(নয়) আল্লাহ তাআলা বলেন,وَإِذَا مَا أُنْزِلَتْ سُورَةٌ نَظَرَ بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ هَلْ يَرَاكُمْ مِنْ أَحَدٍ ثُمَّ انْصَرَفُوا صَرَفَ اللَّهُ قُلُوبَهُمْ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَا يَفْقَهُونَ ‘আর যখনই কোনো সূরা নাযিল করা হয়, তারা একে অপরের দিকে তাকায়। (এবং বলে,) ‘তোমাদেরকে কি কেউ দেখছে’? অতঃপর তারা (চুপিসারে) প্রস্থান করে। আল্লাহ তাদের হৃদয়কে সত্যবিমুখ করে দেন একারণে যে, তারা বোধশক্তিহীন সম্প্রদায়’ (আত-তওবা, ৯/১২৭)। কোনো একটি সূরা নাযিল হলে ঐ সূরার প্রতি আমল ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় হয়ে মুনাফেক্বরা একে অপরের দিকে দৃষ্টি দেয় এবং মুমিনদের চোখের আড়াল হওয়ার সুযোগের অপেক্ষা করে। অতঃপর পলায়ন করে চলে যায় এবং বিমুখ হয়ে ফিরে যায়। তাই তাদের কাজের ধরন থেকেই আল্লাহ তাদের শাস্তির প্রতিদান দেন। সুতরাং যখনই তারা আমল পরিত্যাগ করে, আল্লাহ তাদের অন্তরগুলো পরিবর্তন করে দেন, হক্ব থেকে বিরত রাখেন এবং বিনা সাহায্যে ছেড়ে দেন। কারণ তারা তৃণমূল জাতি তাদের উপকার সাধন করে এমন কোনো বুঝই তারা বুঝে না। কেননা যদি তারা বুঝতই, তাহলে যখন কোনো সূরা নাযিল হতো তারা তার প্রতি ঈমান আনত এবং তাঁর আদেশের নিকট অনুগত থাকত’।[1] যেমনটি আল্লাহ তাআলা বলেন,وَمِنْهُمْ مَنْ يَسْتَمِعُ إِلَيْكَ حَتَّى إِذَا خَرَجُوا مِنْ عِنْدِكَ قَالُوا لِلَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ مَاذَا قَالَ آنِفًا أُولَئِكَ الَّذِينَ طَبَعَ اللهُ عَلَى قُلُوبِهِمْ وَاتَّبَعُوا أَهْوَاءَهُمْ ‘আর তাদের মধ্যে এমন কতক রয়েছে, যারা তোমার প্রতি মনোযোগ দিয়ে শোনে। অবশেষে যখন তারা তোমার কাছ থেকে বের হয়ে যায়, তখন তারা যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে তাদের উদ্দেশ্যে বলে, ‘এইমাত্র সে কী বলল?’ এরাই তারা, যাদের অন্তরসমূহে আল্লাহ মোহর মেরে দিয়েছেন এবং তারা নিজেদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করেছে’ (মুহাম্মাদ, ৪৭/১৬)। তিনি অন্যত্র বলেন,أَفَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ وَأَضَلَّهُ اللَّهُ عَلَى عِلْمٍ وَخَتَمَ عَلَى سَمْعِهِ وَقَلْبِهِ وَجَعَلَ عَلَى بَصَرِهِ غِشَاوَةً فَمَنْ يَهْدِيهِ مِنْ بَعْدِ اللَّهِ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ ‘তবে আপনি কি লক্ষ্য করেছেন, যে তার প্রবৃত্তিকে আপন ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে? তার কাছে জ্ঞান আসার পর আল্লাহ তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন এবং তিনি তার কান ও অন্তরে মোহর মেরে দিয়েছেন। আর তার চোখের উপর স্থাপন করেছেন আবরণ। অতএব, আল্লাহর পর কে তাকে হেদায়াত করবে? তারপরও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?’ (আল-জাছিয়া, ৪৫/২৩)।
(দশ) নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,تِلْكَ صَلاَةُ الْمُنَافِقِ يَجْلِسُ يَرْقُبُ الشَّمْسَ حَتَّى إِذَا كَانَتْ بَيْنَ قَرْنَىِ الشَّيْطَانِ قَامَ فَنَقَرَهَا أَرْبَعًا لاَ يَذْكُرُ اللهَ فِيهَا إِلاَّ قَلِيلاً ‘ঐ ছালাত হলো মুনাফেক্বের ছালাত, যে বসে বসে সূর্যের প্রতি তাকাতে থাকে আর যখন তা ডুবতে বসে, তখন উঠে গিয়ে চার বার ঠোকর মেরে আসে। এভাবে সে আল্লাহকে কমই স্মরণ করতে পারে’।[2] এই হাদীছে মুনাফেক্বের দু’টি বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে। নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো—
(১) ছালাত বিলম্ব করে আদায় করা। (২) ঠোকর মেরে ছালাত আদায় করা এবং ছালাতে অল্পই আল্লাহকে স্মরণ করা।
(এগারো) রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,إِنَّ أَثْقَلَ صَلاَةٍ عَلَى الْمُنَافِقِينَ صَلاَةُ الْعِشَاءِ وَصَلاَةُ الْفَجْرِ وَلَوْ يَعْلَمُونَ مَا فِيهِمَا لأَتَوْهُمَا وَلَوْ حَبْوًا ‘এশা ও ফজরের ছালাত আদায় করা মুনাফেক্বের জন্য সর্বাপেক্ষা কঠিন। তারা যদি জানত যে, এ দু’টি ছালাতের পুরস্কার বা ছওয়াব কত, তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে বুক হেঁচড়ে হলেও তারা এ দুই ওয়াক্ত (ছালাত) জামাআতে উপস্তিত হত’।[3] হাদীছটিতে সংক্ষিপ্ত পরিসরে মুনাফেক্বদের নিম্নবর্ণিত বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রকাশ পেয়েছে:
(১) তারা ঈমানের দাবি করে অথচ তারা মিথ্যাবাদী। (২) তারা আল্লাহকে ও যারা ঈমান এনেছে, তাদেরকে ধোঁকা দেয়। বস্তুত শুধু তারা নিজেদেরকেই ধোঁকা দেয়। (৩) তাদের অন্তরে ব্যাধি আছে। তাই আল্লাহ তাদের ব্যাধি আরো বৃদ্ধি করেন। (৪) তারা সংশোধন-সংস্কারের দাবি করে। অথচ তারাই বিশৃঙ্খলাকারী। (৫) তারা মুমিনদের নির্বোধ হওয়ার অভিযোগ করে। (৬) তারা মুমিনদের নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে ও তাদের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। (৭) হেদায়াতের বিনিময়ে তারা ভ্রষ্টতা ক্রয় করে। (৮) তাদের কথা সুন্দর অথচ তারা প্রচণ্ড ঝগড়াটে। (৯) তাদের অন্তরে যা আছে তার উপর তারা আল্লাহকে সাক্ষী রাখে, অথচ তারা মিথ্যাবাদী। (১০) বাতিল পন্থায় বিতর্কে পারদর্শী। (১১) মানুষের থেকে আড়াল হলেই বাতিলের মধ্যে চেষ্টা চালায়। (১২) যখন তাদের বলা হয়, আল্লাহকে ভয় করো, তখন আত্মগরিমা তাদেরকে অধিকতর পাপে লিপ্ত করে। (১৩) তারা কাফেরদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তাদের সাহায্য করে ও তাদের সেবা করে। (১৪) তারা কাফেরদের নিয়ে গর্ব করে এবং তাদের মাধ্যমে সাহায্য নেয়। (১৫) ছালাতে যখন দাঁড়ায়, অলস অবস্থায় দাঁড়ায়। (১৬) তারা মানুষদেরকে তাদের আমলগুলো দেখায়। (১৭) তারা কমই আল্লাহকে স্মরণ করে। (১৮) তারা মুমিন ও কাফেরদের মাঝে দোদুল্যমান থাকে। (১৯) তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অবিশ্বাস করে। (২০) মুনাফেক্বরাই ফাসেক্ব বা আল্লাহর আনুগত্য-বিচ্যুত। (২১) অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও (বাধ্য হয়ে) তারা দান করে। (২২) মুনাফেক্বরা একে অপরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে। (২৩) তারা তাদের হাতগুলোকে গুটিয়ে রাখে, তাই তারা কল্যাণের পথে ব্যয় করে না। (২৪) তারা অসৎকাজের আদেশ দেয় এবং সৎকাজ হতে বাঁধা দেয়। (২৫) তারা আল্লাহকে ভুলে থাকে। তাই আল্লাহ তাদের ভুলে যান। (২৬) মুমিনদের মধ্যে যারা স্বেচ্ছায় অতিরিক্ত দান করে, তাদের কটাক্ষ করে। (২৭) তারা ছালাতের সময় হতে বিলম্ব করে ছালাত আদায় করে। (২৮) তারা ঠোকর মেরে ছালাত আদায় করে এবং ছালাতে তারা কমই আল্লাহকে স্মরণ করে। (২৯) তাদের উপর সবচেয়ে কঠিন ও ভারী ছালাত হলো এশা ও ফজরের ছালাত। (৩০) তারা জামাআতের সঙ্গে ছালাত আদায় করা হতে বিলম্ব করে। (৩১) তাদের অন্তরসমূহ নিষ্ঠুর এবং বিবেকসমূহ অপূর্ণ। (৩২) তারা দ্বীন বা ধর্ম হিসেবে ইসলামের প্রতি সন্তুষ্ট নয়। (৩৩) তাদের কামনা-বাসনার সঙ্গে যেটুকু মিলে, সেটুকুই তারা দ্বীন বা ধর্ম থেকে গ্রহণ করে। (৩৪) তারা যা বলে, তা করে না। (৩৫) শান্তি বা যুদ্ধবিরতির সময় তারা বীরত্ব প্রকাশ করে। অথচ যুদ্ধক্ষেত্রে তারা ভীতু-কাপুরুষ। (৩৬) তারা একে অপরের বিরুদ্ধে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট বিচার নিয়ে যায় না। (৩৭) আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ফয়সালা থেকে তারা নিজেদের মধ্যে অসুবিধা ও সংকীর্ণতা পায়। (৩৮) তারা মুমিনদের জিহাদ করতে বলে না। (৩৯) আল্লাহর রহমত থেকে তারা নিরাশ হয় এবং তাঁর সাহায্যের ব্যাপারে তাদের আশার অবসান হয়। (৪০) তারা তাদের জিহাদ দ্বারা দুনিয়াকে উদ্দেশ্য করে এবং যখন তারা এর থেকে নিরাশ হয়, তখন তারা জিহাদ না করে বসে থাকে। (৪১) ঝগড়া-বিতর্কের সময় তারা সত্যচ্যুত হয়। (৪২) তারা গোপন পন্থায় ও ইসলামের নাম দিয়ে ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। (৪৩) তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থগুলোই কেবল তারা গুরুত্ব দেয়। (৪৪) তারা একনিষ্ঠ আলেমদের ব্যাপারে মিথ্যা ও বাস্তবতা পরিবর্তনের দোষারোপ করে। (৪৫) তারা ইসলাম সম্পর্কে সন্দেহ-সংশয়ের উসকানি দেয়। যাতে মানুষদের ইসলামে প্রবেশ করা হতে বিরত রাখতে পারে। (৪৬) তারা দ্বীনের সাহায্যকারীদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। (৪৭) কথাবার্তায় তারা মিথ্যা বলে। (৪৮) আল্লাহ, তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুমিনদের সাথে তারা খেয়ানত করে। (৪৯) তারা ওয়াদা ভঙ্গ করে। (৫০) তাদের প্রত্যেকের দুটি মুখ। মুমিনদের জন্য এক মুখ এবং দ্বীনের জন্য শত্রুদের জন্য আরেক মুখ। (৫১) তাদের উপকার দেয় এমন কিছু তারা বোধগম্য করে না, তাদের উপকার সাধন করে এমন কিছু তারা শুনে না এবং আল্লাহর যে সমস্ত আয়াত তাঁর ক্ষমতা প্রমাণ করে সেগুলোর দিকে তারা দৃষ্টি দেয় না। (৫২) তাদের কারো শপথ তাঁর কথার পূর্বে আসে। কারণ সে জানে মুমিনদের অন্তর তাঁর প্রতি আস্থা রাখে না। (৫৩) কল্যাণ হতে তাদের অন্তর অমনোযোগী এবং তাদের দেহগুলো তার দিকেই ছুটে যায়। (৫৪) তারা সবচেয়ে খারাপ অন্তরের এবং সবচেয়ে সুন্দর দেহের মানুষ। (৫৫) তারা নিফাক্বের (মুনাফেক্বীর) গোপন বিষয়গুলো গোপন করে। অতঃপর আল্লাহ তাদের মুখমণ্ডল ও তাদের যবানে সেগুলো প্রকাশ করেছেন। (৫৬) দুনিয়ার জন্য তারা চুক্তি ভঙ্গ করে। (৫৭) তারা কুরআনুল কারীম নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে।
এগুলো মুনাফেক্বদের বৈশিষ্ট্য। হে মুসলিম! আপনার নিকট মৃত্যু আসার পূর্বেই এগুলো থেকে সতর্ক হোন। এই বৈশিষ্ট্যগুলো উদাহরণস্বরূপ বলা হলো’।[4] আল্লাহর কুরআন ও নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ (হাদীছে) মুনাফেক্বদের অনেক বৈশিষ্ট্য আছে। দুনিয়াতে ও আখেরাতে আমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও সুস্থতা কামনা করি।
মূল : ড. সাঈদ ইবনু আলী ইবনে ওয়াহাফ আল-ক্বাহত্বানী রাহিমাহুল্লাহ
অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
নারায়ণপুর, নবাবগঞ্জ, দিনাজপুর।
[1]. আল্লামা সা‘দী, তায়সীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান, পৃ. ৩১৩।
[2]. ছহীহ মুসলিম, ‘মসজিদ ও ছালাতের স্থানসমূহ’ অধ্যায়, ‘আছরের ছালাত আগে আগে আদায় করা মুস্তাহাব’ অনুচ্ছেদ, ১/৪৩৪, হা/৬২২।
[3]. ছহীহ বুখারী, ‘আযান’ অধ্যায়, ‘এশার ছালাত জামাআতে আদায় করার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ, ১/১৮১, হা/৬৫৭; ছহীহ মুসলিম, ‘মসজিদ ও ছালাতের স্থানসমূহ’ অধ্যায়, ‘জামাআতে ছালাত আদায়ের ফযীলত এবং তা পরিত্যাগকারীর প্রতি কঠোরতা’ অনুচ্ছেদ, ১/৪৫১, হা/৬৫১।
[4]. ইবনুল ক্বাইয়িম, ছিফাতুল মুনাফেক্বীন, পৃ. ৪; ড. আব্দুল আযীয হুমায়দী, আল-মুনাফেকূনা ফিল কুরআনিল কারীম, পৃ. ৪৪১।