কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

সালাম : ইসলামের এক অনুপম সৌন্দর্য

ইসলাম পরিপূর্ণ জীবন বিধান। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সবকিছুর গাইডলাইন ইসলাম দিয়েছে। আর আল্লাহর কাছে একমাত্র মনোনীত ধর্ম হলো ইসলাম। আমাদের এই সংক্ষিপ্ত জীবনে অনেক মানুষের সাথে পরিচয় হয়, সম্পর্ক হয়। ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের এবং সম্পর্ক উন্নয়নের অন্যতম মাধ্যম হলো এই সালাম। এই চমৎকার অভিবাদনটি অতি সহজেই অপরিচিত মানুষকে আপন করে নেয়।

‘সালাম’ শব্দটি আরবী এবং তা বাবে ‘তাফঈল’-এর মাছদার। ‘আল-মু‘জামুল ওয়াফী আধুনিক আরবী-বাংলা অভিধান’ অনুযায়ী সালামের আভিধানিক অর্থ শান্তি, নিরাপত্তা, সালাম ও অভিবাদন। অর্থাৎ ‘আস-সালামু আলাইকুম’ অর্থ হলো— আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক।

শরীআতের পরিভাষায়- একজন মুসলিম আরেকজন মুসলিমের সাথে সাক্ষাতের সময় যে বাক্য দ্বারা অভিবাদন জানায়, স্বাগত জানায় এবং ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, শান্তি, নিরাপত্তা, কল্যাণ ও দু‘আ কামনা করে, তাকেই আমরা সালাম বলে থাকি।

সালামের প্রচলন :

সালামের প্রচলন আদম আলাইহিস সালাম-কে সৃষ্টির শুরু থেকে ছিল। এটি নতুন কোনো আবিষ্কার না। হাদীছে এসেছে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,خَلَقَ اللَّهُ آدَمَ وَطُولُهُ سِتُّونَ ذِرَاعًا ثُمَّ قَالَ اذْهَبْ فَسَلِّمْ عَلَى أُولَئِكَ مِنَ الْمَلاَئِكَةِ فَاسْتَمِعْ مَا يُحَيُّونَكَ تَحِيَّتُكَ وَتَحِيَّةُ ذُرِّيَّتِكَ فَقَالَ السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ فَقَالُوا السَّلاَمُ عَلَيْكَ وَرَحْمَةُ اللَّهِ ‘আল্লাহ তাআলা আদম আলাইহিস সালাম-কে সৃষ্টি করলেন। তার উচ্চতা ছিল ৬০ হাত। তারপর আদম আলাইহিস সালাম-কে নির্দেশ করলেন। তুমি ঐ সকল ফেরেশতার কাছে যাও এবং তাদেরকে সালাম করো। দেখো, তারা কীভাবে উত্তর দেয়। সেটিই তোমার এবং তোমার সন্তানাদির অভিবাদন। তখন তিনি ফেরেশতাদেরকে সালাম করেন এবং তারা তার সালামের জবাব দেন’।[1]

সালামের সঠিক ব্যবহার :

সালাম দেওয়া সুন্নাত এবং সালামের জবাব দেওয়া ওয়াজিব। কেউ সালাম দিলে তার জবাব না দিলে সে গুনাহগার হবে। সালামের সঠিক উচ্চারণ হলো— আস-সালামু আলাইকুম। আর পরিপূর্ণ জবাব হলো— ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ। নিয়ম হলো— কথা বলার আগেই সালাম দেওয়া। প্রথমে সালাম না দিলে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথা বলার অনুমতি দিতে নিষেধ করেছেন। আমরা অনেকেই ভুলবশত এ বিষয়টি খেয়াল করতে পারি না। আমরা কারো সাথে কথা বলার শুরুতে ‘হ্যালো’ বলে ‘আস-সালামু আলাইকুম’ বলে থাকি। অথচ শুরুতেই সালাম দিয়ে কথা শুরু করতে হবে। বিভিন্ন অফিস বা কোম্পানির কাস্টমার কেয়ারে তথ্যের জন্য ফোন দিলে যারা ফোন রিসিভ করেন তাদের কেউ কেউ সালাম দেয় আবার কেউ কেউ সালাম দেয় না। আর যারা সালাম দেয়, তারা ভুল উচ্চারণের মাধ্যমে আমাদের মৃত্যু কামনা করেন। কারণ সালামের উচ্চারণটা ঠিকঠাক উচ্চারণ না হলে শান্তির জায়গায় মৃত্যু কামনা অর্থ হয়ে যায়। নির্বিশেষে সকলকে বিকৃত সালাম ‘স্লামালাইকুম’-এর জায়গায় ‘আস-সালামু আলাইকুম’ বলে শুদ্ধচর্চায় অভ্যস্ত হতে হবে।

কে কাকে সালাম দিবে :

চলমান ব্যক্তি উপবিষ্টকে, আরোহী পদব্রজে ব্যক্তিকে, কমসংখ্যক লোক অধিকসংখ্যককে এবং ছোটোরা বড়দেরকে সালাম দিবে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,يُسَلِّمُ الرَّاكِبُ عَلَى الْمَاشِى وَالْمَاشِى عَلَى الْقَاعِدِ وَالْقَلِيلُ عَلَى الْكَثِيرِ ‘আরোহী পদচারীকে, পদচারী উপবিষ্টকে এবং অল্পসংখ্যক অধিকসংখ্যককে সালাম দিবে’।[2] অন্যত্র তিনি বলেন,يُسَلِّمُ الصَّغِيرُ عَلَى الْكَبِيرِ وَالْمَارُّ عَلَى الْقَاعِدِ وَالْقَلِيلُ عَلَى الْكَثِيرِ ‘ছোটোরা বড়দেরকে, পদচারী উপবিষ্টকে এবং অল্পসংখ্যক অধিকসংখ্যককে সালাম দিবে’।[3] আমরা যদি আমাদের শ্রেণিকক্ষের দিকে খেয়াল করি, তাহলে খেয়াল করতে পারব যে, স্যার যখন ক্লাসে প্রবেশ করেন তখন আমরা সবাই দাঁড়িয়ে স্যারকে সালাম দেই। অথচ এটাও ভুল চর্চা। কেননা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কমসংখ্যক লোক বেশিসংখ্যক লোককে সালাম দিবে। মুসলিম পুরুষের সাথে সালাম বিনিময়ের পাশাপাশি মুছাফাহা (পরস্পর হাত মিলানো) উত্তম। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,مَا مِنْ مُسْلِمَيْنِ يَلْتَقِيَانِ فَيَتَصَافَحَانِ إِلاَّ غُفِرَ لَهُمَا قَبْلَ أَنْ يَفْتَرِقَا ‘দুজন মুসলিম একে অপরের সাথে মিলিত হয়ে মুছাফাহা করলে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হওয়ার পূর্বেই তাদের ক্ষমা করে দেওয়া হয়’।[4]

উল্লেখ্য, মুছাফাহা এক হাতে অর্থাৎ দু’জনের দু’হাতে হবে। দু’জনের চার হাতে নয়। এটাও সমাজে বহুল প্রচলিত ভুল। আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সহশিক্ষা থাকার কারণে যে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বলতে হয় যে, গায়রে মাহরাম অর্থাৎ যাদের সাথে বিবাহ বৈধ নয় এরূপ মহিলাদের সাথে মুছাফাহা করা হারাম। উমায়মা বিনতে রুকায়কা রযিয়াল্লাহু আনহা বলেন,جِئْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي نِسْوَةٍ نُبَايِعُهُ فَقَالَ لَنَا ‏ فِيمَا اسْتَطَعْتُنَّ وَأَطَقْتُنَّ إِنِّي لاَ أُصَافِحُ النِّسَاءَ ‘বায়আত নেওয়ার উদ্দেশ্যে আমি কতক মহিলা সমভিব্যাহারে মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট উপস্থিত হলাম। তিনি আমাদের বলেন, যতদূর তোমাদের সামর্থ্যে ও শক্তিতে কুলায় আমি মহিলাদের সাথে মুছাফাহা (করমর্দন) করি না’।[5] অন্যত্র রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,لَأَنْ يُطْعَنَ فِي رَأْسِ أَحَدِكُمْ بِمِخْيَطٍ مِنْ حَدِيدٍ خَيْرٌ لَهُ مِنْ أَنْ يَمَسَّ امْرَأَةً لَا تَحِلُّ لَهُ ‘নিশ্চয় তোমাদের কারো মাথায় লোহার পেরেক ঠুকে দেওয়া ঐ মহিলাকে স্পর্শ করা থেকে অনেক শ্রেয়, যে তার জন্য হালাল নয়’।[6] অন্য বর্ণনায় এসেছে, আলক্বামা বিনতু ওবায়েদ রযিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‌لَا ‌أَمَسُّ ‌أَيْدِي ‌النِّسَاءِ ‘আমি নারীদের হাত স্পর্শ করি না’।[7] অর্থাৎ গায়রে মাহরাম।

সালাম দেওয়ার গুরুত্ব ও ফযীলত :

‘সালাম’ নামক ইসলামিক অভিবাদনের মধ্যে লুকিয়ে আছে বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। নিছক বাক্য হলেও সালাম এমন এক আকর্ষণীয় চুম্বক শক্তি, যা মনের সকল প্রকার দূরত্ব, হিংসা-বিদ্বেষ অনৈক্য দূর করে সবাইকে কাছে এনে ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে দেয়। নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু নির্দেশই দেননি, বরং নিজেও বাস্তব জীবনে এর উপর আমল করে উম্মতের সামনে এক অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি সবাইকে আগে সালাম দেওয়ার চেষ্টা করতেন। হাদীছে এমন রয়েছে যে, অনেকেই তার আগে সালাম দেওয়ার জন্য চেষ্টায় থেকেও তাকে আগে সালাম দিতে পারতেন না। শুধু তাই নয় তিনি ছোটদেরকে শিক্ষার জন্য তাদেরকে সালাম দিতেন। নিচে কিছু সালামের গুরুত্ব ও ফযীলত নিয়ে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে আলোকপাত করা হলো :

আল্লাহ তাআলা বলেছেন,﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَدْخُلُوا بُيُوتًا غَيْرَ بُيُوتِكُمْ حَتَّى تَسْتَأْنِسُوا وَتُسَلِّمُوا عَلَى أَهْلِهَا﴾ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদের গৃহ ব্যতীত অন্য কারও গৃহে গৃহবাসীদের অনুমতি না নিয়ে ও তাদেরকে সালাম না দিয়ে প্রবেশ করো না’ (আন-নূর, ২৪/২৭)। অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন,﴿فَإِذَا دَخَلْتُمْ بُيُوتًا فَسَلِّمُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ تَحِيَّةً مِنْ عِنْدِ اللَّهِ مُبَارَكَةً طَيِّبَةً﴾ ‘যখন তোমরা গৃহে প্রবেশ করবে, তখন তোমরা তোমাদের স্বজনদের প্রতি সালাম বলবে। এ হবে আল্লাহর নিকট হতে কল্যাণময় ও পবিত্র অভিবাদন’ (আন-নূর, ২৪/৬১)। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা আরও বলেছেন,﴿وَإِذَا حُيِّيتُمْ بِتَحِيَّةٍ فَحَيُّوا بِأَحْسَنَ مِنْهَا أَوْ رُدُّوهَا﴾ ‘যখন তোমাদেরকে অভিবাদন করা হয় (সালাম দেওয়া হয়), তখন তোমরাও তা অপেক্ষা উত্তম অভিবাদন করো অথবা ওরই অনুরূপ করো’ (আন-নিসা, ৪/৮৬)

সালামের গুরুত্ব সম্পর্কে হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আছ রযিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করলেন,أَىُّ الإِسْلاَمِ خَيْرٌ قَالَ تُطْعِمُ الطَّعَامَ وَتَقْرَأُ السَّلاَمَ عَلَى مَنْ عَرَفْتَ وَمَنْ لَمْ تَعْرِفْ ‘সর্বোত্তম ইসলামী কাজ কী?’ তিনি বললেন, ‘ক্ষুধার্তকে অন্ন দান করবে এবং পরিচিত-অপরিচিত নির্বিশেষে সকলকে (ব্যাপকভাবে) সালাম পেশ করবে’।[8] আবূ ইউসুফ আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি,أَيُّهَا النَّاسُ أَفْشُوا السَّلاَمَ وَأَطْعِمُوا الطَّعَامَ وَصَلُّوا وَالنَّاسُ نِيَامٌ تَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ بِسَلاَمٍ ‘হে লোক সকল! তোমরা সালাম প্রচার করো, (ক্ষুধার্তকে) অন্ন দান করো, আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখো এবং লোকে যখন (রাতে) ঘুমিয়ে থাকে, তখন তোমরা ছালাত পড়ো। তাহলে তোমরা নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[9]

পরিশেষে বলতে চাই, সকলের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে আল্লাহ আমাদেরকে এই সুন্দর বিধানটি মেনে চলার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

এ. এস. এম. মাহবুবুর রহমান

শিক্ষার্থী, দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া; দাওরায়ে হাদীছ, মাদরাসা মুহাম্মাদিয়া আরাবিয়া, ঢাকা।


[1]. ছহীহ বুখারী, হ/৩৩২৬।

[2]. ছহীহ বুখারী, হ/৬২৩২; ছহীহ মুসলিম, হা/২১৬০; মিশকাত, হা/৪৬৩২।

[3]. ছহীহ বুখারী, হ/৬২৩৪; মিশকাত, হা/৪৬৩৩।

[4]. আবূ দাঊদ, হ/৫২১২; তিরমিযী, হা/২৭২৭, হাদীছ ছহীহ।

[5]. ইবনু মাজাহ, হা/২৮৭৪; তিরমিযী, হা/১৫৯৭, হাদীছ ছহীহ।

[6]. ত্বাবরানী, সিলসিলা ছহীহা, হা/২২৬।

[7]. ত্বাবরানী, কাবীর, ২৪/৩৪২; ছহীহুল জামে‘, হা/৭০৫৪।

[8]. ছহীহ বুখারী, হ/১২; ছহীহ মুসলিম, হা/৩৯; মিশকাত, হা/৪৬২৯।

[9]. তিরমিযী, হা/২৪৮৫, হাদীছ ছহীহ।

Magazine