আফগানিস্তান অসংখ্য পাহাড়বেষ্টিত একটি দেশ। এটিকে দক্ষিণ এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। আফগানিস্তানের পূর্ব ও দক্ষিণে অবস্থিত পাকিস্তান। পশ্চিমে ইরান। উত্তরে তুর্কেমিনিস্তান, উজবেকিস্তান ও তাজাকিস্তান। আর এর উত্তর-পূর্বে গণচীন অবস্থিত। আফগানিস্তান একটি রূঢ় আবহাওয়ার দেশ। এর অধিকাংশ এলাকা পর্বত ও মরুভূমি দ্বারা আবৃত। উত্তর দিকে কিছু সমভূমি দেখতে পাওয়া যায়, যেখানে কিছু গাছপালা রয়েছে। গ্রীষ্মকালে আফগানিস্তানের আবহাওয়া গরম থাকে। আর শীতকালে এখানে প্রচণ্ড শীত পড়ে। আফগানিস্তান প্রাচীনকাল থেকেই এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। অনেক প্রাচীন বাণিজ্য এবং বহিরাক্রমণ এ দেশের মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বহু লোক আফগানিস্তানের মধ্য দিয়েই চলাচল করেছে। অনেক জাতি এখানে বসতি স্থাপন করেছে। এ দেশে বসবাসরত সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী হলো পশতুন জাতি। ৫০ হাজার বছর আগে থেকেই আফগানিস্তানে মানুষের বসতি ছিল। আফগানিস্তানকে অনেক জাতি শাসন করেছে মর্মে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। আফগানিস্তান রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালা ও সৈয়দ মুজতবা আলীর আব্দুর রহমানের দেশ হিসেবেও পরিচিত। সম্প্রতি তালেবানদের অগ্রযাত্রায় আফগানিস্তানের অধিকাংশ এলাকার পতন হয়। ফলে বিশ্বমিডিয়ার সংবাদ মাধ্যমের প্রধান শিরোনাম হয়ে পড়ে আফগানিস্তান। বিশ্ববাসীর মতো বাংলাদেশীদের কাছেও আফগানিস্তানের হাড়ির খবর জানার আগ্রহ বেশ লক্ষণীয়। আফগানিস্তান একটি হতদরিদ্র সার্কভুক্ত দেশ। তবে এর রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য। আফগানিস্তানে জন্ম নেওয়া নানা গোত্র বিভিন্ন কারণে বেশ প্রসিদ্ধ। মধ্যযুগে হিন্দুস্থানে শাসনকার্যে এসকল প্রসিদ্ধ গোত্রের মানুষেরা ব্যাপক অবদান রেখেছে। আধুনিক যুগে উপমহাদেশের রাজনীতিতেও তাদের নামের সংশ্লিষ্টতা দেখতে পাওয়া যায়। সিনেমা, সংগীত, ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আফগানিস্তানের অনেক খানেরা। জড়িয়ে আছে কাপুরেরা, আফ্রিদিরা এবং আরও অনেকে। এসব খান, কাপুর আর আফ্রিদিদের পূর্বপুরুষের শিকড় এই আফগানিস্তান। দূর অতীতের অভিবাসন প্রত্যাশীদের কাছে আফগানিস্তান ছিল একটি সরাইখানার মতো। মরুময় ঝাঁঝালো আবহাওয়া ডিঙিয়ে তারা আসত
সিন্ধু, পাঞ্জাব আর বাংলার উর্বর সবুজ ভূমির দিকে। পাহাড়-পর্বত, বনবাদাড়ের চড়াই-উতরাই মাড়িয়ে তাদের সাক্ষাৎ মিলত গিরিপথের উপর দাঁড়ানো এক সরাইখানার সাথে। আর সে সরাইখানা হলো আফগানিস্তান। অভিবাসন প্রত্যাশীর সকলকেই এ সরাইখানার আতিথেয়তা কিংবা শত্রুতা গ্রহণ করতে হতো। দুটোর যেকোনো একটা গ্রহণ করেই তারপর সামনে এগুতে হতো। খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ বছর আগে এখানে অভিবাসন প্রত্যাশী মানুষজন আসতে শুরু করে। আফগানিস্তান শাসন ও দখলের নিমিত্তে অনেকেই সেখানে প্রবেশ করেছে। কিন্তু তাকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারে নাই। দখলদার ঔপনিবেশকরা পরাজিত হয়েছে। লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়েছে। অনেকে মৃত্যুবরণ করেছে। অবশেষে আত্মসমর্পণের গ্লানি নিয়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছে। দীর্ঘ পরিক্রমায় একের পর এক আফগানিস্তানের হাতবদল হয়েছে। দেশটি অতীতে পারস্য, গ্রীস, সেলুসিড, মৌর্য, আরব, মঙ্গল, খোয়ারিজম ও তিমুরীয় শাসকগণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে পারস্য সাম্রাজ্য এই আফগানিস্তান দখল করে নেয়। তারা বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩০ সালে মহামতি আলেকজান্ডার পারস্য সম্রাটকে পরাজিত করে আফগানিস্তানের দখল নেয়। দখলে নিয়েই আলেকজান্ডার বলেছিলেন, আফগানরা ‘অপরাজেয়’। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে এশিয়ার কুশান জাতি আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেয়। চতুর্থ শতাব্দীতে হুন নামের মধ্য এশিয় এক তুর্কি জাতি কুশান জাতিকে পরাজিত করে। সপ্তম শতাব্দীতে আফগানিস্তানে ইসলাম ধর্মের আগমন ঘটে। আরব মুসলিমরা পশ্চিমের হেরাত ও সিস্তান প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। দশম শতাব্দীতে উজবেকিস্তানের বুখারা থেকে একদল মুসলিম শাসক আফগান এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে। একই সময়ে এখানে গজনবী রাজবংশ প্রতিষ্ঠা হয়। গজনীর সর্বশেষ রাজা ছিলেন মাহমূদ গজনবী। তিনি ৯৯৮ সাল থেকে ১০৩০ সাল পর্যন্ত এই এলাকা শাসন করেন। তিনি প্রায় সকল হিন্দু রাজাদের পরাজিত করে আফগানিস্তানে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। এসময় আফগানিস্তান সাহিত্য ও শিল্প নগরীতে পরিণত হয়। মাহমূদ বুদ্ধিজীবীদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তার মধ্যে রয়েছে ইতিহাসবিদ আল-বিরুনী ও মহাকবি ফেরদৌসী। মাহমূদের মৃত্যুর পর গজনীর প্রভাব হ্রাস পায়। ১২০০ শতাব্দীতে পশ্চিম-মধ্য আফগানিস্তানে ঘুরি রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ১২১৫ সালে খোয়ারিজমি শাহদের কাছে ঘুরি রাজ্যের পতন ঘটে। ১২১৯ সালে মঙ্গল সেনাপতি চেঙ্গিস খান খোয়ারিজিমিদের পরাজিত করেন। ১৪০০ শতাব্দীতে তৈমুর লং আফগানিস্তান জয় করেন। ঘুরি থেকে তৈমুরীয় সাম্রাজ্যের শাসনামলে এখানে ইসলামী স্থাপত্যের ব্যাপক বিকাশ ঘটে। এ সময় তৈরি হয় মসজিদ, মাদরাসা, মিনার ও মাজার-ই-শরীফ। মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাদশা জহির উদ্দিন বাবর ১৫০৪ সালে কাবুল ও কান্দাহার দখল করে নেয়। ১৫২৬ সালে বাবর ভারতে আক্রমণ করেন। তিনি লোদী বংশকে পরাজিত করে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তার জ্যেষ্ঠপুত্র হুমায়ূনকে দিল্লির উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। আর অন্য তিন পুত্র কামরান মির্জা, আস্কার মির্জা ও হিন্দাল মির্জাকে কাবুল, কান্দাহার ও বদকশান শাসনের দায়িত্ব প্রদান করেন। মোগলদের সময়ে কাবুল, দিল্লি ও আগ্রা একই সূত্রে গ্রথিত ছিল। পরবর্তীতে ১৫৪৫ সালে বাবরের জ্যেষ্ঠপুত্র হুমায়ূন কাবুল, কান্দাহার, গজনী ও বদকশানের একচ্ছত্র শাসক হন। দিল্লি থেকেই তখন আফগানিস্তানের প্রদেশগুলো মোগলদের দ্বারা শাসিত হতো।
১৭৪৭ সালে আবির্ভাব ঘটে আহমাদ শাহ দুররানির। তিনি ছিলেন তেহরানের প্রতাপশালী সেনাপতি নাদির শাহের অনুগত এক সেনাধ্যক্ষ। কান্দাহার শহরকে রাজধানী করে দুররানি সাম্রাজ্যের পত্তন করেন। কাবুল, কান্দাহার, হেরাত, গজনী ও পেশাওয়ার নিয়ে জন্ম হয় আধুনিক আফগানিস্তানের। তিনি আফগানিস্তানে স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেন। আর কালক্রমে এক শক্তিশালী শাসক হিসেবে আবির্ভূত হন। তার মৃত্যুর পর পুত্র তৈমুর শাহ আফগানিস্তানের রাজধানী কান্দাহার থেকে কাবুলে স্থানান্তরিত করেন। ১৭৯৩ সালে তৈমুরের মৃত্যু হয়। অতঃপর তাঁর পুত্র জামান শাহ, মাহমূদ শাহ, সুজা শাহ ও অন্যান্যরা সিংহাসনে আরোহন করেন। এ সময়ে আফগানিস্তান নিয়ে সর্বপ্রথম বেপরোয়া নাক গলানো শুরু করে ব্রিটিশরা। তারা ১৮৩৯ সালে আফগানিস্তানে হামলা চালায়। ১৮৪২ সালে তারা আফগানিস্তান দখল করে নেয়। আফগানিস্তান আবার পরাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৯১৪ সালে আফগানিস্তানের শাসক ছিলেন হাবীবুল্লাহ খান। ১৯১৯ সালে তুরস্কের অনুসারী বিদ্রোহীরা তাকে হত্যা করে। তার স্থলাভিষিক্ত হন তাঁর পুত্র আমানুল্লাহ খান। তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। দীর্ঘ যুদ্ধে ইংরেজরা ক্লান্ত ও দিশেহারা হয়ে পড়ে। তারা পরাজয় বরণ করে। এসময় কাবুলে ব্রিটিশ সৈন্যসহ মোট ১৬০০০ ব্রিটিশ নাগরিক অবস্থান করছিল। আফগান যোদ্ধারা তাদেরকে খায়বার গিরিপথ পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে যায়। ব্রিটিশদের অতিরিক্ত নাক গলানোর কারণে এদের প্রায় সকলকেই আফগান যোদ্ধারা হত্যা করে। মাত্র একজন সৈনিকডাক্তার ঘোড়ার পিঠে ঝুলতে ঝুলতে তাদের ঘাঁটিতে ফিরে আসে। এটাও সম্ভব হয়েছিল আফগানদের ইচ্ছাতেই। কারণ তারা চেয়েছিল অন্তত একজন ব্রিটিশ যেন ফিরে গিয়ে তাদের করুণ পরিণতির কথা ব্রিটিশদের কাছে বলতে পারে। স্বাধীনচেতা আফগান শাসক আমানুল্লাহ ইংরেজদের ক্ষমতা খর্ব করেন। আফগানিস্তানকে তিনি স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করেন। ১৯২৯ সালে দেশে আবার অস্থিরতা নেমে আসে। ক্ষমতা দখল করেন হাবীবুল্লাহ কালাকানি নামে এক দস্যু সর্দার। ১৯৩০ সালে আফগানিস্তানের নতুন শাসক হন জহির শাহ। তিনি একটানা ৪০ বছর আফগানিস্তান শাসন করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত ধারাবাহিক রাজতান্ত্রিক শাসন চলমান থাকে। ১৯৭৩ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে জহির শাহ ক্ষমতাচ্যুত হন। এতে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে। প্রজাতন্ত্র হিসেবে আফগানিস্তানের আবির্ভাব ঘটে। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা বজায় ছিল। আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট তখন মুহাম্মাদ দাঊদ খান। তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন বামপন্থী সামরিক নেতা নূর মুহাম্মাদ তারাকি। অতঃপর ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নেন পিপলস পার্টি ও ব্যানার পার্টি। এ সরকারের নাম দেওয়া হয় বামপন্থী পিডিপিএ। এ সরকারের কোনো জনপ্রিয়তা ছিল না। এ সরকারটি ছিল সোভিয়েতের অনুগত তাবেদার বাহিনী। ব্রিটিশদের আদলে এসময় আফগানিস্তানে শুরু হয় সোভিয়েত রাশিয়ার আনাগোনা। তাদের অনুগত সরকারকে সমর্থন করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগান জনগণের উপর চাপ সৃষ্টি করে। স্বাধীনচেতা আফগানরা তা প্রত্যাখ্যান করে। ফলে ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান আক্রমণ করে। তারা ৩০ হাজার সৈন্য নিয়ে আফগানিস্তানে প্রবেশ করে। তারা মাত্র ৬ মাস আফগানিস্তানে থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তারা সেদেশে অবস্থান করেছিল ১০ বছর। তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের স্নায়ুযুদ্ধের ময়দান হয়ে উঠেছিল এই আফগানিস্তান। আফগান-সোভিয়েত যুদ্ধ শুরু হয়ে চলে দীর্ঘ ১০ বছর। এ যুদ্ধে বাস্তুচ্যুত হয় লক্ষ লক্ষ আফগান নাগরিক। ২৮ লাখ আফগান পাকিস্তানে এবং ১৫ লাখ আফগান ইরানে আশ্রয় নেয়। এখনো প্রায় ২০ লাখেরও বেশি আফগান নাগরিক পাকিস্তান, ইরান ও তুরস্কের শরণার্থী শিবিরে জীবনযাপন করছে। সহিংসতার কারণে যাদের অনেকেই দেশে ফেরার ক্ষেত্রে খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। সংঘটিত এ যুদ্ধে ধ্বংস হয় মূল্যবান স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান। এসময় বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতি ও শহুরে গোষ্ঠীগুলো তাবেদার সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। যাদের একটি গ্রুপকে বলা হতো আফগান মুজাহিদীন। আফগান মুজাহিদরা সোভিয়েতের বিরুদ্ধে গেরিলা হামলা অব্যাহত রাখে। পিডিপিএ সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা দিত সোভিয়েত ইউনিয়ন। আর আফগান মুজাহিদদেরকে সহযোগিতা করত যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, সঊদী আরব ও অন্যান্য মুসলিম দেশ। ক্রমাগত মুজাহিদ বাহিনী গেরিলা হামলা জোরদার করতে থাকে। সোভিয়েত বাহিনী ক্লান্ত ও দিশেহারা হয়ে পড়ে। অতঃপর তারা ১৯৮৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করে। চুক্তি মোতাবেক ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যায় ১৯৮৯ সালে। কিন্তু তারা সে দেশে রেখে যায় তাদের তাবেদার সমর্থক গোষ্ঠিকে। আর তাদের এ তাবেদার গোষ্ঠির সাথে বিরোধী গোষ্ঠীর মধ্যে আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ চলমান থাকে। ইতোমধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। সংঘটিত এসব যুদ্ধের মধ্যেই জন্মগ্রহণ করে তালেবান নামক একটি সশস্ত্র ইসলামী সংগঠন। ১৯৯৬ সালে তালেবান তাদের অস্তিত্বের জানান দেয়। তালেবানরা এসময় সংগঠিত হয়ে আত্মপ্রকাশ করে। আল-ক্বায়েদা নামে আরেকটি ইসলামিক গ্রুপকে তালেবানরা আফগানিস্তানে আশ্রয় দেয়। মুজাহিদ বাহিনীর একটা গ্রুপ তালেবানদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। তালেবানরা ১৯৯৬ সালে কাবুল দখল করে নেয়। জিহাদী এ গ্রুপগুলো ইসলামী রাষ্ট্র ক্বায়েমের সংগ্রাম অব্যাহত রাখে। দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকায় তাদের দাপট ছিল। তালেবানরা দেশের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেয়। তারা ১৯৯৮ সালের মধ্যে আফগানিস্তানের পুরো নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। তালেবানরা সরকার গঠন করে। তারা ইসলামী শরীআহ মোতাবেক দেশ পরিচালনা শুরু করে। উল্লেখ্য, এ সময় পর্যন্ত তালেবানদেরকে আমেরিকা মিত্র শক্তি হিসেবে মনে করত। স্বাধীনচেতা আফগানরা স্বাধীনভাবে দেশ চালাতে থাকে। আর এতে ক্রমাম্বয়ে নাখোশ হতে থাকে দীর্ঘদিনের মিত্রশক্তি আমেরিকা। অতঃপর তালেবানের ঘরে সন্ত্রাসের অজুহাত খুঁজতে থাকে বিশ্বমোড়ল আমেরিকা। ঠিক এ সময়েই ২০০১ সালে আমেরিকার টুইন টাওয়ারে এক নৃশংস হামলার ঘটনা ঘটে। এতে ২৫০০ জন আমেরিকান নাগরিক নিহত হয়। আমেরিকা এ হমলার জন্য আফগানিস্তানে আশ্রয় নেওয়া উছামা বিন লাদেনকে দায়ী করে। তাকে আমেরিকার হাতে তুলে দেওয়ার জন্য তালেবানের উপর চাপ সৃষ্টি করে। তালেবানরা তাদের অতিথি উছামা বিন লাদেনকে হস্তান্তর করতে অস্বীকার করে। অতঃপর ঠুনকো এ অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রবাহিনী আফগানিস্তানে একযোগে হামলা চালায়। ২০০১ সাল থেকে ২০২১ সাল। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানে চলে এ হামলা। আর এতদিন পর্যন্ত আমেরিকা অবস্থান করে আফগানিস্তানে! তালেবানদের উপর পৃথিবীর সর্বাধুনিক অস্ত্র ও শক্তি প্রয়োগ করে আমেরিকা। তারা দেশটিকে পদানত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখে। দীর্ঘ দুই দশক ধরে তালেবানরা মার্কিনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেই চলল। যুদ্ধের পুরোটা সময় তারা পরাশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলল। স্রষ্টায় বিশ্বাস আর অদম্য মনোবলই ছিল তাদের একমাত্র অবলম্বন। এ মনোবলের উপর ভর করেই তালেবানরা যুদ্ধ চালিয়ে গেল দীর্ঘ এত বছর! এ যুদ্ধে আমেরিকার ব্যয় হয়েছে ২ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। প্রাণ হারিয়েছে অগণিত সৈন্য। মূলত শান্তির ছদ্মাবরণে মার্কিনীরা চেয়েছিল আফগানিস্তানে একটি পশ্চিমা ঘেঁষা শাসন ক্বায়েম করতে। কিন্তু আমেরিকা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আর এ চেষ্টা যে ব্যর্থ হবে সেটা বুঝা যাচ্ছিল ২০১১ সালেই। কারণ এ বছরই তালেবানের সাথে কূটনৈতিক আলোচনা শুরু করে আমেরিকা। আর আমেরিকার আত্মসমর্পণের পথ উন্মোচন করে দেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে উভয়ের মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ স্বাক্ষরিত চুক্তি নিশ্চিত করে যে, তালেবানদের সম্ভাব্য বিজয় সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসেন। তিনি তার দেশের নিশ্চিত পরাজয়টি বিলম্ব করতে চাননি। ২০২১ সালের ৩১ আগস্টের মধ্যে তাদের সকল সৈন্য ফিরিয়ে নেবেন বলে তিনি ঘোষণা দেন। ইতোমধ্যে তারা সৈন্য ফিরিয়েও নিয়েছে। সৈন্য প্রত্যাহারের আগেই তালেবানরা তাদের হামলা আরো জোরদার করে। এ সময় থেকে মাত্র সাড়ে তিন মাস অতিবাহিত হয়। এর মধ্যেই ১৫ই আগস্ট ২০২১ তারিখে তালেবানের হাতে রাজধানী কাবুলের পতন ঘটে। মার্কিন সমর্থিত আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। সুদীর্ঘ ২০ বছরের হামলায় আফগানিস্তান ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো। আমেরিকা আফগানিস্তানে নির্বিচারে হত্যা চালালো। ধ্বংস করল নানা স্থাপনা। লাখো বেসামরিক লোকের প্রাণহানি ঘটালো তারা। ড্রোন হামলা চালিয়ে অসংখ্য নিরীহ নারী-শিশুকে পঙ্গু বানালো। বিশ্বের সবচেয়ে বড় বোমার মালিক আমেরিকা। যার সফল পরীক্ষা চালালো তারা আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষের উপর। বিশ্ব বিবেক চুপ করে তাকিয়ে তাকিয়ে শুধু দেখল।
আলেকজান্ডার বলেছিলেন, আফগানিস্তান হচ্ছে ‘অপরাজেয়’ একটি দেশ। এর আরেকটি নাম হলো ‘সাম্রাজ্যসমূহের গোরস্থান’। নামটি যথার্থ বলেই মনে হয়। কারণ যত বড় বীর এদেশে প্রবেশ করেছে সকলকেই নাকানি-চুবানি খেতে হয়েছে। সকল বীরকেই পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। আলেকজান্ডারের এই কথা কেউ মনে রাখেনি। যারাই আফগানিস্তান দখল করতে গেছে তাদের সকলকেই করুণ পরিণতির শিকার হতে হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতার সর্বশেষ শিকার বর্তমান বিশ্বের একক পরাশক্তি আমেরিকা। তৃতীয় কোনো শক্তি তালেবানদেরকে এবার সাহায্য করেনি। কোনো সাহায্য ছাড়াই সম্পূর্ণ নিজস্ব শক্তিতে বিজয়ী হলো তালেবানরা। আমেরিকার রাহুমুক্ত হলো আফগানিস্তান। নিজেদের দেশকে শত্রুমুক্ত করল তালেবানরা। ফলে আবারও স্বাধীন হলো আফগানিস্তান। তালেবানকে বিশ্বপরাশক্তিগুলো একযোগে জঙ্গি আখ্যায়িত করেছিল। কিন্তু তাদের বিজয়ের পর পরাশক্তিদের অনেকেই তালেবানদেরকে সমর্থন করেছে। কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা বলেও আখ্যা দিয়েছে। চীন, রাশিয়া, তুরস্কসহ বেশ কয়েকটি দেশ তাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এবার বিশেষ লক্ষণীয় বিষয় হলো, তালেবানরা বিজয়ী হয়ে আমেরিকার সমর্থকদেরকে গুলি করে হত্যা করেনি। প্রেসিডেন্ট প্রাসাদেও রক্তপাত ঘটায়নি। মানুষ হত্যায় সহযোগিতাকারী দালালদেরকে পাকড়াও-ও করেনি। আমেরিকা ও তার মিত্রদের উপর এখনো পর্যন্ত প্রতিশোধ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। বরং তাদেরকে বিদেশিদের দূতাবাস থেকে বিমানবন্দরে যেতে সহায়তা দিয়েছে। নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য সহযোগিতা করেছে। আপাতত তাদেরকে সহনশীল বলেই মনে হচ্ছে। তালেবানরা মূলত আফগানিস্তানে ইসলামী শরীআহ চালু করতে চায়। তালেবান উপপ্রধান মোল্লা আব্দুল গনি বারাদার এক ঘোষণায় বলেছেন, তালেবানের মূল লক্ষ্য আফগানিস্তানের স্বাধীনতা অর্জন করা। তিনি বলেন, তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে চায় না। তালেবান মনে করে, আফগানিস্তানের সব শ্রেণির মানুষ আইনের দৃষ্টিতে সমান। তিনি বলেন, ইসলামী অনুশাসনের আওতায় আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতি প্রণিত হবে। মানবাধিকার ও সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করা হবে। নারী অধিকার এবং বাকস্বাধীনতার প্রতি তালেবান সম্মান প্রদর্শন করবে। এছাড়া তালেবান নারীর শিক্ষা ও চাকরির অধিকার নিশ্চিত করবে। তাদের সম্পদের মালিকানা ও ব্যবসা করার অধিকার প্রদান করবে। আর এসব হবে ইসলামী আইন ও জাতীয় স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রেখে।
যাহোক, তালেবানরা বিজয় অর্জন করেছে। তাদের দেশকে স্বাধীন করেছে। তারা নিজেদের স্বাধীন ইচ্ছায় রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করবে। তারা তাদের স্বাধীন আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার পাবে এটাই স্বাভাবিক। আর এটা আন্তর্জাতিক বিশ্বের স্বীকৃত রীতিও বটে। এ নীতি অনুযায়ী তারা যে কোনো আদর্শ গ্রহণ করতে পারে। আর এটা তাদের একান্তই অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এটা নিয়ে কারো মাথা ব্যথা করা বোকামি ও অনধিকার চর্চার শামিল। কিন্তু তারপরও বিশ্বকে বিষয়টি নিয়ে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশ বেশ উতলা হয়ে পড়েছে। দখলদারদের মিত্রদের জন্য তারা বেশ মায়াকান্না করছে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে তালেবানরা বিজয় অর্জন করে বড় ভুল ও অন্যায় করে ফেলেছে। মূলত তালেবানরা দেওবন্দী ধারার ইসলামী আন্দোলন ও একটি সামরিক সংগঠন। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমর। ১৯৯৪ সালে সংগঠনটি যাত্রা শুরু করে। ১৯৯৬ সালে সংগঠনটি আফগানিস্তানের প্রথম সরকার গঠন করে। ২০০১ সাল পর্যন্ত দেশের তিন-চতুর্থাংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। সংগঠনটি তাদের অধিকৃত অঞ্চলে ইসলামী শরীআহ প্রতিষ্ঠা করে। সংগঠনটি দক্ষিণ-পূর্ব আফগানিস্তানের পশতুন ছাত্রদের নিয়ে গঠিত হয়। এসব ছাত্ররা ঐতিহ্যবাহী ইসলামী বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করত। মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে এই সংগঠনটি দেশের অধিকাংশ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৯৬ সালে দলটি ইসলামী আমিরাত ঘোষণা করে। কান্দাহারকে তারা রাজধানী ঘোষণা করে। সে সময় তালেবান সরকারকে পাকিস্তান, সঊদী আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত-এ তিনটি রাষ্ট্র স্বীকৃতি প্রদান করেছিল।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ার হামলার পর আমেরিকা ও তার মিত্র বাহিনী তালেবান সরকারকে উৎখাত করে। আমেরিকান সমর্থিত হামিদ কারজাই আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়। সেদিন থেকে তালেবান আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত আমেরিকান সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। হামিদ কারজাই ২০০২ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে সমাসীন ছিলেন। ২০১৪ সালে আশরাফ গনি আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ২০২১ সালের ১৫ই আগস্ট আমেরিকান সৈন্যরা যুদ্ধে পরাজিত হয়। এবং তালেবানরা পুনরায় আফগানিস্তানের শাসন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে।
বিশ্ববাসীর নযর এখন তাই আফগানিস্তানের দিকে। অবশ্য তারা কী করবে বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়। ইতোমধ্যে তারা ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছে। তবে বিশ্ব মুসলিমের প্রত্যাশা থাকবে, তালেবান নেতারা সন্ত্রাসী তকমা থেকে বেরিয়ে আসুক! বিশ্ববাসী আমেরিকার অনুগতদের প্রাণভয়ে আফগান ছাড়ার হিড়িক দেখতে পাচ্ছে। তালেবানরাই যে তাদের প্রকৃত বন্ধু সেটা তালেবানকেই প্রমাণ করতে হবে। মক্কা বিজয়ের পর শত্রুদের সাথে নবীজির ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কৃত আচরণ প্রয়োগ করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে আমেরিকানরা নয়, আমরাই তোমাদের প্রকৃত রক্ষক।
মুসলিমরা চায় না, পৃথিবীতে নতুন করে কোনো চরমপন্থী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হোক! তারা চায়, খোলাফায়ে রাশেদার আদলে একটি উদার ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হোক! যেখানে ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বিকাশ ঘটবে। আধ্যাত্মিকতা ও মানবিকতার জয় হবে। ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ বিশ্বে প্রতিষ্ঠা হবে একটি আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্র। সেখানে অনুসৃত হবে বিশ্বজনীন ইসলামের সুমহান শান্তির বার্তা। গোটা বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে সেটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে। আর অন্তরে সেটা লালন করার সুপ্ত ইচ্ছার বিচ্ছুরণ ঘটবে।