কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

আহলেহাদীছদের উপর মিথ্যা অপবাদ ও তার জবাব (পর্ব-৭)

(জুন’২১ সংখ্যায় প্রকাশিতের পর)

ভুল ধারণা-৭ : আহলেহাদীছদের দাওয়াতের উদ্দেশ্য উম্মতের মাধ্যে মতভেদ তৈরি করা :*

প্রত্যেক মতভেদ কি নিন্দনীয়? নিশ্চয়ই না, বরং ঐ মতভেদ নিন্দনীয়, যা সত্যের বিরোধিতার উদ্দেশ্যে করা হয়। হক্বের বিরুদ্ধে মতভেদ করা ভ্রষ্টতা। কিন্তু বাতিল বা অসত্যের বিরোধিতা করা ফরয। ইসলাম কখনো এই শিক্ষা দেয় না যে, সঠিক বিষয়কে বেঠিক আর বেঠিক বিষয়কে সঠিক বলে সাব্যস্ত করতে হবে। যদি এই নীতির অনুসরণ করা হয়, তাহলে সমাজ থেকে النَّهْىِ عَنِ الْمُنْكَرِ তথা অন্যায় কাজে বাধা প্রদান করার যেই আদেশ রয়েছে, তার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হবে। এর ফলশ্রুতিতে সত্য এবং মিথ্যার পার্থক্যই সমাজ থেকে উঠে যাবে। সুতরাং ভুল কথার প্রতিরোধ করা জরুরী, চাই তা ভ্রষ্টতার বিরুদ্ধে হোক বা ইলমী ভুলের বিরুদ্ধে হোক।

১. সত্যের বিরোধিতায় যে ইখতেলাফ করা হয়, তা আহলেহাদীছদের নিকটনিন্দনীয় : সত্যের বিরুদ্ধে মতভেদ করা মূলত নিন্দনীয় কাজ। সত্য উন্মোচিত হওয়ার পর তা অস্বীকার করা বা তার বিরোধিতা করা এবং আহলে হক্ব বা সত্যপন্থীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন দল গঠন করা আল্লাহর নিকট শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মহান আল্লাহ বলেন, وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ ‘আর তোমারা তাদের মতো হয়ো না, যাদের নিকট স্পষ্ট প্রমাণ আসার পরও বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে এবং পরস্পর মতভেদে লিপ্ত হয়েছে; তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি’ (আলে ইমরান, ৩/১০৫)। এই আয়াত দ্বারা স্পষ্ট হয় যে, নিজেদের মাঝে পরস্পরে মারামারি আর ফাসাদ সৃষ্টিসহ সকল মন্দের মূল শেকড় হচ্ছে- সত্য সুস্পষ্ট হওয়ার পরও তার অনুসরণ না করে নিজের জেদের বশীভূত হয়ে তার উপর অটল থাকা। কিন্তু ঐক্যের কথা ভেবে একে অপরের দ্বীনি ভুলগুলোকে উপেক্ষা করা এবং সংশোধনের পদক্ষেপ না নেওয়া নিশ্চয় ভুল হিসেবে গণ্য হবে। কেননা ঐক্যের উদ্দেশ্য এই নয় যে, সত্য-মিথ্যা বিচার না করে শুধু ঐক্য গড়ে তোলা; বরং মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সকল মুসলিমের সত্যের উপর ঐক্যের সেতুবন্ধন তৈরি করা। সুতরাং দলীল দ্বারা প্রমাণিত সত্যের উপর ঐক্য গড়ার স্বার্থে নির্দ্বিধায় সঠিক বিষয়টি বর্ণনা করে দেওয়া আবশ্যক। অন্যথা আলেমগণ তাদের যিম্মাদারী থেকে মুক্ত হতে পারবেন না।

২. উম্মতের মতভেদের যুগে সুন্নাহর অনুসরণেই মুক্তি নিহিত আছে : নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরবর্তী যুগে উম্মতের মাঝে যে মতভেদ সৃষ্টি হবে, তা পূর্বেই বলে গেছেন। সে সময় তিনি এই কথা বলেননি যে, প্রত্যেকে নিজ নিজ মতের উপর থেকেই ঐক্য গড়ে তুলবে; বরং তিনি এই মতবিরোধের যুগে তাঁর এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের পথ অনুসরণ করার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ

‘তোমাদের মধ্য হতে যারা আমার পরে জীবিত থাকবে, তারা অচিরেই প্রচুর মতবিরোধ দেখবে। তখন তোমরা অবশ্যই আমার ‍এবং হেদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহর অনুসরণ করবে, তোমরা তা শক্তভাবে ধারণ করবে এবং দাঁত দিয়ে আঁকড়ে ধরে থাকবে। সাবধান! (ধর্মে) প্রতিটি নবাবিষ্কৃত বিষয় হতে। কারণ প্রতিটি নবাবিষ্কৃত বিষয় হলো বিদআত আর প্রতিটি বিদআতের পরিণাম ভ্রষ্টতা’।[1] ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সকল মতবিরোধের মূল শেকড় হচ্ছে- নিজের মতকে দ্বীন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তার উপর বহাল থাকা এবং দ্বীনের মধ্যে নিজের ইচ্ছানুযায়ী পরিবর্তন করা।

৩. উম্মতের মতবিরোধের সময় সুন্নাহকে আঁকড়ে থাকা অতি সহজ নয় : পররর্তী যুগে শত্রুতা এমন ব্যাপক হবে যে, উম্মতের মতবিরোধের সময় এই মতবিরোধকে সমাধান করার জন্য নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সমাধান (কুরআন এবং হাদীছ) এর দিকে প্রত্যাবর্তন করার বিষয়টি একেবারেই থাকবে না। মানুষ বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে নিজেদের মাঝে দল তৈরির গোঁড়ামির চশমা লাগিয়ে সকল সমস্যার সমাধান করার ব্যর্থ চেষ্টা করবে। এই সময় কিতাব এবং সুন্নাহকে অন্য সকল বিষয়ের উপর প্রাধান্য দানকারীদের বড় বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হবে। আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, المُتَمَسِّكُ بِسُنَّتِي عِنْدِ اخْتِلاَفِ أُمَّتِي كَالْقَابِضِ عَلَى الجَمْرِ ‘আমার উম্মতের মতবিরোধের সময় আমার সুন্নাহকে আঁকড়ে ধারণ করার অবস্থা হবে হাতে জ্বলন্ত আগুন ধারণকারীর ন্যায় (কঠিন হবে)’।[2]

৪. আহলেহাদীছদের নিকট সত্য বলা আবশ্যক- যদিও তা কঠিন হয় : মানুষের শত্রুতা এবং অসন্তুষ্টির ভয় থেকে বাঁচার জন্য সত্যকে গোপন করে মানুষের নিকট সস্তা প্রসিদ্ধি এবং সাময়িক গ্রহণযোগ্যতা ও নিরাপত্তা অর্জিত হতে পারে, তবে মানুষের সামনে সত্যকে প্রকাশ করার যে আল্লাহর যিম্মাদারী ছিল, তা হতে মুক্ত হতে পারবে না। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, أَلاَ لاَ يَمْنَعَنَّ رَجُلاً هَيْبَةُ النَّاسِ أَنْ يَقُولَ بِحَقٍّ إِذَا عَلِمَهُ ‘সাবধান! কেউ যখন কোনো সত্য কথা জানবে, তখন তাকে মানুষের ভয় যেন সেই সত্য বলা থেকে বিরত না রাখে’।[3]

৫. অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা আবশ্যক : আল্লাহর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরবর্তী যুগে সত্যপন্থীদের ফযীলত বর্ণনা করেছেন, তারা মানুষকে ভুল পথ থেকে বাধা প্রদান করবে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, إِنَّ مِنْ أُمَّتِى قَوْماً يُعْطَوْنَ مِثْلَ أُجُورِ أَوَّلِهِمْ فَيُنْكِرُونَ الْمُنْكَرَ ‘আমার উম্মতের মধ্যে এমন কিছু মানুষ থাকবে, যাদেরকে অগ্রগামী ব্যক্তিদের ন্যায় প্রতিদান দেওয়া হবে। তারা ঐ সমস্ত লোক, যারা অন্যায়ের বিরোধিতা করবে’।[4] একথা স্পষ্ট যে, মন্দ কর্মে বাধা প্রদান করার ফলে কিছু মানুষ তাদের কথা মানবে আবার কিছু মানুষ মানবে না, যার ফলে মতভেদের সৃষ্টি হবে। কিন্তু শুধু মতভেদের ভয়ে মন্দকে প্রতিহত করা ছেড়ে দেওয়া নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হেদায়াত এবং প্রজ্ঞাপূর্ণ দাওয়াতী পদ্ধতি বর্জনের শামিল।

৬. দ্বীনের জ্ঞানসমুদ্রকে কল্পকাহিনী, কুসংস্কারের মিশ্রণ হতে পবিত্র করা একান্ত জরুরী : রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘প্রত্যেক আগতদের মধ্যে নেক, তাক্বওয়াসম্পন্ন এবং নির্ভরযোগ্য মানুষ (কিতাব ও সুন্নাহর) এ জ্ঞান গ্রহণ করবেন। আর তারাই এ জ্ঞানের মাধ্যমে সীমালঙ্ঘনকারীদের রদবদল, বাতিলপন্থীদের মিথ্যা অপবাদ এবং অজ্ঞদের ভুল ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে বিদূরিত করবেন’।[5] এই হাদীছ দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, দ্বীনকে সকল ধরনের পরিবর্তন এবং অপব্যাখ্যা হতে রক্ষার জন্য ভুলকে প্রতিহত করা জরুরী। নতুবা দ্বীনের মৌলিক শিক্ষা কুসংস্কার এবং সামাজিক বিভিন্ন রসম-রেওয়াজ এর কবলে চাপা পড়ে যাবে। আর এজন্যই সর্বদা সত্যপন্থীরা দ্বীনের হেফাযতের এই মহান দায়িত্ব পালন করে আসছেন এবং ভবিষ্যতেও করে যাবেন। অনুরূপভাবে যে সকল মানুষ পথভ্রষ্ট হওয়ার পরও নিজেকে সত্যপন্থী প্রমাণ করার চেষ্টায় লেগে আছে এবং অতি চটকদার ভাষা ব্যবহার করে উম্মতের অসচেতন মানুষগুলোকে ফুঁসলিয়ে নিজেদের দুনিয়ার জীবন সুন্দর বানানোর (অর্থ কামানোর) মাধ্যম বানিয়েছে, তাদের মুখোশ উন্মোচন করা শুধু হক্বের প্রচার নয়, বরং উম্মতের কল্যাণের জন্য মৌলিক দায়িত্বও বটে।

সুতরাং আহলেহাদীছদের বক্তব্য এবং লেখনির মধ্যে যেখানেই দ্বীনে হক্ব-এর বর্ণনা এবং কল্যাণের প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়, সেখানেই বাতিল এবং বাতিলপন্থীদের প্রতিহতও করা হয়ে থাকে। এমনকি কোনো জায়গায় কোনো যোগ্য ব্যক্তিরও যদি কোনো বিষয়ে ভুল হয়ে থাকে, তখনও দ্বীনের হেফাযত এবং সত্যকে উন্মোচন করার উদ্দেশ্যে আহলেহাদীছগণ তা বর্ণনা করে দেন। আর এর দ্বারা কোনো ব্যক্তিকে প্রতিহত করা উদ্দেশ্য হয় না, বরং সত্যকে বর্ণনা করে দেওয়াই উদ্দশ্যে হয়ে থাকে। মূলত আহলেহাদীছদের নিকট সত্যের স্থান কারও ব্যক্তিত্বের অনেক উপরে।

মূল (উর্দূ) : আবু যায়েদ যামীর

অনুবাদ : আখতারুজ্জামান বিন মতিউর রহমান

 শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।


[1]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭১৮৫; আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৭; তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মুসতাদরাকে হাকেম, ছহীহুল জামে‘, হা/২৫৪৯।

[2]. আল-হাকীম ফী নাওয়াদিরিল উছূল; ছহীহুল জামে‘, হা/৬৬৭৬।

[3]. তারমিযী, হা/২১৯১; ইবনু মাজাহ, হা/৪০০৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/১১৮৪২।

[4]. ছহীহুল জামে‘, ২২২৪, হাদীছটি ছহীহ।

[5]. বায়হাক্বী; তাহক্বীক্ব মিশকাত, পৃ. ২৪৮, হাদীছটি ছহীহ।

Magazine