কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

অনৈক্যের ফলে বিশ্ব মুসলিমের পরিণতি

post title will place here

এককালে যে মুসলিমজাতির অঙ্গুলি হেলনে প্রবল পরাক্রমশালী রোমক সম্রাট হেরাক্লিয়াস ও পারস্য সম্রাট খসরু পারভেজের রাজমুকুট খসে পড়েছিল, যে জাতির জাগ্রত শক্তির সম্মুখে শত্রুদলের বিপুল সাম্রাজ্যের সুদৃঢ় ইমারতগুলো ভেঙে খান খান হয়ে গিয়েছিল, মদীনায় নব্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের পরিধি মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশের সিংহভাগ জুড়ে বিস্তার লাভ করেছিল, যে জাতি মহাসমুদ্র মন্থন করে দুর্জয় গিরি উল্লঙ্ঘন করে নব নব আবিষ্কার দ্বারা পৃথিবীকে সমৃদ্ধ করেছে, উন্নতি, প্রগতি ও সমৃদ্ধির সকল অঙ্গনে একক প্রভুত্ব ক্বায়েম করেছিল, যে জাতির সার্বিক সফলতায় স্বস্তি, শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্বের সংহতিতে মুগ্ধ হয়ে আজও শ্রদ্ধাভরে সকল জাতি যাকে স্বর্ণযুগ বলে অভিহিত করে— সময়ের আবর্তনে মহাগৌরবান্বিত সেই জাতির দিকে তাকালে মনে হয় এ জাতিই পৃথিবীর সবচেয়ে ইয়াতীম, অসহায় ও দুর্বল জাতি! কেন এ ব্যতিক্রম অবস্থানে এই মহান মুসলিম জাতি?

উপর্যুক্ত কঠিন প্রশ্নকে সামনে রেখে নাতিদীর্ঘ আলোচনা পেশ করতে চাই। ঐক্য-চেতনা মুসলিম জাতির প্রাণশক্তি। যেমন- মহান আল্লাহ কুরআনুল কারীমে ঘোষণা করেছেন, وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا ‘তোমরা সমবেতভাবে আল্লাহর রজ্জুকে মযবূতভাবে আঁকড়ে ধরো, তোমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যেয়ো না’ (আলে ইমরান, ৩/১০৩)। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘পারস্পরিক দয়া, ভালোবাসা, সহানুভূতি প্রদর্শনে তুমি মুমিনদেরকে একটি দেহের মতো দেখতে পাবে; যখন শরীরের একটি অঙ্গ রোগাক্রান্ত হয়, তখন শরীরের সমস্ত অঙ্গ অনিদ্রা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়’।[1] অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, আমরা ইসলামের এসব মহামূল্যবান নির্দেশ উপেক্ষা করে আজ শত শত দলে ও মতে বিভক্ত হয়ে নিজেদের সংহতিকে ভেঙে চুরমার করে ফেলেছি। এসব বিভক্তি ও অনৈক্য মুসলিম পতনের মূল কারণ। অনৈক্য ও মতপার্থক্যের ফলে মুসলিম জাতি ধ্বংসোন্মুখ দুর্বল জাতিতে পরিণত হয়েছে। প্রধানত: দুটি অঙ্গনেই মুসলিমদের সবচেয়ে বেশি মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।

(১) রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে খোলাফায়ে রাশেদার পর থেকে শত, সহস্র যুদ্ধ-বিগ্রহ করে কোটি কোটি মুসলিম ভাইকে অন্য মুসলিম ভাইয়েরা হত্যা করে ক্ষমতা গ্রহণ করার প্রবণতা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের চিন্তাধারা হলো লক্ষ লক্ষ মুসলিমের রক্তে হোলি খেলতে হয় খেলব, লক্ষ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট করতে হয় করব, অসংখ্য ক্ষুরধার প্রতিভাকে চির বিদায় দিতে হয় দেব— তবুও ক্ষমতা আমার চাই! অর্থাৎ আমাদের বুদ্ধি হয়েছে মাথা কাটা বুদ্ধি!

যেমন: কারো মাথা ব্যথা করলে মাথা ব্যথার ঔষধ প্রয়োগ না করে বরং মাথা কেটে ফেলাই শ্রেয়— এমন নির্বুদ্ধিতাই হয়েছে আমাদের শুভবুদ্ধি। এহেন আত্মহিংসার ফলে ও ক্ষমতা লিপ্সার দরুন রাজনৈতিক অঙ্গনে আমরা এক হতে পারলাম না। ফলে যুগ যুগ ধরে রাজনৈতিক অঙ্গন একটি কসাইখানায় পরিণত হয়ে আসছে।

(২) আক্বায়েদ ও মতবাদের দিক দিয়ে আরো বেশি অনৈক্য পরিলক্ষিত হয়; কেউবা সুন্নী, কেউবা রাফেজী, কেউবা খারেজি, কেউবা জাবরী, কেউবা মু‘তাযিলিী, কেউবা আশআরী। আবার পীর মুরিদীর দিক দিয়ে কেউবা কাদেরিয়া, কেউবা চিশতিয়া, কেউবা নকশাবন্দিয়া, কেউবা মোজাদ্দেদিয়া, কেউবা মাইজভান্ডারীয়া, কেউবা ফকিরি মতবাদে বিশ্বাসী হয়ে একই মুসলিম নানা প্রকার মত ও পথের দিশারী হয়ে একে অপরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করে গোটা মুসলিম জাতি আজ ইতিহাসের পাতায় শতধা বিভক্ত জাতিতে পরিণত হয়েছে।

যুগে যুগে মুসলিম জাতির অনৈক্যের ফলে অবস্থা এমন হয়েছে যে, লক্ষ লক্ষ ইট দিয়ে যে ঘর তৈরি হয় সে ঘরের বিভিন্ন স্থানে যদি ফাটল ধরে, তাহলে সে ঘরের যে অবস্থা হয়, আমাদের অবস্থা ঠিক তাই হয়েছে। ফাটা দালানকে চুনকাম করে যেমন টিকানো যায় না; ফাটল বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে পারলে তবেই রক্ষা— ঠিক তেমনিভাবে মুসলিমদের অনৈক্যের স্থলে সংহতির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলেই তবে হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার সম্ভব। তা নাহলে এক কালের গৌরবান্বিত মুসলিম জাতি যে ধ্বংসের চরম সীমায় পৌঁছে যাবে, তা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত ও দিবালোকের ন্যায় ধ্রুব সত্য। মহান আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন- আমীন!

* কালীগঞ্জ, সাতক্ষীরা।


[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৬০১১; ছহীহ মুসলিম, হা/৪৫; মুসনাদ আহমাদ, হা/১৮৪০১।

Magazine