কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

কুরআনের আলোকে হাদীছের অপরিহার্যতা (পর্ব-৩)

post title will place here

শরীআত প্রণয়নে হাদীছের স্বাধীন সত্তা :

আধুনিক যুগের মুনকিরে হাদীছরা সবসময় হাদীছকে কুরআনের বিরুদ্ধে পেশ করে থাকে। তারা সহজ-সরল মুসলিমদের এই বলে মগজ ধোলাই করে যে, আমরা শুধু সেই হাদীছ মানব, যা কুরআনের পক্ষে। কুরআনের বিরুদ্ধে যায় এমন কোনো হাদীছ আমরা মানব না। কুরআনের বিরুদ্ধে যায় এমন হাদীছ মানলে শিরক হবে। অথচ তাদের কাছে স্পষ্ট কোনো মানদণ্ড নেই, যেটা দিয়ে একটি হাদীছের সাথে কুরআনের আয়াতের পারস্পরিক বিরোধিতা বুঝা সম্ভব। বরং তারা হাদীছ অস্বীকারের জন্য এই অজুহাতকে খুব ভালোভাবে প্রয়োগ করে থাকে। নিজের ইচ্ছামতো বুখারী-মুসলিমের অকাট্য ছহীহ হাদীছকেও কুরআন বিরোধী বলে বাতিল করে দেয়। এই বিষয়ে সম্পূর্ণরূপে তারা নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে থাকে। কুরআনের বিপরীতে হাদীছকে পেশ করে কুরআনের সম্মান বাড়ানো কখনই তাদের উদ্দেশ্য নয়। বরং কুরআনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে হাদীছ অস্বীকারের অতি চালাকি রাস্তা তারা অবলম্বন করে থাকে। যা শুধু হাদীছকে অপমান করা নয়, বরং কুরআনকেও অপমান করার শামিল। নিজের সাথে ও মহান আল্লাহর সাথে ছলচাতুরী বৈ কিছুই নয়। তাদের এই ছলচাতুরী বাহানার জবাবে আমরা আজকে পবিত্র কুরআন থেকে এমন কিছু দলীল পেশ করব, যেখানে নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে শরীআত প্রণয়নের স্বাধীনতা স্বয়ং আল্লাহ তাআলা প্রদান করেছেন। যা প্রমাণ করে কুরআন ও হাদীছ কখনই পরস্পর বিরোধী হতে পারে না। হওয়া সম্ভব নয়। বরং কুরআনের মতো হাদীছও শরীআত প্রণয়নে স্বাধীন। একটার সাথে আরেকটি কখনই শর্তযুক্ত নয়। হাদীছ মানার জন্য কুরআনের অনুকূলে অথবা কুরআন মানার জন্য হাদীছের অনুকূলে হওয়ার কোনো শর্ত মহান আল্লাহ প্রদান করেননি। যেহেতু উভয়টিই শরীআত প্রণয়নে স্বাধীন, সেহেতু তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ হওয়া অসম্ভব। যদি এই রকম কোনো শর্তের প্রয়োজন হতো, তবে মহান আল্লাহ অবশ্যই পবিত্র কুরআনে তা বলে দিতেন।

দলীল : ১

আল্লাহ তাআলা বলেন, ﴿مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ﴾ ‘যে রাসূলের অনুসরণ করল, সে মহান আল্লাহর অনুসরণ করল’ (আন-নিসা, ৪/৮০)

ব্যাখ্যা : একদল মুনকিরে হাদীছে বলে থাকে, পবিত্র কুরআনের অনুসরণ করলেই আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ হয়ে যায়। আলাদা করে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণের কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু এই আয়াতে স্বয়ং মহান আল্লাহ তাদের এই দাবির সম্পূর্ণ বিপরীত আদেশ প্রদান করেছেন। তিনি তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্যকেই যথেষ্ট বললেন তাঁর আনুগত্যের জন্য। তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য করলে বাই ডিফল্ট মহান আল্লাহর আনুগত্য হয়ে যাবে। কেননা তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অহীর বাইরে কিছু করেন না বা বলেন না। এখানে আল্লাহ তাআলা হাদীছ মানার জন্য কুরআনের অনুকূলে হওয়ার শর্তারোপ করা তো বহু দূরের কথা, বরং নিঃশর্তভাবে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণের আদেশ দিয়েছেন। শুধু তাই নয় তাঁর অনুসরণকেই আল্লাহর অনুসরণ হিসেবে গণ্য করার ঘোষণা দিয়েছেন।

দলীল : ২

আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿إِنَّ الَّذِينَ يَكْفُرُونَ بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ وَيُرِيدُونَ أَنْ يُفَرِّقُوا بَيْنَ اللَّهِ وَرُسُلِهِ وَيَقُولُونَ نُؤْمِنُ بِبَعْضٍ وَنَكْفُرُ بِبَعْضٍ وَيُرِيدُونَ أَنْ يَتَّخِذُوا بَيْنَ ذَلِكَ سَبِيلًا﴾ ‘নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে কুফুরী করে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের মধ্যে পার্থক্য করতে চায় এবং বলে যে, আমরা কতকের প্রতি (অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি) ঈমান আনয়ন করি এবং কতকের প্রতি (অর্থাৎ রাসূলের প্রতি) কুফরী করি আর তারা মূলত উভয়ের মাঝামাঝি পথ অবলম্বন করতে চায়’ (আন-নিসা, ৪/১৫০)

ব্যাখ্যা : ইয়াহূদী-খ্রিষ্টানগণ আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করলেও আমাদের নবীর আনুগত্য করতে অস্বীকৃতি জানায়। তাদের উদ্দেশ্যেই মূলত মহান আল্লাহ উক্ত আয়াত অবতীর্ণ করেছেন। যেখানে তিনি স্পষ্ট করেছেন যে, আনুগত্যের দিক থেকে নবীগণ স্বাধীন। আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করে যদি রাসূলগণের প্রতি ঈমান না আনা হয়, তবে সেটাও কুফরী। নবীদের হাদীছ বাদ দিয়ে শুধু কুরআন মানার দাবি মূলত দ্বীনের কিছু অংশের প্রতি ঈমান আনয়ন এবং কিছু অংশকে অস্বীকার করার নামান্তর। হাদীছকে বাদ দেওয়ার মাধ্যমে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করা হচ্ছে। আনুগত্যের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে পার্থক্য করা কুফুরী।

মহান আল্লাহ আরো বলেন,﴿وَالَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ وَلَمْ يُفَرِّقُوا بَيْنَ أَحَدٍ مِنْهُمْ أُولَئِكَ سَوْفَ يُؤْتِيهِمْ أُجُورَهُمْ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا﴾ ‘আর যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনয়ন করেছে এবং তাদের কারো মধ্যে কোনোরূপ পার্থক্য সৃষ্টি করেনি, অচিরেই তিনি তাদেরকে তাদের প্রতিদান প্রদান করবেন। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু’ (আন-নিসা, ৪/১৫২)। এই আয়াতে আনুগত্যের দিক থেকে মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মধ্যে পার্থক্য না করার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে।

দলীল : ৩

আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَإِلَى الرَّسُولِ رَأَيْتَ الْمُنَافِقِينَ يَصُدُّونَ عَنْكَ صُدُودًا﴾ ‘আর যখন তাদেরকে বলা হবে যে, তোমরা এসো আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন সেই দিকে এবং তাঁর রাসূলের দিকে, তখন আপনি দেখবেন মুনাফেক্বরা আপনার থেকে বিরাগভাজন হয়ে দূরে সরে যাচ্ছে’ (আন-নিসা, ৪/৬১)

ব্যাখ্যা : উক্ত আয়াতে দুটি বিষয়ের দিকে মানুষকে আহ্বানের কথা বলা হয়েছে। প্রথমত, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তথা কুরআন। দ্বিতীয়ত, আল্লাহর রাসূলের প্রতি। মহান আল্লাহ তাআলা কুরআনের কথা বলার পরও তাঁর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সত্তাকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে উল্লেখ করেছেন। পাশাপাশি যারা তাঁর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাদেরকে মুনাফেক্ব বলে সম্বোধন করেছেন। উক্ত আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, পবিত্র কুরআন ছাড়াও আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদেশ ও নিষেধের ক্ষেত্রে স্বাধীন সত্তা। শুধু কুরআন মানার দাবি এবং হাদীছকে এড়িয়ে চলা এক প্রকার মুনাফেক্বী।

দলীল : ৪

আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ﴾ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর এবং আনুগত্য করো তাঁর রাসূলের আর তোমাদের মধ্যে যারা ক্ষমতাশীল রয়েছে তাদের’ (আন-নিসা, ৪/৬১)

ব্যাখ্যা : উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা ‘আতিঊ’ তথা ‘আনুগত্য করো’ আদেশ-বাচক শব্দটি আলাদা আলাদাভাবে তাঁর নিজের জন্য এবং রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য প্রয়োগ করেছেন। উভয়ের মধ্যে সংযোজক অব্যয় ‘ওয়া’ ব্যবহার করেছেন। এই সংযোজক অব্যয় ‘ওয়া’ ভিন্নতার প্রমাণ বহন করে। পাশাপাশি উভয়ের জন্য একই শব্দ দুইবার ব্যবহার করাও আলাদা স্বাধীন সত্তার প্রমাণ বহন করে। তথা আনুগত্যের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বাধীন সত্তা। প্রশ্নাতীতভাবে তাঁদের আনুগত্য করতে হবে। উল্লেখ্য, এই ধরনের একই সাথে দুইজনের আনুগত্যের নির্দেশ পবিত্র কুরআনের আরো বহু জায়গায় করা হয়েছে। যেমন- সূরা আন-নূর, ২৪/৫৪; মুহাম্মাদ, ৪৭/৩৩ প্রভৃতি আয়াতে।

দলীল : ৫

আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿رَبَّنَا آمَنَّا بِمَا أَنْزَلْتَ وَاتَّبَعْنَا الرَّسُولَ فَاكْتُبْنَا مَعَ الشَّاهِدِينَ﴾ ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি যা অবতীর্ণ করেছেন, আমরা তার প্রতি ঈমান আনয়ন করেছি এবং আপনার রাসূলের অনুসরণ করেছি। অতএব আপনি আমাদেরকে সাক্ষ্যপ্রদানকারীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে দিন’ (আলে ইমরান, ৩/৫৩)

ব্যাখ্যা : উক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ কর্তৃক অবতীর্ণ কুরআনের প্রতি ঈমান আনয়নের পাশাপাশি আলাদাভাবে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণের কথা বলা হয়েছে। যা কুরআন ছাড়াও শরীআত প্রণয়নে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্বাধীন সত্তার প্রমাণ বহন করে।

দলীল : ৬

আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الرَّسُولَ النَّبِيَّ الْأُمِّيَّ الَّذِي يَجِدُونَهُ مَكْتُوبًا عِنْدَهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ يَأْمُرُهُمْ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَاهُمْ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ وَيَضَعُ عَنْهُمْ إِصْرَهُمْ وَالْأَغْلَالَ الَّتِي كَانَتْ عَلَيْهِمْ فَالَّذِينَ آمَنُوا بِهِ وَعَزَّرُوهُ وَنَصَرُوهُ وَاتَّبَعُوا النُّورَ الَّذِي أُنْزِلَ مَعَهُ أُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ﴾ ‘যারা অনুসরণ করে রাসূলের, যিনি নিরক্ষর নবী, যাকে তারা তাদের নিকট তাওরাত ও ইঞ্জীলের মধ্যে লিখিত আকারে পায়। তিনি তাদেরকে সৎকাজের আদেশ দেন এবং তাদেরকে তিনি মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করেন এবং তাদের জন্য পবিত্র জিনিসকে হালাল করেন এবং তাদের জন্য নিকৃষ্ট জিনিসসমূহকে হারাম করেন এবং তিনি তাদের উপর থেকে সেই বোঝা ও শৃঙ্খলসমূহকে অপসারণ করেন, যা তাদের উপর আরোপিত ছিল। সুতরাং যারা তাঁর প্রতি ঈমান আনয়ন করে, তাঁকে সম্মান করে, তাঁকে সহযোগিতা করে এবং তাঁর সাথে অবতীর্ণ নূর (কুরআন) এর অনুসরণ করে, তারাই প্রকৃত সফলকাম’ (আল-আ‘রাফ, ৭/১৫৭)

ব্যাখ্যা : উক্ত আয়াতে উল্লিখিত ‘নূর’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো কুরআন। এই আয়াতে কুরআনের অনুসরণের পাশাপাশি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণের স্বাধীন সত্তাকে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এমন নবী যিনি নিরক্ষর, যার কথা তাওরাত ও ইঞ্জীলে উল্লেখ রয়েছে। যিনি পবিত্র জিনিসকে হালাল করার ক্ষেত্রে স্বাধীন এবং মন্দ জিনিসকে হারাম করার ক্ষেত্রে স্বাধীন। তার স্বাধীন সত্তা কর্তৃক প্রদত্ত হালাল ও হারামের বিধান মানাকে কুরআনের পাশাপাশি সম্পূর্ণ আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যার অনুসরণের উপর, যাকে সহযোগিতার উপর, যার সম্মান করার উপর, ভাল-মন্দ কাজে যার আদেশ-নিষেধ মানার উপর মানুষের সফলতাকে নির্ধারণ করা হয়েছে। উক্ত আয়াতে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রণীত হালাল ও হারাম মানার জন্য কুরআনের অনূকুলে হওয়ার কোনো শর্ত প্রদান করা হয়নি। বরং নিঃশর্তভাবে শরীআত প্রণয়নে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্বাধীন সত্তার কথা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এরপরও যারা এই পরম সত্যকে স্বীকার করতে ও তা মেনে নিতে চাইবে না, তারা মূলত হাদীছ বাদ দিয়ে কুরআন অনুসরণের মিথ্যা দাবি করে মুসলিমদেরকে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে বিপদগামী করতে চায়।

দলীল : ৭

আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى الله وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ الله وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا﴾ ‘আর এটা কোনো মুসলিম নর ও নারীর জন্য সঙ্গত নয় যে, যখন আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল কোনো ফয়সালা দিবেন, তখন সেই বিষয়ে তাদের (ভিন্ন কিছু করার) কোনো ইখতিয়ার থাকবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য হবে, সে নিশ্চিতরূপেই পথভ্রষ্ট হবে’ (আল-আহযাব, ৩৩/৩৬)

ব্যাখ্যা : উক্ত আয়াতটি যায়নাব বিনতে জাহশের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যায়নাব বিনতে জাহশের জন্য যায়েদ ইবনু হারেছার বিবাহের প্রস্তাব পাঠালে, তিনি সম্ভ্রান্ত কুরায়েশ বংশীয় হওয়ায় বিষয়টিকে পছন্দ করেননি। তখন উক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।[1]

দলীলের যৌক্তিকতা : আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক উক্ত বিবাহের সিদ্ধান্তটি কুরআনে কোথাও উল্লিখিত হয়নি। তথা এটি কুরআনের বাহিরে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীছ ছিল। উক্ত আয়াতে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই হাদীছ মানা সকল মুমিন ‍ও মুমিনার জন্য অপরিহার্য ঘোষণা করা হয়েছে। যা শরীআত প্রণয়নে হাদীছের স্বাধীন সত্তার উপর প্রমাণ বহন করে।

দলীল : ৮

আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا﴾ ‘কিন্তু না, তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা ততক্ষণ পর্যন্ত (সত্যিকার) মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের পারস্পরিক বিবাদের বিষয়ে আপনাকে ফয়সালাকারী না মানে, তারপর আপনি যা ফয়সালা প্রদান করেন সেই বিষয়ে তাদের অন্তরে কোনো প্রকার দ্বিধা না থাকে এবং তারা সেই সিদ্ধান্ত সর্বান্তকরণে মেনে নেয়’ (আন-নিসা, ৪/৬৫)

ব্যাখ্যা : উক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছিল যুবায়ের ইবনু আওয়াম ও একজন আনছারীর সাথে পানিকেন্দ্রিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটে তাদের পানির সমস্যা পেশ করা হলে তিনি যুবায়ের রযিয়াল্লাহু আনহু-কে প্রথমে পানি নিয়ে তারপর সেই পানি আনছারীর জমির জন্য ছেড়ে দেওয়ার আদেশ প্রদান করলেন। আনছারী ছাহাবী উক্ত সিদ্ধান্তকে অপছন্দ করেন। যুবায়ের রযিয়াল্লাহু আনহু আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ফুফাতো ভাই বলেই এমন সিদ্ধান্ত দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন। তখন উক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।[2]

দলীলের যৌক্তিকতা : আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের মধ্যে সমাধানকল্পে যে সিদ্ধান্ত প্রদান করেছিলেন, তা পবিত্র কুরআনের কোথাও বর্ণিত হয়নি। এটি কুরআনের বাইরে তাঁর নিজস্ব সিদ্ধান্ত ছিল। তথা তাঁর হাদীছ ছিল। তার হাদীছের এই সিদ্ধান্ত না মানার ফলে মহান আল্লাহ এত কঠোর ও কঠিন আয়াত অবতীর্ণ করেন, যা প্রমাণ করে পবিত্র কুরআনের বাহিরেও আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীছ শরীআত প্রণয়নে স্বাধীন এবং মুমিনগণ তা মানতে বাধ্য।

এখানে বিশেষভাবে স্মর্তব্য যে, ইসলামী শরীআত প্রণয়নে কুরআন যেমন স্বতন্ত্র দলীল, অনুরূপভাবে হাদীছও স্বতন্ত্র দলীল। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, উভয়ের উৎস আলাদা আলাদা। বস্তুত কুরআন ও হাদীছ উভয়ের উৎস একই অর্থাৎ উভয়টি আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের মনগড়াভাবে কোনো কিছুই বলেননি, বরং যা কিছু বলেছেন সবই অহী; আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রত্যাদিষ্ট হয়েই বলেছেন। সুতরাং এই দৃষ্টিকোণ থেকে কুরআন ও হাদীছের মাঝে ব্যবধান সৃষ্টি করার কোনো অবকাশ নেই। মহান আল্লাহ বলেন, ﴿وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى - إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى﴾ ‘আর না তিনি প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে কোনো কথা বলেন। এটা তো কেবল অহী, যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়’ (আন-নাজম, ৫৩/৩-৪)। সুতরাং রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মুখনিঃসৃত বাণী তথা হাদীছও অহীর অন্তর্ভুক্ত। অহীয়ে গায়রে মাতলূ‘ তথা ছালাতে অপঠনযোগ্য অহী আর কুরআন হলো অহীয়ে মাতলূ‘ তথা ছালাতে পঠনযোগ্য অহী। মহান আল্লাহ উভয় শ্রেণির অহীকে সংরক্ষণ করার দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করেছেন (আল-হিজর, ১৫/৯)

কাজেই হাদীছ বাদ দিয়ে শুধু কুরআন মানব— এমন দাবি তোলার সুযোগ অন্তত ইসলামে নেই।

(চলবে)

আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক

ফাযেল, দারুল উলূম দেওবান্দ, ভারত; বি. এ (অনার্স), মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব;
এমএসসি, ইসলামিক ব্যাংকিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, ইউনিভার্সিটি অফ ডান্ডি, যুক্তরাজ্য।


[1]. তাফসীরে কুরতূবী, সূরা আল-আহযাব, ৩৩/৩৬-এর তাফসীর দ্র., পৃ. ৪২৩।

[2]. তাফসীরে ইবনু কাছীর, সূরা আন-নিসা, ৪/৬৫-এর তাফসীর দ্রষ্টব্য, পৃ. ৮৮।

Magazine