এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা অনুষদের ‘খ’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে জাকারিয়া। সে ঢাকার দারুন্নাজাত সিদ্দিকিয়া কামিল মাদরাসার ছাত্র। এছাড়া বিগত এক যুগব্যাপী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় মাদরাসার শিক্ষার্থীরা আকাশচুম্বী সাফল্য দেখিয়েছে। প্রথম স্থানসহ অনেক শীর্ষস্থান তারাই দখল করে আসছে। ২০০৮-২০০৯ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ‘খ’ ইউনিটে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল একজন মাদরাসার ছাত্র। নাম তার আব্দুল খালেক। সেবছর প্রথম ১০ জনের ৪ জনই ছিল মাদরাসার শিক্ষার্থী। ২০০৯-২০১০ শিক্ষাবর্ষে ‘খ’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিল মাদরাসার শিক্ষার্থী আব্দুল আলীম। দ্বিতীয় হয়েছিল আরেক মাদরাসার ছাত্র সেলিমুল কাদের। এছাড়া তৃতীয়, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ স্থান অধিকারী ছিল মাদরাসা ছাত্র। একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘ঘ’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয় মাদরাসার ছাত্র এলিস জাহান। দ্বিতীয় হয় মাদরাসাছাত্র মিজানুল হক। চতুর্থ ও একাদশ স্থানটিও দখল করেছিল ২ জন মাদরাসাছাত্র। ২০১০-২০১১ সেশনে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয় মাদরাসাছাত্র মাসরুর বিন আনসারী। ‘ঘ’ ইউনিটে প্রথম হয় মাদরাসাছাত্র আসাদুজ্জামান। দ্বিতীয় স্থান অধিকারীও ছিল অন্য একজন মাদরাসার ছাত্র। এছাড়া ‘খ’ ইউনিটে ৩য়, ৪র্থ, ৫ম, ১৬তম, ১৭তম ও ১৮তম হয় মাদরাসাছাত্র। ২০১৪-২০১৫ শিক্ষাবর্ষে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ‘খ’ ইউনিটে প্রথম হয় মাদরাসার ছাত্র আব্দুর রহমান মজুমদার। একই বছরে সে ‘ঘ’ ইউনিটেও প্রথম স্থান অধিকার করেছিল। উল্লেখ্য, মেধাতালিকায় ১০ জনের মধ্যে এ বছর মাদরাসার ছাত্র ছিল তিন জন। আব্দুর রহমান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়েও সর্বাধিক নম্বর পেয়েছিল। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সংখ্যা ছিল ২,২২১টি। পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল ৪০ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী। আর উত্তীর্ণ হয়েছিল মাত্র ৩,৮৭৪ জন। আর অকৃতকার্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৩৫ হাজার ৩৮০ জন। আরও মজার ব্যাপার হলো, এ বছরের ভর্তি পরীক্ষায় ইংরেজিতে পাশ করার শর্ত ছিল ১৫ নম্বর পাওয়া। উত্তীর্ণ ৩,৮৭৪ জন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইংরেজিতে ১৫ নম্বর পেয়ে পাশ করেছিল কলেজের মাত্র দুজন ছাত্র। আর মাদরাসার ছাত্র আব্দুর রহমানের ইংরেজিতে প্রাপ্ত নম্বর ছিল ২৮.৫০! আর মাদরাসার অন্য দুজন ছাত্রের ইংরেজিতে প্রাপ্ত নম্বর ছিল ১৫ এর উপরে। অন্যদিকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে আসা কলেজ ছাত্রদের ইংরেজিতে সর্বোচ্চ নম্বর ছিল ২২.৫০।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সত্য কথা হলো, মাদরাসার ছাত্রের সাফল্যে সবসময়ই এক ধরনের জ্ঞানপাপীর গাত্রদাহ শুরু হয়। এত সাফল্যের পরও তারা মাদরাসার ছাত্রদেরকে দুর্বল বলে অভিহিত করেন। মাদরাসায় প্রণীত ১০০ নম্বরের ইংরেজি ও ১০০ নম্বরের বাংলা নাকি এ দুর্বলতার মূল কারণ। অভিযোগের কারণে ২০১৫ সাল থেকে মাদরাসাগুলোতে ২০০ নম্বরের ইংরেজি ও ২০০ নম্বরের বাংলা নতুন করে বাধ্যতামূলক করা হয়। এর পিছনে উদ্দেশ্য ছিল যাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর মাদরাসার শিক্ষার্থী ভর্তি হতে না পারে। কিন্তু এক্ষেত্রেও মাদরাসা ছাত্ররা জ্ঞানপাপীদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয়। ২০১৫-২০১৬ শিক্ষাবর্ষের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পাশের হার ছিল ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ। এতদসত্ত্বেও ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয় মাদরাসাছাত্র আব্দুল্লাহ আল-মামুন। একই ইউনিটে মানবিক শাখা থেকে পরীক্ষা দেওয়া মাদরাসা ছাত্র আব্দুস সামাদ প্রথম হয়। ‘খ’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয় মাদরাসাছাত্র রিজাত হোসেন। ২০১৬-২০১৭ শিক্ষাবর্ষের ‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় একইভাবে প্রথম স্থান অধিকার করে মাদরাসাছাত্র আব্দুল্লাহ মজুমদার। এ বছর পাসের হার ছিল ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। কিন্তু শুধু মাদরাসাছাত্র হওয়ার কারণে আব্দুল্লাহ মজুমদারকে তার পছন্দের সাবজেক্টে পড়তে দেওয়া হয়নি। অনৈতিক ক্ষমতাবলে কর্তৃপক্ষ আব্দুল্লাহর প্রাপ্য অধিকারকে খর্ব করে দেয়। যা সুস্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমান। এত অনৈতিক বাধা-বিপত্তির পরেও ২০১৭-২০১৮ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় মাদরাসাশিক্ষার্থীদের অবস্থান ছিল জয়জয়কার। এ বছর ঢাবির ‘খ’ ইউনিটে একটি মাদরাসা থেকেই চান্স পেয়েছিল ৮৪ জন ছাত্র। এর মধ্যে ছাত্রী ছিল ৫ জন।
এত সাফল্যের পরেও একটি মাদরাসাকেও সরকারি করা হচ্ছে না। প্রতিবছর শতশত প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হলেও মাদরাসাগুলো থেকে যাচ্ছে উপেক্ষিত। অথচ এমন অনেক কলেজ আছে, যেখানে একজন ছাত্রও পাস করেনি। কিন্তু শুধু কলেজ হওয়ার কারণে সেটা জাতীয়করণ হয়ে গেছে।[1] প্রতিবছরই মাদরাসাছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে। এমনকি টপ ২০ জনের মধ্যে ১০ জনই থাকে মাদরাসা থেকে আগত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের সাথে বিমাতাসুলভ আচরণ করেন। তাদেরকে ভালো সাবজেক্টে পড়াশোনার সুযোগ দেন না। এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ৭ কলেজের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে গত ১৭ নভেম্বর ২০২১। এ কলেজগুলোতে কলা ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদের মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২১ হাজার ১৩২ জন। এর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে ১৪ হাজার ৩৮২ জন। আর এদের মধ্যেও প্রথম হয়েছে ঢাকার দারুন্নাজাত সিদ্দিকিয়া কামিল মাদরাসার ছাত্র নাজমুল ইসলাম। ১২০ নম্বরের মধ্যে সে পেয়েছে ১০৭ নম্বর।[2] একইভাবে ২০২০-২১ সালের গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে গত ১৭ নভেম্বর ২০২১। মোট পরীক্ষার্থী ছিল ৫,৫৪৫ জন। উত্তীর্ণ হয়েছে ৪ হাজার ৪৯৫ জন। আর প্রথম হয়েছে তামিরুল মিল্লাত মাদরাসা মহিলা শাখার ছাত্রী হামিদা ইসলাম।
দেশের মোট জনশক্তি এখন ১৬ কোটি ৯১ লাখ। বাংলাদেশ সবেমাত্র এল.সি.ডি অতিক্রম করলেও দেশে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা কম নয়। ‘বিশ্ব ক্ষুধা সূচক ২০২১’-এ ১১৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৬তম। অথচ বর্তমান সরকারের টার্গেট ২০৪১ সালে দেশকে স্বনির্ভর উন্নত বাংলাদেশ উপহার দেওয়া। কিন্তু মাদরাসায় পড়ুয়া অর্ধকোটি জনশক্তিকে তুচ্ছ জ্ঞান করে সে টার্গেটে পৌঁছানো আদৌ সম্ভব নয়। তাদেরকে অবহেলিত রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কারণ তারাও এদেশের মানুষ। তারা এদেশটাকে তাদের প্রাণের চেয়েও ভালোবাসে। এ বিশাল জনশক্তিকে তাই যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া প্রয়োজন। দেশের জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদ দূরীকরণে মাদরাসাশিক্ষার্থীরাই একমাত্র কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম। সুতরাং সরকারের উচিত তাদেরকে প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা। তাদের মাঝে প্রগাঢ় মূল্যবোধ রয়েছে। তাদেরকে এখন কর্মমুখী ও জীবনমুখী করে গড়ে তোলা সময়ের দাবি। তাদের মাঝে ধর্মের যথেষ্ট জ্ঞান আছে। তাদেরকে সতিনের ছেলের মতো দূরে ঠেলে দেওয়া উচিত হবে না। বরং তাদেরকে কাছে টেনে আপন করা উচিত। তাদেরকে বিজ্ঞান ও আবিষ্কারমুখী করে গড়ে তোলা উচিত। স্কুল-কলেজ ও মাদরাসার মাঝে সৃষ্ট দেয়াল দূরীভূত করা উচিত। তাদেরকে প্রশিক্ষণের আওতায় এনে স্ব স্ব ক্ষেত্রে কর্মোদ্যোগী করা উচিত। এতে দেশের সমন্বিত উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। পরস্পরের মনস্তাত্বিক ব্যবধান দূর হবে। ফলে কর্তৃপক্ষের প্রতি তাদের ভালোবাসা সৃষ্টি হবে। সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই কেবল সরকারের উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে পারে।
ড. মো. কামরুজ্জামান
অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
[1]. দৈনিক কালের কণ্ঠ, ১৪ অক্টোবর, ২০১৬।
[2]. bdnআলাইহিস সালামws24.রযিয়াল্লাহু আনহুরহিমাহুমুল্লাহm, ১৭ নভেম্বর, ২০২১।