সূরাতুল ক্বদর ও তার অনুবাদ: আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ - وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ - لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ - تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ - سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ
‘নিশ্চয় আমরা কুরআন নাযিল করেছি লায়লাতুল ক্বদরে। আর আপনাকে কীসে জানাবে লায়লাতুল ক্বদর কী? লায়লাতুল ক্বদর হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। সে রাতে ফেরেশতাগণ ও রূহ নাযিল হন তাদের রবের অনুমতিক্রমে প্রতিটি বিষয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে। শান্তিময় সে রাত, ফজরের আবির্ভাব পর্যন্ত’ (আল-ক্বদর, ৯৭/১-৫)।
সূরাটি নাযিলের পটভূমি:
(১) মুজাহিদ রাহিমাহুল্লাহ হতে বর্ণিত আছে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বানী ইসরাঈলের এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করে বলেন, ঐ লোকটি এক হাজার মাস পর্যন্ত আল্লাহর পথে অস্ত্র ধারণ করেছিল অর্থাৎ জিহাদে অংশ নিয়েছিল। মুসলিমরা এ কথা শুনে বিস্মিত হওয়ায় আল্লাহ তাআলা এ সূরাটি অবতীর্ণ করেন। আল্লাহ তাআলা জানিয়ে দেন যে, লায়লাতুল ক্বদরের ইবাদত ঐ ব্যক্তির এক হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম।[1]
(২) ইবনে জারীর রাহিমাহুল্লাহ মুজাহিদ রাহিমাহুল্লাহ হতে বর্ণনা করেছেন যে, বানী ইসরাঈলের একটি লোক সন্ধ্যা হতে সকাল পর্যন্ত আল্লাহর ইবাদতে লিপ্ত থাকতেন এবং দিনের বেলায় সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত দ্বীনের শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করতেন। এক হাজার মাস পর্যন্ত তিনি এইভাবে কাটিয়ে দেন। অতঃপর আল্লাহ তাআলা এই সূরা অবতীর্ণ করে তাঁর প্রিয় নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মতকে সুসংবাদ দেন যে, এই উম্মতের কোনো ব্যক্তি যদি লায়লাতুল ক্বদরে ইবাদত করে, তবে সে বানী ইসরাঈলের ঐ ইবাদতকারীর চেয়ে অধিক পুণ্য লাভ করবে।
(৩) আলী ইবনে উরওয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বানী ইসরাঈলের চারজন আবেদের কথা উল্লেখ করেন। তারা ৮০ বছর পর্যন্ত আল্লাহ তাআলার ইবাদত করেছিলেন। এই সময়ের মধ্যে ক্ষণিকের জন্য তারা আল্লাহর নাফরমানী করেননি। তাঁরা হলেন, আইয়ূব আলাইহিস সালাম, যাকারিয়া আলাইহিস সালাম, হাকীল ইবনে আ‘জয় আলাইহিস সালাম এবং ইউশা‘ ইবনে নুন আলাইহিস সালাম। ছাহাবীগণ রাযিয়াল্লাহু আনহু এ ঘটনা শুনে খুবই অবাক হলেন। তখন জিবরীল আলাইহিস সালাম রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে বললেন, হে মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনার উম্মত এই ঘটনায় বিস্ময়বোধ করেছেন। জেনে রাখুন, আল্লাহ তাআলা আপনার উপর এর চেয়েও উত্তম জিনিস দান করেছেন। আপনার উম্মত যে ব্যাপারে বিস্মিত হয়েছে এটা তার চেয়েও উত্তম। তারপর তিনি তাঁর কাছে এই সূরাটি পাঠ করলেন। এতে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ছাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত খুশী হন।[2]
লায়লাতুল ক্বদরের শ্রেষ্ঠত্ব ও গুরুত্ব:
লায়লাতুল ক্বদরের অনেক গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো-
(১) এ মহিমান্বিত রজনিতে কুরআন নাযিল হয়েছে। যেমনটি আল্লাহ তাআলা বলেন,إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ ‘নিশ্চয় আমরা কুরআন নাযিল করেছি লায়লাতুল ক্বদরে’ (আল-ক্বদর, ৯৭/১)। তিনি অন্যত্রে বলেন,شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ ‘রামাযান মাস— যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের পথপ্রদর্শক এবং হেদায়াত ও সত্য-মিথ্যার প্রভেদকারীর বিষয়ে সুস্পষ্ট বর্ণনারূপে। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস পাবে, সে যেন এ মাসে ছওম পালন করে’ (আল-বাক্বারা, ২/১৮৫)।
(২) এ রাত্রি হাজারো মাস থেকে উত্তম। অর্থাৎ লায়লাতুল ক্বদর নেই এমন হাজারো মাসে ইবাদতের চেয়ে এ এক রাত্রির ইবাদত অধিক উত্তম। আল্লাহ তাআলা বলেন,لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ ‘লায়লাতুল ক্বদর’ হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ’ (আল-ক্বদর, ৯৭/৩)।
রামাযান মাস আগমন করলে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাহাবীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘তোমাদের নিকট রামাযান আসন্ন। মুবারক মাস। আল্লাহ এর ছওম ফরয করেছেন। এতে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। শয়তানদেরকে জিঞ্জিরাবদ্ধ করা হয়। এতে এমন এক রাত রয়েছে, যা হাজার মাস থেকেও উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাত্রির কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো, সে যাবতীয় কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো’।[3]
(৩) এ রাতে সকল প্রকার কল্যাণ, বরকত ও রহমতসহকারে ফেরেশতাগণ নাযিল হন। আল্লাহ তাআলা বলেন, تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ ‘সে রাতে ফেরেস্তাগণ ও রূহ (জিবরীল) নাযিল হন তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে প্রতিটি বিষয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে’ (আল-ক্বদর, ৯৭/৪)।
(৪) সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত সারাটা রাত শুধু শান্তি আর শান্তি তথা কল্যাণে পরিপূর্ণ। সে রাত্রি সর্বপ্রকার অনিষ্ট থেকে মুক্ত। আল্লাহ তাআলা বলেন,سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ ‘শান্তিময় সে রাত, ফজরের আবির্ভাব পর্যন্ত’ (আল-ক্বদর, ৯৭/৫)।
(৫) এ রাত মহা বরকতময়। আর এ বরকত সূর্যাস্তের পর হতে ফজরের উদয় পর্যন্ত বিস্তৃত। আল্লাহ তাআলা বলেন, إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ ‘নিশ্চয়ই আমি এটা অবতীর্ণ করেছি এক মুবারক রজনিতে’ (আদ-দুখান, ৪৪/৩)।
(৬) এ রাতে সৃষ্টি সম্পর্কিত সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ফয়সালা স্থির করা হয়, যা পরবর্তী শবে ক্বদর পর্যন্ত এক বছরে সংঘটিত হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ ‘এ রাতে প্রতিটি প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থির করা হয়’ (আদ-দুখান, ৪৪/৪)।
(৭) যে ব্যক্তি এ রাত্রি জেগে আল্লাহর ইবাদত করবে, আল্লাহ তার পূর্বকৃত সব গুনাহ মাফ করে দিবেন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, مَنْ يَقُمْ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে নেকীর আশায় ক্বদরের রাতে ইবাদতের মধ্যে রাত্রি জাগবে, তার পূর্বের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে’।[4]
লায়লাতুল ক্বদরের ফযীলত:
রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জবানে লায়লাতুল ক্বদরের ফযীলত সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। যেমন—
(১) আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের নিকট রামাযান উপস্থিত হয়েছে, যা একটি বরকতময় মাস। তোমাদের উপরে আল্লাহ তাআলা এই মাসের ছওম ফরয করেছেন। এ মাসের আগমনে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়, আর আল্লাহর অবাধ্য শয়তানদের লোহার বেড়ি পরানো হয়। এ মাসে একটি রাত রয়েছে, যা এক হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম। যে ব্যক্তি সে রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেল, সে প্রকৃতই বঞ্চিত রয়ে গেল’।[5]
(২) আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে নেকীর আশায় ক্বদরের রাতে ইবাদতের মধ্যে রাত্রি জাগবে, তার পূর্বের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে’।[6]
সূরাতুল ক্বদর থেকে পথনির্দেশনা:
(১) এ সূরা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ মনোনীত একজন নবী ও রাসূল ছিলেন এবং তার কাছে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে অহী আসত।
(২) এ সূরা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ তাআলার ফয়সালা ও তাক্বদীরের ভালো-মন্দের প্রতি ঈমান রাখা ওয়াজিব।
(৩) এ সূরা থেকে সুস্পষ্টভাবে লায়লাতুল ক্বদরের মাহাত্ম্য ও তাতে ইবাদতের অনেক ফযীলত রয়েছে, তা প্রমাণিত হয়।
(৪) এ সূরা থেকে বুঝা যায় যে, কুরআনুল কারীম একত্রে রামাযান মাসেই লাওহে মাহফূয থেকে দুনিয়ার আসমানে নাযিল হয়েছে। আর এ নাযিল হয়েছিল রামাযান মাসে।
(৫) লায়লাতুল ক্বদরে বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করা ও শ্রবণ করা মুস্তাহাব। আল্লাহ তাআলা আমাদের এই রজনিতে বেশি বেশি আমল করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
মাহফুজুর রহমান বিন আব্দুস সাত্তার
কুল্লিয়া ১ম বর্ষ, মাদরাসা মুহাম্মাদীয়া আরাবীয়া, উত্তর যাত্রাবাড়ী, ঢাকা।
[1]. তাফসীরে কুরতুবী, সূরা আল-ক্বদর।
[2]. গ্রাগুক্ত।
[3]. নাসাঈ, হা/২১০৬।
[4]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৫।
[5]. নাসাঈ, হা/২১০৬।
[6]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৫।