চুল কেটে হালাল হতে হবে : উমরার কাজ প্রায় সবই শেষ। এখন মাথার চুল কেটে ইহরাম হতে হালাল হতে হবে। এটা উমরার একটি ওয়াজিব কাজ। যারা ক্বেরান অথবা ইফরাদ হজ্জের ইহরাম বাঁধবে তারা মাথার চুল কাটাতে পারবে না। তারা হজ্জের দিন পাথর মারার পর মাথার চুল কাটাবে বা ন্যাড়া করাবে। পুরুষরা চুল ছোট করে অথবা ন্যাড়া করে হালাল হতে পারে। তবে মাথা ন্যাড়া করা উত্তম। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ন্যাড়ার জন্য তিন বার আর ছোটকারীর জন্য এক বার দু‘আ করেন। হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ رضي الله قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِلْمُحَلِّقِينَ قَالُوا وَلِلْمُقَصِّرِينَ قَالَ اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِلْمُحَلِّقِينَ قَالُوا وَلِلْمُقَصِّرِينَ قَالَهَا ثَلاَثًا قَالَ وَلِلْمُقَصِّرِينَ.
আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে আল্লাহ! মাথা ন্যাড়াকারীকে ক্ষমা করো। ছাহাবীগণ বললেন, যারা চুল ছোট করেছে তাদের জন্য। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে আল্লাহ! যারা মাথা ন্যাড়া করেছেন, তাদের ক্ষমা করো। ছাহাবীগণ বললেন, যারা মাথার চুল ছোট করেছে তাদের জন্য। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে তিন বার বললেন। আর তৃতীয় বা চতুর্থ বার বললেন, যারা চুল ছোট করেছে তাদেরও ক্ষমা করো।[1] তবে উমরা করেই যদি কিছুদিনের মধ্যে হজ্জ শুরু হয়, তাহলে ১০ তারিখে যেন মাথা ন্যাড়া করা যায় এজন্য ন্যাড়া না করে চুল ছোট করাই উত্তম। যেমন ছাহাবীগণ বিদায় হজ্জের সময় করেছিলেন।[2]
মহিলারা তাদের মাথার চুলের শেষ দিক হতে কিছু পরিমাণ কেটে ফেলবে। ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মহিলাদের মাথার চুল ন্যাড়া করতে হবে না। তাদের মাথার চুল ছোট করতে হবে’।[3]
একজন অন্যজনের চুল কেটে দিতে পারে। ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমাকে মুআবিয়া রযিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, আমি একটি কাঁচি দিয়ে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চুল ছোট করে দিয়েছিলাম।[4] এভাবে উমরা হতে হালাল হয়ে যুলহিজ্জার আট তারিখের জন্য অপেক্ষা করবে। অতঃপর আট তারিখে হজ্জের জন্যে নতুন করে ইহরাম বাঁধবে।
যিলহজ্জ মাসের আট তারিখে হজ্জের ইহরাম এবং মিনায় গমন : যিলহজ্জ মাসের আট তারিখ যাকে ‘ইয়াওমুত তারবিয়্যা’ বলা হয়, সে দিন সকালে আপন আপন স্থানে এবং মক্কাবাসী আপন বাসায় পূর্বের মতো ইহরামের প্রস্তুতি নিয়ে অন্তরে হজ্জের নিয়্যত করবে, অতঃপর মুখে বলবে, (لَبَّيْكَ حَجًّا) ‘লাব্বাইকা হাজ্জান’। এ বলে হজ্জের ইহরাম বাঁধবে এবং মিনার দিকে রওয়ানা হবে। এর আগে গোসল করে নিবে। সম্ভব হলে আতর ব্যবহার করবে। ইহরামের পোশাক পরিধান করবে। ‘লাব্বাইকা হাজ্জান’ বলার পর তালবিয়া পড়তে থাকবে, যে তালবিয়া হজ্জের দিন ১০ তারিখ বড় জামরায় পাথর মারা পর্যন্ত চলতে থাকবে। তারপর মিনায় গিয়ে যোহর, আছর, মাগরিব, এশা ক্বছর করে এবং ৯ তারিখের ফজর ছালাত যথারীতি নির্দিষ্ট ওয়াক্তে আদায় করবে। ফজরের ছালাত শেষে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর মিনা থেকে আরাফার মাঠে যাবে।[5] ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিয়ে মিনায় যোহর, আছর, মাগরিব, এশা এবং ফজরের ছালাত আদায় করলেন। তারপর তিনি আরাফায় গেলেন।[6] ইবনু মাসঊদ রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে মিনায় দুই রাকআত ক্বছর ছালাত আদায় করেছি।[7] এখানে মক্কাবাসীদেরও ক্বছর ছালাত আদায় করতে হবে। কেননা, এটা হজ্জের বিধান।
জ্ঞাতব্য : কোনো প্রয়োজনে বা কোনো সমস্যার কারণে সাত তারিখ দিবাগত রাতে মিনায় যেতে হলে ইহরাম বেঁধে যেতে হবে।
যা বর্জন করতে হবে :
(১) মিনায় যাওয়ার পূর্বে ১০ তারিখের অগ্রিম সাঈ করা।
(২) নিজ বাসা থেকে ইহরাম না বেঁধে, কা‘বাঘরে গিয়ে ইহরাম বাঁধা।
(৩) ইহরামের বাক্য ও তালবিয়া ছাড়া মনগড়া কোনো দু‘আ-দরূদ পড়া।
আরাফায় অবস্থান : হাদীছে এসেছে,
عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ أَبِى بَكْرٍ الثَّقَفِىِّ أَنَّهُ سَأَلَ أَنَسَ بْنَ مَالِكٍ وَهُمَا غَادِيَانِ مِنْ مِنًى إِلَى عَرَفَةَ كَيْفَ كُنْتُمْ تَصْنَعُونَ فِى هَذَا الْيَوْمِ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ كَانَ يُهِلُّ مِنَّا الْمُهِلُّ فَلاَ يُنْكِرُ عَلَيْهِ ، وَيُكَبِّرُ مِنَّا الْمُكَبِّرُ فَلاَ يُنْكِرُ عَلَيْهِ.
মুহাম্মাদ ইবনু আবূ বকর আছ-ছাক্বাফী হতে বর্ণিত আছে, তিনি একবার আনাস ইবনু মালেক রযিয়াল্লাহু আনহু-কে জিজ্ঞেস করলেন, তখন তারা উভয়ে ভোর বেলায় মিনা হতে আরাফাতের দিকে যাচ্ছিলেন, আপনারা এই দিনে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে কী করতেন? তিনি বলেন, আমাদের মধ্যে যে ‘তালবিয়া’ বলতে চাইত তালবিয়া বলত, অথচ তার প্রতি কোনো আপত্তি করা হতো না। এভাবে আমাদের মধ্যে যে তাকবীর বলতে চাইত, সে তাকবীর বলত, অথচ তাতে তার প্রতি কোনো আপত্তি করা হতো না।[8]
عَنْ جَابِرٍ فِى حَدِيثِهِ ذَلِكَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ نَحَرْتُ هَا هُنَا وَمِنًى كُلُّهَا مَنْحَرٌ فَانْحَرُوا فِى رِحَالِكُمْ وَوَقَفْتُ هَا هُنَا وَعَرَفَةُ كُلُّهَا مَوْقِفٌ وَوَقَفْتُ هَا هُنَا وَجَمْعٌ كُلُّهَا مَوْقِفٌ.
জাবের রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমি এই জায়গায় কুরবানী করেছি। আর পুরো মিনা এলাকা কুরবানীর জায়গা। সুতরাং তোমরা তোমাদের আবাসে কুরবানী করো। আমি ঐ স্থানে অবস্থান করেছি আর পুরো আরাফার মাঠ অবস্থানের স্থল। আমি এই জায়গায় অবস্থান করেছি। আর গোটা মুযদালিফা অবস্থানের জায়গা’।[9]
عَنْ عَائِشَة إِنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَا مِنْ يَوْمٍ أَكْثَرَ مِنْ أَنْ يُعْتِقَ اللهُ فِيهِ عَبْدًا مِنَ النَّارِ مِنْ يَوْمِ عَرَفَةَ وَإِنَّهُ لَيَدْنُو ثُمَّ يُبَاهِي بِهِمِ الْمَلَائِكَةَ فَيَقُولُ مَا أَرَادَ هَؤُلَاءِ.
আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আরাফার দিন ছাড়া এমন কোনো দিন নাই যে দিনে আল্লাহ তাআলা আপন বান্দাদের জাহান্নাম হতে অধিকহারে মুক্তি দিয়ে থাকেন। তিনি সেদিন তাদের অতি নিকটবর্তী হন এবং তাদের নিয়ে ফেরেশতাদের নিকট গর্ব করেন এবং বলেন, তারা কী চায় বলো? (আমি তাদের তাই দিব)’।[10]
عَنْ عَمْرِو بْنِ عَبْدِ اللّٰهِ بْنِ صَفْوَانَ عَنْ خَالٍ لَه يُقَالُ لَه يَزِيدُ بْنُ شَيْبَانَ قَالَ كُنَّا فِىْ مَوْقِفٍ لَنَا بِعَرَفَةَ يُبَاعِدُه عَمْرٌو مِنْ مَوْقِفِ الْإِمَامِ جِدًّا فَأَتَانَا ابْنُ مِرْبَعٍ الْأَنْصَارِىُّ فَقَالَ إِنِّىْ رَسُولُ رَسُولِ اللّٰهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَيْكُمْ يَقُولُ لَكُمْ قِفُوْا عَلٰى مَشَاعِرِكُمْ فَإِنَّكُمْ عَلٰى اِرْثِ مِنْ إِرْثِ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ عَلَيْهِ السَّلَامُ.
আমর ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু ছাফওয়ান তার এক মামা হতে বর্ণনা করেন, যাকে ইয়াযীদ ইবনু শায়বান বলা হতো। ইয়াযীদ রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমরা আরাফাতে আমাদের পূর্বপুরুষদের স্থানে ছিলাম। আমর বলেন, এ স্থানটি ইমামের স্থান হতে অনেক দূরে ছিল। ইয়াযীদ রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এমন সময় আমাদের কাছে ইবনু মিরবা আল-আনছারী এসে বলেন, আমি তোমাদের কাছে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পক্ষ হতে প্রেরিত প্রতিনিধি। তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদেরকে তোমাদের অবস্থানেই (ইবাদতগারে) থাকার জন্য বলেছেন। কারণ তোমরা তোমাদের পিতা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর সুন্নাতের উপরে রয়েছ।[11]
عَنْ جَابِرُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ كُلُّ عَرَفَةَ مَوْقِفٌ وَكُلُّ مِنًى مَنْحَرٌ وَكُلُّ الْمُزْدَلِفَةِ مَوْقِفٌ وَكُلُّ فِجَاجِ مَكَّةَ طَرِيقٌ وَمَنْحَرٌ.
জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আরাফার সম্পূর্ণ স্থানই অবস্থানস্থল, মিনার সম্পূর্ণ স্থানই কুরবানীর স্থান, মুযদালিফার সম্পূর্ণটাই অবস্থানস্থল এবং মক্কার সকল পথই রাস্তা ও কুরবানীর স্থান’।[12]
عَنْ خَالِدِ بْنَ هَوْذَةَ قَالَ رَأَيْتُ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَخْطُبُ النَّاسَ يَوْمَ عَرَفَةَ عَلٰى بَعِيرٍ قَائِمًا فِى الرِّكَابَيْنِ.
খালেদ ইবনু হাওদা রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আরাফার দিনে একটি উটের উপর দু’পাদানীতে পা রেখে ভাষণ দিতে দেখেছি।[13]
عَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ عَنْ أَبِيهِ عَنْ جَدِّه أَنَّ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ خَيْرُ الدُّعَاءِ دُعَاءُ يَوْمِ عَرَفَةَ وَخَيْرُ مَا قُلْتُ أَنَا وَالنَّبِيُّونَ مِنْ قَبْلِي لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ لَهُ المُلْكُ وَلَهُ الحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ.
আমর ইবনু শুআইব তার পিতার মাধ্যমে তার দাদা হতে বর্ণনা করেন যে, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘দু‘আর মধ্যে শ্রেষ্ঠ দু‘আ হলো আরাফার দিনের দু‘আ এবং সর্বোত্তম যিকির যা আমি পাঠ করেছি ও আমার পূর্ববর্তী নবীগণ পাঠ করেছেন তা হলো, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকালাহু লাহুলমুলকু ওয়ালাহুল হামদু ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শায়ইন কাদীর’। অর্থ : ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো মা‘বূদ নাই। তিনি অদ্বিতীয়, তাঁর কোনো শরীক নাই, রাজত্ব তাঁরই। তাঁরই জন্য সকল প্রশংসা, তিনি সবকিছু করতে সক্ষম’।[14]
জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘সম্পূর্ণ আরাফা অবস্থানের জায়গা। অতএব, বাতনে আরাফাত স্থান হতে চলে যাও। সম্পূর্ণ মুযদালিফা অবস্থানের জায়গা। অতএব, বাত্বনে মুহাসসার হতে চলে যাও। সম্পূর্ণ মিনা কুরবানীর স্থান’।[15] অতএব, নিয়ম হলো আরাফায় প্রবেশের আগে নামেরা প্রান্তরে উরানা উপত্যকায় অবস্থান করে সূর্য ঢলে গেলে যোহর ও আছরের ছালাত একসাথে এক আযানে ও দুই ইক্বামতে ক্বছর করে আদায় করে আরাফার সীমানায় প্রবেশ করবে। কিন্তু এত মানুষের পক্ষে সেভাবে সম্ভব হয়ে উঠবে না। ফলে মিনা হতে সরাসরি আরাফার সীমানায় যাওয়া হয়। আশা করা যায় যে, নিরুপায় অবস্থার কারণে কোনো সমস্যা হবে না। তবে কেউ যদি কাফেলা ছাড়াই একাকী হজ্জ করে, তাহলে প্রাণপণে চেষ্টা করা উচিত। এখানে যোহর-আছরের আগে পরে কোনো সুন্নাত পড়বে না। কারণ, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো সফরে সুন্নাত পড়তেন না। তবে তিনি ফজরের দুই রাকআত সুন্নাত সফরে পড়তেন। এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম যে, মিনা হতে সূর্য উদিত হওয়ার পর আরাফায় যেতে হবে। কিন্তু ভিড়ের কারণে সূর্য উদিত হওয়ার আগেই মিনা হতে আরাফার মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়। যদি কাউকে নিরুপায় হয়ে যেতে হয়, তাহলে কোনো সমস্যা হবে না।
মূলত আরাফায় অবস্থান করাই হলো হজ্জ। কাজেই আরাফায় অবস্থান করা ফরয। আরাফায় অবস্থান ছুটে গেলে হজ্জ বাতিল বলে গণ্য হবে। আর সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফায় থাকা জরুরী। আব্দুর রহমান ইবনু ইয়া‘মার রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আরাফাই মূলত হজ্জ। মুযদালিফার রাতে ফজরের সময় হওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত কেউ যদি আরাফার মাঠে উপস্থিত হতে পারে, তাহলে তার হজ্জ হয়ে যাবে। আর মিনায় থাকার সময়সীমা হলো তিন দিন। যদি কেউ দুই দিন থেকে চলে যায় তার গুনাহ হবে না। আর যদি কেউ তিন দিন থাকে তাহলে তার গুনাহ হবে না’।[16] উরওয়া ইবনু মুযাররিস আত-ত্বাঈ রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি মুযদালিফায় রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আসলাম। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! ‘ত্বায়ে’ অবস্থিত একটি পাহাড়ের নিকট হতে এসেছি। আমার বাহন ক্লান্ত হয়ে গেছে। আমি নিজেও ক্লান্ত হয়েছি। আল্লাহর কসম! আমি এমন কোনো পাহাড় ছাড়িনি, যেখানে আমি অবস্থান করিনি (আমার ও বাহনের ক্লান্তির কারণে সব পাহাড়েই অবস্থান করতে হয়েছে)। এ অবস্থায় আমার হজ্জ সম্পূর্ণ হয়েছে কি? তখন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের সাথে মুযদালিফায় ফজরের ছালাত আদায় করল এবং এ সময়ের পূর্বের দিনে বা রাতে আরাফাতে উপস্থিত হলো, সে তার হজ্জ পরিপূর্ণ করল এবং হজ্জের সমস্ত কাজ সম্পূর্ণ করল’।[17]
আরাফার দিন সূর্য ঢলা পর্যন্ত আরাফার মাঠে অবস্থান করলে ফরয আদায় হয়ে যাবে। তবে সূর্যাস্ত পর্যন্ত থাকতে না পারলে ওয়াজিব ছুটে যাবে। তখন কাফফারা দিতে হবে। আরাফার দিন সূর্য ঢলে যাওয়ার পর যোহর ও আছর এক আযানে এবং দুই ইক্বামতে যোহরের সময়ে ক্বছর করতে হবে। সম্ভব হলে ইমামের সাথে জামাআতে আদায় করবে। সম্ভব না হলে নিজ স্থানে যোহর-আছর এক সাথে ক্বছর আদায় করবে। কারণ এটাই নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাত এবং ছাহাবীগণের আমল। যোহর ও আছর নির্ধারিত সময়ে পূর্ণ ছালাত আদায় করা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাত অমান্য করা। জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন,ثُمَّ أَذَّنَ بِلَالٌ ثُمَّ أَقَامَ فَصَلَّى الظُّهْرَ ثُمَّ أَقَامَ فَصَلَّى الْعَصْرَ وَلَمْ يُصَلِّ بَيْنَهُمَا شَيْئًا ‘অতঃপর বেলাল আযান দিলেন। এরপর তিনি ইক্বামত দিলে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যোহরের ছালাত আদায় করালেন। আবার ইক্বামত দিলেন, তিনি আছরের ছালাত আদায় করালেন। তবে উভয় ছালাতের মাঝে কোনো সুন্নাত পড়লেন না’।[18]
রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মত হয়ে তাঁর সুন্নাত বিরোধী কোনো আমল করা কোন মুসলিমের জন্য জায়েয নয়। আরাফার দিন ছিয়াম পালন করলে অনেক নেকী। তবে যারা হজ্জ পালন করতে এসেছে, তারা ছিয়াম পালন করতে পারবে না। হারেছের কন্যা উম্মুল ফাযল রযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, কিছু লোক রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফার দিন ছিয়াম অবস্থায় আছেন কি না, তাতে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তাদের কেউ বলল, তিনি ছিয়াম আছেন। আর কেউ বলল, না, তিনি ছিয়াম নেই। এতে উম্মুল ফাযল রযিয়াল্লাহু আনহা এক পিয়ালা দুধ রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে পাঠালেন। তখন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা পান করলেন। এ সময় তিনি আরাফায় উটের উপর অবস্থান করছিলেন।[19] এই হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, হজ্জ পালনকারীদের আরাফার দিন ছিয়াম পালন করতে হবে না। অতএব, যোহর এবং আছর এক আযানে ও দুই ইক্বামতে দুই রাকআত করে মোট চার রাকআত ক্বছর ছালাত যোহরের সময়ে আদায় করে আরাফার ময়দানে দু‘আ-দরূদ, যিকির-আযকার ও তাসবীহ-তাহলীল এবং তালবীয়াহ পাঠে ব্যস্ত থাকা উচিত। মূলত, এটাই রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাত।
আব্দুল্লাহ ইবনু উমার রযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘সবচেয়ে উত্তম দু‘আ হলো আরাফার দিনের দু‘আ। আর সবচেয়ে উত্তম দু‘আ যা আমি বলেছি এবং আমার পূর্ববর্তী নবীগণ বলেছে তা হলো,لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ، لَهُ المُلْكُ وَلَهُ الحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ অর্থ : ‘আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো মা‘বূদ নেই। তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই। রাজত্ব তাঁরই। প্রশংসা তাঁর। তিনিই সর্বশক্তিমান’।[20]
উক্ত হাদীছসমূহ থেকে বুঝা যায়, এই দু‘আটিসহ তালবিয়া বেশি বেশি পাঠ করতে হবে। কোনো ত্বরীক্বা বা বিশেষ কোনো পদ্ধতিতে দু‘আ-দরূদ, যিকির-আযকার করা যাবে না; বরং একাকী কেবলামুখী হয়ে দুই হাত তুলে দু‘আ করবে। উসামা ইবনু যায়েদ রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি আরাফার মাঠে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিছনে বসেছিলাম। তিনি তাঁর দুই হাত তুলে দু‘আ করতে লাগলেন। ইতোমধ্যে তাঁর উটটি একটু সরে গেল। তখন তার লাগামটি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাত হতে পড়ে গেল। তিনি তাঁর এক হাত দিয়ে লাগামটি উঠিয়ে নিলেন এবং অপর হাতটি উঠানো ছিল।[21] এই হাদীছ প্রমাণ করে আরাফার মাঠে হাত তুলে দু‘আ করতে হবে। সম্ভব হলে জাবালে রহমতকে সামনে রেখে কেবলামুখী হয়ে দুই হাত তুলে দু‘আ করবে। তবে গোটা আরাফাই অবস্থানের জায়গা। জাবের রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমি এখানে কুরবানী করলাম, গোটা মিনা কুরবানীর স্থান। তোমরা তোমাদের স্থানে কুরবানী করো। আমি এখানে অবস্থান করলাম। গোটা আরাফাই অবস্থানের জায়গা। আর আমি এখানে অবস্থান করলাম। গোটা মুযদালিফায় অবস্থানের জায়গা’।[22] এসব স্থানে অবস্থান করতে হবে, তাসবীহ-তাহলীল, যিকির-আযকার করতে হবে ও তালবীয়া পাঠ করতে হবে।
যা করা নিষিদ্ধ :
(১) আরাফার জন্য বিশেষভাবে গোসল করা।
(২) বিভিন্ন ত্বরীক্বার অযীফা ও বানোয়াট দু‘আ-দরূদ পাঠ করা।
(৩) জাবালে রহমত পাহাড়ে উঠা, পাথরে চুমু খাওয়া ও চেহারায় মালিশ করা।
(৪) জাবালে রহমতে ত্বাওয়াফ করা ও ছবি তোলা বা সেখানে কিছু লিখা।
(৫) খুৎবা শেষ হওয়ার পূর্বে ছালাত আদায় করা।
(৬) যোহর-আছর ছালাত এক সাথে আদায় না করে নির্ধারিত সময়ে ভিন্নভাবে আদায় করা।
(৭) যোহর-আছরের সুন্নাত বা অন্য কোনো নফল ছালাত আদায় করা।
(৮) অনর্থক গল্প-গুজবে লিপ্ত হওয়া।
(৯) বিশেষ পদ্ধতিতে মীলাদ ও যিকির করা।
(১০) সূর্যাস্তের পূর্বে আরাফার ময়দান ত্যাগ করা।
(১১) আরাফার সীমান্তের বাইরে ঘোরাফেরা করা।
(চলবে)
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/১৭২৮; ছহীহ মুসলিম, হা/১৩০২।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৪১১; মিশকাত, হা/২৬৩৬।
[3]. আবূ দাঊদ, হা/১৯৮৫; হাদীছ ছহীহ; মিশকাত, হা/২৬৫৪।
[4]. ছহীহ বুখারী, হা/১৭৩০; ছহীহ মুসলিম, হা/১২৪৬।
[5]. বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা, হা/৯৫০২।
[6]. তিরমিযী, হা/৮৭৯, হাদীছ ছহীহ।
[7]. ছহীহ বুখারী, হা/১০৮২; তিরমিযী, হা/৮৮২, হাদীছ ছহীহ।
[8]. ছহীহ বুখারী, হা/১৬৫৯; ছহীহ মুসলিম, হা/১২৮৫; মিশকাত, হা/২৫৯২।
[9]. ছহীহ মুসলিম, হা/১২১৮; মিশকাত, হা/২৫৯৩।
[10]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৩৪৮; মিশকাত, হা/২৫৯৪।
[11]. আবূ দাঊদ, হা/১৯১৯, হাদীছ ছহীহ; মিশকাত, হা/২৫৯৫।
[12]. আবূ দাঊদ, হা/১৯৩৭, হাদীছ ছহীহ; মিশকাত, হা/২৫৯৬।
[13]. আবূ দাঊদ, হা/১৯১৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/২০৩৫০, হাদীছ ছহীহ; মিশকাত, হা/২৫৯৭।
[14]. তিরমিযী, হা/৩৫৮৫, হাদীছ হাসান, তাহক্বীক : আহমাদ শাকের; মিশকাত, হা/২৫৯৮।
[15]. ইবনু মাজাহ, হা/৩০১২, হাদীছ ছহীহ।
[16]. তিরমিযী, হা/৮৮৯, হাদীছ ছহীহ, তাহক্বীক : আহমাদ শাকের; আবূ দাঊদ, হা/১৯৪৯; মিশকাত, হা/২৭১৪।
[17]. তিরমিযী, হা/৮৯১, হাদীছ ছহীহ, তাহক্বীক : আহমাদ শাকের; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮৩২৬; আবূ দাঊদ, হা/১৯৫০।
[18]. ছহীহ মুসলিম, হা/১২১৮; মিশকাত, হা/২৫৫৫।
[19]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯৮৮; ছহীহ মুসলিম, হা/১১২৩।
[20]. তিরমিযী, হা/৩৫৮৫, হাদীছ হাসান; মিশকাত, হা/২৫৯৮।
[21]. নাসাঈ, হা/৩০১১, সনদ ছহীহ; মুসনাদে আহমাদ, হা/২১৮৭০।
[22]. ছহীহ মুসলিম, হা/১২১৮; মিশকাত, হা/২৫৯৩।