা আব্দুল্লাহ ইবনু জায’ ৮৬ হিজরীতে মিসরে মৃত্যুবরণ করেন। এই মর্মে ইবনু হাজার আসক্বালানী রহিমাহুল্লাহ বলেন, عبد الله بن الحارث بن جزء صحابي أبو حارث سكن مصر وهو آخر من مات بها من الصحابة سنة خمس أو ست أو سبع أو ثمان وثمانين والثاني أصح ‘আব্দুল্লাহ ইবনুল হারেছ ইবনু জায’ রযিয়াল্লাহু আনহু একজন ছাহাবী ছিলেন। তিনি মিসরে বসবাস করতেন এবং ৮৫, ৮৬, ৮৭ অথবা ৮৮ হিজরীতে মিসরে মারা যান। মিসরে ছাহাবীদের মধ্যে তিনি সর্বশেষ মৃত্যুবরণকারী ছাহাবী ছিলেন’।[8]

মুহাক্বিক্ব আল্লামা শামী এবং ইবনু তাহেরের বর্ণনানুযায়ী আব্দুল্লাহ রযিয়াল্লাহু আনহু–এর মৃত্যুও উক্ত হিজরীতে হয়েছিল। সামনে এই বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা আসবে। তাহলে প্রমাণিত হয় যে, ইবনু জায’-এর মৃত্যুর সময় ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ–এর বয়স ছিল ছয় বছর। সুতরাং কীভাবে বলা যায় যে, ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ ১৬ বছর বয়সে ৯৬ হিজরীতে আব্দুল্লাহ ইবনু জায’–এর সাথে সাক্ষাৎ করেছেন এবং তার থেকে দুইটি হাদীছ শুনেছেন?

এসব লেখকের গবেষণার ভুল, ইলমী ঘাটতি এবং নির্বুদ্ধিতার পরিচয় বহন করে। তাদের এসব দাবি যে মিথ্যা তা ইবনুল আবেদীন হানাফী রহিমাহুল্লাহ রাদ্দুল মুখতারে স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ ৯৬ হিজরীতে হজ্জ করেছেন। তখন মসজিদে হারামে আব্দুল্লাহ ইবনু জায’ রযিয়াল্লাহু আনহু-কে পাঠদান করতে দেখেন এবং তার থেকে দুইটি হাদীছ শুনেছেন— এসব বর্ণনাকে একদল প্রত্যাখ্যান করেছেন। কেননা এসব বর্ণনার সূত্রে বিভিন্ন রদবদল রয়েছে। আর একথা সর্বসম্মতিক্রমে মিথ্যা যে, ইবনু জায’ রযিয়াল্লাহু আনহু–এর সাথে ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ-এর সাক্ষাৎ হয়েছে। কেননা তখন ইমাম আবূ হানীফার বয়স ছয় বছর ছিল; আর আব্দুল্লাহ ইবনু জায’ কখনো কূফা নগরীতে গমন করেননি।[9]

সতর্কবাণী : এই কথা দাবি করা যে, জাবের রযিয়াল্লাহু আনহু–এর সাথে ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ-এর সাক্ষাৎ হয়েছে, যিনি তাঁর জন্মের এক অথবা দুই বছর পূর্বে মৃত্যুবরণ করেছেন। অনুরূপভাবে আব্দুল্লাহ ইবনু উনাইস রযিয়াল্লাহু আনহু–এর সাথে, যিনি ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ-এর ২৬ বছর পূর্বে মৃত্যুবরণ করেছেন। অনুরূপভাবে ৯৬ হিজরীতে ইবনু জায’ রযিয়াল্লাহু আনহু–এর সাথে, যিনি ৮৬ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। এসব কাণ্ডজ্ঞানহীনদের থেকে এমন কথার উদ্ভব নতুন নয়! কেননা যে বলতে পারে খাযির আলাইহিস সালাম ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ থেকে ৩০ বছর যাবৎ জ্ঞান অর্জন করেছেন। যার পাঁচ বছর ইমামের জীবদ্দশায় এবং ২৫ বছর মৃত্যুর পর কবরে। এরাও তো তাদেরই ভাই। সুতরাং এরা ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ-এর সাথে দুই-তিন জন ছাহাবীর সাক্ষাতের দাবি করা কোনো আশ্চর্যের বিষয় নয়। কেননা গোঁড়ামি ও কাণ্ডজ্ঞানহীনতার দিক থেকে তারা সবাই সমান। সুতরাং ভেবে দেখুন!

وَالسَّابِقُونَ الأوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالأنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الأنْهَارُ

‘আর মুহাজির ও আনছারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা সুন্দরভাবে তাদের অনুসরণ করেছে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন আর তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন জান্নাতসমূহ, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত। তারা সেখানে চিরস্থায়ী হবে। এটাই মহাসফলতা’ (আত-তওবা, ৯/১০০)

উক্ত আয়াতের উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে মৌলবী মুহাম্মাদ শাহ পাক পাটনী বলেছেন, অন্য ইমামদের তুলনায় ইলমের আধিক্য এবং মর্যাদা ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ–কে বাকি তিন ইমামের উপর উচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত করেছে। কেননা বাকি তিন ইমামের মাঝে এই গুণ ও মর্যাদা পাওয়া যায় না। কেননা ইমাম মালেক রহিমাহুল্লাহ ৯৩, ৯৪ অথবা ৯৭ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেছেন। তিনি আবূ তুফায়ল রযিয়াল্লাহু আনহু–এর সাথে সাক্ষাৎ করেছেন এমনটি জানা যায় না। কেননা সেসময় তার মক্বায় গমনের বিষয়টি প্রমাণিত নয়। বরং ইবনু ছালাহ বলেছেন, ইমাম মালেক তাবে-তাবেঈ ছিলেন অর্থাৎ তার সাথে কোনো ছাহাবীর সাক্ষাৎ হয়নি। আর ইমাম শাফেঈ রহিমাহুল্লাহ ২৫০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইমাম মুহাম্মাদ ও ইমাম মালেক রহিমাহুমাল্লাহ–এর ছাত্র ছিলেন। আর আহমাদ ইবনু হাম্বল রহিমাহুল্লাহ ইমাম শাফেঈ রহিমাহুল্লাহ–এর ছাত্র ছিলেন। তিনি ১৬৪ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, ইমাম আ‘যম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ-এর মর্যাদা মুজতাহিদ বিদ্বানগণের অনেক ঊর্ধ্বে।

জবাব : ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ এই আয়াতের উদ্দেশ্যে তখনই পৌঁছাতেন যদি তিনি তাবেঈ হতেন। তিনি যে তাবেঈ নয়, তা পূর্বের বিস্তারিত আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে। সুতরাং বাকি তিন ইমামের চেয়ে ইমাম আবূ হানীফার মর্যাদার আধিক্য যদি তাবেঈ হওয়ার ভিত্তিতে হয়ে থাকে, তাহলে তা আর নেই। সুতরাং তাবেঈ না হওয়ার দৃষ্টিতে চার ইমাম সমান মর্যাদার অধিকারী। যেহেতু তারা কেউ তাবেঈ নয়, সেহেতু সবাই উক্ত আয়াতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় মর্যাদায় সমান। ইমাম বায়যাবী রহিমাহুল্লাহ উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, والذين اتبعوهم _ بإحسان اللاحقون بالسابقين من القبيلتين أو من اتبعوهم بالإيمان والطاعة إلى يوم القيامة ‘আর যারা সুন্দরভাবে তাদেরকে অনুসরণ করেছে’। অনুসরণীয় অগ্রগামীগণ হচ্ছেন দুই গোত্রের মধ্য হতে ইসলাম গ্রহণে অগ্রগামী ছাহাবীগণ এবং তারাও যারা তাদের পরে ক্বিয়ামত পর্যন্ত ঈমান এবং আনুগত্যের সহিত তাদের অনুসরণ করবেন’।[10]

এরপরও যদি আপনারা বলেন যে, কিছু হাদীছ দ্বারা বুঝা যায়, ইমাম আবূ হানীফার মর্যাদা অন্যদের থেকে বেশি যেমনটি লেখক বলেছেন যে, ‘তাবঈযুস ছহীফা’ বইয়ে ইমাম সুয়ূতী রহিমাহুল্লাহ লিখেছেন, ইমাম আবূ হানীফার মর্যাদা বর্ণনায় ছহীহ বুখারীর এই হাদীছটিই যথেষ্ট। আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালমান আল-ফারেসী রযিয়াল্লাহু আনহু-এর উপর হাত রেখে বললেন, لَوْ كَانَ الإِيمَانُ عِنْدَ الثُّرَيَّا لَنَالَهُ رِجَالٌ مِنْ فَارِس ‘ঈমান সুরাইয়া নক্ষত্রের কাছে থাকলেও আমাদের কিছু লোক অথবা তাদের (পারস্যদের) এক ব্যক্তি তা অবশ্যই পেয়ে যাবে’।[11] তথাপিও অন্যান্য ইমামদের উপর তার মর্যাদা প্রমাণিত হবে না। কেননা অন্যান্য ইমামগণও এরূপ অনেক হাদীছের উদ্দেশ্য হতে পারেন। যেমন, يُوشِكُ أَنْ يَضْرِبَ النَّاسُ أَكْبَادَ الإِبِلِ يَطْلُبُونَ الْعِلْمَ فَلاَ يَجِدُونَ أَحَدًا أَعْلَمَ مِنْ عَالِمِ الْمَدِينَةِ ‘অচিরেই লোকেরা ইলম তালাশে তাদের উটের উপর চড়ে সফর করবে। কিন্তু তারা মদীনার আলেম অপেক্ষা বেশি জ্ঞানী আর কাউকে পাবে না’।[12] এই হাদীছের উদ্দেশ্য ইমাম মালেক রহিমাহুল্লাহ হতে পারেন। আর ইমাম শাফেঈ রহিমাহুল্লাহ কয়েকটি হাদীছের উদ্দেশ্য হতে পারেন। ইমাম নববী রহিমাহুল্লাহ এ মর্মে বর্ণিত হাদীছগুলোর বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আর আপনারা যদি বলেন যে, এই হাদীছগুলোতে তো কোনো ইমামের নাম বলা নেই যে, এ হাদীছ দ্বারা অমুক ইমাম উদ্দেশ্য; বরং মানুষেরা তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী একেক ইমামকে উদ্দেশ্য বানিয়েছে, তাহলে তো কোনো কথা নেই। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে— ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ-এর নাম উল্লেখ্য করে এমন কিছু হাদীছ বর্ণনা করা হয়, যেগুলোতে ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ-এর মর্যাদাকেই স্পষ্ট করে।

(চলবে)

মূল (উর্দূ) : সাইয়্যেদমিয়াঁনাযীর হুসাইন দেহলভী রহিমাহুল্লাহ

অনুবাদ : আখতারুজ্জামান বিন মতিউর রহমান

শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।


[1]. তাক্বরীবুত তাহযীব, পৃ. ১৬৮।

[2]. তাহযীবুল আসমা, তরজমা নং ২৮৬, ২/২৬১।

[3]. রাদ্দুল মুহতার, ‘ভূমিকা’, ১/৪৫।

[4]. প্রাগুক্ত।

[5]. প্রাগুক্ত।

[6]. প্রাগুক্ত।

[7]. তাক্বরীবুত তাহযীব, পৃ. ৩৬৮।

[8]. প্রাগুক্ত।

[9]. রাদ্দুল মুহতার, ১/৫৪; তাযকিরাতুল মাউযূআত, পৃ. ১১১; আল-ই‘লালুল মুতানাহিয়্যা, ১/১২৮।

[10]. তাফসীরে বায়যাবী, ২/৩৪৬, সূরা আত-তওবা, ৯/১০০।

[11]. তাবয়ীযুস ছহীফা, পৃ. ৮।

[12]. তিরমিযী, হা/২৬৮০; মিশকাত, হা/২৪৬।

Magazine