কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

অহির বাস্তবতা বিশ্লেষণ (১৪তম পর্ব)

post title will place here

(মিন্নাতুল বারী- ২১তম পর্ব)


[যে হাদীছের ব্যাখ্যা চলছে :

حَدَّثَنَا عَبْدَانُ، قَالَ: أَخْبَرَنَا عَبْدُ اللَّهِ قَالَ: أَخْبَرَنَا يُونُسُ، عَنِ الزُّهْرِيِّ، ح وحَدَّثَنَا بِشْرُ بْنُ مُحَمَّدٍ، قَالَ: أَخْبَرَنَا عَبْدُ اللَّهِ، قَالَ: أَخْبَرَنَا يُونُسُ، وَمَعْمَرٌ، عَنِ الزُّهْرِيِّ، نَحْوَهُ قَالَ: أَخْبَرَنِي عُبَيْدُ اللَّهِ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ:كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَجْوَدَ النَّاسِ، وَكَانَ أَجْوَدُ مَا يَكُونُ فِي رَمَضَانَ حِينَ يَلْقَاهُ جِبْرِيلُ، وَكَانَ يَلْقَاهُ فِي كُلِّ لَيْلَةٍ مِنْ رَمَضَانَ فَيُدَارِسُهُ القُرْآنَ، فَلَرَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَجْوَدُ بِالخَيْرِ مِنَ الرِّيحِ المُرْسَلَةِ.

অনুবাদ :

ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ বলেন, আমাকে আবদান হাদীছ শুনিয়েছে। তিনি বলেন, আমাকে আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহিমাহুল্লাহ হাদীছ শুনিয়েছে। তিনি বলেন, আমাকে ইউনুসরহিমাহুল্লাহ হাদীছ শুনিয়েছে, তিনি যুহরী রহিমাহুল্লাহ থেকে। ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ বলেন, আমাকে আরো হাদীছ শুনিয়েছেন বিশর ইবনু মুহাম্মাদ রহিমাহুল্লাহ। তিনি বলেন, আমাকে আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহিমাহুল্লাহ হাদীছ শুনিয়েছেন। তিনি বলেন, আমাকে ইউনুস ও মা‘মার হাদীছ শুনিয়েছেন, তারা যুহরী রহিমাহুল্লাহ থেকে। তিনি বলেন, আমাকে হাদীছ শুনিয়েছেন উবায়দুল্লাহ ইবনু আব্দুল্লাহরহিমাহুল্লাহ, তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা। রামাযানে তিনি আরো বেশি দানশীল হতেন, যখন জিবরীল আলাইহিস সালাম তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন। আর রামাযানের প্রতি রাতেই জিবরীল আলাইহিস সালাম তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং তাঁরা পরস্পর কুরআন তেলাওয়াত করে শোনাতেন। নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রহমতের বাতাস থেকেও অধিক দানশীল ছিলেন।]

রাবী পরিচিতি :

(১) আবদান :

তার প্রকৃত নাম নাম আব্দুল্লাহ ইবনু উছমান। উপনাম আবূ আব্দুর রহমান এবং উপাধি আবদান। কেন তাকে আবদান নামে ডাকা হয় তা নিয়ে দুই ধরনের মত রয়েছে।

(ক) আরবীতে অনেক সময় নাম পরিচিত হয়ে গেলে নামকে পরিবর্তন করে দেওয়া হয়। যেমন আলীকে আল্লান, আহমাদ ইউসুফ আস-সুলামীকে হামদান, ওয়াহহাব ইবনু বাকিয়্যাকে অহবান বলা হয়, ঠিক তেমনি আব্দুল্লাহ ইবনু উছমান রহিমাহুল্লাহ-কে আবদান বলা হয়। আব্দুল্লাহ-এর আবদ আর উছমান-এর আলিফ-নূন মিলিয়ে আবদান।

(খ) মূলত তার নাম আব্দুল্লাহ এবং তার উপনাম আবূ আব্দুর রহমান। নাম ও উপনাম দুটোই আবদ দিয়ে শুরু হওয়ায় আবদ-এর দ্বিবচন আবদান নামে তিনি প্রসিদ্ধ হয়ে যান।

শিক্ষকবৃন্দ : (১) আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক, (২) শু‘বা ইবনুল হাজ্জাজ, (৩) হাম্মাদ ইবনু যায়েদ, (৪) আব্বাদ ইবনুল আওয়াম, (৫) মালেক ইবনু আনাস, (৬) ইবরাহীম ইবনু সা‘দ, (৭) জারীর ইবনু আব্দুল হামীদ রহিমাহুমুল্লাহ প্রমুখ।

ছাত্রবৃন্দ : (১) ইমাম বুখারী, (২) মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াহইয়া আয-যুহলী, (৩) ইয়াকূব ইবনু সুফিয়ান আল-ফারেসী, (৪) হামেদ ইবনু মাহমূদ আল-মারওয়াযী, (৫) আহমাদ ইবনু সায়য়ার আল-মারওয়াযী, (৬) আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু সিবওয়াইহ আল-মারওয়াযী রহিমাহুমুল্লাহ প্রমুখ।

তিনি মযবূত ও গ্রহণযোগ্য রাবী। তিনি অনেক দানশীল ও মানুষের প্রতি সাহায্যপরায়ণ ছিলেন। যেমন তিনি নিজেই বলেন, مَا سَأَلَنِيْ أَحَدٌ حَاجَةً إِلَّا قُمْتُ لَهُ بِنَفْسِيْ অর্থাৎ ‘কোনো ব্যক্তি আমার কাছে সাহায্য চাওয়ার জন্য এসেছে আর আমি নিজে তার প্রয়োজন পূরণ করার জন্য চেষ্টা করিনি এমনটা কখনোই হয়নি’। এই মহান মানুষটি ২২১ হিজরীতে ৭২ বছর বয়সে মারা যান।[1]

(২) আব্দুল্লাহ :

তার পূর্ণ নাম আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক আল-হানযালী আল-মারওয়াযী রহিমাহুল্লাহ। তিনি অনেক বড় মুহাদ্দিছ, মুফাসসির, ফক্বীহ ও মুজাহিদ ছিলেন। তার পদচারণা শুধু ইলমের জগতে ছিল না, বরং তিনি যেমন দারসে হাদীছে মহান মুহাদ্দিছ, তেমনি জিহাদের ময়দানেও বীরযোদ্ধা ছিলেন। দানশীলতা, তাক্বওয়া, পরহেযগারিতা ও দুনিয়াবিমুখতায় তার জুড়ি পাওয়া ভার। তিনি এক বছর হজ্জের জন্য বের হতেন আরেক বছর জিহাদের জন্য বের হতেন। এভাবেই ইবাদত, ইলমের খেদমত ও জিহাদের মাধ্যমে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন।

শিক্ষকবৃন্দ : (১) জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ, (২) আবূ হুরায়রা, (৩) আবূ ক্বাতাদা আল-আনছারী, (৪) মুআবিয়া ইবনু আবী সুফিয়ান, (৫) যুবাইদ ইবনুছ ছালত, (৬) সায়েব ইবনু ইয়াযীদ, (৭) আব্দুল্লাহ ইবনু কারেয রহিমাহুমুল্লাহ প্রমুখ।

ছাত্রবৃন্দ : (১) উমার ইবনু আব্দুল আযীয, (২) উবাইদুল্লাহ ইবনু আবী ইয়াযীদ, (৩) ইয়াহইয়া ইবনু আবী কাছীর, (৪) আবূ সালামা ইবনু আব্দুর রহমান ইবনু আউফ, (৫) আবূ আহমাদের ছেলের মনিব আবূ সুফিয়ান রহিমাহুমুল্লাহ প্রমুখ।

সুফিয়ান ছাওরী রহিমাহুল্লাহ বলেন,لو جهدت جهدي أن أكون في السنة ثلاثة أيام على ما عليه ابن المبارك لم أقدر অর্থাৎ ‘আমি যদি বছরে তিন দিন আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহিমাহুল্লাহ-এর মতো হওয়ার চেষ্টা করি, তবুও সক্ষম হব না’। এই মহান মনীষী ১৮১ হিজরীতে দুনিয়া থেকে বিদায় নেন।[2]

(৩) ইউনুস :

তার পূর্ণ নাম ইউনুস ইবনু যুবায়ের আল-বাহেলী রহিমাহুল্লাহ। উপনাম আবূ গেলাব। তার নিসবত বাছরী, বাহেলী ও আয়লী। ইমাম যুহরী রহিমাহুল্লাহ-এর ছাত্রদের মধ্যে যারা সবচেয়ে মযবূত ও গ্রহণযোগ্য তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন ইউনুস ইবনু ইয়াযীদ আল-আয়লী রহিমাহুল্লাহ।

শিক্ষকবৃন্দ : (১) বারা ইবনু আযেব, (২) কাছীর ইবনুছ ছালত, (৩) মুহাম্মাদ ইবনু সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ, (৪) আব্দুল্লাহ ইবনু উমার ইবনুল খাত্ত্বাব, (৫) জুনদুব ইবনু আব্দুল্লাহ আল-বাজালী রযিয়াল্লাহু আনহুম।

ছাত্রবৃন্দ : (১) হুমাইদ ইবনু হেলাল আল-আদাবী, (২) আব্দুল্লাহ ইবনু আউন, (৩) ক্বাতাদা ইবনু দি‘আমা, (৪) মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন রহিমাহুমুল্লাহ। তিনি ৯০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।[3]

(৪) বিশর ইবনু মুহাম্মাদ :

তার পূর্ণ নাম বিশর ইবনু মুহাম্মাদ আস-সিখতিয়ানী রহিমাহুল্লাহ। উপনাম আবূ মুহাম্মাদ। কুতুবে সিত্তাহর কেউই তার থেকে হাদীছ গ্রহণ করেননি। শুধু ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ হাদীছ গ্রহণ করেছেন। তার উপর মুরজিয়া হওয়ার বক্তব্য আছে। ইবনু হিব্বান রহিমাহুল্লাহ তাকে ‘কিতাবুছ ছিক্বাত’-এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। যেহেতু তিনি ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ-এর শিক্ষকগণের অন্তর্ভুক্ত, সেহেতু তার হাদীছ সম্পর্কে ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ-ই বেশি অবগত ছিলেন।

শিক্ষকবৃন্দ : (১) আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক, (২) ফাযল ইবনু মূসা আস-সিনানী, (৩) ইয়াহইয়া ইবনু ওয়াযিহ রহিমাহুমুল্লাহ।

ছাত্রবৃন্দ : (১) ইমাম বুখারী, (২) আহমাদ ইবনু সায়য়ার আল-মারওয়াযী, (৩) জা‘ফর ইবনু মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান আল-ফিরয়াবী রহিমাহুমুল্লাহ। তিনি ২২৪ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।[4]

(৫) মা‘মার :

মা‘মার ইবনু রাশেদ রহিমাহুল্লাহ। তার পূর্ণ নাম মা‘মার ইবনু রাশেদ আল-আযদী রহিমাহুল্লাহ। উপনাম আবূ উরওয়া আল-বাছরী। তিনি ইয়ামানের বিখ্যাত মুহাদ্দিছ। তার অন্যতম ছাত্র মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাকের লেখক আব্দুর রাযযাক ইবনু হাম্মাম আছ-ছানআনী তার থেকে প্রায় ১০ হাজার হাদীছ শ্রবণ করেছেন। স্বাভাবিকভাবে তিনি একজন মযবূত ও গ্রহণযোগ্য ইমাম ছিলেন। তবে যখন তিনি নিজ শহর ইয়ামানের বাহিরে সফর করা অবস্থায় বিশেষ করে ইরাকের বাছরা নগরীতে হাদীছ বর্ণনা করেন, তখন তার নিকটে তার লিখিত পাণ্ডুলিপি না থাকায় কিছু বর্ণনায় সমস্যা হয়। তেমনিভাবে তিনি যখন ছাবিত আ‘মাশ ও হিশাম থেকে কোনো হাদীছ বর্ণনা করেন, তখনও কিছু ত্রুটি হয়ে যায়। তার লিখিত অন্যতম হাদীছগ্রন্থ জামে‘ মা‘মার ইবনু রাশেদ বর্তমানে প্রকাশিত আকারে পাওয়া যায়।

শিক্ষকবৃন্দ : (১) ইবরাহীম ইবনু মায়সারা, (২) যিয়াদ ইবনু ইলাকা, (৩) ছালেহ ইবনু কায়সান, (৪) আব্দুল্লাহ ইবনু তাঊস, (৫) আতা আল-খুরাসানী, (৬) আমর ইবনু দীনার আল-মাক্কী, (৭) মুহাম্মাদ ইবনু মুনকাদির, (৮) হিশাম ইবনু উরওয়া রহিমাহুমুল্লাহ।

ছাত্রবৃন্দ : (১) সুফিয়ান ইবনু উয়াইনা, (২) শু‘বা ইবনুল হাজ্জাজ, (৩) আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক, (৪) আমর ইবনু দীনার, (৫) মুহাম্মাদ ইবনু আমর আল-ওয়াক্বীদী, (৬) মুহাম্মাদ ইবনু কাছীর আছ-ছানআনী, (৭) মারওয়ান ইবনু মুআবিয়া আল-ফাযারী, (৮) ইয়াহইয়া ইবনু আবী কাছীর রহিমাহুমুল্লাহ। এই মহান মুহাদ্দিছ ১৫৪ হিজরীতে দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করেন।[5]

(৬) উবাইদুল্লাহ ইবনু আব্দুল্লাহ :

তার পূর্ণ নাম উবাইদুল্লাহ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু উতবা ইবনু মাসঊদ রহিমাহুল্লাহ। কুনিয়াত বা উপনাম আবূ আব্দুল্লাহ। নিসবত আল-হুযালী ও মাদানী। তিনি উমার ইবনু আব্দুল আযীয রহিমাহুল্লাহ-এর শিক্ষক ছিলেন। মদীনার বিখ্যাত সাতজন ফক্বীহর একজন ছিলেন তিনি, যারা ছাহাবীগণের জীবদ্দশাতেই ফতওয়া দিতেন। কুতুবে সিত্তাহর সকলেই তার হাদীছ গ্রহণ করেছেন।

শিক্ষকবৃন্দ : (১) আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস, (২) আব্দুল্লাহ ইবনু যামআ, (৩) আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ, (৪) উরওয়া ইবনু যুবায়ের, (৫) আব্দুল্লাহ ইবনু উমার ইবনুল খাত্ত্বাব, (৬) উমার ইবনুল খাত্ত্বাব, (৭) আম্মার ইবনু ইয়াসার, (৮) আবূ সাঈদ খুদরী রযিয়াল্লাহু আনহুম।

ছাত্রবৃন্দ : (১) ছালেহ ইবনু কায়সান, (২) সা‘দ ইবনু ইবরাহীম, (৩) মূসা ইবনু আবী আয়েশা, (৪) ইরাক ইবনু মালেক, (৫) সাঈদ ইবনু আবী হিন্দ, (৬) সালেম আবূ নাযর রহিমাহুমুল্লাহ। এই মহান ইমাম ৯৪ হিজরী মতান্তরে ৯৮ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।[6]

সনদের সূক্ষ্মতা :

উক্ত হাদীছে ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ তার থেকে নিয়ে ইমাম যুহরী রহিমাহুল্লাহ পর্যন্ত দুটি আলাদা সনদ উল্লেখ করেছেন। এই দুটি আলাদা সনদ উল্লেখ করতে গিয়ে উছূলে হাদীছের দুটি পরিভাষা তিনি ব্যবহার করেছেন।

প্রথমত, আরবী বর্ণ (ح) চিহ্নের মাধ্যমে সনদের মধ্যে পরিবর্তনকে বুঝিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, উভয় সনদের ইবারতের মধ্যে কতটুকু মিল রয়েছে তা বুঝাতে আরবী শব্দ ‘নাহওয়াহু’ (نحوه) ব্যবহার করেছেন। নিম্নে এই দুটি বিষয়ের উপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।

মিছলাহু (مثله) ও নাহওয়াহু (نحوه)-এর মধ্যে পার্থক্য : সাধারণত হাদীছের কয়েকটি সনদ হলে সনদের সাথে সাথে মতন বা মূল টেক্সটেও কিছু নতুনত্ব থাকে। সনদের পরিবর্তনের সাথে সাথে মতনের এই পরিবর্তন কতটুকু তা বুঝানোর জন্য মুহাদ্দিছগণ সাধারণত দুটি শব্দ ব্যবহার করে থাকেন। একটি মিছলাহু (مثله) এবং অন্যটি নাহওয়াহু (نحوه)। যদি বলা হয় মিছলাহু, তাহলে উদ্দেশ্য হচ্ছে শব্দে শব্দে হুবহু মিল রয়েছে। আর যদি বলা হয় নাহওয়াহু, তাহলে বুঝতে হবে শব্দে হালকা পার্থক্য থাকলেও ভাবার্থ এক।[7]

তাহবীল কী ও কেন?

এক সনদ থেকে আরেক সনদের দিকে যাওয়ার জন্য মধ্যখানে (ح) হা চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। যার দ্বারা তাহবীল (تحويل) উদ্দেশ্য। মূল মাদ্দাহ ح-و-ل থেকে বাবে তাফঈল-এর মাছদার হচ্ছে তাহবীল (تحويل)। যার শাব্দিক অর্থ পরিবর্তন। তাহবীলের পরিবর্তে তার সংক্ষিপ্ত রূপ হা (ح) ব্যবহার করা হয়। হাদীছ পড়ার সময় উক্ত হা (ح)-এর জায়গায় তাহবীল পুরোটাই উচ্চারণ করা যায় অথবা শুধু (حاء) হাউন তানবীনসহ পুরো বর্ণ উচ্চারণ করা যায়। তবে বর্তমানে হাদীছ পড়ার সময় যেটা প্রচলিত আছে তা হচ্ছে শুধু হা (ح) উচ্চারণ করা। শুধু হা (ح) উচ্চারণ শুনলেই ছাত্ররা বুঝে ফেলে যে, এখানে সনদ পরিবর্তন হচ্ছে। তবে হা (ح) উচ্চারণের পরপরই সবসময় একটা শব্দ অতিরিক্ত করা উচিত আর তা হচ্ছে ‘ওয়া বিহি কলা’ (وبه قال)। তথা একত্রে হা (ح وبه قال حدثنا) ‘ওয়া বিহি কলা হাদ্দাছানা’। এখানে ওয়া বিহি দ্বারা আমরা যে সনদে মূল লেখক তথা ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছেছে সেই সনদ উদ্দেশ্য। আর ‘কলা’ (قال) দ্বারা ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ বলেছেন উদ্দেশ্য।

কেউ কেউ হা (ح) দ্বারা হায়েল (حائل) উদ্দেশ্য নিয়েছেন। যার অর্থ হচ্ছে দুটি বিষয়ের মাঝে আড় সৃষ্টি করা। তথা এখানে দুটি সনদ যেন একত্রিত না হয়ে যায় এই জন্য হা (ح) দেওয়া হয়েছে। যারা হা (ح) দ্বারা হায়েল উদ্দেশ্য নিয়েছেন তারা হাদীছ পড়ার সময় এখানে কোনো কিছু উচ্চারণের কথা বলেননি। বরং তাদের মতে এখানে চুপ থাকতে হবে।

পশ্চিম বা স্পেনের উলামায়ে কেরাম হা (ح) দ্বারা হাদীছ উদ্দেশ্য গ্রহণ করেন এবং হা-এর জায়গায় সবসময় হাদীছ পড়ে থাকেন তারা।

কেউ কেউ এখানে হা-এর পরিবর্তে (صح) ‘ছহ’ ব্যবহার করেছেন যার অর্থ হচ্ছে সঠিক। তথা কেউ যেন মনে না করে যে এখানে কোনো সমস্যা আছে বা কোনো রাবী বা শব্দ বিলুপ্ত হয়েছে, বরং যেভাবে আছে সেভাবেই বিশুদ্ধ আছে।[8]

হাদীছের সাথে অধ্যায়ের সম্পর্ক :

আলোচ্য হাদীছটির স্বাভাবিক অর্থ দেখলে সবাই মনে করবে এই হাদীছ রামাযানের ফযীলতের হাদীছ। কিন্তু ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ এই হাদীছকে অহির প্রারম্ভ অধ্যায়ে নিয়ে এসেছেন। অথচ এই হাদীছে অহির প্রারম্ভ নিয়ে কিছুই বলা নাই। সুতরাং এই হাদীছের সাথে অধ্যায়ের সামঞ্জস্য জানা অতীব জরুরী।

ব্যাখ্যাকারগণ লিখেছেন, পবিত্র কুরআন সর্বপ্রথম রামাযান মাসে অবতীর্ণ হয়েছে মর্মে সরাসরি কোনো বক্তব্য ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ-এর ছহীহ হওয়ার শর্ত অনুযায়ী না পাওয়ার কারণে তিনি এমন একটি হাদীছ খুঁজেছেন, যার দ্বারা তিনি পবিত্র কুরআনের রামাযান মাসে অবতীর্ণ হওয়া প্রমাণ করবেন। আর সেই লক্ষ্যেই তিনি এই হাদীছকে এখানে উল্লেখ করেছেন। এই হাদীছে রামাযান মাসের প্রতি রাতে জিবরীল আলাইহিস সালাম-এর আসা এবং পবিত্র কুরআন শুনিয়ে যাওয়া প্রমাণ করে পবিত্র রামাযান মাসের সাথে পবিত্র কুরআনের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। অন্যদিকে পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াত প্রমাণ করে, পবিত্র কুরআন রামাযান মাসে অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং প্রমাণিত হয় যে, রামাযান মাসের সাথে পবিত্র কুরআনের গভীর সম্পর্কটিই হচ্ছে পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে রামাযান মাসে। প্রথম অহিও এসেছে রামাযান মাসে। সুতরাং হাদীছের সাথে অহির সূচনা বা অধ্যায়ের নামের কোনো বৈপরীত্য নাই।[9]

(চলবে)

আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক

ফাযেল, দারুল উলূম দেওবান্দ, ভারত; বি. এ (অনার্স), মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব;
এমএসসি, ইসলামিক ব্যাংকিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, ইউনিভার্সিটি অফ ডান্ডি, যুক্তরাজ্য।

[1]. আল-জারহ ওয়াত-তা‘দীল, ৫/১১৩; তারীখুল ইসলাম, ৫/৬০৫।

[2]. আল-জারহ ওয়াত-তা‘দীল, ৫/১৭৯; তারীখুল ইসলাম, ৪/৮৮২।

[3]. তারীখুল ইসলাম, ৪/২৫৭।

[4]. তাহযীবুত তাহযীব, ১/২৩১।

[5]. সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৭/৫।

[6]. তাহযীবুত তাহযীব, ৩/১৫।

[7]. ইরশাদুস সারী, ১/৭১।

[8]. উমদাতুল ক্বারী, ১/৮; মুক্বাদ্দামা ইবনুছ ছালাহ, পৃ. ৮৮।

[9]. ফাতহুল বারী, ১/৮।

Magazine