কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

আল্লাহর দিকে দাওয়াত : দলীয় মোড়কে নাকি পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে? (পর্ব-১৩)

post title will place here

একাদশ পরিচ্ছেদ: হিযবিয়্যাহ বা দলাদলি হারাম

সমস্ত মুসলিমের নিকট একটি স্বতঃসিদ্ধ বিষয় হচ্ছে, ‘ইসলাম মুসলিমদেরকে এমন বন্ধনে বেঁধেছে, মানবরচিত কোনো সংগঠনের পক্ষে যার ধারেকাছে যাওয়া মোটেও সম্ভব নয়— সেই সংগঠন যতই শক্তি ও সূক্ষ্মতা অর্জন করুক না কেন। ইসলামে ইসলামী ভ্রাতৃত্বই হচ্ছে অলা ও বারা তথা সম্পর্ক রক্ষা বা ছিন্ন করার মূল ভিত্তি। অতএব, একজন মুসলিম অপর মুসলিমের বন্ধু, সে তাকে চিনুক বা না চিনুক; বরং একজন যদি প্রাচ্যে এবং অপরজন পাশ্চাত্যে থাকে, তবুও।[1]

একথার অর্থ এই যে, ইসলাম তার অভ্যন্তরে ভিন্ন কোনো সংগঠন বা বিশেষ ব্যবস্থাপনার অনুমোদন দেয় না, যে সংগঠন বা ব্যবস্থাপনার মূলনীতি সম্পর্ক রক্ষা করা বা ছিন্ন করার মূলনীতি হিসেবে গণ্য হতে পারে। কারণ এই ধরনের সংগঠন বা বিশেষ ব্যবস্থাপনার দাবি হচ্ছে, যে ব্যক্তি সেখানে যুক্ত থাকবে, সে সাহায্য-সহযোগিতা, ভ্রাতৃত্ব ইত্যাদি অধিকার পাওয়ার হক্বদার। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি সেখানে যুক্ত থাকবে না, সে এই অধিকারগুলো পাওয়ার হক্বদার নয়। অথচ ইসলাম একজন মুসলিমকে এই অধিকারগুলোর সবই দিয়েছে কেবল মুসলিম হওয়ার কারণে; অন্য কোনো কারণে নয়। এখান থেকেই নিম্নবর্ণিত হাদীছটির মর্মার্থ স্পষ্ট হয়:‌لَا ‌حِلْفَ ‌فِي ‌الْإِسْلَامِ، وَأَيُّمَا حِلْفٍ كَانَ فِي الْجَاهِلِيَّةِ لَمْ يَزِدْهُ الْإِسْلَامُ إِلَّا شِدَّةً ‘ইসলামে কোনো মৈত্রীচুক্তি নেই। তবে জাহেলী যুগে ভালো কাজের জন্য যেসব চুক্তি করা হয়েছে, তাকে ইসলাম আরও দৃঢ় ও মযবূত করেছে’।[2]

অতএব, ইসলাম যেহেতু সমস্ত ভালোবাসা-বন্ধুত্বের মর্মমূলে কুঠারাঘাত করেছে, জাহেলীযুগে যেগুলো ছিলো সম্পর্ক রক্ষা বা ছিন্ন করার মূলভিত্তি এবং ইসলামকেই সম্পর্ক রক্ষা বা ছিন্ন করার মূল উপাদান হিসেবে গণ্য করেছে আর সকল মুসলিমকে অধিকারের ক্ষেত্রে সমান গণ্য করেছে, সেহেতু ইসলামে বিচ্ছিন্ন, ভিন্ন ভিন্ন দল-উপদল তৈরির অন্য কোনো সুযোগ অবশিষ্ট নেই। যদি কোনো এক দলের বিশেষ কোনো অধিকার ও সম্পর্ক থাকত, তখন না হয় পৃথক সম্প্রীতির চুক্তি করার প্রয়োজন পড়ত।

ফলে, হাদীছটি প্রমাণ করে, দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে যাওয়া ইসলামের সাথে মানায় না এবং ইসলামে তা কল্পনাই করা যায় না’।[3] ‘কারণ বিশেষ চুক্তির মাধ্যমে পার্থক্য সৃষ্টিই চুক্তির বাইরের মানুষকে চুক্তিবদ্ধ মানুষের তুলনায় নিম্নস্তরের করে দেয়’।[4] আর এটা শরী‘আতে জায়েয নেই। কেননা নিম্নমান বা উঁচুমানের মূলভিত্তিই হচ্ছে সৎকাজ; সম্প্রীতি ও জামা‘আতবদ্ধতার উল্টো কোনো কিছু নিম্নমান বা উঁচুমান নির্ণয়ের মানদণ্ড হতে পারে না। শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘কারো অধিকার নেই যে, সে উম্মতের জন্য নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত অন্য কাউকে খাঁড়া করে তার পথে মানুষকে আহ্বান করবে এবং সেই পথকে কোনো মুসলিমের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক গড়া বা না গড়ার মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করবে। অনুরূপভাবে তার জন্য এটাও বৈধ নয় যে, সে আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বক্তব্য এবং যেসব বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর ‘ইজমা’ হয়েছে, সেগুলো ব্যতীত অন্য কোনো বক্তব্যের জন্ম দিয়ে তাকে কোনো মুসলিমের সাথে আন্তরিক সুসম্পর্ক গড়া বা না গড়ার মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করবে। বরং এটি বিদআতীদের কাজ, যারা উম্মতের জন্য কোনো ব্যক্তি বা বক্তব্যকে দাঁড় করিয়ে এর মাধ্যমে তাদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করে; ফলে তারা এই সৃষ্ট বক্তব্য বা এই সম্বন্ধের উপর ভিত্তি করে মিত্রতা বা শত্রুতা পোষণ করে’।[5]

‘বর্তমান সময়ের অনেক ইসলামী জামা‘আত ও দলের কিন্তু একই অবস্থা। তারা কিছু ব্যক্তিকে তাদের নেতৃত্বের আসনে বসিয়ে তাদের বন্ধুদের সাথে বন্ধুত্ব পোষণ করছে এবং শত্রুদের সাথে শত্রুতা পোষণ করছে আর তারা (নেতারা) তাদের জন্য যা ফতওয়া দিচ্ছে, তাতেই তারা তাদেরকে অনুসরণ করছে। এক্ষেত্রে তারা কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরে যাচ্ছে না বা তাদের বক্তব্য ও ফতওয়ার পক্ষের দলীল সম্পর্কেও জিজ্ঞেস করছে না।

এই ধরনের কোনো মানহাজ পরিবর্তনের বা মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের ভিত্তি হতে পারে না। বরং কতিপয় দেশ বা দলের বহু চেষ্টা সত্ত্বেও কোনো একটি মাযহাবের উপর বা দলের উপর মুসলিমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে— এমনটা কখনও ঘটেনি’।[6]

‘এই অর্থের উপর ভিত্তি করে ইসলামে বিভিন্ন নীতিগত দলের হুকুম উপলব্ধি করা সম্ভব। কারণ নৈতিক দলগুলো নিজেদের জন্য চয়নকৃত মূলনীতি ও সূত্রাবলির উপর দলের লোকদেরকে সংগঠিত করে। অতঃপর দলে যোগদানকে সম্পর্ক রক্ষা করা বা ছিন্ন করার মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করে।

কোনো দল যখন সেই দলের বাইরের কারো সাথে সদ্ব্যবহার করে, তখন তার সাথে ঠিক সেভাবে ব্যবহার করে, যেভাবে মহান আল্লাহ মুসলিমদেরকে কাফেরদের সাথে ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন। ঠিক এভাবে—لَا يَنْهَاكُمُ اللهُ عَنِ الَّذِينَ لَمْ يُقَاتِلُوكُمْ فِي الدِّينِ وَلَمْ يُخْرِجُوكُمْ مِنْ دِيَارِكُمْ أَنْ تَبَرُّوهُمْ وَتُقْسِطُوا إِلَيْهِمْ ‘দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে তোমাদের বাড়ি-ঘর থেকে বের করে দেয়নি, তাদের সঙ্গে সদয় ব্যবহার করতে এবং তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না’ (আল-মুমতাহানা, ৬০/৮)

এই সদ্ব্যবহারের উপরে যে আন্তরিক সম্পর্ক হতে পারে, সেই আন্তরিক সম্পর্ক দল কেবল তাকেই দেয়, যে তাতে যোগদান করে।

এরপর বলতে চাই, আমরা যদি ইসলামে বহু নৈতিক দল তৈরির পক্ষে মত দেই, তাহলে এখানে দু’টি বিষয়: হয় দল কারো সাথে সম্পর্ক রক্ষা করা বা ছিন্ন করার মূলভিত্তি হিসেবে ইসলামকে গ্রহণ করবে অন্যথা অন্যকিছুকে। দল যদি ইসলামকেই কারো সাথে সম্পর্ক রক্ষা করা বা ছিন্ন করার মূলভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে, তাহলে ইসলামে এ ধরনের দল বা সংগঠন খোলার দরকারই নেই। কারণ ইসলাম নিজেই সেই ভিত্তি হওয়ার জন্য যথেষ্ট’।[7]

‘মূল কথা হচ্ছে, শরী‘আত সেসব বিষয়কে পুরোপুরি হারাম করে, যেগুলো একজন মুসলিমের সাথে অপর মুসলিমের সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়। অপরপক্ষে, সেসব বিষয়কে অবধারিত করে, যেগুলো একজন মুসলিমের সাথে অপর মুসলিমের সম্পর্ক ও ভালোবাসার বন্ধন সৃষ্টি করে’।[8]

এর আলোকে, হুকুম স্পষ্ট হয়ে গেলো এবং প্রমাণিত হলো যে, এসব দলাদলি নিষিদ্ধ।[9] এই নিষেধাজ্ঞা যুক্তি ও দলীলের আলোকে অভ্যন্তরীণ ও বহিস্থ সবভাবেই প্রমাণিত, যে হুকুমকে রদ করার সাধ্য কারো নেই ইনশাআল্লাহ; তবে কিছু ফাঁকা বুলি আওড়ানো সম্ভব… অস্বীকার করা সম্ভব… ভয়ভীতি দেখিয়ে মানুষকে দূরে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব…

অবশ্য এগুলোর কানাকড়িও কোনো মূল্য নেই।

সঊদী আরবের উচ্চ উলামা পরিষদের স্থায়ী কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত ফতওয়া[10] এই নিষেধাজ্ঞাকেই শক্তিশালী করে এবং এসব দলাদলি হারাম হওয়ার ব্যাপারটা পরিগ্রহ করে।[11] ফতওয়াটি শায়খ আব্দুল আযীয ইবনে বায-এর সভাপতিত্বে ৭/১০/১৩৯৭ হিজরীতে প্রকাশিত হয়, যার নম্বর ১৬৭৪।

ইসলামী ফিক্বহ একাডেমির চেয়ারম্যান শায়খ বাকর আবু যায়েদ বিরচিত ‘হুকমুল ইনতিমা ইলাল জামা‘আত ওয়াল আহযাব আল-ইসলামিয়্যাহ’ বইটিতে সুস্পষ্ট অনেক দলীল-প্রমাণের আলোকে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে। যা কোনো ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তির পক্ষে খণ্ডন করা সম্ভব নয় এবং কোনো বাতিলপন্থীও সেগুলোকে প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না।

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ :হিযবিয়্যাহ বা দলাদলির চিত্র

এ বিষয়ে কোনো আলেমের মধ্যে দ্বিমত নেই যে, ‘নাম বদলালে বাস্তবতা বদলায় না’।[12] সুতরাং আমরা মন্দের নাম যদি ভালো দিয়ে দেই, তাহলে তা ভালো হবে না। অনুরূপভাবে অনিষ্টের নাম যদি কল্যাণ দিয়ে দেই, তাহলে তা কল্যাণ হবে না। এভাবে…

সুতরাং বিভক্তির নাম যদি ঐক্য দিয়ে দেই, তাহলে তা শরী‘আতসম্মত হবে না। দুর্বলতার নাম শক্তি দিয়ে দিলে তা শক্তি হবে না। আর হিযবিয়্যাহ বা দলাদলি দ্বীন হয়ে যাবে না, যদি তার নাম দিয়েদেই ‘যৌথ কাজ’ বা ‘জামা‘আত’ বা ‘সংগঠন’ বা ‘কমিটি’ বা ‘আন্দোলন’ বা অন্য কিছু।

মূল বিষয় হচ্ছে বাস্তবতায়; নামে নয়। সেকারণে ‘শরী‘আতে নিষিদ্ধ কোনো বিষয়ের হুকুম তার গঠন পরিবর্তন হওয়ার কারণে পরিবর্তন হয়ে যাবে না’।[13]

এই নামগুলো ছোট হতে পারে, কিন্তু এর ভয়াবহতা বিরাট। এজন্য, ‘দ্বীনের ব্যাপারে ছোট ছোট নবাবিষ্কার থেকে বেঁচে থাকুন। কারণ ছোট ছোট বিদ‘আতই এক সময় বড় হয়ে যায়। এই উম্মতের মধ্যে সৃষ্ট সকল বিদ‘আতের কিন্তু একই অবস্থা। প্রথমে ছোট ছিল, হক্বের সাথে যার মিল ছিল। ফলে সেখানেযোগদানকারীরা তার দ্বারা প্রতারিত হয়েছে। কিন্তু তারপর সেখান থেকে বের হওয়ার আর পথপায়নি। অবশেষে তা বড় হয়ে দ্বীনে পরিণত হয়েছে, যাকে দ্বীন হিসেবে পালন করা হয়’।[14]

এসব ভাসমান অষ্পষ্ট নাম ও পরিভাষা ইসলাম ও মুসলিমদের উপর কত যে ক্ষতি ডেকে এনেছে। এসব সমসাময়িক দলাদলি ও জমায়েতও অনুরূপই। শুরুতে নিয়্যত থাকে ভালো; তারপর দলে-উপদলে পরিণত হয়ে সেগুলোই উদ্দীষ্ট হয়ে থাকে। তখনই ‘জামা‘আত বা সংগঠনের পক্ষে দলীল গ্রহণের জন্য কুরআন-হাদীছের বক্তব্যকে ব্যবহার করা হয়।…অথচ এটা উল্টো পদ্ধতি। শারঈ পদ্ধতি হচ্ছে, দলীল অনুযায়ী আমল করতে হবে’[15], কোনো প্রকার বিকৃতি ও অপব্যাখ্যা ছাড়াই।

‘অতএব, -আল্লাহ আপনার প্রতি রহম করুন- সমসাময়িক যে কারো যে কোনো কথার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করুন। তাড়াহুড়ো করে কারো কথার মধ্যেই প্রবেশ করবেন না, যতক্ষণ না এ প্রশ্ন করছেন: সেই বিষয়ে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর কোনো ছাহাবী বা কোনো আলেম কি কথা বলেছেন?

যদি তাদের কারো পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পেয়ে যান, তাহলে তা আঁকড়ে ধরুন। এটা ছেড়ে অন্য কোনো দিকে ধাবিত হবেন না। এর বাইরে অন্য কিছু বেছে নিয়ে জাহান্নামে নিপতিত হবেন না’।[16]

এখানে দু’টি বিষয়ে খুব গুরুত্ব দেওয়া জরুরী:

এক. মনের অতি আবেগ যদি কুরআন-সুন্নাহর দলীল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়, তাহলে তা ব্যক্তির জন্য অকল্যাণ ও ধ্বংস বয়ে আনে।

কল্যাণের প্রতি ভালোবাসা, ইসলামের জন্য কাজ করার প্রতি ভালোবাসা এবং আল্লাহর দিকে দাওয়াতের প্রতি ভালোবাসা— সবই কিন্তু শারঈ দলীলের মানদণ্ডে মাপতে হবে। ‘বেশি ভালো’ বা ‘তড়িৎ ফলাফল’ বা ‘বিন্যাস’ বা ‘ব্যবস্থাপনা’ বা ‘সংগঠন’— তাদের এসব ধারণার উপর ভিত্তি করে দলীল থেকে বের হয়ে অন্য কোনো দিকে যাওয়া যাবে না।

শরী‘আতে যা এসেছে, তা ছাড়া অন্য কোনো বিন্যাস চলবে না।

শ্রেষ্ঠসৃষ্টির পক্ষ থেকে যা বিশুদ্ধসূত্রে প্রমাণিত হয়েছে, তার বাইরে অন্য কোনো ব্যবস্থাপনা চলবে না।

তিনি ইসলামে আমাদের নিকট যে সমন্বয় এনেছেন, তার বাইরে কোনো সমন্বয় চলবে না।

দুই. আল্লাহর বান্দা! আপনি যে কাজে আপতিত হয়ে তাকে শারঈ কাজ ভাবছেন, অথচ তা বিদ‘আতী কাজ, সে ব্যাপারে নিজেকে পরীক্ষা করুন এভাবে:

(ক) আপনার দলের বাইরের অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন ও অধিক জ্ঞানী কোনো আলেমের দিকে কি আপনি ততটা ধাবিত হন, যতটা ধাবিত হন আপনার দলের অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতাসম্পন্ন ও অল্প জ্ঞানী আলেমের দিকে?

(খ) কল্যাণের কাজ, আল্লাহর দিকে দাওয়াত, ইসলামের পথে চলা— এগুলো কি আপনি ঈমানী তাগিদে করেন নাকি এগুলোর পেছনে আপনার দলের নির্দেশ[17], আপনার সভাপতির নির্দেশনা এবং আপনার নেতার দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে?

(গ) আপনি কি ইসলামের নিয়ম-কানুন, এর আদেশ-নিষেধের প্রতি সেভাবে যত্নশীল হতে পারেন, যতটা যত্নশীল হতে পারেন আপনার দলের নিয়ম-কানুন মানার প্রতি, আপনার জামা‘আতের সভা-সমাবেশ এবং আপনার দলের নির্ধারিত সময় ও স্থানে উপস্থিত হওয়ার প্রতি?

প্রিয় ভাই আমার! আমি আপনার জবাবের অপেক্ষা করছি না। …কথায় বলে, ‘প্রত্যেকটি মানুষ তার নিজের হিসাবকারী’।

অতঃপর আপনার মোটেও এ ধারণা করা ঠিক হবে না যে, দলাদলি শুধু প্রতীক ও শ্লোগান বা বায়‘আত ও ইমারতের নাম। বরং তা প্রয়োগ, লেনদেন ও পরিচালনার নাম।

অতএব, যার নাম দল, সংগঠন বা জামা‘আত, কেবল তা দল নয়— যেমনটা কেউ কেউ মনে করে থাকে।

‘আর একথা সুবিদিত যে, ঐসব গোলযোগ বাস্তবতার সাথে সম্পর্কিত, যা নাম ও বাহ্যিক রূপ পরিবর্তন করলে দূর হওয়ার নয়’।[18]وَاللهُ عَلِيمٌ ‌بِذَاتِ ‌الصُّدُورِ ‘মহান আল্লাহ অন্তরসমূহের কথা সম্পর্কে বিশেষভাবে অবহিত’ (আলে ইমরান, ৩/১৫৪)

(চলবে)


মূল : আলী ইবনে হাসান আল-হালাবী আল-আছারী

অনুবাদ : আব্দুল আলীম ইবনে কাওছার মাদানী

বি. এ. (অনার্স), উচ্চতর ডিপ্লোমা, এম. এ. এবং এম.ফিল., মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব; অধ্যক্ষ, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।


[1]. লালকাঈ তার ‘শারহু উছূলিস সুন্নাহ’ (নম্বর ৫০) গ্রন্থে ইউসুফ ইবনে আসবাত-এর সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি সুফিয়ান ছাওরীকে বলতে শুনেছি, إِذَا بَلَغَكَ عَنْ رَجُلٍ بِالْمَشْرِقِ صَاحِبِ سُنَّةٍ وَآخَرَ بِالْمَغْرِبِ فَابْعَثْ إِلَيْهِمَا بِالسَّلَامِ وَادْعُ لَهُمَا مَا أَقَلَّ أَهْلَ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ. ‘পৃথিবীর পূর্ব প্রান্তে এবং পশ্চিম প্রান্তে অবস্থানকারী আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের দু’জন ব্যক্তির সংবাদ যদি তোমার কাছে পৌঁছে, তাহলে তাদের উভয়ের নিকট তুমি সালাম পাঠাও এবং তাদের জন্য দু‘আ কর। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের লোকদের সংখ্যা কতই না কম!’।

এটাই হচ্ছে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের পারস্পরিক সম্পর্কের আল্লাহপ্রদত্ত ব্যবস্থাপনা।

অতএব, দলবাজ এবং বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টিকারী বিদ‘আতী সংগঠনসমূহের দাঈগণ যেন আল্লাহকে ভয় করেন, যারা তাদের দল ও সংগঠনের নির্দেশনা মোতাবেক সম্পর্ক রক্ষা করেন বা ছিন্ন করেন।

[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৩০।

[3]. আল-আহযাব আস-সিয়াসিয়্যাহ, ১/১২৩; তাম্বীহু উলিল আবছার, পৃ. ২৫২।

[4]. মুছান্নাফাতুন নুযুমিল ইসলামিয়্যাহ, পৃ. ৩৩১; এখান থেকেই বক্তব্যটি ‘হুকমুল ইনতিমা’ কিতাবের ১২৩ পৃষ্ঠায় সংকলিত হয়েছে।

[5]. মাজমূ‘উল ফাতাওয়া, ২০/১৬৪; আল-ফাতাওয়া আল-‘ইরাক্বিয়্যাহ, পৃ. ১০০-১০১।

[6]. মুহাম্মাদ সুরূর যায়নুল আবেদীন, মানহাজুল আম্বিয়া ফিদ-দাওয়াতি ইলাল্লাহ, ১/১৬।

[7]. আল-আহযাব আস-সিয়াসিয়্যাহ, পৃ. ৪৬।

[8]. আব্দুর রহমান আব্দুল খালেক, আল-মাক্বাছেদ আল-‘আম্মাহ লিশ-শারী‘আতিল ইসলামিয়্যাহ, পৃ. ৩২।

[9]. দেখুন: মুহাম্মাদ ইবরাহীম শাক্বরাহ, ‘নাযরাহ মাওযূ‘ইয়্যাহ ফিত-তা‘আদ্দুদিয়্যাহ ওয়াল হিযবিয়্যাহ, (৫/২/১৯৯০ সালে সোমবারে ‘জারীদাতুদ-দুসতূর আল-উরদুনিয়্যাহ-তে প্রকাশিত প্রবন্ধ)। এখানে এই নিষেধাজ্ঞার সমর্থনে বক্তব্য রয়েছে।

[10]. সেই ফতওয়া থেকেই শায়খ ছলেহ আস-সুহাইমী রচিত ‘মানহাজুস সালাফ ফিল আক্বীদাহ ওয়া আছারুহু ফী ওয়াহদাতিল মুসলিমীন’ বইয়ের ৪০ পৃষ্ঠায় আলোচনা উদ্ধৃত হয়েছে।

[11]. আমাদের শিক্ষাগুরু বর্তমানযুগের মুহাদ্দিছ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানীর বক্তব্যে অনেক কিছুই রয়েছে, যেগুলো দলাদলি হারাম হওয়ার ব্যাপারটা জোরদার করে এবং এসবের বিচ্যুতি ও ভয়াবহতা বর্ণনা করে। তার বক্তব্যগুলো সংকলন করলে পৃথক পুস্তকে পরিণত হবে, যার কিছু কিছু ইতোপূর্বে আলোচিত হয়েছে। তার বক্তব্যগুলো তার বিভিন্ন ক্যাসেটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, যেগুলো তার বিভিন্ন তা‘লীমী বৈঠক ও ফতওয়া থেকে সংকলিত হয়েছে।

[12]. ইবনুল ক্বাইয়িম, ‘মিফতাহু দারিস সা‘আদাহ, পৃ. ১৫৩ ও ‘ই‘লামুল মুওয়াক্কে‘ঈন, ৩/১৩০।

[13]. ইবনুল ক্বাইয়িম, ‘ইগাছাতুল লাহফান, ১/৩৪৯।

[14]. বারবাহারী, ‘শারহুস সুন্নাহ’, নং ৫।

[15]. হুকমুল ইনতিমা, পৃ. ১৩৭।

[16]. শারহুস সুন্নাহ, নং ৫।

[17]. এখানে আমি আপনার ব্যক্তিগত স্বার্থের কথা উঠাচ্ছি না। ‘কারণ বৈষয়িক স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে যৌথ কর্মকে লক্ষ্যবস্তু বানানো দাওয়াতী ময়দানের একটি ভ্রান্ত পথ’!! যেমনটি শায়খ আব্দুর রহমান আব্দুল খালেক ‘মাজাল্লাতুল ফুরক্বান’-এর ১৭ সংখ্যার ২৪ পৃষ্ঠায় বলেছেন।

[18]. ইগাছাতুল লাহফান, ১/৩৫৩।

Magazine