নারী সমাজদেহের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পুরুষ যদি দেহের একটি হাত হয়, তাহলে নারী হবে অপর হাত। পুরুষ যদি দেহের একটি পা হয়, তাহলে নারী হবে অপর পা। পুরুষ যদি দেহের একটি চোখ হয়, তাহলে নারী হবে অপর চোখ। পুরুষ যদি দেহের মেরুদণ্ড হয়, তাহলে নারী হবে দেহের হৃৎপিণ্ড। পুরুষ যদি জীবনগাড়ির একটি চাকা হয়, তাহলে নারী হবে অপর চাকাটি। আর সংখ্যার বিচারে নারী হচ্ছে সমাজের অর্ধেক বা তার চেয়ে বেশি। স্নেহ, মমতা, প্রেম-ভালোবাসা ও আবেগের দিক থেকে উৎকৃষ্টতম।
নারীর অবদানকে অবমূল্যায়ন, অবজ্ঞা কিংবা অস্বীকার করে কোনো জাতি কোনোদিন প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি; ভবিষ্যতেও পারবে না। বরং নারীত্বকে যথাযথ সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মাধ্যমেই প্রকৃত কল্যাণ ও মুক্তি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এ নারীকে অবলম্বন করেই কবিরা পেয়েছেন কবিতার ভাষা, বীরেরা পেয়েছেন শৌর্য-বীর্য, ভীরুরা পেয়েছেন সাহস-শক্তি। এ নারী থেকেই শিশুরা পেয়েছে মায়া-মমতা, আদর-স্নেহের সুশীতল পরশ আর শিক্ষাদীক্ষার উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। কিশোর-যুবকেরা পেয়েছে নিজেকে আবিষ্কারের শক্তি, ভাবনার সীমাহীন দিগন্ত। এ নারীই পুরুষের বংশের বাতি, চারিত্রিক সনদ, প্রেরণার উৎস, জীবন সংগ্রামের সফরসঙ্গী, বেদনা-বিরহের একমাত্র সাথী, পরিবারের রাণী, প্রেম-ভালোবাসা আধার, সকল চিন্তা-চেতনার কেন্দ্রবিন্দু এবং জান্নাত লাভের মাধ্যম। এ নারী হচ্ছেন— সুস্থ ব্যক্তি, আদর্শ পরিবার, আলোকিত সমাজ, সমৃদ্ধ রাষ্ট্র ও শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গঠনের মূল কারিগর।
নারীর মাধ্যমেই পৃথিবী ফুলে-ফলে সুশোভিত হয়েছে। এ নারীর স্নেহ-ভালোবাসায় সিক্ত এবং নরম হাতের কোমল পরশে বেড়ে ওঠা সন্তানরা বিশ্বকে উপহার দিয়েছে নব নব আবিষ্কার। এ নারীর প্রেরণায় ভীরু-কাপুরুষ, আত্মভোলা ঘুমন্ত জাতির প্রতিটি সন্তান পরিণত হয়েছে নরশার্দূলে। এ নারীর হাত ধরেই সভ্যতা আজ সত্য, সুন্দর আর আলোকের সন্ধান পেয়েছে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, নারীরা একদিন বীরত্বগাথা রচনা করেছিলেন উহুদ, খন্দক, ইয়ারমুক, জাঙ্গে জামাল, কাদেসিয়া আর ইয়ামামার প্রান্তরে। এ নারীদের স্নেহ, ভালোবাসা, উৎসাহ-উদ্দীপনা আর ত্যাগের বিনিময়েই কালজয়ী জীবনাদর্শ ইসলামের পদচুম্বন করতে বাধ্য হয়েছিল সমগ্র বিশ্ব। তখন নারীদের জীবনব্যবস্থা ছিল ইসলাম, বর্ম ছিল কুরআন আর কর্ম ছিল সুন্নাত। এ নারী জাতি তো ইতিহাসের বিস্ময় আসিয়া, হাজেরা, সারা (আ.), খাদীজা, আয়েশা, আসমা, ফাতেমা, উম্মে সুলায়ম, সুমাইয়া, হাবীবা, খাওলা (রা.)-এর উত্তরসূরী। এ নারীরাই তো আবূ বকর, উমার, উছমান, আলী, জুবায়ের, খাব্বাব, খুবাইব, খালেদ রাযিয়াল্লাহু আনহুম-এর মতো বীর সন্তানের জন্মদাত্রী। এ নারীই তো তারেক বিন যিয়াদ, মূসা বিন নুছাইর, উমার বিন আব্দুল আযীয, ছালাহুদ্দীন আইয়ূবী রাহিমাহুমুল্লাহ-এর মতো এক একটি নক্ষত্র বিশ্বকে উপহার দিয়েছেন। এ নারীই ইমাম আবূ হানীফা, ইমাম শাফেঈ, ইমাম মালেক, ইমাম আহমাদ, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুমুল্লাহ-এর মতো জগদ্বিখ্যাত ইমামদের গর্বিত মাতা।
বর্তমান যুগ প্রচারণার যুগ। মানুষের চিন্তায়, মননে, গ্রহণে-বর্জনে প্রচারের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে এ প্রচারণায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে গলাবাজি, ধাপ্পাবাজি আর চাপাবাজি। আর বিষয়বস্তু হিসেবে সিংহভাগ জুড়ে আছে নারী, নারীমুক্তি, নারী স্বাধীনতা, নারীর ক্ষমতায়ন। কিন্তু নারীদের প্রচারণায় শীর্ষে অবস্থানটা যতটা না ইতিবাচক ফল বয়ে এনেছে, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি নেতিবাচক ফল বয়ে এনেছে। বন্ধুরূপী মুখোশধারী হায়েনারা নারীকে ছলেবলে, কলাকৌশলে ঘরের বাইরে এনে তার রূপ-রস-সৌন্দর্যকে বিজ্ঞাপন পণ্যে পরিণত করেছে। নারীকে ঘরের রাণী থেকে অফিসের বসের মনোরঞ্জনের সামগ্রীতে পরিণত করেছে, তাকে প্রকৃতি ও স্বাভাবিক বিকাশ থেকে বিচ্যুত করে যন্ত্রমানবে পরিণত করেছে, নারী শুধু কলুর বলদের মতো স্বীয় উপার্জিত অর্থের স্বত্ব ত্যাগের স্বাধীনতা লাভ করেছে। সে কারণে পশ্চিমাদের নগ্ন ও বস্তাপচা সংস্কৃতির সাপ্লায়ার এবং নারীকে ভালোবাসার হোলসেল এজেন্টের দাবিদার নারী মৌ লোভী সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠীর সদস্যরা নিজেরা সুটেড, বুটেড, কোটেড অর্থাৎ নিজে সুট, সু, কোট-টাই পড়ে ভদ্র লোকের বেশ ধারণ করলেও তাঁর সঙ্গী নারীটিকে উলঙ্গ বা অর্ধ-উলঙ্গ অবস্থায় রাখাকেই সভ্যতা বলে প্রচার করছে। এসব বন্ধুরূপী শত্রুরা নারীকে স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিণী ও ক্ষতিগ্রস্ত হতে প্ররোচনা দেয়, তা আজ দিবালোকের মতো পরিষ্কার।
এসব হায়েনা নিজেদেরকে নারীর স্বাধীনতা, মুক্তি, প্রগতির একমাত্র দাবিদার মনে করছে এবং তাদের বাইরের সবাইকে নারীর শত্রু বলে প্রচার করছে। এদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা হচ্ছে— নারীকে স্বামী-সন্তান-স্বজনদের প্রতি সমস্ত দায়িত্ব-কর্তব্য থেকে মুক্তি দেওয়ার নামে পরিবার নামক স্বর্গের সংস্পর্শ থেকে বঞ্চিত করা, একই সাথে নারীকে পোশাকের ওজনের ঝামেলা থেকে মুক্তি দেওয়ার নামে অনায়াসে ইন্দ্রিয়তৃপ্তি চরিতার্থ করা। এ লক্ষ্যেই তারা নারীকে ‘নিজের কর্মে নিজে খাই, পোশাকের ওজন কমাই’ —শ্লোগানটি রপ্ত করাতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
প্রকৃত সত্য হচ্ছে, এমন কোনো পুরুষের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না, যিনি নারীর শত্রু হতে পারেন। কারণ, নারীর মধ্যেই তো পুরুষেরা তাদের মা, বোন, স্ত্রী, কন্যা, ফুফু, খালা, চাচি, মামি অথবা অন্য কোনো আপনজনের প্রতিচ্ছবি দেখে থাকেন। কেউ কি নিজের মা, স্ত্রী, মেয়ে, বোনের শত্রু হতে পারে? না, তা পারে না। পুরুষ যদি তার মা, স্ত্রী, মেয়ে অথবা বোনকে কোনো কাজ থেকে বিরত রাখতে চায়, তবে বুঝতে হবে সেটা সে করতে চায় প্রথমত তার আপনজনের কল্যাণ চিন্তায় ও মঙ্গল কামনায়। অতঃপর তার মাধ্যমেই বৃহত্তর সমাজের ও রাষ্ট্রের কল্যাণ প্রত্যাশায়। সুতরাং নারীকে কোনো কিছু দেওয়া বা না দেওয়ায় শত্রুতা বা বন্ধুত্বের প্রশ্ন ওঠে না। এতে কেবল সম্ভাব্য কল্যাণ বা অকল্যাণের প্রশ্নই জড়িত থাকতে পারে।
সে কারণে সচেতন মহলের মনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগছে, নারীর বন্ধু হওয়ার অর্থ কি নারীকে এমন কাজে-কর্মে উৎসাহিত করা, যাতে তার দুর্নাম হয়, কলঙ্ক রটে, স্বার্থ ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়, সামাজিক, শারীরিক ও মানসিক দুর্দশা বাড়ে? না, তাও নয়। যে বন্ধু তার অপর বন্ধুর প্রতি এরূপ আচরণ করে বা করতে চায়, সে আসলে তার বন্ধু নয; বরং শত্রু। সে তার আবেগ ও আকাঙ্ক্ষার প্রতি শ্রদ্ধায় গদগদ হয়ে উদার, দরদি ও কান্নাভেজা কণ্ঠে ইনিয়ে-বিনিয়ে যত কথাই বলুক না কেন। সুতরাং নারীর বন্ধু ও শত্রু প্রশ্নে শ্রেণি বিভক্তি সৃষ্টি করা যে ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
কিন্তু নিষ্ঠুর বাস্তবতা হচ্ছে, নারী জাতি, বিশেষ করে মুসলিম নারীরা বন্ধুবেশী পশ্চিমাদের এসব এজেন্টদের খপ্পরে পড়ে গেছে। তারা তাদের সমৃদ্ধ অতীত আর সোনালি ঐতিহ্য ভুলে মরীচিকার পেছনে ঘুরে ঘুরে সর্বশান্ত হচ্ছে। আজকে মুসলিমদের মধ্যে অধিকাংশ নারীই কুরআন ও হাদীছ সম্পর্কে তথা নিজেদের প্রকৃত পরিচয় ও দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে অজ্ঞ। এ কারণে ইসলামপ্রদত্ত সীমাহীন সম্মান ও মর্যাদাকে প্রত্যাখ্যান করে তার সমাধিকারের দাবিতে আন্দোলনে ঘর্মক্লান্ত। নৈতিকতা বলতে যা বুঝায়, তা তাদের চরিত্রে আজ অনুপস্থিত। তাদের কাছে পিতা-মাতা, স্বামী-সন্তান আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেওয়ার মতো নৈতিক উপকরণ মওজুদ নেই। তারা সারাক্ষণ ব্যস্ত ‘জি বাংলা’ আর ‘স্টার জলসা’র মতো বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এবং এসবের অনুষ্ঠানাদি নিয়ে। ঘর-বর, সন্তান-স্বজন গোল্লাই গেলেও সে দিকে তাকানোর সময় তাদের নেই। তারা আধুনিকতার নামে যা কিছু আঁকড়ে ধরছে, তা নোংরামি, নষ্টামি, নগ্নতা, নিচতা ও আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া কিছুই নয়।
কিন্তু বিধি যে বাম। প্রায় এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে নারীর স্বাধীনতা, মুক্তি, ক্ষমতায়ন, উন্নতি, অগ্রগতি প্রশ্নে চলমান আন্দোলন নারীকে রীতিমতো হতাশ করেছে। এ আন্দোলনে শামিল হতে গিয়ে নারী ঘর-বর, সন্তান-স্বজন ছেড়েছে। বিসর্জন দিয়েছে নিজের সকল সুখ-শান্তি-বিশ্রাম, সম্মান ও সম্ভ্রম। কিন্তু এসবের বিনিময়ে যা অর্জন করেছে, তা হারানোর তুলনায় খুবই নগণ্য। একটি সাময়িকের জন্য পেলে অন্যটি তাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলতে হয়েছে। জীবনে ১ কোটি টাকা উপার্জন করতে গিয়ে ১০০ কোটি টাকা মূল্যের স্বামী-সন্তানকে সে হারিয়েছে। বাড়ি আঙিনার সতেজ অক্সিজেন পরিত্যাগ করে উন্মুক্ত আকাশের নিচে প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে গিয়ে সে হায়েনার হিংস্র ছোবলে ক্ষতবিক্ষত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। বস্ত্রের ওজন কমাতে যেয়ে সে বস্ত্রহীন হয়ে পড়ছে। পৃথিবীটা তাঁর জন্য বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে। ঘরে-বাইরে সর্বত্র তাঁর সম্মান-সম্ভ্রম হুমকির মুখে, তাঁর জীবন আজ দুর্বিষহ। মোট মিলে এক একজন নারী এক একটি জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হচ্ছে।
ভাবতে অবাক লাগে, একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, স্পিকার থেকে শুরু করে ডজন ডজন মন্ত্রী-এমপি নারী থাকার পরও ধর্ষণ, হত্যা, নির্যাতন থেকে নারীর মুক্তি মিলছে না। বরং নারীর ক্ষমতায়ন আন্দোলনে তারা অনেক দূর এগোলেও ধর্ষণ, হত্যা, নির্যাতনের মতো জঘন্য কার্যকলাপ পূর্বের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। যাদের আহ্বানে, প্রলোভনে, প্ররোচনায় নারী তাঁর অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে, তারা কি আজ নারীর পাশে আছে? শত বক্তৃতা-বিবৃতি, মিছিল-মিটিং, মানববন্ধন-স্মারকলিপিতে নারী কি তার হারানো সম্ভ্রম-সম্মান ফিরে পাচ্ছে? না, পাচ্ছে না।
নারীদের এ হতাশা ও ব্যর্থতার একমাত্র কারণ হলো তাদের মর্যাদা-সম্মানের উৎস ও রক্ষাকবচ ইসলামকে অবহেলা বা অস্বীকার করা এবং শান্তি, স্বাধীনতা, উন্নতি-প্রগতির নামে ভ্রান্ত ও অপর্যাপ্ত দর্শনকে সঠিক মনে করা। এমতাবস্থায় পৃথিবীর মূল চালিকা শক্তি এ নারীজাতিকে অত্যাচার, অবহেলা, অশিক্ষা, কুশিক্ষা আর কুসংস্কার থেকে মুক্তি দিয়ে তাদের হৃতগৌরব ফিরিয়ে দিতে পারে একমাত্র কালজয়ী ইলাহী জীবনবিধান ইসলাম।
নারীর শত্রু-মিত্র উভয় পক্ষের অপরিণামদর্শী বাড়াবাড়ি থেকে সর্তক দূরত্বে থেকে নারীর প্রতি অযথা শত্রুতা বা অন্ধ ও মায়াকান্নাপূর্ণ বন্ধুত্বের বাইরে এসে একটি আধুনিক, রুচিশীল, মার্জিত, চরিত্রবান ও অটুট নীতির অনুসারী মুসলিম সমাজে নারীর সঠিক স্থান ও ভূমিকা চিহ্নিত করা এবং নারীর সম্মান ও মর্যাদার প্রকৃত উৎসের সন্ধান দেওয়ার সাথে সাথে নারীর আধুনিক ও প্রাচীন— সকল সমস্যার সমাধানে কার্যকর, পরীক্ষিত, যুক্তিগ্রাহ্য ও বাস্তবসম্মত দিক-নির্দেশনা দেওয়া সময়ের দাবি।
মো. হাসিম আলী
সহকারী শিক্ষক, পল্লী উন্নয়ন একাডেমী ল্যাবরেটরী স্কুল এন্ড কলেজ, বগুড়া।