জুমআর দিন মুসলিমদের সাপ্তাহিক ঈদের দিন। কুরআন-হাদীছে এই দিনের বহু ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। এই দিনের বহু আদব রয়েছে, যা সঠিকভাবে পালনের মাধ্যমে আমরা ব্যাপক নেকী অর্জন করতে পারি। আলোচ্য প্রবন্ধে জুমআর দিনের আদব সম্পর্কে সংক্ষিপ্তাকারে আলোকপাত করা হলো—
১. জামাআতের সাথে ফজরের ছালাত আদায় করা : একজন মুসলিম হিসাবে আমাদের প্রত্যেককে ফজরের ছালাত আদায়ের মধ্য দিয়ে দিন শুরু করতে হয়। আর জুমআর দিন এ ক্ষেত্রে আমাদের বেশি সচেষ্ট হওয়া উচিত। আবূ উবাইদা ইবনুল জাররাহ রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, إِنَّ أَفْضَلَ الصَّلَوَاتِ صَلاةُ الصُّبْحِ يَوْمَ الْجُمُعَةِ فِي جَمَاعَةٍ ‘সবচেয়ে উত্তম ছালাত হলো জুমআর দিন ফজরের জামাআত সহকারে ছালাত’।[1]
২. সূরা আল-কাহফ তেলাওয়াত করা : জুমআর দিন সূরা আল-কাহফ তেলাওয়াত করা সুন্নাত। আবূ সাঈদ খুদরী রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَنْ قَرَأَ سُورَةَ الْكَهْفِ فِى يَوْمِ الْجُمُعَةِ أَضَاءَ لَهُ مِنَ النُّورِ مَا بَيْنَ الْجُمُعَتَيْنِ ‘যে ব্যক্তি জুমআর দিন সূরা আল-কাহফ পাঠ করবে, তার জন্য দুই জুমআর মধ্যবর্তীকাল জ্যোতির্ময় হবে’।[2]
৩. গোসল করা : জুমআর দিন গোসল করা সুন্নাত। ইবনু উমার রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,إِذَا جَاءَ أَحَدُكُمُ الجُمُعَةَ فَلْيَغْتَسِلْ ‘তোমাদের কেউ যখন জুমআতে আসার ইচ্ছা করবে, তখন সে যেন গোসল করে’।[3] অন্য হাদীছে এসেছে, আবূ সাঈদ খুদরী রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,غُسْلُ يَوْمِ الجُمُعَةِ وَاجِبٌ عَلَى كُلِّ مُحْتَلِمٍ ‘প্রত্যেক সাবালকের উপর জুমআর দিনের গোসল ওয়াজিব’।[4] তবে এখানে উল্লেখিত আদেশ থেকে গোসল ফরয সাব্যস্ত হবে না; বরং তার অর্থ হলো গোসল উত্তম। সামুরা রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, مَنْ تَوَضَّأَ يَوْمَ الجُمُعَةِ فَبِهَا وَنِعْمَتْ وَمَنِ اغْتَسَلَ فَالغُسْلُ أَفْضَلُ ‘যে ব্যক্তি জুমআর দিনে ওযূ করল, তাহলে তা যথেষ্ট ও উত্তম। আর যে গোসল করল, (তার) গোসল হলো সর্বোত্তম’।[5]
৪. মেসওয়াক ও সুগন্ধি ব্যবহার করা :এ মর্মে হাদীছে এসেছে,
عَنْ عُبَيْدِ بْنِ السَّبَّاقِ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي جُمُعَةٍ مِنَ الْجُمَعِ: يَا مَعْشَرَ الْمُسْلِمِينَ إِنَّ هذَا يَوْمٌ جَعَلَهُ اللّهُ عِيْدًا فَاغْتَسِلُوْا وَمَنْ كَانَ عِنْدَه طِيْبٌ فَلَا يَضُرُّه أَنْ يَمَسَّ مِنْهُ وَعَلَيْكُمْ بِالسِّوَاكِ.
উবাইদ ইবনু সাব্বাক্ব রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো এক জুমআর দিন বলেছেন, ‘হে মুসলিমগণ! এ দিন, যে দিনকে আল্লাহ তাআলা ঈদ হিসাবে গণ্য করেছেন। অতএব, তোমরা এ দিন গোসল করবে। যার কাছে সুগন্ধি আছে সে তা ব্যবহার করলেও কোনো ক্ষতি নেই। তোমরা অবশ্যই অবশ্যই মিসওয়াক করবে’।[6]
৫. সুন্দর পোশাক পরিধান করা : জুমআর দিন সামর্থ্য অনুযায়ী সবচেয়ে সুন্দর পোশাক পরিধান করা উচিত। আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَا عَلى اَحَدِكُمْ إِنْ وَجَدَ أَنْ يَتَّخِذَ ثَوْبَيْنِ لِيَوْمِ الْجُمُعَةِ سِوى ثَوْبَيْ مَهْنَتِه ‘তোমাদের কারো সামর্থ্য থাকলে, সে যেন তার কাজ-কর্মের পোশাক ছাড়া জুমআর দিনের জন্য এক জোড়া পোশাক রাখে’।[7]
৬. সকাল সকাল ছালাতের জন্য যাওয়া : জুমআর দিন সকাল সকাল ছালাতের জন্য রওনা হওয়া উচিত। আমাদের সালাফ এ কাজে প্রতিযোগিতা করতেন। কেননা জুমআর দিন আগেভাগে মসজিদে যাওয়ার বিশেষ ফযীলত রয়েছে।
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا كَانَ يَوْمُ الْجُمُعَةِ وَقَفَتِ الْمَلَائِكَةُ عَلى بَابِ الْمَسْجِدِ يَكْتُبُونَ الْأَوَّلَ فَالْأَوَّلَ وَمَثَلُ الْمُهَجِّرِ كَمَثَلِ الَّذِىْ يُهْدِىْ بَدَنَةً ثُمَّ كَالَّذِي يُهْدِىْ بَقَرَةً ثُمَّ كَبْشًا ثُمَّ دَجَاجَةً ثُمَّ بَيْضَةً فَإِذَا خَرَجَ الْإِمَامُ طَوَوْا صُحُفَهُمْ وَيَسْتَمِعُوْنَ الذِّكْرَ.
আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘জুমআর দিন ফেরেশতারা মসজিদের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে যান। যে ব্যক্তি মসজিদে প্রথমে আসে তার নাম লিখেন। এরপর তার পরের ব্যক্তির নাম লিখেন। (অতঃপর তিনি বলেন,) যে ব্যক্তি মসজিদে প্রথমে যান তার দৃষ্টান্ত হলো, যে মক্কায় কুরবানী দেওয়ার জন্য একটি উট পাঠায়। তারপর যে ব্যক্তি মসজিদে আসে তার দৃষ্টান্ত হলো, যে একটি গরু পাঠায়। তারপর যে লোক মসজিদে আসে তার উপমা হলো, যে একটি দুম্বা পাঠায়। তারপর যে ব্যক্তি মসজিদে আসে তার উদাহরণ হলো, যে একটি মুরগী পাঠায়। তারপর যে ব্যক্তি মসজিদে আসে তার উপমা হলো, যে একটি ডিম পাঠায়। আর ইমাম খুৎবা দেওয়ার জন্য বের হলে তারা তাদের দপ্তর গুটিয়ে খুৎবা শোনেন’।[8]
৭. পায়ে হেঁটে মসজিদে যাওয়া : জুমআর দিন পায়ে হেঁটে মসজিদে যাওয়া সুন্নাত। এ ক্ষেত্রে সম্ভব হলে যানবাহন-সাওয়ারী ব্যবহার করা অনুচিত। আওস ইবনু আওস রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَنْ غَسَّلَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَاغْتَسَلَ وَبَكَّرَ وَابْتَكَرَ وَمَشى وَلَمْ يَرْكَبْ وَدَنَا مِنَ الْإِمَامِ وَاسْتَمَعَ وَلَمْ يَلْغُ كَانَ لَه بِكُلِّ خُطْوَةٍ عَمَلُ سَنَةٍ أَجْرُ صِيَامِهَا وَقِيَامِهَا ‘যে ব্যক্তি জুমআর দিনে পোশাক-পরিচ্ছদ ধৌত করবে ও নিজে গোসল করবে, এরপর সকাল সকাল প্রস্তুত হবে, সওয়ার না হয়ে পায়ে হেঁটে আগে মাসজিদে যাবে, ইমামের নিকট গিয়ে বসবে, চুপচাপ ইমামের খুৎবা শুনবে এবং বেহুদা কাজ করবে না— তার প্রতি কদমে এক বছরের আমলের ছওয়াব হবে। অর্থাৎ এক বছরের দিনের ছিয়াম ও রাতের ছালাতের আমলের পরিমাণ ছাওয়াব হবে’।[9]
৮. মসজিদে প্রবেশ করে দুই রাকআত ছালাত আদায় করা : জুমআর দিনের আদবসমূহের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আদব হচ্ছে, জুমআর দিন মসজিদে প্রবেশ করে বসার পূর্বে দুই রাকআত ছালাত আদায় করা। নিম্নের হাদীছটি এর গুরুত্ব বহন করে।
عَن جَابِرٍ بْنِ عَبْدِ اللهِ قَالَ جَاءَ سُلَيْكٌ الْغَطَفَانِىُّ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَرَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَخْطُبُ فَجَلَسَ فَقَالَ لَهُ يَا سُلَيْكُ قُمْ فَارْكَعْ رَكْعَتَيْنِ وَتَجَوَّزْ فِيهِمَا ثُمَّ قَالَ - إِذَا جَاءَ أَحَدُكُمْ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَالإِمَامُ يَخْطُبُ فَلْيَرْكَعْ رَكْعَتَيْنِ وَلْيَتَجَوَّزْ فِيهِمَا
জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একদা সুলাইক গাতফানী জুমআর দিন মসজিদে প্রবেশ করে বসে পড়লে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তুমি ছালাত পড়েছ কি? লোকটি বললেন, না। তিনি বললেন, উঠো এবং হালকা করে দুই রাকআত পড়ে নাও। অতঃপর তিনি বললেন, ‘তোমাদের কেউ যখন জুমআর দিন ইমামের খুৎবা দেওয়াকালীন সময়ে উপস্থিত হয়, সে যেন (সংক্ষেপে) দুই রাকআত ছালাত পড়ে নেয়’।[10]
৯. সম্ভবপর নফল ছালাত আদায় করা : শুধু জুমআর দিনই এমন একটি দিন, যেদিন ইমামের খুৎবার আগ পর্যন্ত দুই বা চার রাকআত করে সম্ভবপর নফল ছালাত পড়া যায়। আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَنِ اغْتَسَلَ ثُمَّ أَتَى الْجُمُعَةَ فَصَلّى مَا قُدِّرَ لَه ثُمَّ أَنْصَتَ حَتّى يَفْرُغَ مِنْ خُطْبَتِه ثُمَّ يُصَلِّيَ مَعَه غُفِرَ لَه مَا بَيْنَه وَبَيْنَ الْجُمُعَةِ الْأُخْرى وَفَضْلُ ثَلَاثَةِ أَيَّام ‘যে ব্যক্তি গোসল করে জুমআর ছালাত আদায় করতে এসেছে ও যতটুকু সম্ভব হয়েছে (নফল) ছালাত আদায় করেছে, ইমামের খুৎবা শেষ হওয়া পর্যন্ত চুপচাপ রয়েছে, এরপর ইমামের সাথে জুমআর ছালাত আদায় করেছে— তাহলে তার এ জুমআ থেকে বিগত জুমআর মাঝখানে, বরং এর চেয়েও তিন দিন আগের গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হবে’।[11]
১০. মনোযোগের সাথে খুৎবা শ্রবণ করা : জুমআর দিনের গুরুত্বপূর্ণ আদব হচ্ছে, জুমআর দিন মনোযোগ সহকারে খুৎবা শোনা। আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَنْ تَوَضَّأَ فَأَحْسَنَ الْوُضُوءَ ثُمَّ أَتَى الْجُمُعَةَ فَاسْتَمَعَ وَأَنْصَتَ غُفِرَ لَه مَا بَيْنَه وَبَيْنَ الْجُمُعَةِ وَزِيَادَةُ ثَلَاثَةِ أَيَّامٍ وَمَنْ مَسَّ الْحَصى فَقَدْ لَغَا ‘যে ব্যক্তি সুন্দর করে ওযূ করে জুমআর ছালাতে যাবে, চুপচাপ খুৎবা শুনবে, তার এই জুমআ হতে ওই জুমআ পর্যন্ত সব গুনাহ ক্ষমা করা হবে, অধিকন্তু আরও তিন দিনের। আর যে ব্যক্তি খুৎবার সময় কঙ্কর নাড়ল, সে অর্থহীন কাজ করল’।[12] অপর একটি হাদীছে এসেছে, আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,إِذَا تَكَلَّمْتَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ فَقَدْ لَغَوْتَ وَ أَلْغَيْتَ يعَنِي وَ اْلإمَامُ يَخْطُبُ ‘জুমআর দিন ইমামের খুৎবা দানকালে কথা বললে তুমি অনর্থ কর্ম করলে এবং (জুমআর ছওয়াব) বাতিল করলে’।[13]
১১. কাউকে উঠিয়ে দিয়ে না বসা : জাবের রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,لَا يُقِيمَنَّ أَحَدُكُمْ أَخَاهُ يَوْمَ الْجُمُعَةِ ثُمَّ يُخَالِفُ إِلى مَقْعَدِه فَيَقْعُدَ فِيهِ وَلكِنْ يَقُوْلُ: اِفْسَحُوْا ‘তোমাদের কেউ যেন জুমআর দিনে কোনো মুসলিম ভাইকে তার জায়গা হতে উঠিয়ে দিয়ে সেখানে নিজে না বসে। বরং সে বলতে পারে, ভাই! একটু জায়গা করে দিন’।[14]
১২. মানুষের কাঁধের উপর দিয়ে অতিক্রম করে বা দু’জনকে বিচ্ছিন্ন করে না বসা : জুমআর দিন মানুষের কাঁধের উপর দিয়ে অতিক্রম করে বা দু’জনকে বিচ্ছিন্ন করে বসা নিষিদ্ধ।
عَنْ أَبِى الزَّاهِرِيَّةِ قَالَ كُنَّا مَعَ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ بُسْرٍ صَاحِبِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ فَجَاءَ رَجُلٌ يَتَخَطَّى رِقَابَ النَّاسِ فَقَالَ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ بُسْرٍ جَاءَ رَجُلٌ يَتَخَطَّى رِقَابَ النَّاسِ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَالنَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَخْطُبُ فَقَالَ لَهُ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اجْلِسْ فَقَدْ آذَيْتَ.
আবুয যাহিরিয়্যাহ রহিমাহুল্লাহ হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা জুমআর দিনে আমরা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু বুসর রযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে লোকদের ঘাড় ডিঙিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছিল। আব্দুল্লাহ ইবনু বুসর রযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, একদা জুমআর দিন এক ব্যক্তি লোকদের ঘাড় ডিঙিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন খুৎবা দিচ্ছিলেন। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি বসো, তুমি লোকদের কষ্ট দিয়েছো।[15]
১৩. খুৎবার সময় হাঁটুকে পেটের সাথে লাগিয়ে না বসা : জুমআর দিনের নিষিদ্ধ কর্মসমূহের মধ্যে খুৎবার সময় হাঁটুকে পেটের সাথে লাগিয়ে বসা অন্যতম। হাদীছে এসেছে,
عَنْ مُعَاذِ بْنِ أَنَسٍ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَهى عَنِ الْحُبْوَةِ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَالْإِمَامُ يَخْطُبُ.
মুআয ইবনু আনাস আল-জুহানী রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমুআর দিন ইমামের খুৎবার সময় হাঁটু উচিয়ে দু’হাত দিয়ে তা জড়িয়ে ধরে বসতে নিষেধ করেছেন’।[16]
১৪. জুমআর ছালাত পড়া : প্রাপ্তবয়স্ক সকল পুরুষের উপর জুমআর ছালাত ফরয। মহান আল্লাহ বলেন,﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ﴾ ‘হে বিশ্বাসীগণ! জুমআর দিনে যখন ছালাতের জন্য আহ্বান করা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের জন্য ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ করো। এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয়, যদি তোমরা উপলব্ধি কর’ (আল-জুমুআ, ৬২/৯)। হাদীছে এসেছে,
عَنْ طَارِقِ بْنِ شِهَابٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْجُمُعَةُ حَقٌّ وَاجِبٌ عَلى كُلِّ مُسْلِمٍ فِي جَمَاعَةٍ إِلَّا عَلى أَرْبَعَةٍ عَبْدٍ مَمْلُوكٍ أَوِ امْرَأَةٍ أَوْ صَبِيٍّ أَوْ مَرِيْضٍ.
তারেক ইবনু শিহাব রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলিমের জন্য জামাআত সহকারে জুমআ ফরয। অবশ্য চার ব্যক্তির জন্য ফরয নয়— ক্রীতদাস, মহিলা, শিশু ও অসুস্থ’।[17] জুমআর ছালাত ত্যাগকারীর জন্য নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঠিন হুঁশিয়ারি ব্যক্ত করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনু উমার ও আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, আমরা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, ‘লোকেরা যেন জুমআর ছালাত ছেড়ে না দেয়। (যদি ছেড়ে দেয়) আল্লাহ তাআলা তাদের অন্তরসমূহে মোহর মেরে দেবেন। অতঃপর সে ব্যক্তি অমনোযোগীদের মধ্যে গণ্য হবে’।[18] অন্য হাদীছে এসেছে, ইবনু মাসঊদ রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন লোক সম্পর্কে বলেছেন, যারা জুমআর ছালাতে উপস্থিত হয় না, তাদের সম্পর্কে আমি চিন্তা করে দেখেছি যে, আমি কাউকে আদেশ করব, সে আমার স্থানে লোকদের ইমামতি করবে আর আমি গিয়ে তাদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিব’।[19]
১৫. জুমআর ফরয ছালাতের পরে সুন্নাত ছালাত পড়া : জুমআর ফরয ছালাতের পরে মসজিদে চার রাকআত ছালাত পড়া সুন্নাত। আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, مَنْ كَانَ مِنْكُمْ مُصَلِّيًا بَعْدَ الْجُمُعَةِ فَلْيُصَلِّ أَرْبَعًا ‘তোমাদের যে লোক জুমআর (ফরয ছালাতের) পর ছালাত আদায় করতে চায়, সে যেন চার রাকআত ছালাত আদায় করে নেয়’।[20] আর বাড়িতে পড়লে দুই রাকআত পড়া সুন্নাত। ইবনু উমার রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন,كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا يُصَلِّىْ بَعْدَ الْجُمُعَةِ حَتّى يَنْصَرِفَ فَيُصَلِّىْ رَكْعَتَيْنِ فِي بَيْتِه ‘নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমার ছালাতের পর কামরায় পৌঁছার পূর্বে কোনো ছালাত আদায় করতেন না। কামরায় পৌঁছার পর তিনি দুই রাকআত ছালাত আদায় করতেন’।[21]
১৬. বেশি বেশি দরূদ পড়া : জুমআর দিন বেশি বেশি দরূদ পড়ার জন্য নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাগিদ দিয়েছেন। আবূ দারদা রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,أَكْثِرُوا الصَّلَاةَ عَلَيَّ يَوْمَ الْجُمُعَةِ فَإِنَّه مَشْهُودٌ تَشْهَدُهُ الْمَلَائِكَةُ وَإِنَّ أَحَدًا لَنْ يُصَلِّىْ عَلَيَّ إِلَّا عُرِضَتْ عَلَيَّ صَلَاتُه حَتّى يَفْرُغَ مِنْهَا ‘তোমরা জুমআর দিন আমার ওপর বেশি পরিমাণ করে দরূদ পড়ো। কেননা এ দিনটি হাযিরার দিন। এ দিনে ফেরেশতাগণ হাযির হয়ে থাকেন। যে বক্তি আমার ওপর দরূদ পাঠ করে, তার দরূদ আমার কাছে পেশ করা হতে থাকে, যে পর্যন্ত সে এর থেকে অবসর না হয়’।[22]
১৭. বেশি বেশি দু‘আ করা : এ প্রসঙ্গে হাদীছে এসেছে, আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,إِنَّ فِي الْجُمُعَةِ لَسَاعَةً لَا يُوَافِقُهَا عَبْدٌ مُسْلِمٌ يَسْأَلُ اللّهَ فِيهَا خَيْرًا إِلَّا أعطَاهُ إِيَّاه ‘জুমআর দিনে এমন একটি মুহূর্ত রয়েছে, সে মুহূর্তটি যদি কোনো মুমিন বান্দা পায় আর আল্লাহর নিকট কোনো কল্যাণ কামনা করে, আল্লাহ তাআলা তাকে তা দান করেন’।[23] অধিকাংশ আলেমের মতে, দু‘আ কবুলের সম্ভাবনার সেই সময়টি হলো আছরের ছালাতের পরের সময়। দ্বিপ্রহরের সময়টিতেও দু‘আ কবুলের আশা করা যেতে পারে। আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন।
১৮. জুমআর দিনকে বিশেষ কোনো ছালাত ও ছওমের জন্য নির্দিষ্ট না করা : এ মর্মে হাদীছে এসেছে, আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,لاَ تَخُصُّوا لَيْلَةَ الجُمُعَةِ بِقِيَامٍ مِنْ بَيْنِ اللَّيَالِي وَلاَ تَخُصُّوا يَومَ الجُمُعَةِ بِصِيَامٍ مِنْ بَيْنِ الأَيَّامِ إِلاَّ أَنْ يَكُونَ فِي صَومٍ يَصُومُهُ أَحَدُكُمْ ‘রাত্রিসমূহের মধ্যে জুমআর রাতকে ক্বিয়াম (নফল ছালাত) পড়ার জন্য নির্দিষ্ট করো না এবং দিনসমূহের মধ্যে জুমআর দিনকে (নফল) ছিয়াম রাখার জন্য নির্ধারিত করো না। তবে যদি তোমাদের কারও কোনো নফল ছওমের দিন সেই দিনেই পড়ে যায় (তাহলে সে কথা ভিন্ন)’।[24]
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদেরকে জুমআর দিনের উক্ত আদবগুলো যথাযথভাবে পালন করার তওফীক্ব দান করুন এবং এর মাধ্যমে অশেষ ছওয়াবের অধিকারী করুন— আমীন!
মো. দেলোয়ার হোসেন
অনার্স ১ম বর্ষ, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
[1]. সিলসিলা ছহীহা, হা/১৫৬৬।
[2]. সুনান দারেমী, হা/৩৪৫০; মুসতাদরাক হাকেম, হা/৩৩৯২; ছহীহ তারগীব, হা/৭৩৬, ছহীহুল জামে‘, হা/৬৪৭০; মিশকাত, হা/২১৭৫।
[3]. ছহীহ বুখারী, হা/৮৮২, ৮৯৪; ছহীহ মুসলিম, হা/৮৪৪, ৮৪৫; ইবনু মাজাহ, হা/১০৮৮; আবূ দাঊদ, হা/৩৪০; তিরমিযী, হা/৪৯২; নাসাঈ, হা/১৩৭৬; মিশকাত, হা/৫৩৭।
[4]. ছহীহ বুখারী, হা/৮৫৮; ছহীহ মুসলিম, হা/৮৪৬।
[5]. তিরমিযী, হা/৪৯৭, হাদীছ ছহীহ; ইবনু মাজাহ, হা/১০৯১; নাসাঈ, হা/১৩৮০।
[6]. ইবনু মাজাহ, হা/১০৯৮, হাদীছ হাসান; মিশকাত, হা/১৩৯৮।
[7]. আবূ দাঊদ, হা/১০৭৮, হাদীছ ছহীহ; ইবনু মাজাহ, হা/১০৯৬; মিশকাত, হা/১৩৮৯।
[8]. ছহীহ বুখারী, হা/৯২৯; ছহীহ মুসলিম, হা/৮৫০; মিশকাত, হা/১৩৮৪।
[9]. আবূ দাঊদ, হা/৩৪৫, হাদীছ ছহীহ; ইবনু মাজাহ, হা/১০৮৭; মিশকাত, হা/১৩৮৮।
[10]. ছহীহ বুখারী, হা/৯৩০; ছহীহ মুসলিম, হা/৮৭৫; ইবনু মাজাহ, হা/১১১২; আবূ দাঊদ, হা/১১১৬।
[11]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮৫৭; মিশকাত, হা/১৩৮২।
[12]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮৫৭; আবূ দাঊদ, হা/১০৫০; তিরমিযী, হা/৪৯৮; ইবনু মাজাহ, হা/১০৯০; মিশকাত, হা/১৩৮৩।
[13]. ছহীহ বুখারী, হা/৯৩৪; ছহীহ মুসলিম, হা/৮৫১; আবূ দাঊদ, হা/১১১২; নাসাঈ, হা/১৪০২; ইবনু মাজাহ, হা/১১১০; মিশকাত, হা/১৩৮৫।
[14]. ছহীহ মুসলিম, হা/২১৭৮; মিশকাত, হা/১৩৮৬।
[15]. আবূ দাঊদ হা/১১১৮, হাদীছ ছহীহ।
[16]. আবূ দাঊদ, হা/১১১০, হাদীছ হাসান; তিরমিযী, হা/৫১৪; মিশকাত, হা/১৩৯৩।
[17]. আবূ দাঊদ, হা/১০৬৭, হাদীছ ছহীহ; মিশকাত, হা/১৩৭৭।
[18]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮৬৫; ইবনু মাজাহ, হা/৭৯৪; মিশকাত, হা/১৩৭০।
[19]. ছহীহ মুসলিম, হা/৬৫২; মিশকাত, হা/১৩৭৭।
[20]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮৮১; মিশকাত, হা/১১৬৬।
[21]. ছহীহ বুখারী, হা/৯৩৭; ছহীহ মুসলিম, হা/৮৮২; মিশকাত, হা/১১৬১।
[22]. ইবনু মাজাহ, হা/১৬৩৭; মিশকাত, হা/১৩৬৬, হাদীছ ছহীহ।
[23]. ছহীহ বুখারী, হা/৫২৯৪; ছহীহ মুসলিম, হা/৮৫২; তিরমিযী, হা/৪৯১; নাসাঈ, হা/১৪৩১; মিশকাত, হা/১১৫৭।
[24]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৪৪; মিশকাত, হা/২০৫২।