কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

আশূরায়ে মুহাররম : গুরুত্ব ও ফযীলত

আরবী বছরের প্রথম মাস মুহাররম। আরবরা এ মাসকে ‘ছফরুল আউয়াল’ তথা প্রথম ছফর নামকরণ করে নিজেদের ইচ্ছামতো যুদ্ধ-বিগ্রহসহ বিভিন্ন কাজকে হালাল ও হারাম করত। অবশেষে আল্লাহ তাআলা এ অবস্থাকে নিষিদ্ধ করে এ মাসের ইসলামী নামকরণ করেন ‘শাহরুল্লাহিল মুহাররম’ তথা ‘মুহাররম আল্লাহর মাস’ নামে। এ মাসের ১০ তারিখ আশূরা বলে পরিচিত। নিঃসন্দেহে আশূরার দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদার দিন।

মুহাররম মাসের গুরুত্ব :

মুহাররম মাস হিজরী সনের ১২ মাসের প্রথম মাস, যা হারাম বা পবিত্র মাসগুলোর অন্তর্ভুক্ত। মহান আল্লাহ বছরের ১২টি মাস সম্পর্কে বলেন,

إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُوْرِ عِنْدَ اللهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِيْ كِتَابِ اللهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ذَلِكَ الدِّيْنُ الْقَيِّمُ فَلَا تَظْلِمُوْا فِيْهِنَّ أَنْفُسَكُمْ وَقَاتِلُوا الْمُشْرِكِيْنَ كَافَّةً كَمَا يُقَاتِلُوْنَكُمْ كَافَّةً وَاعْلَمُوْا أَنَّ اللهَ مَعَ الْمُتَّقِيْنَ

‘নিশ্চয় আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন হতে আল্লাহর বিধানে আল্লাহর নিকট মাস গণনায় ১২টি মাস, তন্মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস, এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীন। সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি যুলুম করো না এবং তোমরা মুশরিকদের সাথে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করো, যেমন তারা তোমাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করে থাকে। আর জেনে রাখো! আল্লাহ মুত্তাক্বীদের সঙ্গে আছেন’ (আত-তওবা, ৯/৩৬)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘পবিত্র মাস পবিত্র মাসের বিনিময়ে। এতে নিষিদ্ধ জিনিসের জন্য ক্বিছাছ (প্রতিবদলা) এর বিধান রয়েছে’ (আল-বাক্বারা, ২/১৯৪)। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ১২টি মাস সম্পর্কে বলেন,

الزَّمَانُ قَدْ اسْتَدَارَ كَهَيْئَتِهِ يَوْمَ خَلَقَ اللهُ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ السَّنَةُ اثْنَا عَشَرَ شَهْرً مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ثَلاَثَةٌ مُتَوَالِيَاتٌ ذُو القَعْدَةِ وَذُو الحِجَّةِ وَالمُحَرَّمُ وَرَجَبُ مُضَرَ الَّذِيْ بَيْنَ جُمَادَى وَشَعْبَانَ

‘আল্লাহ যেদিন আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন, সেদিন হতে সময় যেভাবে আবর্তিত হচ্ছিল, আজও তা সেভাবে আবর্তিত হচ্ছে। ১২ মাসে এক বছর। এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। যুলক্বা‘দাহ, যুলহিজ্জাহ ও মুহাররম। এ তিনটি মাস পরস্পর রয়েছে। আর একটি মাস হলো রজব-ই-মুযার, যা জুমাদা (ছানিয়াহ) ও শা‘বান মাসের মধ্যে অবস্থিত’।[1] ক্বাতাদা রহিমাহুল্লাহ বলেন, فَلَا تَظْلِمُوْا فِيْهِنَّ أَنْفُسَكُمْ এ অংশ থেকে বুঝা যায়, অন্য মাসের চেয়ে এ মাসে যুলুম করা মহাঅপরাধ বা বড় গোনাহর কারণ। যদিও যুলুম সর্বদায় কাবীরা গোনাহ।

আশূরা কী?

আশূরা শব্দটির বিশ্লেষণ নিয়ে ভাষাবিদগণ বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন। অধিকাংশের নিকট মুহাররম মাসের দশম তারিখই আশূরার দিন। এটা আরবী শব্দ (عشر) আশারা হতে নির্গত, যার অর্থ হলো দশ। অতএব, মুহাররম মাসের দশম তারিখে ছিয়াম রাখার নামই হলো আশূরার ছিয়াম।[2]

আশূরার ছিয়ামের প্রেক্ষাপট :

মহান আল্লাহর শুকরিয়াস্বরূপ এই দিনে ছিয়াম রাখা হয়। কারণ, মহান আল্লাহ এই দিনে তাঁর নবী মূসা আলাইহিস সালাম এবং তাঁর ক্বওমকে ফেরাউন ও তার দলবল থেকে রক্ষা করেছিলেন। হাদীছে এসেছে—

عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ k قَالَ قَدِمَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ المَدِينَةَ فَرَأَى اليَهُوْدَ تَصُوْمُ يَوْمَ عَاشُوْرَاءَ فَقَالَ مَا هَذَا؟ قَالُوْا هَذَا يَوْمٌ صَالِحٌ هَذَا يَوْمٌ نَجَّى اللهُ بَنِىْ إِسْرَائِيْلَ مِنْ عَدُوِّهِمْ فَصَامَهُ مُوْسٰى قَالَ فَأَنَا أَحَقُّ بِمُوْسٰى مِنْكُمْ فَصَامَهُ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ.

ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় এসে ইয়াহূদীদের দেখতে পেলেন যে, তারা আশূরার ছিয়াম পালন করছে। তিনি বললেন, এটা কী? তারা বলল, ‘এটা একটা ভালো দিন, এটা এমন একদিন, যেদিন আল্লাহ বানূ ইসরাঈলকে তাদের শত্রুদের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। সুতরাং মূসা আলাইহিস সালাম এই দিন ছিয়াম পালন করেছেন’। তিনি বললেন, ‘আমি তোমাদের চেয়ে মূসা আলাইহিস সালাম-এর ব্যাপারে অধিক হক্বদার’। এরপর তিনি নিজে এই ছিয়াম পালন

করেন এবং ছাহাবীদেরকেও ছিয়াম পালনের নির্দেশ দেন।[3]

মুসনাদে আহমাদের বর্ণনায় এ হাদীছটির বর্ধিত অংশে বলা হয়েছে, আশূরা এমন একটি দিন, যেদিনে নূহ আলাইহিস সালাম-এর কিশতী জুদী পর্বতে অবতরণ করেছিল। ফলে তিনি শুকরিয়াস্বরূপ এ দিনটিতে ছিয়াম রাখেন। অতএব, প্রমাণিত হয় যে, পূর্ববর্তী নবী ও উম্মতের মাঝেও আশূরায়ে মুহাররমে ছিয়াম রাখার ইবাদত চালু ছিল।

আশূরার ছিয়ামের হুকুম :

ইসলামের পূর্বযুগ হতেই এ ছিয়ামের প্রচলন ছিল। অতঃপর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাধ্যমে তা উম্মাতে মুহাম্মাদীর জন্য ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়। রামাযানের ছিয়াম ফরয হওয়ার পর এটা সকলের ঐকমত্যে সুন্নাত। কিন্তু রামাযানের ছিয়াম ফরয হওয়ার পূর্বে তার হুকুম সম্পর্কে বিদ্বানগণ বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন। কেউ ওয়াজিব বলেছেন, আবার কেউ সুন্নাত বলেছেন। নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে এ ছিয়াম রেখেছেন এবং ছাহাবীদের রাখার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। হাদীছে এসেছে—

عَنْ عَائِشَةَ i قَالَتْ كَانَ يَوْمُ عَاشُوْرَاءَ تَصُوْمُهُ قُرَيْشٌ فِي الْجَاهِلِيَّةِ وَكَانَ رَسُوْلُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَصُوْمُهُ فَلَمَّا قَدِمَ الْمَدِيْنَةَ صَامَهُ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ فَلَمَّا فُرِضَ رَمَضَانُ تَرَكَ يَوْمَ عَاشُوْرَاءَ فَمَنْ شَاءَ صَامَهُ وَمَنْ شَاءَ تَرَكَهُ‏.‏

আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, কুরায়শরা জাহেলী যুগে আশূরার দিন ছিয়াম পালন করত। এসময় আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এ দিনে ছিয়াম রেখেছেন। অতঃপর তিনি যখন মদীনায় আসেন, তখনও (প্রথমত) তিনি নিজে এ ছিয়াম পালন করেন এবং ছাহাবীদের তা পালন করার হুকুম দেন। তারপর যখন রামাযানের ছিয়াম ফরয হয়, তখন তিনি আশূরার ছিয়াম ছেড়ে দেন। অতঃপর যার ইচ্ছা সে তা রাখত আর যার ইচ্ছা সে তা ছেড়ে দিত।[4]

আশূরার ছিয়ামের ফযীলত :

আশূরার ছিয়াম বড় ফযীলতপূর্ণ। কেননা হাদীছে এসেছে—

عَنْ عُبَيْدِ اللَّهِ بْنِ أَبِي يَزِيدَ سَمِعَ ابْنَ عَبَّاسٍ k وَسُئِلَ عَنْ صِيَامِ يَوْمِ عَاشُورَاءَ‏ فَقَالَ مَا عَلِمْتُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ صَامَ يَوْمًا يَطْلُبُ فَضْلَهُ عَلَى الأَيَّامِ إِلاَّ هَذَا الْيَوْمَ وَلاَ شَهْرًا إِلاَّ هَذَا الشَّهْرَ يَعْنِي رَمَضَانَ‏.‏

উবায়দুল্লাহ ইবনে আবূ ইয়াযীদ রহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা-কে আশূরার দিনে ছওম পালন করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, এ দিন ব্যতীত রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো দিনকে অন্য দিনের তুলনায় উত্তম মনে করে সেদিনে ছওম পালন করেছেন বলে আমার জানা নেই। অনুরূপভাবে রামাযান ব্যতীত রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো মাসকে অন্য মাসের তুলনায় শ্রেষ্ঠ মনে করে ছওম পালন করেছেন বলেও আমার জানা নেই।[5]

রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন,صِيَامُ يَوْمِ عَاشُورَاءَ أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ ‘আশূরার দিনের ছওমের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে আমি আশাবাদী যে, তিনি এর দ্বারা আগের বছরের গুনাহ মোচন করে দিবেন’।[6]

আশূরার ছিয়ামের সংখ্যা :

এ সম্পর্কে হাদীছে এসেছে—

عَنْ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عَبَّاسٍ k يَقُولُ حِينَ صَامَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّهُ يَوْمٌ تُعَظِّمُهُ الْيَهُودُ وَالنَّصَارَى‏ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَإِذَا كَانَ الْعَامُ الْمُقْبِلُ إِنْ شَاءَ اللَّهُ صُمْنَا الْيَوْمَ التَّاسِعَ‏ قَالَ فَلَمْ يَأْتِ الْعَامُ الْمُقْبِلُ حَتَّى تُوُفِّيَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ.

আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আশূরার দিন ছিয়াম পালন করেন এবং লোকদেরকে ছিয়াম পালনের নির্দেশ দেন, তখন ছাহাবীগণ বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! ইয়াহূদ এবং নাছারারারা এ দিনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ইনশা-আল্লাহ আগামী বছর আমরা নবম তারিখেও ছিয়াম পালন করব। বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর আগামী বছর আসার আগেই রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মৃত্যু হয়ে যায়।[7]

আল্লাহ আমাদের সকলকে সকল ক্ষেত্রে বিশেষ করে আশূরায় মুহাররামে নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাত অনুযায়ী ইবাদত করার তাওফীক্ব দিন এবং আশূরাকে কেন্দ্র করে বিদআত, কুসংস্কার ও জাহেলী কর্মকাণ্ড হতে হেফাযত করুন- আমীন!


[1]. ছহীহ বুখারী হা/৩১৯৭।

[2]. মিরআতুল মাফাতীহ, ৭/৪৫।

[3]. ছহীহ বুখারী, হা/২০০৪।

[4]. ছহীহ বুখারী, হা/২০০২।

[5]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৩২।

[6]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৬২; মিশকাত, হা/২০৪৪।

[7]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৩৪।

Magazine