‘যাকাত’ শব্দের অর্থ হলো- বৃদ্ধি করা, পবিত্র করা। আর যাকাতের পারিভাষিক অর্থ হলো, ‘ইসলামী শরীআত কর্তৃক নির্ধারিত নিছাব পরিমাণ মালের নির্দিষ্ট অংশ নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করাকে যাকাত বলে’। কুরআন মাজীদের সর্বমোট ৫৮ জায়াগায় যাকাত শব্দটি এসেছে। এর মধ্যে ২৬টি আয়াতে ছালাতের সাথে যাকাত শব্দটি এসেছে।
যাকাত ইসলামের তৃতীয় রুকন। যাকাত বিত্তশালীদের ওপর ফরয। কেউ যাকাত অস্বীকার করলে সে কাফের হিসেবে গণ্য হবে। আর পরকালে তার জন্য শাস্তি রয়েছে। ছালাতের পরই যাকাতের অবস্থান। তাই কুরআনুল কারীমে বহু জায়গায় ছালাতের সাথে যাকাতের কথা উল্লেখ রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, وَأَقِيْمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ ‘তোমরা ছালাত ক্বায়েম করো, যাকাত আদায় করো’ (আল-বাক্বারা, ২/৮৩)। যাকাত না দেওয়া কাফেরদের বৈশিষ্ট্য এবং জাহান্নামের শাস্তির অন্যতম কারণ। যাকাত আর্থিক ইবাদত। যাকাত ফরয হওয়া সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا أَنْفِقُوْا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا كَسَبْتُمْ وَمِمَّا أَخْرَجْنَا لَكُمْ مِنَ الْأَرْضِ وَلَا تَيَمَّمُوا الْخَبِيْثَ مِنْهُ تُنْفِقُوْنَ وَلَسْتُمْ بِآخِذِيْهِ إِلَّا أَنْ تُغْمِضُوْا فِيْهِ وَاعْلَمُوْا أَنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ حَمِيْدٌ - الشَّيْطَانُ يَعِدُكُمُ الْفَقْرَ وَيَأْمُرُكُمْ بِالْفَحْشَاءِ وَاللَّهُ يَعِدُكُمْ مَغْفِرَةً مِنْهُ وَفَضْلًا وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيْمٌ
‘হে মুমিনগণ! তোমাদের উপার্জিত উত্তম সম্পদ থেকে এবং তোমাদের জন্য ভূমি থেকে যা উৎপন্ন করেছি তা থেকে ব্যয় করো এবং মন্দ বস্তু ব্যয় করার সংকল্প করো না। বস্তুত তোমরা তা নিজেরাই গ্রহণ করো না, যদি না তোমাদের চক্ষু বন্ধ করে নিয়ে নাও। আর জেনে রেখো, আল্লাহ অমুখাপেক্ষী, প্রশংসিত। শয়তান তোমাদের গরীব হয়ে যাওয়ার ভয় দেখায় এবং অশ্লীলতা-বেহায়াপনার নির্দেশ দেয়। আর আল্লাহ তোমাদের সাথে তাঁর ক্ষমা ও অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দেন। আল্লাহ প্রাচুর্যের অধিকারী, মহাজ্ঞানী’ (আল-বাক্বারা, ২/২৬৭-২৬৮)।
যাকাত আদায়ের উপকারিতা:
যাকাত আদায়ের মাধ্যমে নিজেকে ও মালকে পবিত্র ও বিশুদ্ধ করা যায়। মহান আল্লাহ বলেন,
خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيْهِمْ بِهَا وَصَلِّ عَلَيْهِمْ إِنَّ صَلَاتَكَ سَكَنٌ لَهُمْ وَاللَّهُ سَمِيْعٌ عَلِيْمٌ- أَلَمْ يَعْلَمُوْا أَنَّ اللَّهَ هُوَ يَقْبَلُ التَّوْبَةَ عَنْ عِبَادِهِ وَيَأْخُذُ الصَّدَقَاتِ وَأَنَّ اللَّهَ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيْمُ
‘তাদের সম্পদ থেকে ছাদাক্বা গ্রহণ করুন, যাতে তা দিয়ে তাদেরকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করতে পারেন’ (আত-তাওবা, ৯/১০৩)।
যাকাত আদায় করলে পরকালে কোনো ভয় ও চিন্তা থাকবে না। মহান আল্লাহ বলেন,
الَّذِيْنَ يُنْفِقُوْنَ أَمْوَالَهُمْ بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ سِرًّا وَعَلَانِيَةً فَلَهُمْ أَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُوْنَ
‘যারা নিজেদের সম্পদ রাতে-দিনে, প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে ব্যয় করে থাকে, তাদের জন্য তাদের রবের নিকট প্রতিদান রয়েছে এবং তাদের কোনো ভয় থাকবে, তারা দুঃখিতও হবে না’ (আল-বাক্বারা, ২/২৭৪)।
যাকাত আদায় করলে পরকালে তার বিনিময় পাওয়া যাবে। মহান আল্লাহ বলেন,
قُلْ إِنَّ رَبِّيْ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَيَقْدِرُ لَهُ وَمَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ شَيْءٍ فَهُوَ يُخْلِفُهُ وَهُوَ خَيْرُ الرَّازِقِيْنَ
‘বলো, আমার প্রতিপালকই তাঁর বান্দাদের মধ্যে থেকে যার জন্য ইচ্ছা রিযিক্ব প্রশস্ত করেন, আর যার জন্য ইচ্ছা সীমিত করেন। তোমরা যা কিছু ব্যয় করো, তিনি তার বিনিময় দিবেন। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ রিযিক্বদাতা’ (সাবা, ৩৪/৩৯)।
যাকাত কেউ দিবে আর কেউ নিবে এটা আল্লাহর বিধান:
আল্লাহ ধনী ও গরীব উভয় শ্রেণির মানুষ সৃষ্টি করেছেন। ফলে একে অপরের সহযোগিতা নিতে পারে। মহান আল্লাহ বলেন,
نَحْنُ قَسَمْنَا بَيْنَهُمْ مَعِيْشَتَهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَرَفَعْنَا بَعْضَهُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِيَتَّخِذَ بَعْضُهُمْ بَعْضًا سُخْرِيًّا وَرَحْمَتُ رَبِّكَ خَيْرٌ مِمَّا يَجْمَعُوْنَ
‘আমরা তাদের (মানুষের) মাঝে পার্থিব জীবনের উপকরণ বণ্টন করে দিয়েছি এবং মর্যাদায় কতককে কতকের ওপর সমুন্নত করেছি, যাতে তারা একে অন্যের সহায়তা গ্রহণ করতে পারে। তারা যা সঞ্চয় করে, তোমার রবের অনুগ্রহ তা থেকে উত্তম’ (আয-যুখরুফ, ৪৩/৩২)। ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, একদা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুআয ইবনু জাবাল রযিয়াল্লাহু আনহু-কে ইয়ামানের শাসনকর্তা করে পাঠালেন এবং বললেন,
إِنَّكَ سَتَأْتِيْ قَوْمًا أَهْلَ كِتَابٍ، فَإِذَا جِئْتَهُمْ، فَادْعُهُمْ إِلَى أَنْ يَشْهَدُوْا أَنْ لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُوْلُ اللَّهِ، فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوْا لَكَ بِذَلِكَ ، فَأَخْبِرْهُمْ أَنَّ اللَّهَ قَدْ فَرَضَ عَلَيْهِمْ خَمْسَ صَلَوَاتٍ فِيْ كُلِّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ، فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوْا لَكَ بِذَلِكَ، فَأَخْبِرْهُمْ أَنَّ اللَّهَ قَدْ فَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَائِهِمْ فَتُرَدُّ عَلَى فُقَرَائِهِمْ، فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوْا لَكَ بِذَلِكَ، فَإِيَّاكَ وَكَرَائِمَ أَمْوَالِهِمْ وَاتَّقِ دَعْوَةَ المَظْلُوْمِ، فَإِنَّهُ لَيْسَ بَيْنَهُ وَبَيْنَ اللَّهِ حِجَابٌ.
‘(হে মুআয!) তুমি আহলে কিতাবের এক সম্প্রদায়ের নিকট যাচ্ছ। কাজেই তুমি প্রথমে তাদের এই ঘোষণা করতে আহ্বান করবে, ‘আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোনো উপাস্য বা মা‘বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল! যদি তারা তোমার এই কথা মেনে নেয়, তাহলে তাদের বলবে যে, আল্লাহ তাআলা তাদের ওপর দিবা-রাত্রে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয করেছেন। তারা যদি তা মেনে নেয়, তাহলে তাদের বলবে, আল্লাহ তাআলা তাদের ওপর যাকাত ফরয করেছেন, যা তাদের ধনীদের নিকট হতে গ্রহণ করা হবে। অতঃপর তাদের দরিদ্রদের ফেরত দেওয়া হবে। এ ব্যাপারে যদি তারা তোমার কথা মেনে নেয়, তবে সাবধান! (যাকাত আদায়ের সময়) তুমি বেছে বেছে তাদের উত্তম মাল নেবে না। বেঁচে থাকবে মাযলূম বা অত্যাচারিতদের বদদু‘আ হতে। কেননা মাযলূমের বদদু‘আ এবং আল্লাহর মধ্যে কোনো আড়াল বা বাধা থাকে না’।[1] অর্থাৎ তুমি তাদের থেকে শুধু ভালো মাল বেছে নিয়ে যুলম করবে না। কারণ মাযলূমের দু‘আ গৃহীত হয়।
যাকাত আদায় করার শর্তাবলি:
(ক) মুসলিম হওয়া, (খ) স্বাধীন হওয়া, (গ) নিছাবের মালিক হওয়া; মাল স্থিতিশীল থাকা এবং (ঘ) এক বছর পূর্ণ হওয়া।
যে সকল মালের যাকাত দেওয়া ফরয, তা ৫ প্রকার: (১) গৃহপালিত পশু, (২) স্বর্ণ ও রৌপ্যে অথবা এর সমপরিমাণ টাকা থাকলে, (৩) ব্যবসায়িক মালে, (৪) শস্য ও ফলে এবং (৫) খনিজ ও মাটির ভেতরে লুক্কায়িত সম্পদে।
স্বর্ণ, রৌপ্য ও নগদ টাকার নিছাব: স্বর্ণের বর্তমান হিসাব ৮৫ গ্রাম, এক ভরি সমান ১১.৬৬ গ্রাম, সে হিসেবে ৭.২৯ ভরি বা ৭ ভরি ৫ আনা ৫ রতি স্বর্ণ। রৌপ্যের নিসাব ৫৯৫ গ্রাম, তথা ৫১.০২ ভরি রৌপ্য হয়। অথবা এর সমমূল্যের টাকা থাকলে, শতকরা ২.৫০ টাকা যাকাত দিতে হবে। ব্যবসায়িক মালের নিছাব- স্বর্ণ ও রৌপ্যের নিছাবের ন্যায়।
শস্য ও ফলের নিছাব: শস্য ৭৫০ কেজি বা ১৮ মন ৩০ কেজি হলে যাকাত দিতে হবে।[2] যেসব ফল-ফসল পরিমাপযোগ্য, গুদামজাত করা যায় এবং বর্তমান ও পরবর্তী সময়ে উপকৃত হওয়া যায়, এমন সকল উৎপাদিত পণ্যে যাকাত দিতে হবে। যেমন- গম, যব, খেজুর, কিশমিশ, ধান, সরিষা, ভুট্টা ইত্যাদি।[3] তবে শাকসবজি বা কাঁচামালের যেমন- মরিচ, আলু, টমেটো ইত্যাদিতে যাকাত দিতে হবে না।[4] তবে কাঁচামালের ব্যবসা করলে বছরান্তে টাকা হিসাব করে শতকরা ২.৫০ টাকা যাকাত দিতে হবে।
শস্যক্ষেত্রের যাকাত বা ওশর: মহান আল্লাহ বলেন,
وَهُوَ الَّذِيْ أَنْشَأَ جَنَّاتٍ مَعْرُوْشَاتٍ وَغَيْرَ مَعْرُوْشَاتٍ وَالنَّخْلَ وَالزَّرْعَ مُخْتَلِفًا أُكُلُهُ وَالزَّيْتُوْنَ وَالرُّمَّانَ مُتَشَابِهًا وَغَيْرَ مُتَشَابِهٍ كُلُوْا مِنْ ثَمَرِهِ إِذَا أَثْمَرَ وَآتُوْا حَقَّهُ يَوْمَ حَصَادِهِ وَلَا تُسْرِفُوْا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِيْنَ
‘আর তিনি সৃষ্টি করেছেন লতা (যা মাচা বা অন্য কিছুকে জড়িয়ে বাড়ে) ও গুল্মবিশিষ্ট (যা স্বীয় কাণ্ডের উপর দাঁড়িয়ে থাকে) উদ্যানরাজি, খেজুরগাছ ও বিভিন্ন স্বাদের খাদ্যশস্য, একই ধরনের ও আলাদা ধরনের যায়তুন ও ডালিম। যখন ফল ধরে, তখন ফল খাও। আর ফসল আহরণ করার দিন এর হক্ব আদায় করো। অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না’ (আল-আনআম, ৬/১৪১)। অর্থাৎ ক্ষেতের উৎপন্ন ফসলের ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি হক্ব আরোপ করা হয়েছে আর তা হচ্ছে- আসমানের পানি দ্বারা ফসল উৎপন্ন হলে ১০ ভাগের ১ ভাগ প্রদান করতে হবে। আর সেচের মাধ্যমে ফসল উৎপন্ন হলে ২০ ভাগের ১ ভাগ প্রদান করতে হবে।[5] আর ফল নামানোর সময় গরীব-মিসকীন উপস্থিত হলে, তাদের কিছু প্রদান করতে হবে। এই হলো ফলের হক্ব। খাজনার জমিতেও উৎপাদিত ফসলের যাকাত বা ওশর দিতে হবে। উমার ইবনু আব্দুল আযীয রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ‘খাজনা হলো জমির ওপর আর ওশর হলো ফসলের ওপর’।[6] আর যে হাদীছে এসেছে, ‘মুসলিমদের ওপর একইসাথে খাজনা ও ওশর একত্রিত হয় না’— ইমাম বায়হাক্বী তা বাতিল হাদীছ বলেছেন।[7]
গৃহপালিত পশুর যাকাত ফরয হওয়ার শর্ত ৩টি:
(১) নিছাব পরিমাণ হওয়া। আর তা হলো- ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা নিম্নে ৪০টি হলে, গরু-মহিষ ৩০টি এবং উট ৫টি হলে। (২) পূর্ণ এক বছর মালিকানায় থাকা। (৩) পশু হতে হবে বিচরণশীল অর্থাৎ যে পশু বছরের অধিকাংশ সময় নিজেই বিচরণ করে খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। আর বছরের অধিকাংশ সময় মালিক নিজে খাদ্য সংগ্রহ করে খাওয়ালে সে পশুর ওপর যাকাত ফরয নয়।[8]
যাকাতের মাল ব্যয়ের খাতসমূহ:
কুরআন মাজীদে যাকাত ও ছাদাক্বার মাল ব্যয়ের ৮টি খাতের কথা বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِيْنِ وَالْعَامِلِيْنَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوْبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِيْنَ وَفِيْ سَبِيْلِ اللَّهِ وَابْنِ السَّبِيْلِ فَرِيْضَةً مِنَ اللَّهِ وَاللَّهُ عَلِيْمٌ حَكِيْمٌ
‘ছাদাক্বা হলো ফকীর, মিসকীন, তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারী, যাদের মন জয় করা উদ্দেশ্য তাদের জন্য, দাসমুক্তি, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরের জন্য। এটা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ফরয। আর আল্লাহ হলেন সর্বজ্ঞ, মহাজ্ঞানী’ (আত-তাওবা, ৯/৬০)। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,وَفِيْ أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِلسَّائِلِ وَالْمَحْرُوْمِ ‘ধনীদের সম্পদে রয়েছে যাচ্ঞাকারী ও বঞ্চিতদের অধিকার’ (আয-যারিয়াত, ৫১/১৯)।
যাকাত আদায় না করার ভয়াবহতা:
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,
وَالَّذِيْنَ يَكْنِزُوْنَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنْفِقُوْنَهَا فِيْ سَبِيْلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيْمٍ - يَوْمَ يُحْمَى عَلَيْهَا فِيْ نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَى بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوْبُهُمْ وَظُهُوْرُهُمْ هَذَا مَا كَنَزْتُمْ لِأَنْفُسِكُمْ فَذُوْقُوْا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُوْنَ
‘যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য জমা করে আর আল্লাহর পথে তা ব্যয় করে না, তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দাও। যে দিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করে তা দিয়ে তাদের কপালে, পার্শ্বদেশে ও পিঠে দাগ দেওয়া হবে। আর তাদের বলা হবে, এটা হলো সেই সম্পদ, যা তোমরা নিজেদের জন্য জমা করেছিলে। কাজেই যা জমা করেছিলে, তার স্বাদ গ্রহণ করো’ (আত-তাওবা, ৯/৩৪-৩৫)।
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো ধনী ব্যক্তি তার মালের হক্ব (তথা যাকাত) আদায় না করলে ক্বিয়ামতের দিন স্বর্ণ ও রৌপ্য জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করে তার ললাটে, তার পার্শ্বদেশে সেঁক দেওয়া হবে। এমন শাস্তি অব্যাহত থাকবে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে ফয়সালা করার দিন পর্যন্ত। যে দিন হবে তোমাদের গণনা অনুসারে ৫০ হাজার বছরের সমান। এরপর সে নিজের গন্তব্যস্থান চাক্ষুষ দেখবে, হয়তো জান্নাত অথবা জাহান্নাম। আর যে মেষপালের মালিক তার যাকাত দেয় না, ক্বিয়ামাতের দিন সেগুলো পূর্বের চেয়ে অধিক সংখ্যক ও মোটা-তাজা অবস্থায় উপস্থিত হবে এবং তাকে শিং দিয়ে গুঁতা মারবে ও খুর দিয়ে দলিত করবে। ওসবের কোনোটিই বাঁকা শিংবিশিষ্ট বা শিংবিহীন হবে না। যখন সর্বশেষ জন্তু তাকে দলিত করে চলে যাবে, তখন প্রথমটিকে আবার তার কাছে আনা হবে। এরূপ চলতে থাকবে বান্দাদের মধ্যে মীমাংসা করার দিন পর্যন্ত। যে দিনটি হবে তোমাদের হিসাব মতে ৫০ হাজার বছরের সমান। এরপর সে তার গন্তব্যস্থান প্রত্যক্ষ করবে জান্নাত অথবা জাহান্নাম। আর যে উটের মালিক তার উটের যাকাত দেয় না, ক্বিয়ামাতের দিন ঐ উট পূর্বের চেয়েও সংখ্যায় অধিক ও মোটা-তাজা অবস্থায় মালিকের নিকট উপস্থিত হবে। তাকে এর বিশাল সমভূমিতে উপুড় করে শোয়ানো হবে এবং উটগুলো তাকে খুর দিয়ে দলিত করতে থাকবে। সর্বশেষ উটটি তাকে অতিক্রম করার পর প্রথমটিকে আবার তার কাছে আনা হবে। এরূপ চলতে থাকবে বান্দাদের মধ্যে মীমাংসা করার দিন পর্যন্ত। যে দিনটি হবে তোমাদের হিসাব মতে ৫০ হাজার বছরের সমান। অতঃপর সে তার গন্তব্যস্থল প্রত্যক্ষ করবে জান্নাত অথবা জাহান্নাম’।[9] যাকাত সঠিকভাবে আদায় হলে সমাজ থেকে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই-রাহাজানি ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সকল অপরাধ উঠে যাবে।
যারা ছালাত প্রতিষ্ঠা করে না এবং যাকাত আদায় করে না, তাদের সাথে যুদ্ধ করার নির্দেশ রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে দেওয়া হয়েছে। ইবনু উমার রযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوْا أَنْ لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُوْلُ اللَّهِ، وَيُقِيْمُوا الصَّلاَةَ، وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ، فَإِذَا فَعَلُوْا ذَلِكَ عَصَمُوْا مِنِّيْ دِمَاءَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ إِلَّا بِحَقِّ الإِسْلاَمِ، وَحِسَابُهُمْ عَلَى اللَّهِ.
‘আমি লোকদের সাথে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য আদিষ্ট হয়েছি, যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো হক্ব মা‘বূদ বা উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, ছালাত প্রতিষ্ঠা করে ও যাকাত প্রদান করে। তারা যদি এগুলো করে, তবে আমার পক্ষ হতে তাদের জান-মালের নিরাপত্তা লাভ করল। তবে ইসলামের বিধান অনুযায়ী যদি কোনো কারণ থাকে, তাহলে সেটা স্বতন্ত্র ব্যাপার। আর তাদের হিসাবের ভার আল্লাহর ওপর থাকবে’।[10]
পরিশেষে, প্রত্যেক মুসলিমের উচিত, যথাযথভাবে যাকাত আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা এবং পার্থিব ও পারলৌকিক কল্যাণ নিশ্চিত করা। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
মাহবূবুর রহমান মাদানী
শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/১৪৯৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১৬।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/১৪৮৪।
[3]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ওয়া মাকালাত বিন বায রহিমাহুল্লাহ, ১৪/৬৮।
[4]. ছহীহ জামিউছ ছগীর, হা/৫৪১১।
[5]. ছহীহ বুখারী, হা/১৪৮৩।
[6]. মা‘রেফাতুস সুনান ওয়ালা আছার, হা/৮২৪৮।
[7]. ইমাম বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা, হা/৭৪৯৯।
[8]. ছহীহ বুখারী, হা/১৪৫৪।
[9]. আবূ দাঊদ, হা/১৬৫৮।
[10]. ছহীহ বুখারী, হা/২৫; ছহীহ মুসলিম, হা/২২।