খ্রিষ্টপূর্ব তিন হাজার বছর আগের কথা।*ফিলিস্তীনে জন্ম নিয়েছিলেন ইসহাক আলাইহিস সালাম, ইয়াকূব আলাইহিস সালাম, ইউসুফ আলাইহিস সালাম, যাকারিয়া আলাইহিস সালাম ও ঈসা আলাইহিস সালামসহ অনেক নবী ও রাসূল আলাইহিমুস সালাম। ফিলিস্তীনের পার্শ্ববর্তী দেশ জর্ডানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন নূহ আলাইহিস সালাম, লূত আলাইহিস সালাম ও আইঊব আলাইহিস সালাম। আরেক পার্শ্ববর্তী দেশ লেবাননে জন্ম নেন ছালেহ আলাইহিস সালাম। আর পাশের দেশ মিশরে জন্ম নেন মূসা, হারূন ও শুআইব আলাইহিস সালাম। এসকল নবী-রাসূল আলাইহিমুস সালাম ছিলেন সমসাময়িক যুগের পথপ্রদর্শক ও সংশ্লিষ্ট দেশের জনপ্রতিনিধি। ইতিহাস অধ্যয়নে জানা যায়, ইয়াকূব আলাইহিস সালাম-এর বংশধরেরা খ্রিষ্টপূর্ব ১৩শ বছর যাবতকাল ফিলিস্তীন শাসন করতেন। দাঊদ আলাইহিস সালাম তাঁর শাসনামলে জেরুজালেমে বায়তুল মুক্বাদ্দাস নির্মাণ কাজ শুরু করেছিলেন। আর তাঁর পুত্র সুলায়মান আলাইহিস সালাম নির্মাণ কাজ শেষ করেছিলেন। এ মসজিদেই মি‘রাজের রজনীতে সকল নবীর আগমন ঘটেছিল। আর শেষ নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইমামতিতে ছালাত অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দাঊদ আলাইহিস সালাম-এর মৃত্যুর পর ফিলিস্তীনের শাসনভার গ্রহণ করেন তাঁরই পুত্র সুলায়মান আলাইহিস সালাম। আর এতসব কারণেই ফিলিস্তীন, জেরুজালেম ও বায়তুল মুক্বাদ্দাস মুসলিমবিশ্বে পূণ্যভূমি হিসেবে পরিচিত। নবী সুলায়মান আলাইহিস সালাম-এর পরে ইতিহাসের গতিধারায় ফিলিস্তীনে ইয়াহূদী, খ্রিষ্টান ও মুসলিমরা বসবাস করতে থাকে। কিন্তু ইয়াহূদীরা তাদের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে অন্যদেরকে পাত্তা না দিয়ে নিজেরা জুদাহ নামে একটি রাষ্ট্র গঠন করে। জেরুজালেমকে তারা রাজধানী ঘোষণা করে। এতে খ্রিষ্টান এবং মুসলিমগণ ক্ষুব্দ হয়ে ওঠে। ১৩২ সালে খ্রিষ্টান রাজা কনস্টানটিন (রোমান সম্রাট) ইয়াহূদীদেরকে জেরুজালেম থেকে বিতাড়িত করে। ফিলিস্তীন ঈসা আলাইহিস সালাম-এর জন্মভূমি হওয়ার কারণে খ্রিষ্টানদের কাছে সেটি হয়ে ওঠে বিশেষ পূণ্যভূমি। অবশ্য সপ্তম শতাব্দীতে রোমানরা মুসলিমদের কাছে পরাজিত হয়। ফিলিস্তীন চলে আসে আবার মুসলিম শাসনের অধীনে। এ সময় থেকে পরবর্তী ১২০০ বছর পর্যন্ত ফিলিস্তীন ছিল স্বাধীন এক মুসলিম জাতিরাষ্ট্রের নাম। হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন ইয়াহূদী এ সময় ফিলিস্তীনে বসবাস করত। রোমানদের কাছে পরাজিত হয়ে ইয়াহূদীরা ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। নীতিভ্রষ্টতার কারণে কোনো দেশেই তাদের
জায়গা হয়নি। ভূমিহীন যাযাবর-রিফিউজি হিসেবে বিভিন্ন দেশের বস্তিতে তারা বসবাস করতে থাকে। সৃষ্টিলগ্নের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ইয়াহূদীদের স্থায়ী কোনো বসতভিটা ছিল না। তারা কোনো জাতির সাথেই মিলেমিশে বাস করতে পারেনি। তাই এভাবেই তারা নির্বাসিত জীবনযাপন করতে থাকে। ওদিকে সৃষ্টির শুরু থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ছিল প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। তাই ইউরোপ-আমেরিকার লোভাতুর দৃষ্টি ছিল এসব দেশের প্রতি। তাই পূর্ব থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে তাদের একটি মিত্র ও বন্ধু রাষ্ট্র গঠনের বাসনা ছিল। ওদিকে যাযাবরি জীবন থেকে মুক্তির জন্য ইয়াহূদীরাও একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা করতে থাকে। আর এ লক্ষ্যে তারা গড়ে তোলে ‘জায়নবাদি সংগঠন’। একদিকে ইউরোপ-আমেরিকার বাসনা, অন্যদিকে ইয়াহূদীদের পরিকল্পনা ত্বরান্বিত করতে থাকে ইয়াহূদী রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তুতি।
সপ্তম শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী। দীর্ঘ ১২০০ বছর। সুদীর্ঘ এ সময় পর্যন্ত ফিলিস্তীন বাংলাদেশের ন্যায় একটি মুসলিম জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে পরিচিত ছিল। সেখানে মুসলিমদের পাশাপাশি খ্রিষ্টান এবং স্বল্পসংখ্যক ইয়াহূদীও বসবাস করত। ১৮৭৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তীনে ইয়াহূদীদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩.২ শতাংশ। ১৯১৪ সালে সংঘটিত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ফিলিস্তীন ছিল উছমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে। আর উছমানীয় সাম্রাজ্য ছিল ব্রিটিশ বলয়ের বিরুদ্ধে। এ যুদ্ধে ব্রিটিশবলয় বিজয়ী হয়। ফলে উছমানীয় সাম্রাজ্য ভেঙে যায়। আর ফিলিস্তীন চলে যায় ব্রিটিশদের অধীনে। ১৯১৭ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশকর্তৃক ফিলিস্তীন শোষিত হয়। ব্রিটিশরা ফিলিস্তীনিদেরকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দেওয়ার মিথ্যা আশ্বাস দেয়। এ আশ্বাসের উদ্দেশ্য ছিল ফিলিস্তীনে তাদের শাসনসীমা দীর্ঘায়িত করে ইয়াহূদীদেরকে প্রতিষ্ঠিত করা। এরই মধ্যে যুদ্ধ চলমান অবস্থায় ইয়াহূদী বিজ্ঞানী ড. হেইস বেইজম্যান দুর্লভ বোমা তৈরি করেন, যা ব্রিটিশদের যুদ্ধজয়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এ ভূমিকার উপহারস্বরূপ ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেলফোর ফিলিস্তীনকে ইয়াহূদীদের হাতে তুলে দেওয়ার জোর প্রস্তুতি নিতে থাকে। শুরু হয় ইয়াহূদী বসতি স্থাপনের কার্যক্রম। ১৯২২ সালে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে জাহাজ ভর্তি ইয়াহূদীরা ফিলিস্তীনে আসতে শুরু করে। আর তাদেরকে পুনর্বাসন করতে অর্থযোগান দিতে থাকে ব্রিটিশরা। এ দীর্ঘ সময়ে ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি ফিলিস্তীনকে আরব ও মুসলিম শূন্য করার কাজটি ভালোভাবে সেরে নেয়। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশরা ফিলিস্তীন ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু ততদিনে ইয়াহূদীরা ফিলিস্তীনের মাটির গভীরে শিকড় গেড়ে বসে। ১৯১৮ সালে ইয়াহূদীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০ হাজারে উন্নীত হয়। ১৯২৩ সালে এ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৩৫ হাজারে। ১৯৩১ সালে এ সংখ্যা এসে পৌঁছায় ১ লাখ ৮০ হাজারে। আর ১৯৪৮ সালে এ সংখ্যাটি উন্নীত হয় ৬ লাখে। ঠিক এ দীর্ঘ সময় ধরে ইয়াহূদীরা ব্রিটিশদের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত শক্তিশালী সন্ত্রাসী সংগঠন গড়ে তোলে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চলতে থাকে ফিলিস্তীনি মুসলিমদের উচ্ছেদ অভিযান। আর দ্রুততার সাথে চলতে থাকে ইয়াহূদীদের বসতিস্থাপন। ফলশ্রুতিতে ২০ লাখ বসতির মধ্যে ইয়াহূদীর সংখ্যা দাঁড়ায় গিয়ে ৬ লাখে। এভাবে স্বাধীন ইয়াহূদী রাষ্ট্র গঠনের কাজ এগিয়ে যেতে থাকে দ্রুতগতিতে। অবৈধ ও অযৌক্তিক রাষ্ট্রটি আন্তর্জাতিক বৈধতা পেতে জোর লবিং চালাতে থাকে। ওদিকে ১৪ মে ১৯৪৮ ফিলিস্তীন থেকে ব্রিটিশ রাজত্ব শেষ হওয়ার কথা। সুতরাং যা করবার করতে হবে অতি দ্রুত। ইয়াহূদী-ব্রিটিশের জোর লবিং বিষয়টিকে নিয়ে যায় তাই জাতিসংঘে। আর ব্রিটিশ-আমেরিকা নিয়ন্ত্রিত জাতিসংঘ ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তীন নিয়ে ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’ প্রস্তাব পাশ করে। প্রাচীন ফিলিস্তীন ভেঙে তৈরি হয় ফিলিস্তীন ও ইসরাঈল। ভারত, পাকিস্তান ও ইরান এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। কানাডা, চেকোস্লাভাকিয়া, পেরু, গুয়েতেমালা, নেদারল্যান্ড, রাশিয়া, আমেরিকা ও উরুগুয়ে ফিলিস্তীনকে বিভক্ত করার পক্ষে প্রস্তাব দেয়। মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ হয়েও ৫৭% ভূমি পায় ইয়াহূদীরা। আর ৪৩% পায় ফিলিস্তীনিরা। এভাবেই পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত জাতিসংঘের মাধ্যমে পাশ হয়ে যায় একটি অবৈধ ও অযৌক্তিক প্রস্তাব। প্রতিষ্ঠিত হয় একটি অবৈধ রাষ্ট্র।
এ সিদ্ধান্তের পরপরই ফিলিস্তীনে নেমে আসে ইয়াহূদীদের ভয়াবহ আগ্রাসন। এ আগ্রাসনে তিন মাসেই নিহত হয় ১৭০০ মুসলিম। দিনে দিনে বেড়েই চলে তাদের নিষ্ঠুরতা। একটি দিনের জন্যও শান্তিতে ঘুমাতে পারেনি নিরীহ-নিরস্ত্র ফিলিস্তীনিরা। এ নির্মমতার মধ্যেই ইয়াহূদীরা ইসরাঈলের স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়। ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে, রাত তখন ১২টা ১ মিনিট। ইসরাঈলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে ইয়াহূদী নেতা দাভিদ বেনগুরিয়ান। এ ঘোষণার মাত্র ১০ মিনিট পর ইসরাঈলকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রদান করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুমান। অতঃপর স্বীকৃতি দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন ও রাশিয়া। এ স্বীকৃতির ঠিক ১ ঘণ্টার মধ্যেই আরব-ইসরাঈল যুদ্ধ শুরু হয়। ইয়াহূদী সৈন্যরা ফিলিস্তীনের ৫০০টি গ্রামের ৪০০টিই জনশূন্য করে দেয়। ইয়াহূদী, ফরাসি আর ব্রিটিশ শক্তির কাছে সমন্বয়হীন এবং নেতৃত্বশূন্য আরবরা যুদ্ধে পরাজিত হয়। সম্পূর্ণ ফিলিস্তীন দখল করে নেয় ইসরাঈল। ফিলিস্তীনের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ শরণার্থীতে পরিণত হয়। সাত লক্ষ মুসলিম বাড়িছাড়া হয়। তারা লেবানন, সঊদী আরব, মিশরসহ বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসেবে জীবনযাপন করে। আজও তারা ফিরে পায়নি তাদের বাড়ি-ঘর। সেই থেকে ফিলিস্তীনিরা আজও পর্যন্ত নিজ দেশে হয়ে আছে পরবাসী। আন্তর্জাতিক সকল রীতি-নীতি উপেক্ষা করে ইসরাঈল প্রতিনিয়ত নির্মাণ করেই চলছে দেয়াল। চালিয়ে যাচ্ছে তাদের আগ্রাসী অভিযান। অব্যাহত রেখেছে তাদের উচ্ছেদ অভিযান। জবরদখল আর নৃশংসতায় ফিলিস্তীন এখন পরিণত হয়েছে এক ভয়ংকর মৃত্যুকূপে। আর রামাযান মাস আসলেই ইসরাঈল মুসলিমদের উপর তাদের এ নৃশংসতা বাড়িয়ে দেয়। গত ১০ মে ২৬শে রামাযান ইসরাঈল ফিলিস্তীনিদের উপর ব্যাপক হামলা শুরু করে। এ হামলা চলে টানা ১১ দিন। আর এতে প্রাণ হারায় ২৩২ জন শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও তরুণ-তরুণী। আর বরাবরের মতো এ হামলা ছিল এক তরফা। এক তরফা এ হামলায় ঈদের দিনেও নিহত হয়েছে ১৯ জন ফিলিস্তীনি। এর প্রতিবাদে বিশ্ববাসী শুধু নিন্দা করেই শেষ। ঘটেছে সাময়িক যুদ্ধবিরতি। এমন নিন্দা আর যুদ্ধবিরতি নতুন নয়। হামলা আর যুদ্ধবিরতির ঘটনা ১৯৪৮ থেকেই চলমান। বিশ্বনেতাদের নিন্দায় ফিলিস্তীনিরা পায় না তাদের অধিকার ও প্রতিকার। মুসলিমরা কোনোদিন পায়নি কোনো সুবিচার।
এটাই হলো প্রাচীন মুসলিম ফিলিস্তীনের বর্তমান নির্মম বাস্তবতা। ফিলিস্তীনিদের মাটিতে জাতিসংঘ জায়গা করে দিল ইয়াহূদীদের। কিন্তু ফিলিস্তীনিদের প্রতিশ্রুত রাষ্ট্রটি আজও প্রতিষ্ঠিত হলো না। ১৯৭৪ সাল থেকে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মর্যাদায় আছে ফিলিস্তীন ভূখণ্ডটি। স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা ফিলিস্তীন আজও পায়নি। ফিলিস্তীনিদের দাবি হলো, তাদের দেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা ও স্বীকৃতি দেওয়া হোক। জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রের পদ দেওয়া হোক। যাতে করে দেশটি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। জাতিসংঘের কোনো প্রস্তাবের পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দিতে পারে। জাতিসংঘের নির্বাহী পদে নিজেদের প্রার্থী দাঁড় করাতে পারে। তারা শুধু ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক বণ্টিত ৪৩% ভূমিটুকুই ফেরত চায়। যার সবটুকুই ইসরাঈল তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। আর এ ভূমিটুকু ফেরত পেতে প্রয়োজন জাতিসংঘের সদিচ্ছা। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের নূন্যতম ৯টি রাষ্ট্র ভোট দিলেই কেবল এই মর্যাদা অর্জন করবে ফিলিস্তীন। নিরাপত্তা পরিষদে ভোটের ক্ষমতাসম্পন্ন পাঁচটি স্থায়ী সদস্যরাষ্ট্র হলো : যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীন। বাকি অস্থায়ী দশটি রাষ্ট্র হলো : ভারত, জার্মানি, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, পর্তুগাল, লেবানন, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, নাইজেরিয়া ও কলম্বিয়া। অর্থাৎ স্বাধীন ফিলিস্তীন রাষ্ট্রেরর মর্যাদা পেতে হলে— (১) উল্লেখিত ১৪টি রাষ্ট্রের মধ্য হতে ৯টি রাষ্ট্রের ভোট পেতে হবে। (২) স্থায়ী ৫ সদস্য রাষ্ট্রের কোনো একটি সদস্য দেশ ভেটো দেবে না। (৩) নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত এ প্রস্তাব সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত হবে। (৪) সাধারণ পরিষদের ১৯৩টি রাষ্ট্রের মধ্যে ১২৮টি রাষ্ট্রের সমর্থন পেতে হবে। তবেই কেবল ফিলিস্তীন একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা পাবে। আর এ মর্যাদা পেতে দীর্ঘ ৭৩ বছর ধরে রক্ত ঝরাচ্ছে ফিলিস্তীনিরা। ফিলিস্তীনিদের এ দাবি নিরাপত্তা পরিষদে আটকে আছে ১৯৪৮ সাল থেকে। অবশ্য ফিলিস্তীনকে পূর্ণ সদস্য পদ দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। আর তাতে ক্ষেপে গিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছে সংস্থাটি। বার্ষিক ৬ কোটি ডলার তহবিল বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যা ইউনেস্কোর বার্ষিক বাজেটের এক-পঞ্চমাংশ। অথচ সদস্যপদ দেওয়া বিষয়ে ইউনেস্কোতে ১৭৩টি দেশের মধ্যে ফিলিস্তীনের পক্ষে ভোট পড়ে ১০৭টি। বিপক্ষে পড়ে ১৪টি। ভোটদানে বিরত থাকে ৫২টি দেশ। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও জার্মানি সদস্যপদের বিরোধিতা করে ভোট দেয়। অন্যদিকে ফিলিস্তীনের দাবির সমর্থনে ভোট দেয় ব্রাজিল, চীন, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা। আর ব্রিটেন থাকে নিরপেক্ষ অবস্থানে। মূলত ফিলিস্তীন ইসরাঈলের উচ্ছেদ চায় না। তারা শুধু বাঁচতে চায়। ইসরাঈলের উচ্ছেদ মানেই হলো ইউরোপ-আমেরিকা মহাদেশের উচ্ছেদ। এটা বিশ্বের কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। এছাড়া ইসরাঈল একটি পারমানবিক শক্তিধর দেশ। তাদের রয়েছে বোমারু বিমান, মিসাইল বোট, পেট্রোল বোট, সাবমেরিন ইত্যাদি। এর বিপরীতে ফিলিস্তীনের গুলতি, পাথর আর কিছু মাছ ধরার নৌকা ছাড়া কিছুই নেই। বিগত সাত দশকের অধিক সময় ধরে উচ্ছেদ অভিযানে নিষ্পেষিত ফিলিস্তীনিরা এখন বড়ই ক্লান্ত। আকাশপথে ঝাকে ঝাকে বোমারু বিমানের হামলা, স্থলপথে ট্যাংক, গানবোট আর কামানের গোলাবর্ষণে প্রতিনিয়ত উড়ে যাচ্ছে ফিলিস্তীনিদের হাত, পা, চোখ ও কান। থেতলে যাচ্ছে তাদের মাথা। আর ঝলসে যাচ্ছে দেহ ও মুখ। ১০ তলা ভবন নিমিষেই মিশে যাচ্ছে মাটির সাথে। প্রতিদিনের মিডিয়ায় ভেসে আসছে ফিলিস্তীনি অবুঝ শিশুদের নিষ্পাপ আর্তনাদ। অথচ ৮০০ কোটি বিশ্ববিবেক চুপচাপ। প্রতিবাদী পাথর কিংবা গুলতিটাই ছরবের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশ্বমিডিয়ায়। সেখানেই ষড়যন্ত্র আর সন্ত্রাস খুঁজে ফিরে চলছে পশ্চিমা মিডিয়া। আর ঝাকবাঁধা বোমারু বিমান, ট্যাংক আর কামানের হামলা সেখানে ইসরাঈলের আত্মরক্ষার অধিকার! হায়রে মানবতা! হায়রে বিশ্ববিবেক! হায়রে জাতিসংঘ! বিশ্ববিবেকের কাছে প্রশ্ন হলো, পৃথিবীর মোট আয়তন ৫১,০০৯৮,৫২০ বর্গকিমি। আর স্থলভাগের আয়তন ১৪,৮৯,৫০,৩২০ বর্গকিমি। আর বিশ্বের মোট জনসংখ্যা ৭৭১ কোটি। ফিলিস্তীনের আয়তন ৬,০২০ কিমি। আর জনসংখ্যা ৫১ লাখ। এতবড় বিশাল পৃথিবীতে এই সামান্য ৫১ লাখ ফিলিস্তীনের কি বাঁচবার অধিকার নাই? জাতিসংঘের কাছে প্রশ্ন— কোন কারণে ভূমিহীন-যাযাবর ইয়াহূদীজাতিকে পরের জায়গায় অন্যায়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হলো? ফিলিস্তীনিদের মাটিতে কেন তাদের ভাগ দেওয়া হলো? এর পিছনে কী কারণ থাকতে পারে? কারণটা কি তাহলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মানবিক, না-কি ধর্মীয়? ঠিক যে কারণে অবৈধভাবে ইয়াহূদীদের প্রতিষ্ঠিত করা হলো, ঐ একই কারণে ফিলিস্তীনিদেরও দিতে হবে তাদের বৈধ স্বাধিকার। দিতে হবে তাদের ন্যায্য স্বাধীনতা। ফিরিয়ে দিতে হবে তাদের স্বাধীন রাষ্ট্র। আর এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে হবে মুসলিমবিশ্বকে। ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে আরববিশ্বকে। স্বজাতির করুণ আর্তনাদে দীপ্ত ও সাহসী হতে হবে। জাতীয় চেতনায় হতে হবে উজ্জীবিত। চাপ প্রয়োগ করতে হবে জাতিসংঘকে। নিশ্চিত করতে হবে স্বাধীন ফিলিস্তীনের। প্রতিষ্ঠিত করতে ফিলিস্তীনিদের নিরাপত্তা। আর এ দায়িত্ব নিতে হবে জাতিসংঘকেই। অংশগ্রহণ থাকতে হবে আরববিশ্বসহ গোটা মুসলিমবিশ্বের। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
* অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।