কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

একটি লিফলেটের ইলমী জবাব (পর্ব-৪)

(সেপ্টেম্বর’২১ সংখ্যায় প্রকাশিতের পর)

(৬) পায়ে পা না লাগিয়ে কাঁধের সাথে কাঁধ লাগিয়ে কাতার সোজা করা :*

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. সূত্রে বর্ণিত, রাসূল সা. ইরশাদ করেন, তোমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাতার সোজা করো। মাঝের খালি জায়গা পূরণ করো এবং অপর ভাইয়ের সঙ্গে নমনীয় আচরণ করো। শয়তানের জন্যে মাঝে মাঝে ফাঁকা জায়গা রেখে দিওনা (আবূ দাঊদ হা/৬৬৬)। 

জবাব : এ হাদীছটি ছহীহ। এতে কোনো সন্দেহ নেই। এ হাদীছ দ্বারাই প্রতীয়মান হয়, পায়ের সাথে পা লাগাতে হবে। কেননা মাঝের খালি জায়গা পূরণ হবে কীভাবে যদি পায়ের সাথে পা না মিলে? শয়তানের জন্য মাঝখানে ফাঁকা জায়গা তখনই বন্ধ হবে, যখন মুছল্লীরা টাখনুর সাথে টাখনু মিলিয়ে দাঁড়াবে। যতই কাঁধের সাথে কাঁধ মিলানো হোক না কেন নিচের দিকে উভয় মুছল্লীর মাঝে ফাঁকা থাকবেই। অথচ উপরিউক্ত হাদীছে ফাঁকা রাখতে নিষেধ করা হয়েছে। এ ব্যতীত আরও কিছু হাদীছ রয়েছে। যা নিম্নরূপ-

(১) আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদীছে বলা হয়েছে যে, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুজনের মাঝে ফাঁকা রাখতে নিষেধ করেছেন। কেননা উভয়ের মাঝে ফাঁকা রাখলে শয়তান তাতে প্রবেশ করে।[1]

(২) নু‘মান ইবনু বাশীর রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদীছে আছে যে, ছাহাবীগণ কাঁধে কাঁধ, পায়ে পা এবং ও গোড়ালির সাথে গোড়ালি মিলিয়ে ছালাত আদায় করতেন।[2]

সুতরাং মুফতী সাহেবের পেশকৃত হাদীছ ও পরের দুটি হাদীছ দ্বারা স্পষ্টভাব টাখনুর সাথে টাখনু মিলানোর দলীল পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে উভয়ের মাঝে কোনোভাবেই ফাঁকা রাখে না। কেননা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনটি করতে নিষেধ করেছেন। এছাড়াও এতে শয়তানকে প্রবেশের জন্য জায়গা করে দেওয়া হয়।

(৭) মাগরিবের পূর্বে কোনো সুন্নাত বা মুস্তাহাব ছালাত নেই :

এ শিরোনামে একটি হাদীছ আনা হয়েছে। যেমন—

عَنْ ابي بُردَةَ قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : إِنَّ عِنْدَ كُلِّ أَذَانَيْنِ رَكْعَتَيْنِ مَا خَلَا صَلَاةَ الْمَغْرِبِ.

হযরত আবু বুরদাহ রা. বলেন,নবীজি সা. ইরশাদ করেছেন, মাগরীব ছাড়া প্রতি ওয়াক্তের আযান ও ইক্বামতের মাঝে দু’রাকাত নামায রয়েছে’ (সুনানে দারাকুতনী হাদীস নং-১০৪০)

জবাব : ইমাম বায়হাক্বী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন,

رَوَاهُ حَيَّانُ بْنُ عُبَيْدِ اللهِ عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ بُرَيْدَةَ وَأَخْطَأَ فِي إِسْنَادِهِ وَأَتَى بِزِيَادَةٍ لَمْ يُتَابَعَ عَلَيْهَا.

‘হাদীছটি হাইয়ান ইবনু উবায়দুল্লাহ বর্ণনা করেছেন আব্দুল্লাহ ইবনু বুরায়দা হতে। তিনি সনদে ভুল করেছেন। তিনি যে বর্ধিতাংশটুকু (মাগরিব ব্যতীত অংশটুকু) এনেছেন, তার সমর্থক কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না’।[3]

মাগরিবের ছালাতের পূর্বে দু’রাকআত নফল ছালাত আদায়ের দলীলসমূহ : এ ব্যাপারে অনেকগুলো ছহীহ হাদীছ রয়েছে। যেমন—

হাদীছ—১ :

عَنِ ابْنِ بُرَيْدَةَ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مُغَفَّلٍ المُزَنِيِّ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ بَيْنَ كُلِّ أَذَانَيْنِ صَلاَةٌ، ثَلاَثًا لِمَنْ شَاءَ.

আব্দুল্লাহ ইবনু মুগাফফাল হতে বর্ণিত যে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘প্রত্যেক আযান ও ইক্বামতের মাঝে ছালাত রয়েছে। এটি তিনি তিন বার বলার পর বললেন, যার মন চায় সে পড়বে’।[4] এটি ছহীহ বুখারীর হাদীছ। এর বিশুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্নই আসে না।

হাদীছ—২ :

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ بُرَيْدَةَ قَالَ حَدَّثَنِي عَبْدُ اللهِ المُزَنِيُّ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ صَلُّوا قَبْلَ صَلاَةِ المَغْرِبِ قَالَ فِي الثَّالِثَةِ لِمَنْ شَاءَ كَرَاهِيَةَ أَنْ يَتَّخِذَهَا النَّاسُ سُنَّةً.

নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সরাসরি আদেশ করে বলেছেন, ‘তোমরা মাগরিবের ছালাতের পূর্বে ছালাত আদায় করো’। রাবী বলেন, ‘তৃতীয়বারে তিনি বললেন, যার মন চায় সে পড়বে’। এ ভয়ে তিনি বললেন, যেন লোকেরা একে সুন্নাত (অপরিহার্য রীতি)[5] মনে না করে’।[6]

হাদীছ—৩ :

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ كَانَ المؤَذِّنُ إِذَا أَذَّنَ قَامَ نَاسٌ مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَبْتَدِرُونَ السَّوَارِيَ حَتَّى يَخْرُجَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُمْ كَذَلِكَ يُصَلُّونَ الرَّكْعَتَيْنِ قَبْلَ المغْرِبِ.

আনাস ইবনু মালেক হতে বর্ণিত, মুয়াযযিন যখন আযান দিতেন তখন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ছাহাবীদের মধ্যে অনেকেই তড়িঘড়ি করে মসজিদের খুঁটির কাছে ছুটে যেতেন এবং নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বের হওয়ার আগ পর্যন্ত মাগরিবের পূর্বে দু’রাকআত ছালাত আদায় করতেন।[7]

হাদীছ—৪ :

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ الْمُزَنِيِّ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ صَلُّوا قَبْلَ الْمَغْرِبِ رَكْعَتَيْنِ ثُمَّ قَالَ صَلُّوا قَبْلَ الْمَغْرِبِ رَكْعَتَيْنِ لِمَنْ شَاءَ خَشْيَةَ أَنْ يَتَّخِذَهَا النَّاسُ سُنَّةً.

আব্দুল্লাহ মুযানী রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা মাগরিবের পূর্বে দু’রাকআত ছালাত আদায় করবে। অতঃপর তিনি বললেন, ‘যার মন চায় সে মাগরিবের ছালাতের পূর্বে দু’রাকআত ছালাত পড়বে’।

লোকেরা যেন একে সুন্নাত (অপরিহার্য রীতি) মনে না করে সে আশঙ্কায় তিনি এমনটি বলেছিলেন।[8]

হাদীছ—৫ :

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ صَلَّيْتُ الرَّكْعَتَيْنِ قَبْلَ الْمَغْرِبِ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ قُلْتُ لِأَنَسٍ أَرَآكُمْ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ قَالَ نَعَمْ رَآنَا فَلَمْ يَأْمُرْنَا وَلَمْ يَنْهَنَا.

আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যামানায় মাগরিবের ছালাতের আগে দু’রাকআত ছালাত আদায় করতাম’। রাবী বলেন, ‘আমি আনাসকে জিজ্ঞেস করলাম যে, তোমাদেরকে কি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখেছিলেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তিনি আমাদেরকে দেখেছেন। কিন্তু তিনি আমাদেরকে কোনো আদেশ-নিষেধ করেননি’।[9]

এ হাদীছগুলো প্রমাণ করে যে, মাগরিবের ছালাতের পূর্বে দু’রাকআত ছালাত আদায় করার বিষয়টি সুস্পষ্ট ছহীহ দলীল দ্বারা প্রমাণিত। তবে পড়ার না পড়ার বিষয়টি মানুষের ইচ্ছাধীন। যার মন চায় পড়বে। আর যার মন চায় না পড়বে না। কেউ যদি আদায় করে তাতে তার ছওয়াব রয়েছে এবং তা উত্তম। আর কেউ ছেড়ে দিলে তাতে তার কোনো প্রকারের গুনাহ হবে না। সুতরাং মানুষকে আমলের প্রতি উৎসাহ প্রদান না করে তার বিরোধিতা করা হাস্যকর।

 (চলবে)

আহমাদুল্লাহ

সৈয়দপুর, নীলফামারী।


[1]. আবূ দাঊদ, হা/৬৬৭, হাদীছ ছহীহ।

[2]. আবূ দাঊদ, হা/৬৬২; ছহীহ বুখারী, হা/৭২৫, আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে।

[3]. বায়হাক্বী কুবরা, হা/৪১৭১-৭২।

[4]. ছহীহ বুখারী, হা/৬২৪।

[5]. হাফেয ইবনু হাজার আসকালানী রাহিমাহুল্লাহ ‘সুন্নাত’ এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, وَمَعْنَى قَوْلِهِ سُنَّةً أَيْ شَرِيعَةً وَطَرِيقَةً لَازِمَةً অর্থাৎ ‘শরীআত ও অপরিহার্য রীতি’ (ফাতহুল বারী, ৩য় খণ্ড ৬০ পৃষ্ঠা)। 

[6]. ছহীহ বুখারী, হা/১১৮৩।

[7]. ছহীহ বুখারী, হা/৬২৫।

[8]. আবূ দাঊদ, হা/১২৮১, হাদীছ ছহীহ।

[9]. আবূ দাঊদ, হা/১২৮২, হাদীছ ছহীহ।

Magazine