কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

হজ্জ ও উমরা (পর্ব-১৫)

রমল : ধীর পদে বীর বেশে দ্রুত চলার নাম রমল। রমল শুধু ত্বাওয়াফে কুদূমে এবং প্রথম তিন চক্করে করতে হবে।

عَنْ سَالِمٍ عَنْ أَبِيهِ رضي الله عنه قَالَ رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حِينَ يَقْدَمُ مَكَّةَ، إِذَا اسْتَلَمَ الرُّكْنَ الأَسْوَدَ أَوَّلَ مَا يَطُوفُ يَخُبُّ ثَلاَثَةَ أَطْوَافٍ مِنَ السَّبْعِ

সালেম রাযিয়াল্লাহু আনহু তার পিতা হতে বর্ণনা করেন, তার পিতা বলেন, আমি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে দেখেছি, তিনি মক্কায় এসে কালো পাথরে চুম্বন দিলেন। আর সাত চক্করের প্রথম তিন চক্করে রমল করলেন।[1]

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رضي الله عنهما قَالَ قَدِمَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَصْحَابُهُ فَقَالَ الْمُشْرِكُونَ إِنَّهُ يَقْدَمُ عَلَيْكُمْ ، وَقَدْ وَهَنَهُمْ حُمَّى يَثْرِبَ . فَأَمَرَهُمُ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ يَرْمُلُوا الأَشْوَاطَ الثَّلاَثَةَ ، وَأَنْ يَمْشُوا مَا بَيْنَ الرُّكْنَيْنِ ، وَلَمْ يَمْنَعْهُ أَنْ يَأْمُرَهُمْ أَنْ يَرْمُلُوا الأَشْوَاطَ كُلَّهَا إِلاَّ الإِبْقَاءُ عَلَيْهِمْ

ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাহাবীগণকে নিয়ে মক্কায় আসলেন। তখন মুশরিকরা মন্তব্য করল, এমন একদল লোক তোমাদের কাছে আসছে, যাদের ইয়াসরিব (মদীনার) এর জ্বর দুর্বল করে দিয়েছে। (একথা শুনে) নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাহাবীগণকে ত্বাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে রমল করতে আদেশ করলেন আর উভয় রুকনের মধ্যবর্তী স্থানে স্বাভাবিক গতিতে চলতে আদেশ করলেন। ছাহাবীগণের প্রতি দয়া করে সব চক্করে রমল করতে আদেশ করলেন না।[2] এই হাদীছে বুঝা যায়, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেন রমল করার আদেশ করেছিলেন। পরবর্তীতে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাহাবীদের নিয়ে বিদায় হজ্জে আসলেন এবং রমল করলেন যার কারণে রমলের বিধান বলবৎ রয়েছে। নারী-পুরুষ সকলকেই সাত চক্কর ত্বাওয়াফ করতে হবে। ত্বাওয়াফের গণনায় সন্দেহ হলে যে সংখ্যা দৃঢ় মনে হবে, সে অনুযায়ী বাকী চক্কর পূর্ণ করতে হবে। ত্বাওয়াফ চলাকালে ছালাত শুরু হলে ছালাতে দাঁড়িয়ে যাবে। ছালাত শেষে যেখান থেকে ছেড়েছে, সেখান থেকে আরম্ভ করবে।

ত্বাওয়াফের দুই রাকআত ছালাত : ত্বাওয়াফ শেষ করে সম্ভব হলে মাক্বামে ইবরাহীমের পিছনে দুই রাকআত ছালাত আদায় করবে। প্রথম রাকআতে কাফেরূন এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা ইখলাছ পড়বে। জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মাক্বামে ইবরাহীম পৌঁছলেন, তখন এ আয়াতটি পড়লেন, وَاتَّخِذُوا مِنْ مَقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى তারপর তিনি দুই রাকআত ছালাত আদায় করলেন। তিনি সূরা ফাতেহা পড়লেন, তারপর সূরা কাফেরূন পড়লেন। তারপরের রাকআতে সূরা ইখলাছ পড়লেন।[3] মাক্বামে ইবরাহীমের পিছনে সম্ভব না হলে যে কোনো স্থানে পড়বে।

মুলতাযাম : হাজরে আসওয়াদ এবং কা‘বার দরজার মাঝের অংশ মুলতাযাম। এখানে বুক, মুখ ও দুই হাত রেখে দু‘আ করা যায়।

 عَمْرُو بْنُ شُعَيْبٍ عَنْ أَبِيهِ عَنْ جَدِّهِ قَالَ طُفْتُ مَعَ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو فَلَمَّا فَرَغْنَا مِنَ السَّبْعِ رَكَعْنَا فِى دُبُرِ الْكَعْبَةِ فَقُلْتُ أَلاَ نَتَعَوَّذُ بِاللَّهِ مِنَ النَّارِ. قَالَ أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ النَّارِ. قَالَ ثُمَّ مَضَى فَاسْتَلَمَ الرُّكْنَ ثُمَّ قَامَ بَيْنَ الْحَجَرِ وَالْبَابِ فَأَلْصَقَ صَدْرَهُ وَيَدَيْهِ وَخَدَّهُ إِلَيْهِ ثُمَّ قَالَ هَكَذَا رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَفْعَلُ

আমর ইবনু শুআইব তার পিতা হতে বর্ণনা করেন, তার পিতা বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনু আমরের সাথে ত্বাওয়াফ করলাম। তিনি যখন ত্বাওয়াফের সাত চক্কর শেষ করলেন, তখন কা‘বার পিছনে দুই রাকআত ছালাত আদায় করলেন। আমি বললাম, আল্লাহ নিকট জাহান্নাম হতে আশ্রয় চাইবেন না? তিনি বললেন, اَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ النَّارِ ‘আমি আল্লাহর নিকট জাহান্নাম হতে আশ্রয় চাই’। তারপর তিনি কালো পাথরে চুম্বন দিলেন, তারপর কালো পাথর ও দরজার মাঝে দাঁড়ালেন, তারপর বুক, দুই হাত এবং গাল লাগালেন। তারপর তিনি বললেন, আমি এভাবে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে করতে দেখেছি।[4]

كَانَ يَضَعُ صَدْرَهُ ووَجْهَهُ وذِرَاعَيْهِ وكَفَّيْهِ بَيْنَ الرُّكْنِ والْبَابِ. يَعْنِي فِي الطَّوَافِ

রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার বুক, চেহারা, দুই বাহু এবং দুই হাত হাজরে আসওয়াদ এবং দরজার মাঝে লাগাতেন।[5]

যা করা যাবে না :

(১) হাজরে আসওয়াদ কোনো ক্ষতি বা কোনো উপকার করতে পারে- এ ধারণা রাখা যাবে না।

(২) হাজরে আসওয়াদে চুমু দেওয়ার জন্য হুড়াহুড়ি, ঠেলাঠেলি করা যাবে না।

(৩) হাজরে আসওয়াদে ইশারা করা যাবে তবে হাতে চুম্বন দেওয়া যাবে না এবং চেহারা মুছা যাবে না।

(৪) ত্বাওয়াফের প্রতি চক্করে বিশেষ দু‘আ বলা যাবে না।

(৫) রমলে বা হাজরে আসওয়াদে বিশেষ কোনো দু‘আ নেই।

(৬) কা‘বাঘরের ছাদে পানি পড়ার স্থানে দু‘আ করা যাবে না।

(৭) কা‘বার গেলাফে এবং দেওয়ালে চুমু খাওয়া যাবে না। কা‘বাঘর হাত মুছে চেহারা ও বুকে মালিশ করা যাবে না। কা‘বার গেলাফ ধরে কান্নাকাটি এবং শরীরে মালিশ করা যাবে না।

(৮) ত্বাওয়াফে সমস্বরে যিকির বা দু‘আ করা যাবে না এবং উচ্চকণ্ঠে কান্না করা ও দু‘আ-দরূদ পড়া যাবে না।

(৯) ত্বাওয়াফের সাত চক্করেই রমল করা যাবে না।

(১০) হাজরে আসওয়াদে না পৌঁছেই ত্বাওয়াফ শুরু করা যাবে না।

(১১) ত্বাওয়াফ শেষে দুই রাকআতের বেশি ছালাত আদায় করা যাবে না এবং দলবদ্ধভাবে দু‘আ করা যাবে না। 

যমযমের পানি পান : ত্বাওয়াফের ছালাত শেষ করে যমযমের পানি পান করা উত্তম এবং মাথায় পানি দিতে পারে। আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, كَانَ يَحْمِلُ مَاءَ زَمْزَمَ فِي الْأَدَاوِىْ وَ الْقِرَبِ وَ كَانَ يَصُبُّ عَلَى الْمَرْضَى وَ يَسْقِيْهِمْ ‘নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মশকের এবং পাত্রে যমযমের পানি বহন করতেন। অসুস্থ ব্যক্তির মাথায় পানি ঢালতেন এবং তাদের পান করাতেন’।[6]

جَابِرَ بْنَ عَبْدِ اللَّهِ يَقُولُ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ مَاءُ زَمْزَمَ لِمَا شُرِبَ لَهُ.

জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি। যমযমের পানি যে নিয়তে পান করবে, তাই হবে।[7] ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,خَيْرُ مَاءٍ عَلَى وَجْهِ الْأَرْضِ مَاءِ زَمْزَمَ ، فِيْهِ طَعَامٌ مِنَ الطُّعْمِ وَ شِفَاءٌ مِنَ السَّقَمِ

‘মাটির উপর সবচেয়ে উত্তম পানি হলো যমযমের পানি। এটা এক প্রকার খাদ্য এবং রোগের আরোগ্য’।[8] আবূ যার গেফারী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যমযম বরকতময় পানি। এটা ক্ষুধার্তের খাদ্য এবং রোগের নিরাময়।[9]

أَنَّ ابْنَ عَبَّاسٍ k حَدَّثَهُ قَالَ سَقَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ زَمْزَمَ فَشَرِبَ وَهُوَ قَائِمٌ

ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য বালতিতে করে যমযমের পানি নিয়ে আসলাম। তিনি তা দাঁড়ানো অবস্থায় পান করলেন।[10]

عَنْ عَائِشَةَ رضى الله عنها أَنَّهَا كَانَتْ تَحْمِلُ مِنْ مَاءِ زَمْزَمَ وَتُخْبِرُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَحْمِلُهُ

আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা যমযমের পানি বহন করতেন এবং বলতেন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যমযমের পানি বহন করতেন।[11]

উক্ত হাদীছসমূহ প্রমাণ করে যমযমের পানি যে উদ্দেশ্যে পান করা হবে তা পূর্ণ হবে। যমযমের পানি রোগ নিরাময়ের ওষুধ। যমযমের পানি মূলত ইসমাঈল এবং তার মা হাজেরাকে আল্লাহ দান করেন। তারপর আল্লাহ বিশেষ অনুগ্রহে এ পানি আজ পর্যন্ত চালু আছে।

 (চলবে)


[1]. ছহীহ বুখারী, হা/১৬০৩; ছহীহ মুসলিম, হা/১২৬১।

[2]. ছহীহ বুখারী, হা/১৬০২।

[3]. নাসাঈ, হা/২৯৬৩; মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক, হা/১৬০৭০, হাদীছ ছহীহ।

[4]. ইবনু মাজাহ, হা/২৯৬২, হাদীছ হাসান।

[5]. সিলসিলা ছহীহা, হা/২১৩৮, হাদীছ ছহীহ।

[6]. সিলসিলা ছহীহা, হা/৮৮৩, হাদীছ হাসান।

[7]. ইবনু মাজাহ, হা/৩০৬২, হাদীছ ছহীহ।

[8]. সিলসিলা ছহীহা, হা/১০৫৬, হাদীছ হাসান।

[9]. সিলসিলা ছহীহা, হা/১০৫৬-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।

[10]. ছহীহ বুখারী, হা/১৬৩৭; ছহীহ মুসলিম, হা/২০২৭; মিশকাত, হা/৪২৬৭।

[11]. তিরমিযী, হা/৯৬৩; সিলসিলা ছহীহা, হা/৮৮৩, হাদীছ ছহীহ।

Magazine