‘আল-ইবানাহ’ গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা
গ্রন্থের নাম:
শায়খ ছালেহ ইবনে মুক্ববিল আল-উছাইমী বলেন, আমি এ গ্রন্থের তিনটি নাম পেয়েছি— (১) আত-তাওহীদ। (২) আল-ইবানাহ ফী উছূলিদ দিয়ানাহ। (৩) আল-ইবানাহ আন উছূলিদ দিয়ানাহ।
এরপর শায়খ উছাইমী বলেন, দ্বিতীয় ও তৃতীয় নামের মাঝে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। আর প্রথম তথা ‘আত-তাওহীদ’ নামের ব্যাপারে বলেন, ‘সম্ভবত কোনো পাণ্ডুলিপিকার এ নাম ব্যবহার করেছেন। কারণ, ‘আন উছূলিদ দিয়ানাহ’ বাক্যের অর্থপ্রকাশক শব্দ ‘আত-তাওহীদ’। তাই পাণ্ডুলিপিকার বইটির নাম সংক্ষিপ্ত করে ‘আত-তাওহীদ’ উল্লেখ করেছেন’।[1]
যারা এ গ্রন্থ ইমাম আশআরীর বলে সাব্যস্ত করেছেন:
‘আল-ইবানাহ’ কিতাবের মতো এমন কোনো কিতাব পাওয়া দুষ্কর, যে কিতাব এত সংখ্যক আলেম ইমাম আশআরীর দিকে সম্পৃক্ত করেছেন। অসংখ্য আলেম সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, ইমাম আশআরী ‘আল-ইবানাহ’ গ্রন্থ সংকলন করেন। নিম্নে কয়েকজন ইমাম, আলেম ও গবেষকের নাম উল্লেখ করা হলো, যারা এ গ্রন্থকে ইমাম আশআরীর বলে সাব্যস্ত করেছেন—
(১) হাফেয ইবনে আসাকির। সর্বপ্রথম তার নাম উল্লেখ করা হলো। কেননা ইমাম আশআরীর ব্যাপারে তার গভীর জ্ঞান ও তার দিকে নিজেকে সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। বরং তিনি তার মর্যাদা নিয়ে ও তার পক্ষাবলম্বন করে একটি গ্রন্থ লিখেন। তিনি তার ‘তাবয়ীনু কাযিবিল মুফতারী’ গ্রন্থের একাধিক স্থানে এ গ্রন্থের কথা বলেছেন।[2] (২) নাছরুদ্দীন আস-সিজযী।[3] (৩) শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়া।[4] (৪) ইবনে ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়্যাহ।[5] (৫) আবূ বকর বায়হাক্বী।[6] (৬) আবূ উছমান ইসমাঈল আছ-ছাবূনী।[7]
(৭) আবূ বকর আস-সামআনী।[8] (৮) আহমাদ ইবনে ছাবেত আত-তরক্বী।[9] (৯) আবুল মাআলী মুজাল্লী।[10] (১০) আবূ মুহাম্মাদ ইবনুত্ব ত্বব্বাখ।[11] (১১) ইমাম নববী।[12] (১২) কাযী আবূ বকর আল-বাকিল্লানী। তিনি এ গ্রন্থের ব্যাখ্যা লিখেছেন।[13] (১৩) আবুল কাসেম আব্দুল মালেক ঈসা ইবনে দারবাস আশ-শাফেঈ।[14] (১৪) হাফেয আয-যাহাবী।[15] (১৫) হাফেয ইবনে কাছীর।[16] (১৬) আল-মাকরীযী।[17] (১৭) হাফেয ইবনে হাজার।[18] (১৮) ইবনুল ঈমাদ হাম্বালী।[19] (১৯) মুরতাযা আয-যাবীদী।[20] (২০) খালেদ আন-নাকশাবান্দী।[21] (২১) খায়রুদ্দীন আল-আলুসী।[22] (২২) আব্দুল আযীয ইবনে বায। তিনি এ গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন।[23] (২৩) মুহিব্বুদ্দীন আল-খত্বীব।[24] (২৪) মুহাম্মাদ ইবনে ছালেহ আল-উছায়মীন।[25] (২৫) মুহাম্মাদ যাহেদ কাওছারী।[26] (২৬) হামূদা গারাবাহ।[27] (২৭) জালাল মূসা।[28] (২৮) ছালেহ আল-ফাওযান।[29] (২৯) ইসমাঈল আল-আনছারী।[30] (৩০) হাফেয হাকামী।[31] (৩১) হাম্মাদ আল-আনছারী।[32] (৩২) ড. আব্দুর রহমান আল-মাহমূদ।[33] (৩৩) ড. ফারূক্ব আদ-দাসুকী।[34] (৩৪) ড. ফাওকিয়া বিনত হুসাইন। তিনি এ গ্রন্থের তাহক্বীক্ব করেন। (৩৫) ড. মুহাম্মাদ ইবরাহীম আল-ফাইউমী।[35]
‘আল-ইবানাহ’ ইমাম আশআরীর শেষ গ্রন্থ:
ইমাম আশআরী প্রথমে মু‘তাযিলা ছিলেন, এরপর কুল্লাবিয়া মতবাদ গ্রহণ করেন এবং তৃতীয় স্তরে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর দিকে প্রত্যাবর্তন করেন; যদিও তার মাঝে কুল্লাবিয়া মতবাদের কিছুটা প্রভাব ছিল। তিনি এই তৃতীয় স্তরে এসে ‘আল-ইবানাহ’ গ্রন্থটি লিখেন এবং এটি তার শেষ গ্রন্থ। এ ব্যাপারে বেশ কিছু প্রমাণ—
১. ইবনে ফূরাক আল-ইবানাহ গ্রন্থটি সেসব গ্রন্থের মাঝে উল্লেখ করেননি, যা তিনি ৩২০ হিজরীর পূর্বে সংকলন করেন। কাজেই প্রমাণ হয়, তিনি এ গ্রন্থটি ৩২০ হিজরীর পর লিখেন। কেননা মু‘তাযিলা মতবাদ বর্জন করার পরপরই এ গ্রন্থ সংকলন করা অসম্ভব। তিনি যদি মু‘তাযিলা মতবাদ বর্জন করার পরপরই এ গ্রন্থ সংকলন করতেন, তাহলে তিনি এ গ্রন্থের কথা তিনি তার ‘আল-উমাদ’ গ্রন্থে উল্লেখ করতেন।
২. ইবনে আসাকির ইমাম আবুল হাসান আশআরীর মু‘তাযিলা মতবাদ বর্জনের ঘটনায় উল্লেখ করেছেন যে, তিনি মিম্বারে উঠার পর মানুষদেরকে ‘আল-লুমা’ গ্রন্থটি দেন। কাজেই এ ঘটনা থেকে প্রমাণ হয়, তিনি মু‘তাযিলা বর্জনের পরপরই ‘আল-লুমা’ গ্রন্থটি সংকলন করেন। অতএব, প্রমাণ হয়, ‘আল-ইবানাহ’ গ্রন্থটি ‘আল-লুমা’ গ্রন্থের পর লিখিত; মু‘তাযিলা মতবাদে বিশ্বাসী হওয়ার সময় নয়।
৩. এ বিষয়ে আরও শক্তিশালী দলীল হলো, হাম্বালী শায়খ ইমাম বারবাহারীর সাথে ইমাম আশআরীর কাহিনী। কাহিনীটি হলো— ইমাম আশআরী বাগদাদে আগমন করলে তিনি আবূ মুহাম্মাদ বারবাহারীর কাছে যান। তিনি তার কাছে গিয়ে বলেন, ‘আমি জুব্বায়ীর খণ্ডন করেছি। আমি অগ্নীপূজকদের খণ্ডন করেছি। আমি খ্রিষ্টানদের খণ্ডন করেছি’। তখন আবূ মুহাম্মাদ বারবাহারী বলেন, ‘আমি বুঝছি না, আপনি কী বলছেন? এগুলো কি কোনো কাজ? আমরা কেবল তাই জানি, যা ইমাম আহমাদ বলেছেন’। এরপর ইমাম আশআরী বের হয়ে ‘আল-ইবানাহ’ গ্রন্থ লিখেন। কিন্তু তিনি কবুল করেননি।[36] কাজেই এ ঘটনা প্রমাণ করে এটি শেষ গ্রন্থ।
৪. আমরা দেখতে পাই যে, ‘আল-ইবানাহ’ গ্রন্থে ইমাম আবুল হাসান আশআরী খাবারিয়া (কুরআন ও সুন্নাহতে বর্ণিত) ও আক্বলিয়া (বিবেকগত) আল্লাহর গুণাবলি সাব্যস্ত করেছেন; বরং আমরা দেখতে পাই তিনি এ গ্রন্থে কিতাব ও সুন্নাহর ওপর নির্ভর করেছেন এবং তাবীল বর্জন করেছেন। তিনি এ গ্রন্থে ইলমুল কালাম বিষয়ক কোনো আলোচনা করেননি; অথচ তিনি ‘আল-লুমা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এ থেকে প্রমাণ হয়, তিনি ইলমুল কালাম থেকে পর্যায়ক্রমে সরে আসেন। কেননা যখন তিনি ‘আল-লুমা’ গ্রন্থ সংকলন করেন, তখন আহলুল হাদীছের মানহাজের তুলনায় ইলমুল কালামে বেশি জ্ঞান রাখতেন। এ কারণে ‘আল-লুমা’ গ্রন্থটি আহলুল হাদীছের মানহাজের তুলনায় কালামপন্থিদের মানহাজের অধিক নিকটবর্তী।
৫. অনেক আলেম বলেছেন এটি তার শেষ গ্রন্থ। তাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হলেন—
(১) শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়া।[37] (২) আবুল কাসেম আব্দুল মালেক ঈসা ইবনে দারবাস আশ-শাফেঈ।[38] (৩) ইবনুল ঈমাদ হাম্বালী।[39] (৪) হাফেয ইবনে কাছীর।[40] (৫) নু‘মান আলুসী।[41] (৬) খালেদ আন-নাকশাবান্দী।[42] (৭) হাফেয হাকামী।[43] (৮) মুহিব্বুদ্দীন আল-খত্বীব।[44] (৯) ড. আব্দুর রহমান আল-মাহমূদ।[45] (১০) আব্দুল ফাত্তাহ আহমাদ।[46] (১১) আহমাদ ইবনে হাজার আলু বূতামী।[47] (১২) রাজেহ আল-কুরদী।[48]
(চলবেইনশা-আল্লাহ)
শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, বীরহাটাব-হাটাব, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।
[1]. শায়খ উছাইমী কর্তৃক তাহক্বীক্বকৃত ‘আল-ইবানাহ’ গ্রন্থ, পৃ. ১২৭
[2]. তাবয়ীনু কাযিবিল মুফতারী, পৃ. ১৭১, ১৫২, ৩৮৮-৩৮৯।
[3]. বায়ানু তালবীসিল জাহমিয়া, ১/১৪১-১৪২।
[4]. বায়ানু তালবীসিল জাহমিয়া, ১/১৩৬; মাজমূউল ফাতাওয়া, ৬/৩৫৯; দারউ তাআরুযিল আক্বল ওয়ান নাক্বল, ২/১৬।
[5]. ইজতিমাউল জুয়ূশ, পৃ. ১৬৭; আন-নূনিয়্যাহ, পৃ. ৬৯, ৭০; আস-সওয়াঈকুল মুরসালাহ, ১/২৬০।
[6]. আল-ই‘তিক্বাদ, পৃ. ২০৪, ২০৫।
[7]. তাবয়ীনু কাযিবিল মুফতারী, পৃ. ৩৮৯; বায়ানু তালবীসিল জাহমিয়া, ১/১৩৯।
[8]. বায়ানু তালবীসিল জাহমিয়া, ১/১৩৬।
[9]. বায়ানু তালবীসিল জাহমিয়া, ১/১৪০; আল-উলূ, ২/১২৪৯।
[10]. বায়ানু তালবীসিল জাহমিয়া, ১/১৪২।
[11]. বায়ানু তালবীসিল জাহমিয়া, ১/১৪২।
[12]. কিতাবুল উলূ লিয যাহাবী, ২/১২৪৮।
[13]. তবাকাতুল ফুক্বাহা আশ-শাফেঈন, ১/১৯৯।
[14]. রিসালাতুন ফিয যাব্বি আন আবিল হাসান আশআরী, পৃ. ১৩১।
[15]. কিতাবুল উলূ, ২/১২৪৮; কিতাবুল আরশ, ২/২৯৪, ২/২৯৮।
[16]. তবাকাতুল ফুক্বাহা আশ-শাফেঈন, ১/১৯৯।
[17]. কিতাবুল মাওয়াঈয ওয়াল ই‘তিবার, ৪/১৯৪।
[18]. লিসানুল মীযান, ১/৩৫৪।
[19]. শাযারাতুয যাহাব, ৪/১৩১।
[20]. ইতহাফুস সাদাহ, ২/৪।
[21]. জালাউল আইনাইন, পৃ. ১৫৭।
[22]. জালাউল আইনাইন, পৃ. ২৪৭।
[23]. আল-ইবানাহ, পৃ. ৪৩।
[24]. আল-মুনতাকা, পৃ. ৪৬।
[25]. আল-কাওয়াঈদুল মুসলা, পৃ. ৮০-৮১।
[26]. তাবয়ীনু কাযিবিল মুফতারী, পৃ. ৩৫-এর টীকা দ্রষ্টব্য।
[27]. আবুল হাসান আশআরী, পৃ. ৬৬; ‘আল-লুমা’ গ্রন্থের ভূমিকা, পৃ. ৭।
[28]. নাশআতুল আশআরী ওয়া তাতাওউরুহা, পৃ. ১৭০।
[29]. আল-ইবানাহ আন উছূলিদ দিয়ানাহ, পৃ. ৪।
[30]. আল-ইবানাহ আন উছূলিদ দিয়ানাহ, পৃ. ৪৫।
[31]. মাআরিজুল কবূল, পৃ. ৩১০।
[32]. আল-ইবানাহ আন উসূলিদ দিয়ানাহ, পৃ. ১৮।
[33]. মাওকিফু ইবনে তায়মিয়া মিনাল আশাঈরা, ১/৩৪৮।
[34]. আল-কাযা ওয়াল কাদর, ২/৩২৩।
[35]. তারীখুল ফিরাকিল ইসলামিয়্যাহ, পৃ. ৩৯।
[36]. সিয়ারু আলামিন নুবালা, ১৫/৯০; তবাকাতুল হানাবিলাহ, ২/১৮; আল-ওয়াফী, ১২/২৪৬; তাবয়ীনু কাযিবিল মুফতারী, পৃ. ৩৯০-৩৯১।
[37]. বায়ানু তালবীসিল জাহমিয়া, ১/১৩৬, ১৪৩; মাজমূউল ফাতাওয়া, ৬/৩৫৯, ৫/৯৩; দারউ তাআরুযিল আক্বল ওয়ান নাক্বল, ২/১৬।
[38]. রিসালাতুন ফিয যাব্বি আন আবিল হাসান আশআরী, পৃ. ১১৫।
[39]. তবাকাতুল ফুক্বাহা আশ-শাফেঈন, ১/১৯৯; ইতহাফুস সাদাহ, ২/৬।
[40]. শাযারাতুয যাহাব, ৪/১৩১।
[41]. জালাউল আইনাইন, পৃ. ৪৬২।
[42]. জালাউল আইনাইন, পৃ. ১৫৭।
[43]. মাআরিজুল কবূল, পৃ. ৩১০।
[44]. আল-মুনতাকা, পৃ. ৪৬।
[45]. মাওকিফু ইবনে তায়মিয়া মিনাল আশাঈরা, ১/৩৮৪।
[46]. আল-ফিরাকুল ইসলামিয়্যাহ, পৃ. ১৩২।
[47]. আল-আক্বাইদুস সালাফিয়্যাহ, পৃ. ১৫৭-১৫৮।
[48]. আলাকুত ছিফাতিল্লাহ ফিযাতিহ, পৃ. ১২৮।