তাক্বওয়ার পুরস্কার :
(ক) ব্যক্তিগত জীবনে তাক্বওয়ার পুরস্কার :
(১) জীবন চালানোকে আল্লাহসহজ করে দিবেন : আল্লাহ তাআলা বলেন, وَمَن يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَل لَّهُ مِنْ أَمْرِهِ يُسْرًا ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার কাজ সহজ করে দেন’ (আত-তালাক, ৬৫/৪)।
(২) মর্যাদা বৃদ্ধি করে দিবেন : আল্লাহ তাআলা বলেন,إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ ‘তোমাদের মধ্যে যে অধিক পরহেযগার সেই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদার অধিকারী। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাজ্ঞানী ও সবকিছু সম্পর্কে অবহিত’ (আল-হুজুরাত, ৪৯/১৩)।
(৩) পরকালে উত্তম পুরস্কার পাবে : আল্লাহ তাআলা বলেন,تِلْكَ الدَّارُ الْآَخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لَا يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلَا فَسَادًا وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ ‘সেই পারলৌকিক আলয় আমি তাদের জন্যই নির্ধারিত করেছি যারা পৃথিবীতে উদ্ধত ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায় না, (পরকালে) শুভ পরিণাম মুত্তাক্বীদের জন্যই’ (আল-ক্বাছাছ, ২৮/৮৩)।
(৪) পরকালে জান্নাত লাভ করবে : আল্লাহ তাআলা বলেন, وَأُزْلِفَتِ الْجَنَّةُ لِلْمُتَّقِينَ ‘আর মুত্তাক্বীদের জন্য জান্নাত নিকটবর্তী করা হবে’ (আশ-শু‘আরা, ২৬/৯০)।
(৫) আল্লাহ পাপ মোচন করে দিবেন : আল্লাহ তাআলা বলেন, ذَلِكَ أَمْرُ اللَّهِ أَنزَلَهُ إِلَيْكُمْ وَمَن يَتَّقِ اللَّهَ يُكَفِّرْ عَنْهُ سَيِّئَاتِهِ وَيُعْظِمْ لَهُ أَجْرًا ‘এটা আল্লাহর নির্দেশ যা তিনি তোমার প্রতি নাযিল করেছেন। যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার পাপ মোচন করেন এবং তাকে মহাপুরস্কার দেন’ (আত-তালাক, ৬৫/৫)।
(৬) পার্থিব জীবনে সুসংবাদ আছে : আল্লাহ তাআলা বলেন, الَّذِينَ آمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ - لَهُمُ الْبُشْرَى فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ لَا تَبْدِيلَ لِكَلِمَاتِ اللَّهِ ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ ‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাক্বওয়া অবলম্বন করত, তাদের জন্য সুসংবাদ পার্থিব জীবনে ও পরকালীন জীবনে। আল্লাহর কথার কখনো হেরফের হয় না। এটাই হলো মহাসফলতা’ (ইউনুস, ১০/৬৩-৬৪)।
(৭) জীবনে সফল হবে : আল্লাহ তাআলা বলেন,وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَخْشَ اللَّهَ وَيَتَّقْهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَائِزُونَ ‘আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে এবং তাঁর তাক্বওয়া অবলম্বন করে, তারাই কৃতকার্য’ (আন-নূর, ২৪/৫২)।
(৮) ক্বিয়ামতে পরিত্রাণের মাধ্যম হবে : আল্লাহ তাআলা তাক্বওয়াশীল বান্দাদেরকে ক্বিয়ামতের দিন মুক্তি দান করবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,ثُمَّ نُنَجِّي الَّذِينَ اتَّقَوْا وَنَذَرُ الظَّالِمِينَ فِيهَا جِثِيًّا ‘তারপর আমি (পুলছিরাত থেকে) মুত্তাক্বীদের উদ্ধার করব। আর যালেমদের সেখানে নতজানু অবস্থায় রেখে দেব’ (মারইয়াম, ১৯/৭২)।
(৯) রিযিক্বের দুয়ার খুলে যাবে : আল্লাহ তাআলা বলেন,وَمَن يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَل لَّهُ مَخْرَجًا - وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ وَمَن يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ ‘আর যে আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার জন্য নিষ্কৃতির পথ করে দেবেন। আর তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিযিক্ব দিবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট’ (আত-তালাক, ৬৫/২-৩)।
(১০) সর্বোপরি আল্লাহর ভালোবাসা পাবে : আল্লাহ তাআলা বলেন,وَلَا تَرْكَنُوا إِلَى الَّذِينَ ظَلَمُوا فَتَمَسَّكُمُ النَّارُ وَمَا لَكُم مِّن دُونِ اللَّهِ مِنْ أَوْلِيَاءَ ثُمَّ لَا تُنصَرُونَ ‘আর যারা যুলুম করেছে তোমরা তাদের প্রতি ঝুঁকে পড়ো না; পড়লে আগুন তোমাদেরকে স্পর্শ করবে। এ অবস্থায় আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোনো সাহায্যকারী থাকবে না। তারপর তোমাদেরকে সাহায্য করা হবে না’ (হূদ, ১১/১১৩)। ইমাম শাফেঈ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আমি তিনটি বিষয় পছন্দ করি। তা হলো— (ক) অভাবের সময় দান করা, (খ) নির্জনে আল্লাহকে ভয় করা, (গ) যার কাছে আশা করা হয় অথবা যাকে ভয় করা হয়, তার সামনে উচিত কথা বলা’।[1]
(খ) তাক্বওয়ার সামাজিক গুরুত্ব : সুষ্ঠু, সুন্দর সমাজ গঠনে যেসব গুণের প্রয়োজন, তা একজন তাক্বওয়া অবলম্বনকারী ব্যক্তির মধ্যে পূর্ণমাত্রায় থাকে। ফলে সে মিথ্যা বলে না, প্রতারণা করে না এবং সুষ্ঠু, সুন্দর সমাজ গড়ে তোলে।
সমাজ জীবনে তাক্বওয়া অবলম্বন করলে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা গড়ে ওঠে। যার মধ্যে তাক্বওয়া আছে সে যেমন অন্যায় কাজ করতে পারে না, তেমনি সমাজের কোনো অনিষ্ট বা অকল্যাণ হয় এমন কোনো কাজও করতে পারে না। সামাজিক মূল্যবোধ জলাঞ্জলি দিতে পারে না। মুত্তাক্বী ব্যক্তি যেমন মিথ্যা বলতে পারে না, ঠিক তেমনি আমানতের খেয়ানতও করতে পারে না। সে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে। কুরআনে এসেছে,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ كُونُواْ قَوَّامِينَ لِلّهِ شُهَدَاء بِالْقِسْطِ وَلاَ يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَى أَلاَّ تَعْدِلُواْ اعْدِلُواْ هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى وَاتَّقُواْ اللّهَ إِنَّ اللّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে অবিচল থাকবে এবং কোনো সম্প্রদায়ের শত্রুতার কারণে কখনও ন্যায়বিচার পরিত্যাগ করো না। তোমরা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করো, কেননা ন্যায়বিচার তাক্বওয়ার খুব নিকটবর্তী। আল্লাহকে ভয় করো। তোমরা যা করো, নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত’ (আল-মায়েদা, ৫/৮)।
তাক্বওয়াবিহীন সমাজে কারো প্রতি কারো আস্থা থাকে না। ফলে মানুষ মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় নেয়। নিষ্ঠাবান মানুষ ছাড়া সমাজের উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর নিষ্ঠার মূল উৎস হলো তাক্বওয়া। তাক্বওয়া থেকেই মানুষের অন্তরে দায়িত্ব, কর্তব্যবোধ আসে।
তাক্বওয়াবিহীন জীবনের পরিণতি :
তাক্বওয়াবিহীন জীবনের পরিণতি মারাত্মক। মৃত্যুর পর শেষ ঠিকানা হবে জাহান্নাম। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন, فَأَمَّا مَنْ طَغَى - وَآثَرَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا - فَإِنَّ الْجَحِيمَ هِيَ الْمَأْوَى ‘যে ব্যক্তি সীমালঙ্ঘন করে এবং পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দেয়, জাহান্নামই তার আশ্রয়স্থল’ (আন-নাযিআত, ৭৯/৩৭-৩৯)।
তাক্বওয়াবিহীন ইবাদতের আল্লাহর কাছে কোনো মূল্য নেই। আল্লাহর কাছে সেসব ইবাদত পৌঁছায়ই না। সুতরাং ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য তাক্বওয়া পূর্বশর্ত। যেমন ইরশাদ হয়েছে,لَنْ يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَكِنْ يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنْكُمْ ‘এগুলোর (কুরবানীর পশুর) গোশত ও রক্ত কখনই আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের মনের তাক্বওয়া’ (আল-হাজ্জ, ২২/৩৭)।
যার মধ্যে তাক্বওয়া নেই, তার অন্তর দুর্বল। ফলে সে অন্য সৃষ্টির কাছে মাথা নত করে। তাক্বওয়াবিহীন জীবন মানুষকে পাপ কাজের দিকে আকৃষ্ট ও ধাবিত করে। ইরশাদ হয়েছে,وَمَا أُبَرِّئُ نَفْسِي إِنَّ النَّفْسَ لأَمَّارَةٌ بِالسُّوءِ إِلاَّ مَا رَحِمَ رَبِّيَ إِنَّ رَبِّي غَفُورٌ رَّحِيمٌ ‘আমি নিজেকে নির্দোষ বলি না। নিশ্চয় মানুষের মন মন্দকর্মপ্রবণ, কিন্তু সে নয় যার প্রতি আমার পালনকর্তা অনুগ্রহ করেন। নিশ্চয় আমার পালনকর্তা ক্ষমাশীল, দয়ালু’ (ইউসুফ, ১২/৫৩)।
তাক্বওয়া ইবাদতের প্রাণ। তাক্বওয়াবিহীন ইবাদতের কোনো মূল্য নেই। এ সম্বন্ধে আল্লাহ তাআলা বলেন,سَوَاء عَلَيْهِمْ أَسْتَغْفَرْتَ لَهُمْ أَمْ لَمْ تَسْتَغْفِرْ لَهُمْ لَن يَغْفِرَ اللَّهُ لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ ‘তুমি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো অথবা না করো, উভয়ই সমান। আল্লাহ কখনও তাদেরকে ক্ষমা করবেন না। আল্লাহ পাপাচারী সম্প্রদায়কে কখনো সঠিক পথ প্রদর্শন করেন না’ (আল-মুনাফিকূন, ৬৩/৬)।
তাক্বওয়া অর্জনের উপায় :
তাক্বওয়া একটি সাধনার ব্যাপার। এটা কোনো একটি বিশেষ গুণের নাম নয়, বরং সমস্ত আখলাক্বের বুনিয়াদ। অর্থাৎ সমস্ত চরিত্রের ভিত্তি। এজন্য তাক্বওয়ার মতো গুণ অর্জনের উপায় হলো—
(ক) মনোযোগ সহকারে কুরআনুল কারীম অধ্যয়ন করা। অর্থাৎ আল্লাহর শক্তি, ক্ষমতা, ছিফাত এবং আল-কুরআনের নানা বিষয় খুঁটে খুঁটে জানা ও অর্জনের সিদ্ধান্ত নেওয়া।
(খ) ঈমানকে মযবূত করা। অর্থাৎ জ্ঞানার্জনের পর তাক্বওয়ার অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে ঈমান। আল্লাহর নির্দেশের উপর দৃঢ় ঈমান প্রয়োজন। এ বিশ্বাস হবে এমন যে, কোনো আঘাত, কোনো নির্যাতন কিংবা কোনো লোভ তাদেরকে দ্বীন থেকে একচুল নাড়াতে পারবে না। বিশ্বাস হবে এমন যে, তাদের জীবন্ত দেহের অঙ্গগুলো এক এক করে খুলে ফেলা যাবে কিন্তু হৃদয় থেকে ঈমানকে বের করা যাবে না। হারাম পথে নেওয়ার জন্য সমস্ত জগতও যদি চেষ্টা করে তবু সে একা দাঁড়িয়ে থাকবে। আর আল্লাহর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পথে তামাম দুনিয়াও যদি বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তবুও সে একা লড়ে যাবে। সত্যিকারের মুমিন আল্লাহকে জীবন-মরণ তথা সবকিছুর উপর অগ্রাধিকার দেয়।
(গ) ছিয়াম পালন করা। এটা তাক্বওয়া অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেছেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর ছিয়ামকে ফরয করা হয়েছে। যেমনিভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরয করা হয়েছিল যাতে তোমরা তাক্বওয়ার অধিকারী হতে পার’ (আল-বাক্বারা, ২/১৮৩)।
(ঘ) নবীদের জীবনী, বিশেষভাবে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সিরাত ও ছাহাবায়ে কেরামের জীবনী অধ্যয়ন করা। অর্থাৎ যাদের জীবনে আছে তাক্বওয়ার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাক্বওয়ার গুণে নিজেদেরকে গুণান্বিত করতে হলে নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ছাহাবায়ে কেরামের জীবন অনুসরণ করা একান্ত জরুরী। এমন আদর্শজীবনকে উদাহরণ হিসেবে ধরে নিয়ে গড়তে হবে নিজেদের জীবন।
(ঙ) বিশেষভাবে তাক্বওয়া অর্জনের জন্য মহান আল্লাহর কাছে দো‘আ করতে হবে।
আল্লাহ আমাদেরকে তাক্বওয়াশীল বান্দা হিসেবে কবুল করুন— আমীন!
* মুহিমনগর, চৈতনখিলা, শেরপুর।
[1]. জামেউল উলূম ওয়াল হিকাম, ১৯/১৮।