কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ইসলামে শূকরের গোশত হারাম কেন

post title will place here

দ্বীন ইসলাম অহীয়ে মাতলূ কুরআন ও অহীয়ে গায়রে মাতলূ ছহীহ হাদীছনির্ভর একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। ইসলামী শরীআতও শতভাগ কুরআন এবং ছহীহ হাদীছের আলোকে সালাফদের অনুসরণে নির্ধারিত। ইসলামী শরীআতের বিধান কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে হালাল-হারাম সুস্পষ্ট ও সুনির্ধারিত। আল্লাহর কালাম কুরআন এবং রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী ছহীহ হাদীছ দ্বারা ক্বিয়ামত পর্যন্ত উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য যে সকল খাদ্য হারাম করা হয়েছে, তার মধ্যে শূকর অন্যতম।

মহান আল্লাহর একমাত্র মনোনীত ধর্ম ইসলামে রয়েছে সুশৃঙ্খল নিয়মকানুন, রয়েছে নানা ধরনের বিধিনিষেধ। আর বিধিনিষেধগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ইসলামের বিধি মোতাবেক শূকরের গোশত মুসলিমদের জন্য মহান আল্লাহ হারাম করেছেন, বিধায় ঈমানদার কোনো মুসলিম শূকরের গোশত খেতে পারবে না। অর্থাৎ আল্লাহ মুসলিমদের জন্য যা কিছু খারাপ, ক্ষতিকর, বিপজ্জনক তাই হারাম ঘোষণা করেছেন আর যা কিছু ভালো, উপকারী তার প্রায় সবগুলোই মুসলিমদের জন্য হালাল।

আমাদের প্রতি মহান আল্লাহর রহমত এবং তাঁর পক্ষ থেকে সহজায়ন হচ্ছে তিনি আমাদের জন্য পবিত্র বস্তুসমূহ খাওয়া বৈধ করেছেন এবং শুধু অপবিত্র বস্তুসমূহ হারাম করেছেন।

ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বী অধিকাংশ লোকই শূকরের গোশত খায়। কিন্তু মুসলিমদের কাছে শূকরের গোশতকে কুরআনের স্পষ্ট আয়াত দ্বারা হারাম করা হয়েছে বলে কোনো মুসলিম শূকরের গোশত খায় না। মুসলিমরা শূকরের গোশত খায় না বলে অন্য ধর্মাবলম্বীদের অনেকেই এটা নিয়ে মুসলিমদের সমালোচনা করেন। কিন্তু শূকরের গোশত কেন ইসলামে হারাম করা হয়েছে সেই রহস্য জানলে শুধু মুসলিমগণই নয় বরং বিধর্মীরাও বলবে শূকরের গোশত নিষিদ্ধ হওয়াই যুক্তিযুক্ত। আসুন! আলোচ্য প্রবন্ধে জেনে নিই ইসলামে কেন শূকরের গোশত নিষিদ্ধ।

কুরআনে নিষিদ্ধতা :

শূকরের গোশত খাওয়া নিষেধ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ চার স্থানে শূকরের গোশত খেতে নিষেধ করেছেন। কারণ তা মানুষের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং বিভিন্ন রোগের কারণ। কুরআনের যে চার জায়গায় নিষেধ করা হয়েছে সেগুলো হলো, মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন,﴿إِنَّمَا حَرَّمَ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةَ وَالدَّمَ وَلَحْمَ الْخِنْزِيرِ وَمَا أُهِلَّ بِهِ لِغَيْرِ اللَّهِ فَمَنِ اضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍ وَلَا عَادٍ فَلَا إِثْمَ عَلَيْهِ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ﴾ ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি হারাম করেছেন মৃত জীবজন্তুর গোশত, প্রবাহমান রক্ত, শূকরের গোশত এবং সেইসব জন্তু যা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে উৎসর্গ করা হয়। তবে কেউ নিরুপায় হয়ে নাফরমানী কিংবা সীমালঙ্ঘন না করে গ্রহণ করলে,, তার উপর কোনো গুনাহ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু’ (আল-বাক্বারা, ২/১৭৩)। আল্লাহ তাআলা কুরআনে আরও বলেন,

﴿حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنْزِيرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ وَالْمُنْخَنِقَةُ وَالْمَوْقُوذَةُ وَالْمُتَرَدِّيَةُ وَالنَّطِيحَةُ وَمَا أَكَلَ السَّبُعُ إِلَّا مَا ذَكَّيْتُمْ وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ وَأَنْ تَسْتَقْسِمُوا بِالْأَزْلَامِ ذَلِكُمْ فِسْقٌ الْيَوْمَ يَئِسَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ دِينِكُمْ فَلَا تَخْشَوْهُمْ وَاخْشَوْنِ الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا فَمَنِ اضْطُرَّ فِي مَخْمَصَةٍ غَيْرَ مُتَجَانِفٍ لِإِثْمٍ فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ﴾

‘তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত জন্তু, প্রবাহমান রক্ত, শূকরের গোশত, আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃত জন্তু, আঘাতে মৃত জন্তু, উপর থেকে পতনের ফলে মৃত, সংঘর্ষে মৃত আর হিংস্র জন্তুর খাওয়া পশু। তবে জীবিত পেয়ে যা তোমরা যবেহ করতে পেরেছ তা বাদে। আর যা কোনো মূর্তির বেদিতে যবেহ করা হয়েছে। আর জুয়ার তীর দ্বারা ভাগ্য নির্ণয় করা (এগুলো তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে)। এ সবগুলো পাপ কাজ। আজ কাফেরগণ তোমাদের দ্বীনের বিরোধিতা করার ব্যাপারে পুরোপুরি নিরাশ হয়ে গেছে, কাজেই তাদেরকে ভয় করো না, কেবল আমাকেই ভয় করো। আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামত পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে মনোনীত করে দিলাম। তবে কেউ পাপ করার প্রবণতা ব্যতীত ক্ষুধার জ্বালায় তা গ্রহণ করতে বাধ্য হলে আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (আল-মায়েদাহ, ৫/৩)। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,

﴿قُلْ لَا أَجِدُ فِي مَا أُوحِيَ إِلَيَّ مُحَرَّمًا عَلَى طَاعِمٍ يَطْعَمُهُ إِلَّا أَنْ يَكُونَ مَيْتَةً أَوْ دَمًا مَسْفُوحًا أَوْ لَحْمَ خِنْزِيرٍ فَإِنَّهُ رِجْسٌ أَوْ فِسْقًا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ فَمَنِ اضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍ وَلَا عَادٍ فَإِنَّ رَبَّكَ غَفُورٌ رَحِيمٌ﴾

‘বলো! আমার প্রতি যে অহী করা হয়েছে তাতে মানুষ যা আহার করে তার কিছুই নিষিদ্ধ পাই না; মৃত, প্রবাহমান রক্ত ও শূকরের গোশত ছাড়া। কারণ তা অপবিত্র অথবা আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে যবেহ করা ফাসেক্বী কাজ। তবে কেউ নিরুপায় হয়ে নাফরমানী কিংবা সীমালঙ্ঘন না করে গ্রহণ করলে, তাহলে তোমার প্রতিপালক বড়ই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (আল-আনআম, ৬/১৪৫)

আল্লাহ আরও বলেন,﴿إِنَّمَا حَرَّمَ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةَ وَالدَّمَ وَلَحْمَ الْخِنْزِيرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ فَمَنِ اضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍ وَلَا عَادٍ فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ﴾ ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য হারাম করেছেন মৃত পশু, রক্ত, শূকরের গোশত আর যা আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে যবেহ করা হয়েছে। তবে কেউ নিরুপায় হয়ে নাফরমানী কিংবা সীমালঙ্ঘন না করে গ্রহণ করলে, আল্লাহ তো বড়ই ক্ষমাশীল, বড়ই দয়ালু’ (আন-নাহল, ১৬/১১৫)

ইসলামে শূকরের গোশত কেন নিষেধ করা হয়েছে তার সন্তোষজনক উত্তরের জন্য কুরআনের উল্লিখিত আয়াতসমূহই যথেষ্ট।

বাইবেলে নিষিদ্ধতা :

পবিত্র কুরআন ছাড়া বাইবেলেও শূকরের গোশত নিষেধ করা হয়েছে। বাইবেল লেভীটিকাস্থ গ্রন্থে শূকরের গোশত খেতে নিষেধ করেছে। বলা হয়েছে, আর শূকর যদিও তার ক্ষুর দ্বিখণ্ডিত এবং ক্ষুরযুক্ত পদবিশিষ্ট। এমনকি সে চিবিয়ে খায়, জাবর কাটে না। (তবু) ওটা অপরিচ্ছন্ন (অপবিত্র) তোমার জন্য’। একই গ্রন্থের ১১ অধ্যায় ৭ ও ৮ স্তবকে বলা হয়েছে, ওগুলোর গোশত তুমি খাবে না এবং ওগুলোর মৃতদেহ তুমি স্পর্শও করবে না, ওগুলো অপবিত্র তোমার জন্য।

বাইবেলের পঞ্চম গ্রন্থ ডিউট্যারনমী (Deuteronomy)-তেও শূকরের গোশতকে ‘অপবিত্র’ বলা হয়েছে, আর শূকর কারণ তার ক্ষুর দ্বিখণ্ডিত, এমনকি চিবিয়ে খায়, জাবর কাটে না, ওটা অপবিত্র তোমার জন্য তুমি ওগুলোর গোশত খাবে না, না ওগুলোর মৃতদেহ তুমি স্পর্শ করবে।[1]

শূকরের গোশত ভয়ংকর রোগের কারণ :

বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ ব্যতীত বিজ্ঞানের মাধ্যমেও আজ প্রমাণিত যে, শূকরের গোশত মানুষের জন্য কতটা ক্ষতিকর। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান মানবদেহের উপর শূকর খাওয়ার বিভিন্ন অপকারিতার প্রমাণ পেয়েছে। অন্যান্য অমুসলিম ও নাস্তিকরা হয়তো উপযুক্ত কারণ ও বিজ্ঞানের যুক্তি-প্রমাণে মেনে নিতে পারে। শূকরের গোশত ভক্ষণ কমপক্ষে ৭০টি রোগের উদ্ভব ঘটাতে পারে। আক্রান্ত হতে পারে বিভিন্ন প্রকার কৃমির দ্বারা। যেমন বৃত্তাকার কৃমি, ক্ষুদ্র কাঁটাযুক্ত কৃমি এবং বক্র কৃমি। শূকরের গোশত খাওয়া চর্মরোগ ও পাকস্থলির ছিদ্র ইত্যাদি রোগের কারণ। শূকরের গোশত খাওয়ার সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হলো, শূকরের গোশতে ফিতা কৃমির শুক্রকীট থাকে; যাকে বলা হয় টিনিয়া সলিয়াম (Taenia Solium)। সাধারণভাবে যেটাকে ফিতা কৃমি বলা হয়। এটা পেটের মধ্যে বেড়ে ওঠে এবং অনেক লম্বা হয়। এ কৃমি ২-৩ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এ কৃমির ডিমগুলো যদি মস্তিষ্কে বৃদ্ধি পায় তাহলে পরবর্তীতে মানুষ পাগলামি ও হিস্টিরিয়া রোগে আক্রান্ত হতে পারে। আর যদি হার্টে বৃদ্ধি পায় তাহলে মানুষ উচ্চ রক্তচাপ ও হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হতে পারে। শূকরের গোশতের মধ্যে আরো যেসব কৃমি থাকতে পারে সেগুলো হচ্ছে ট্রিচিনিয়াসিস কৃমির শুক্রকীট যা রান্না করলেও মরে না। মানুষের শরীরে এ কৃমি বাড়ার ফলে মানুষ প্যারালাইসিস ও চামড়ায় ফুসকুড়িতে আক্রান্ত হতে পারে। এর ডিম রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করে এবং দেহের প্রায় সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ঢুকে পড়তে পারে, যদি এটা মস্তিস্কে ঢোকে, তাহলে স্মৃতিভ্রষ্ট হওয়ার কারণ ঘটতে পারে। হৃদযন্ত্রের মধ্যে ঢুকলে বন্ধ করে দিতে পারে হৃদযন্ত্রক্রিয়া। চোখে ঢুকলে অন্ধত্বের কারণ হয়, কলিজায় ঢুকলে সেখানে মারাত্মক ক্ষতের সৃষ্টি করে অর্থাৎ এটা শরীরের যে কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কর্মক্ষমতাকে ধ্বংস করে দিতে পারে। এরপরও আছে আরও ভয়ংকর ‘ত্রীচুরা টিচুরাসীস্থ’। এটা ভালো করে রান্না করলেও এর ডিম মারা যায় না। এর ওপরে আমেরিকায় গবেষণা চালানো হয়েছে। ফলাফলে এসেছে ভালো করে রান্না করার পরও প্রতি ২৪ জনের ২২ জন এই ‘ত্রীচুরাসীস্থ’ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে।

এ ছাড়া মানুষের এমন কিছু রোগ আছে যে রোগগুলো প্রাণীদের মধ্যে শুধু শূকরের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। যেমন- বাতরোগ (Rheumatology) ও জয়েন্টের ব্যথা।[2]

শূকরে রয়েছে চর্বি উৎপাদনের উপাদান প্রচুর :

বিভিন্ন প্রাণীর গোশতের মধ্যে শূকরের গোশতে সবচেয়ে বেশি চর্বিযুক্ত কোলেস্টেরল রয়েছে। মানুষের রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্তনালি ব্লক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এছাড়া শূকরের গোশতে থাকা ‘ফ্যাটি এসিড’ অন্য সকল খাদ্যে থাকা ফ্যাটি এসিড থেকে ভিন্নরকম ও ভিন্ন গঠনের। তাই অন্য যেকোনো খাদ্যের তুলনায় মানুষের শরীর খুব সহজে একে চুষে নেয়। যার ফলে রক্তে কোলেস্টেরল এর পরিমাণ বেড়ে যায়।[3]

শূকরের গোশত ও চর্বি মেদ বাড়ায় এবং মেদসংক্রান্ত রোগ বাড়ায়; যেগুলোর চিকিৎসা করা অনেক দুরূহ। শূকরের গোশত ও চর্বি কোলন ক্যান্সার (বৃহদন্ত্রের ক্যান্সার), রেক্টাল ক্যান্সার (মলদ্বারের ক্যান্সার), অণ্ডকোষের ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার ও ব্লাড ক্যান্সার এর বিস্তার ঘটায়।

শূকরের গোশতে পেশী তৈরির উপাদান অত্যন্ত নগণ্য পরিমাণে থাকে। পক্ষান্তরে চর্বি উৎপাদনের উপাদান প্রচুর। এ জাতীয় চর্বি বেশিরভাগ রক্তনালিতে জমা হয়, যা কারণ ঘটায় হাইপার টেনশন এবং হার্ট অ্যাটাকের। অবাক হওয়ার কিছু নেই যে ৫০ ভাগ আমেরিকান হাইপার টেনশনের রোগী।[4]

গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে শূকরের চর্বি মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই বর্তমানে ইউরোপীয় অনেক উন্নত দেশ শূকরের গোশত থেকে চর্বি আলাদা করে বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে রপ্তানি করছে! আমাদের দেশের খবরেও প্রকাশিত হয়েছে এবং পরীক্ষায়ও প্রমাণিত হয়েছে যে, এদেশের অনেক নামিদামি আইসক্রিম কোম্পানি এবং অনেক ডেইরি মিল্ক কোম্পানির চকোলেট তৈরিতে কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত হয় ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে সস্তায় আমদানি করা শূকরের চর্বি।[5] আর আমাদের সন্তানেরা না জেনেই এ মারাত্মক ও হারাম মুখরোচক মজাদার খাবার হিসাবে দেদারসে খাচ্ছে, না জেনে অবাধ্যতার মধ্যে নিপতিত হচ্ছে আর ঝুঁকিপূর্ণ করছে তাদের ভবিষ্যৎ জীবন! যেটি মারাত্মক বিভীষিকাময় হতে পারে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং সরকার এ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে যথাযথ আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

শূকর নোংরা ও পঙ্কিলতম প্রাণী :

এই নোংরা প্রাণীটি বসবাস করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে নিজেদের বিষ্ঠা, মানুষের মল ও ময়লাপূর্ণ জায়গায়। আল্লাহ তাআলা সমাজবদ্ধ সৃষ্টিকুলের মেথর বা ময়লা পরিষ্কারক হিসাবেই বোধ করি এ প্রাণীটি সৃষ্টি করেছেন। আজ থেকে পঞ্চাশ কি ষাট বছর আগেও যখন স্যানিটারি ল্যাট্রিন আবিষ্কৃত হয়নি তখন যে কোনো শহরের পায়খানার ধরন ছিল উম্মুক্ত। লোকেরা উম্মুক্ত স্থানে তাদের প্রয়োজন পূরণ করত আর মেথর এসে তা ট্যাঙ্কি ভরে নিয়ে যেত এবং শহরের উপকণ্ঠে কোথাও ফেলত। যা ছিল শূকরদলের পরম আনন্দ নিবাস। শূকর গোবর, পায়খানা ও ময়লা-আবর্জনার উপর জীবন-যাপন করে এবং মহান আল্লাহ শূকরকে সর্বাধিক নিকৃষ্ট জিনিসভোক্তা ও ময়লা-আবর্জনার উপর লালিত-পালিত প্রাণী বানিয়েছেন বলে শূকররা এ ধরনের ময়লা খতম করে।[6] অনেকেই হয়তো এখন বিতর্কে নেমে পড়বেন উন্নত বিশ্বে এখন শূকরের পরিচ্ছন্ন খামার করা হয়েছে যেখানে ওগুলো লালিতপালিত হয়। তাদের এই অনেক উন্নত, স্বাস্থ্যকর খামারেও ওগুলো নোংরা জীবনযাপন করে। অত্যন্ত আনন্দের সাথেই তারা তাদের নিজেদের ও সঙ্গীদের বিষ্ঠা নিয়ে তাদের চোখ, নাক দিয়ে নাড়াচাড়া করে আর উৎসবের খাদ্য হিসেবেই খায়।

শূকর নির্লজ্জ পশু :

ভূপৃষ্ঠের উপরে শূকর অশ্লীলতায় নির্লজ্জতম প্রাণী। শূকরই একমাত্র পশু যে তার স্ত্রী-সঙ্গীর সাথে সঙ্গম করার জন্য অন্যান্য পুরুষ সঙ্গীদের ডেকে আনে।[7] ইউরোপ-আমেরিকার অধিকাংশ মানুষের প্রিয় খাদ্য শূকরের গোশত। খাদ্যাভ্যাস আচরণে প্রকাশ পায়, বিজ্ঞানের এ সূত্রের জীবন্ত নমুনা তারাই। ওদের প্রিয় হলো নেচে-গেয়ে পার্টি জমানো আর উত্তেজনায় উন্মত্ত হয়ে তখন একে অপরের সাথে বউ বদল করা। অনেকেই আবার জীবন্ত নীল জগতের স্বাদ নিতে স্ত্রীর সাথে মিলিত হতে বন্ধুবান্ধব ডেকে নেয়। এসব প্রমাণ করে, শূকরের গোশত মানুষকে নির্লজ্জতার দিকে ধাবিত করে।

পরিশেষে বলা যায় যে, কুরআনে শূকর হারাম হওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে এটি ‘রিজস’ বা অপবিত্র। মানুষের সুস্থ বিবেক ও শরীআত কর্তৃক নিন্দনীয় যেকোনো জিনিসকে আরবীতে ‘রিজস’ বলা হয়। শূকরের গোশত হারাম হওয়ার কারণ হিসেবে এটিই যথেষ্ট। এছাড়াও খাদ্য-পানীয় বস্তু হালাল বা হারাম হওয়ার জন্য যে সাধারণ মূলনীতি ঘোষণা করা হয়েছে তার আলোকেও শূকরের গোশত হারামের আওতায় পড়ে।

সূরা আল-আ‘রাফের ১৫৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তিনি (আল্লাহ) তাদের জন্য উত্তম জিনিস হালাল করেছেন আর খাবাইছ (নিকৃষ্ট জিনিস) হারাম করেছেন’। এখানে ‘খাবাইছ’ দ্বারা ওই সমস্ত জিনিস উদ্দেশ্য করা হয়েছে যা মানুষের শারীরিক, মানসিক, চারিত্রিক বা আর্থিক ক্ষতিসাধন করে। সুতরাং যে জিনিসই মানুষের জন্য কোনো ক্ষতিকর ফল বয়ে আনে তাই খাবাইছ এর অন্তর্ভুক্ত হবে।

শূকরের গোশত ভক্ষণের ফলে মানুষ যেমন ইহকালীন রোগবালাই আর কষ্ট ভোগ করবে, তেমনি পরকালে ভোগ করবে জাহান্নামের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। তাই আমাদের কোনোভাবেই আল্লাহর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কোনো কাজ করা উচিত নয়। তাহলেই আমাদের ইহকাল ও পরকাল উভয় শান্তির হবে।

আল্লাহ আমাদেরকে এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে শূকর নামক এ নিকৃষ্ট প্রাণীর সকল অপকারিতা থেকে রক্ষা করুন আর আমরা যেন সকল প্রকার হারাম থেকে বেঁচে থাকতে পারি সে তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

অধ্যাপক ওবায়দুল বারী বিন সিরাজউদ্দিন

 পিএইচডি গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


[1]. ডিউট্যারনমী, ১৪:৮।

[2]. ডা. জাকির নায়েক লেকচার সমগ্র, অধ্যায় : ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিমদের নানা জিজ্ঞাসার জবাব, প্রশ্ন- ১১ (৩), পৃ. ৩৪৬ এবং প্রশ্ন- ৩৩ (খ), পৃ. ৪১৬।

[3]. প্রাগুক্ত, প্রশ্ন- ১১ (৪), পৃ. ৩৪৬ এবং প্রশ্ন- ৩৩ (খ), পৃ. ৪১৬।

[4]. প্রাগুক্ত।

[5]. দৈনিক নয়াদিগন্ত, ২১ মার্চ ২০২২, প্রবন্ধ শিরোনাম : শূকরের চর্বিজাত খাবার ও প্রসাধনী নিয়ে সতর্কতা।

[6]. ডা. জাকির নায়েক লেকচার সমগ্র, অধ্যায় : ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিমদের নানা জিজ্ঞাসার জবাব, প্রশ্ন- ৩৩ (খ), পৃ. ৪১৬।

[7]. প্রাগুক্ত, প্রশ্ন- ১১ (৪), পৃ. ৩৪৬ এবং প্রশ্ন- ৩৩ (খ), পৃ. ৪১৬।

Magazine